আমি আর জ্যোতি বসে ড্রইংরুমে বসে আম্মুর করা পাস্তা খাচ্ছিলাম।
জ্যোতি বলল "তোকে আমি কেন বিয়ে করব জানিস? আন্টির এই পাস্তার জন্য! আন্টির কিছু গুণ তো তুই পাবি! বিয়ের পর তুই আমাকে রান্না করে পাস্তা খাওয়াবি!"
আপনি যদি আগে থেকে কিছু না জেনে থাকেন তবে ভাবছেন জ্যোতি একটা ছেলে আর আমি মেয়ে?! ভুল! জ্যোতি আমার রূপবতী অহংকারী স্বঘোষিত গার্লফ্রেন্ড! ওর কথার ধরনই এমন!
কথা অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য আমি বললাম "ইদানিং ইভ টিজিং কীভাবে বেড়েছে দেখেছিস?"
জ্যোতি বলল "ইদানিং বাড়ে নি, আগে থেকেই ছিল, মিডিয়া ইদানিং বিষয়টা প্রচার করছে তাই মনে হচ্ছে বেড়েছে! ইভ টিজিং বাড়ছিলো গুণোত্তর ধারায়...! ওপ্স! এসব তো তুই বুঝিস না! তোর সাথে কথা বলার সময় আমাকে একটু লো লেভেলে এসে কথা বলতে হয় যাতে এই সব তোর মাথার উপর দিয়ে না যায়!"
আমি এই কথায় মাইন্ড খেলাম না, গুণোত্তর জিনিসটা যে আসলেই কী জিনিস আমি জানি না! কোনমতে যোগ বিয়োগ পারি, গুণের উত্তর কী হবে আমি কেমনে জানব?! আর জ্যোতির কথা মাথার উপর দিয়ে না যাওয়ার কোন কারণ নাই!
আম্মুর করা সেই সুস্বাদু পাস্তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম
"তুই কখনো ইভটিজিং এর শিকার হয়েছিস?"
"আমি? নাহ! পাগল! আমাকে টিজ করবে কীভাবে? আমার সামনে আসলেই তো সব ভুলে যেত? কিছু বলতেও পারত না কিছু করতেও পারত না!"
"আঙ্কল র্যাবের কর্মকর্তা এই জন্য তো বুঝতে পেরেছি!"
"কচু বুঝেছিস! ওরা আসলে আমাকেই ভয় পেত!"
আমি বললাম "হেহে! টাইকোয়ান্ডো যে জানিস, এইটাও তো জানত ছেলেরা?"
"হ্যা! কোন কারণে কি হয়েছে তা বের করতে হলে... আমরা যদি পারেটো প্রিন্সিপাল এপ্লাই করি, ২০% কজ ৮০% ইফেক্টের জন্য দায়ী...(ওর জ্ঞানের ট্রেইন চলতে লাগল!)... অনির্ণেয় সময় পর ট্রেইন থামলে "সরি জান্টুস! আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমি এই সব বোঝো না! আসলে সব সময় বুদ্ধিশুদ্ধিওয়ালা ছেলেমেয়েদের সাথে চলি তো মাঝে মাঝে ভুলেই যাই যে তুমি..."
ও ওর কথা শেষ করল না, আমিও বুদ্ধি করে 'না' বুঝে নিলাম বাকি অংশটুকু!
"ইভ টিজিং সলভিং নিয়ে কিছু ভেবেছ? তোমার মাথায় কোন সল্যুশন আছে?"
"আছে মানে! জ্যোতির্ময় সল্যুশনই আছে! ছেলেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে! ওরা অলস বসে থাকে বলে মেয়েদের পিছনে ঘুরঘুর করে, এই যেমন তুমি করছ!"
"আমি ঘুরঘুর করছি? কে কার বাসায় এসেছে শুনি?" আমি তেড়ে উঠি! এই মিথ্যে অভিযোগ কাহাতক আর সহ্য করা যায়?!
"আহা! জান্টুস রাগো কেন? তুমি আমার বাসায় যেতে লজ্জা পাও, তাই আমিই আসি শ্বশুরবাড়িতে!"
আমি, লজ্জা না আসলে ভয় পাই, ওর বাবা র্যাবে চাকরি করে! কবে যে ক্রসফায়ার করে দেয়! "আমার মেয়ের সাথে প্রেম করিস! ইয়া ঠিসা ঠিসা!" তার পরদিন পত্রিকায় আসবে র্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে ইভ টিজার নিহত!...
জ্যোতির কথায় দুঃস্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম!
"আচ্ছা আসল কথায় আসি। ছেলেগুলাকে কাজে লাগাতে হবে, যেমন ধরো কমিউনিটিঅ্যাকশন এর Action: উষ্ণতা র কথাই ধরো! ছেলে গুলো যদি গরিব মানুষদের কাপড় বিলানোর মত জনদরদি কাজ করত তাহলে ওদের হৃদয়ে আর অন্যদের জন্য জায়গা কিংবা স্কুল কলেজের সামনে দাঁড়ানোর মত সময় থাকত না!!"
আমি বললাম "হেহে! ওরা করবে সোশ্যাল ওয়ার্ক?! এই তোমার জ্যোতির্ময় সল্যুশন?!"
"ওদেরকে আসলে কেউ কাজ দিচ্ছে না, এই সব কাজের গুরুত্ব বুঝাচ্ছে না! আর যেই সব ব্যাটারা না শুনবে ওদের জামা কাপড় নিয়ে গরিবদের দিয়ে দিতে হবে!"
"আসলে ইভটিজিং একটা ছোট্ট সমস্যা না। অনেক গুলো সমস্যা ইন্টার কানেক্টেড। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া ইভটিজিং পুরোপুরি দূর করা সম্ভব না। তবে ইমিডিয়েটলি ইভটিজিং কমাতে হলে সেটা মেয়েদেরই করতে হবে! কিন্তু মেয়েরা পর্যাপ্ত সাহস পাচ্ছে না, এক হচ্ছে না। ওদের একটা আইডল এর দরকার। ওদের দরকার একটা রোল মডেল এর"!
"হেহে! ওদের দরকার ব্যাটম্যান থুক্কু ব্যাটগার্ল! খিক খিক!"
"তুমি হেসো না জান্টুস! হাসলে তোমাকে খুব বিশ্রি লাগে!!"(আমি হাসি থামিয়ে দিলাম! নিজের গার্লফ্রেন্ড যদি এমন কথা বলে মাইনষে কি কয় আল্লাহই জানে!)
"আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসছে!"” জ্যোতি হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ওর চোখ চকমক করতে থাকে। “"এই আইডিয়ায় তোমাকে লাগবে, তুমি থাকবে না জান্টুস? একটা সচেতনামূলক ভিডিও বানাবো!"
আমি ঢোক গিললাম! এর আগের বার ছবি তুলতে রাজি হয়ে যে বিপদে পড়েছি! আর এবারে ভিডিও?!
"প্লিজ জান্টুস! রাজি হয়ে যাও! তুমি সোশ্যাল ওয়ার্কই তো করবে! মুভিটা হবে সোশ্যাল ওয়ার্কারদের অভিনীত সামাজিক অ্যাকশন!"
"অ্যাকশন?! এই খানে অ্যাকশনও থাকবে নাকি?" আমি ভয়ে কাপাকাপি শুরু করে দেই!
"হ্যা! না হলে কি মুভি জমবে?"
"ইয়ে মাইরটা কে খাবে? "(আমার সূক্ষ্ম না পুরো স্থূল সন্দেহ মাইর টাইর সব আমারেই খাইতে হবে!)
"কে আবার তুমি?! তোমার কত্ত শক্তি! কত্ত সাহস!! আমার হিরো জান্টুস! " এই বলে ও আমার হাতের মাসলে চাপ দেয়, আমি ব্যথায় আউচ করতে যেয়েও করি না!
"তোমাকে পাগলে পেয়েছে? না কখনোই না! আমি কোনভাবেই তোমার কথা শুনছি না! দেখা যাবে তুমি আমাকে সত্যি সত্যি মেরে বসবে!" আমি জ্যোতির কাছ থেকে দূরে সরে বসি।
কিন্তু না জ্যোতি নাছোড়বান্দা, সে গ্রামীনফোনের "কাছেই থাকুন" ফর্মূলায় এগিয়ে এসে দূরত্ব ঘুচায়
"ছি ছি জান্টুস! তোমাকে আমি আজ পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখেছি? (দেখো নি মানে?!: এই মাত্র হাতে চিপি দিলো কে?! ) তুমি আমাকে এতটা অবিশ্বাস করো! চিন্তা করে দেখো, আমি একটা মুভি বানাতে যাচ্ছি যার মেইন থিম হবে একটা মেয়ে কীভাবে ইভ টিজারদের সাইজ করে!"
"তুমি আমাকে ইভ টিজার হতে বলছো?! তোমার কি মাথা খারাপ?"
"আহা! রাগছো কেন? তোমার সাথে একজন আইডিয়াল ইভ টিজারের সব মিল আছে!"
"হোয়াট?!"
"হ্যা! তাহলে আর বলছি কী! ধরো তোমার চেহারার বখাটে ভাব! সরু চোখের তাকানি! আর বিশ্রি ভিলেনী হাসি! তোমার পুরো লুকটাই পুরা “লুইচ্চা লুক”!! "
আমি তো হতভম্ভ! দুনিয়ার কোন গার্লফ্রেন্ড তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে এইসব বলছে বলে ইতিহাসে নাই(আমি কোন ইতিহাসে কত পাইছি এইটা আবার জিগায়েন না ভাই পিলিজ লাগে! এম্নিতেই মেজাজ বহুত খারাপ!)
২।
শেষমেষ আমাকে মেষই হতে হল, মানে রাজী হতে হলো।
জ্যোতি আমাকে পুরো মুভিটি বোঝাল। মূল উদ্দেশ্য মেয়েদের জন্য একটা রোল মডেল তৈরি করা। তাশফিয়া নামের এক মেয়ে কলেজে পড়ে, মেয়েটিকে হিজাবী দেখানো হবে(কারণ শালীন পোষাকই একমাত্র সমাধান না এটা বোঝানো হবে ) এবং দেখানো হবে একজন ইভ টিজারকে সে একাই গণপিটুনী দেয়। এরপর থেকে ঐ এলাকায় তাশফিয়া কারাতে গার্ল হিসেবে পরিচিত হবে।
মুভির নাম কারাতে গার্ল।
শুটিং চলল কয়েকদিন ধরে। (জ্যোতি যে ব্যাপক গুণবতী সেটা আরেকবার বুঝে নিলাম!)
মুভির জন্য আমাকে শিস দেয়া শিখতে হলো! (জ্যোতিই শেখালো! "তুই শিস দিতে পারিস না! ছি ছি শেইম শেইম!")
আমাকে মোস্তফা সারোয়ার ফারুকীর মুভি/টেলিফিল্ম দেখতে হলো দিনের পর দিন, লুইচ্চামী শেখার জন্য!(এই ব্যাটার মনে হয় লুইচ্চামীর উপর পিএইচডি ডিগ্রি আছে!?!)
চুলে জেল দিতে হলো, হাতে ব্রেসলেট পরতে হলো, বাইক চালাতে পারি না তবে একটা বাইক কীভাবে ধরে টেনে হেচড়ে নিতে হয় সেটা শিখতে হলো! যেই দিন ফাইনাল শ্যুটিং, অর্থাৎ আমার মার খাবার দিন, সেই দিন জ্যোতি বলল, সিনটা রিয়েলিস্টিক করার জন্য, ক্যামেরা দূরে থাকবে এবং হিডেন থাকবে!
আমি তো আত্তাহিয়াতু থেকে শুরু করে দোয়া কুনুত সব পড়া শুরু করলাম! কোনটা কাজে লেগে যায় বলা তো যায় না!
আমার সিন শুরু হবে, আমি কলেজের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। জ্যোতি গেট থেকে বের হয়ে এল। সাথে দুই বান্ধবী। জ্যোতির পরনে, সালোয়ার কামিজ, উপরে কোট, মাথায় স্কার্ফ।
আমি শিস দিয়ে বললাম "তাশফি চলেছে একা পথে ..."আর আমার সাথের মোটর সাইকেলটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। "রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো" এই জায়গায় আসা মাত্রই জ্যোতি ফ্লাইং কিক বসাল বুকে!! এবং সেটা সত্যি কিক! ব্যথায় "কোৎ" শব্দটিও না করতে পেরে আমি পড়ে গেলাম। এরপরও ওর বান্ধবীরাও এগিয়ে এল! “মারহাবা তাশফিয়া” বলে তারাও আমাকে মারা শুরু করল!
তাঁরা "মার টিজার মার টিজার" বলে আমাকে বেদম মার দিতে লাগল! জ্যোতি ওদের না থামিয়ে সাথে সাথে ধোলাই করতে লাগল!
কিছুক্ষণ পর জ্ঞান হারালাম, হয়ত মরেই গেলাম!
৩।
জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি হাসপাতালে! (যাক বাবা মরি নি তাহলে! মরলেই বোধহয়ভালো ছিল। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ করা! মানুষের ৪২০ টা না কয়টা জানি হাড্ডি থাকে জানতাম, একটাও আস্তা নাই এই ব্যাপারে শতভাগ শিওর হয়ে গেলাম!)
তাকিয়ে দেখি আম্মু! "কেমন ছেলে পেট এ ধরলাম গো! আমার মরন হলো না কেনো গো! মেয়েদের টিজ করে বেড়ায় গো..."
আমি দুর্বল গলায় বলতে গেলাম "আম্মু ওটা অভিনয় ছিলো!" কিন্তু গলা দিয়ে কথা বেরুলো না, বেরুলো শিস! আম্মু শিসের শব্দ শুনে বললো "কী ছেলে পেট এ ধরলাম গো হাসপাতালেও শিস বাজায় গো..."
কিছুক্ষণ পর...
জ্যোতি বলল "জান্টুস কি রেগে আছো?!" আমি মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতে চাইলাম। পারলাম না! কারণ ঘাড় নাড়ানোর অবস্থা নাই, প্লাস্টার করা। “তুমি কল্পনাও করবে না! আসলে তখন কী যে হলো! তোমাকে পুরাই ইভ টিজারের মত লাগছিলো, আমার আবার জোশ এসে গিয়েছিলো...তাই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি নি! সে যাক গে! আমাদের মুভি কত্ত বড় হিট হয়ে গেছে! ইউটিউবে এক লাখ হিট ছাড়িয়ে গেছে। একটা কোম্পানী মুভিটা রিমেক করতে চায় এবং সেখানে ওরা তোমাকেই নিতে চায় টিজার এর পার্টে!"
এই কথা শুনেই আমি জ্ঞান হারালাম!
আবার যখন জ্ঞান আসল, তখন জ্যোতি আমার বেডের পাশেই বসে।
"জান্টুস! তখন সব কথা বলতে পারি নি! তোমার জন্য সুসংবাদ আছে! তুমি লজ্জা পেয়ো না, ইউটিউবে অনেকে তোমাকে দেখলেও চিনতে পারে নি, কারণ মাইরের কারণে তোমার চেহারা চেনার কোন উপায় ছিলো না! তোমার চেহারা এখন পুরাই চেইঞ্জড!! " চেহারা চেইঞ্জ হওয়াটা কীভাবে খুশির সংবাদ হয় আমি বুঝতে পারলাম না!
"আরও ভালো খবর আছে! আমাদের এলাকা সহ আশেপাশের এলাকায় মেয়েরা এখন আমার স্টাইলে পোষাক পরা শুরু করেছে, ওরা গ্রুপে চলাফেরা করছে এবং কারাতে শিখছে! ওরা এখন একই সাথে সচেতন এবং সাহসী! কারাতে প্র্যাক্টিসের সময় তাঁরা জোরে জোরে বলছে "মার টিজার মার টিজার"! বাই দ্যা ওয়ে মুভির নাম কারাতে গার্ল থেকে চেইঞ্জ করে ত্রাস The Fear রাখা হয়ছে!! (তাশফিয়া থেকে ত্রাস The Fear!) এখন ইভ টিজাররাই ভয় পাবে! কারণ মেয়েরা এখন সাহসী, ওরা প্রতিবাদ করতে জানে!“" এটা বলার সময় ওর মুখ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠল, আমার ভাঙা হাড়গোড়ের আড়ালে থাকা হৃদয়টা ওর খুশীতে খুশী হয়ে গেল।
"তবে তোমার জন্য ছোট্ট একটা দুঃসংবাদ আছে...আমার আব্বু তোমাকে খুঁজছে!! সে তোমাকে সত্যি সত্যি ইভ টিজার ভেবেছে। এখন তোমাকে পেলে ক্রসফায়ারে ...”"
আমি বাকিটা শুনি নি। জ্ঞান হারিয়েছি আগেই!
উৎসর্গঃ তারান্নুম আপু। জ্যোতি ভক্তদের মধ্যে বিশেষ একজন!
জ্যোতির ফেইসবুক পেইজ, এক খান লাইক দিয়া যান
**জ্যোতির্ময় বচন ৪২৫০+ পেইজভিউ প্রাপ্ত পোস্ট!
আনসিরিয়াস কথামালার জ্যোতিকে ইভটিজিং এর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আনার মুল কারণ একজন অনলাইন লেখক হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা। আসুন সবাই মিলে ইভটিজিং সহ যে কোন ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই!
ইভ টিজিং প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন- ফেইসবুক গ্রুপ
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১১:৪৩