somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিএইচডি সহ একাডেমিক গবেষণাকাজে গবেষকরা যেভাবে জালিয়াতি করেন

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গবেষণা একটি শ্রমলব্ধ সময় সাপেক্ষ দিনে ১৮ ঘন্টার কাজ। একটা প্যাশনের কাজ। এ কাজে অযোগ্য শিক্ষার্থীদের কাছে 'নকল' সহজ ও জনপ্রিয় একটি পথ। আমরা সাধারণত ধরেই নেই যে যিনি গবেষণা করবেন বলে মনস্থির করেছেন তিনি উঁচু মানের নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে খ্যাতি ও শর্টকাটের মোহে শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ কেউ এপথে পা বাড়ান এবং তার নিজের ও শিক্ষালয়ের সম্মানহানি ঘটান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান, ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক সাম্প্রতিককালে এই গর্হিত পথের পথিক হয়েছেন।

খবরের কাগজে সামিয়া এবং মারজান সম্পর্কে যা জানলাম তাতে মনে হয়েছে উভয়েই নকল বিষয়ে বিশেষ পারঙ্গম। শিক্ষক হয়েও তারা ফুকো বা এডওয়ার্ড সাঈদদের নিরাপদে থাকতে দেননি। পাতার পর পাতা কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। নিজের চরিত্রস্খলনের শিকার বানিয়েছেন। একবার নয়, বহুবার। বারবার।

গবেষণামূলক নিবন্ধ, থিসিস ইত্যাদিতে সামিয়া রহমানরা কীভাবে জালিয়াতি করেন সে ব্যাপারে খানিকটা ধারণা দেয়ার জন্য এই লেখার অবতারণা। এই অনৈতিকতার চর্চা নানাভাবেই হয়ে থাকে তার মধ্যে সবচেয়ে common কিছু চর্চার কথা লিখলাম। ইংরেজিতে এই চর্চাকে প্লেজিয়ারিজম(plagiarism) বলা হয়ে থাকে।

নিচের নামগুলো আমার দেয়া, এতে ছাত্রদের সুবিধা হয় বুঝতে।

১) সেক্স ওয়ার্কারঃ
লেখালেখিতে অভিজ্ঞ এমন কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়া বা গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে বিশেষ দক্ষতা আছে এমন কাউকে ধরে বিশ্লেষণ গুলো করিয়ে নেয়া। এ ধরনের কাজে সাহায্যকারী ওয়েবসাইটও আছে, পেশাদার লেখকদের গ্রুপও আছে যারা ইউনিভার্সিটির আশেপাশে 'রাইটিং সার্ভিস' নামে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। এরা সাধারণত $৪০-$১০০ চার্জ করে প্রতি পৃষ্ঠায়। এদের আমি সেক্স ওয়ার্কার নামে ডাকি। যৌনতার পরিবর্তে এরা মেধা বিক্রি করে।

২) ওয়াশিং মেশিনঃ
অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস জোগাড় করে সেটাকে নানাভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উল্টে পালটে নিজের মন মত বানিয়ে নেয়া। আমি এটাকে নাম দিয়েছি ওয়াশিং মেশিন ট্রিটমেন্ট।

৩) ফ্রাইড ফিশঃ
থিসিস যদি ইংরেজিতে হয় আর গবেষকের যদি সে ভাষায় লেখালেখিতে দখল কম থাকে তাহলে তিনি নিজের সাচ্ছন্দ্যের ভাষায় থিসিস লিখে কাউকে দিয়ে ইংরেজিতে পুনরনুবাদ করিয়ে নেন। মাছ ভাঁজার মত উল্টে নেয়া।

৪) স্কুপিং(scooping)ঃ
অন্য কারো একই বিষয়ে(topic) বা ধারণার(idea) গবেষণা করা থাকলে কেউ কেউ সেখান থেকে প্রয়োজনীয় চ্যাপ্টারগুলো কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়। নিজের খাটাখাটুনি করতে হলো না।

৫) স্ক্যাল্পার(scalper)ঃ
কোনও প্রতিষ্ঠানের করা কোনও গবেষণাপত্র, অর্থ দিয়ে হোক বা ইনফ্লুয়েন্স দিয়ে হোক বা সেখানে কাজ করার সুযোগে হোক, কোনওভাবে হাতিয়ে নিয়ে নিজের গবেষণা বলেও জাহির করেন অনেকে। ধরুন, হারিস মঙ্গোলিয়াতে গবেষণা করছে ক্ষুদ্রঋণের উপর। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের একটা ফিল্ড লেভেল রিসার্চ ওর বন্ধু দীপুকে দিয়ে আনিয়ে কিছু data কপি করে বসিয়ে দিয়ে গবেষণা শেষ করল। স্ক্যাল্পার হচ্ছে ব্ল্যাকার।

৬) স্লিপিহেড(sleepyhead)ঃ
অন্য ভাষায় প্রকাশিত কোনও লেখা বা গবেষণাপত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া। উদাহরণ দিচ্ছি, ধরুন 'আব ওয়াক্ত নাহি হ্যায় রোনেকা' শিরোনামে উর্দুতে 'আল জাজিরা' নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ৭০ বছর আগে। জার্মানিতে বসে এক গবেষক সেটা পেয়ে গেলেন এবং দেখলেন যে সেখানে অনেক কিছুই আছে যা তার থিসিস উপযোগী। তিনি সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে উনার নিজের কাজ বলে পেপারে যোগ করে নিলেন। স্থান এবং ভাষার ভিন্নতার কারণে পরীক্ষকের পক্ষে এই।প্রতারণা তাৎক্ষণিকভাবে ধরা মুশকিল।

৭) ডেটা মাইনার(data miner)ঃ
Data সংগ্রহে জালিয়াতিটা সবচেয়ে কমন। যেমন, গবেষকের হয়তো তথ্য সংগ্রহ করতে ৫০টি গ্রামের ২০০ স্কুলে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা দরকার। তিনি ২৪টি গ্রামের ৭০টি স্কুলে গিয়ে বাকীগুলো বাসায় বসে মনগড়া তথ্য দিয়ে বানিয়ে নিলেন। এই জালিয়াতিটাও অনেকে করতে চায় না, তারা data developer দিয়ে নকল data তৈরি করে নেয়। এদের নাম দিয়েছি data miner. এরা data খননের কাজ করে।

৮) শ্মুজার(schmoozer)ঃ
অনেক গবেষক আছেন, অন্যের ধারণা(idea) বা তত্ত্ব(theory) নিজের বলে চালিয়ে দেন। এ কাজটা প্রধানত paraphrase করে করা হয়। Paraphrase কী সেটা উদাহরণটা দেখলেই বুঝবেন। মনে করুন, আনিসের একটা তত্ত্ব বা তথ্য আছে যে,'সূর্য অস্ত গেলে অন্ধকার হয়ে আসে পৃথিবী'। এটাকে আজিজ paraphrase করল, 'আফতাব অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে সারা মাখলুকাতে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে', জোসেফ করল, 'রোদ ছাড়া জগত আন্ধার'। এখানে নতুন কোনো তথ্য বা তত্ব বা ধারণার অবস্থান নেই। শুধু ভাষার প্রয়োগে ভিন্নতা এনে উপস্থাপন করা। কিন্তু আনিসের নাম উল্লেখ করল না থিসিসে। কত্তবড় বদমায়েশ! এরা মিষ্টি কথায় সব গুলিয়ে দেয়।

৯) ভেজিটেবলসঃ
অলস, অকর্মণ্য, ঝুমা মুরগী, বা অতিব্যস্ত ধরনের কিছু সুপারভাইজার থাকেন যারা পৃথিবীর হালচাল সম্পর্কে আর ওয়াকিবহাল নন। জীবন সম্পর্কে উনার দৃষ্টিভঙ্গি বাসা-অফিস-ক্লাস-বার-বিঙ্গো হল পর্যন্ত বিস্তৃত। গবেষণার ক্ষেত্র বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান অপ্রতুল আবার জানার আগ্রহও নেই। সময় বা নিষ্ঠার বা উভয়েরই অভাবে তাঁর ছাত্রের গবেষণায় যথেষ্ট পরামর্শ বা মনোযোগও দিতে পারেন না। দূর্ভাগ্যবশত, এঁদের হাত ফসকে কিছু অসৎ থিসিস বের হয়ে যায়। আমার কাছে এঁরা vegetables.

১০) ডেড কেইসঃ
কিছু সুপারভাইজার আছেন যিনি নিজেই সক্রিয়ভাবে ছাত্রের থিসিস লেখায় অংশগ্রহণ করেন। শুধু তাই না, নিজের সংগ্রহে থাকা তথ্য-উপাত্ত দিয়েও ছাত্রকে সাহায্য করেন সফল হতে। এটা অনৈতিক, অন্যায়, এবং ক্রিমিনাল। Sexual favour, স্বজনপ্রীতি, কার্যকরী নেতৃত্বদানে অক্ষমতা, নিজ স্বার্থ, ইত্যাদি কারণে এধরণের স্খলন ঘটে থাকে। আমি এদের ডাকি dead case.

পিএইচডি'র গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির এগুলোই মূল উপজীব্য।

এই প্রতারণার শাস্তি খুবই কঠোর হয়ে থাকে তবে শাস্তির মাত্রা জালিয়াতির পরিমাণ, ধরন, এবং উদ্দেশ্যের উপরও নির্ভর করে। পত্রিকায় পড়েছি, সামিয়া ও মারজান ৬০-৮০ শতাংশ কপি পেইস্ট করেছেন অন্যের লেখা থেকে। এটা অত্যন্ত বড় একটা চুরি। এর অর্থ হচ্ছে তাদের নিজের কোনো গবেষণাই নেই। একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই অপরাধের শাস্তি অনেক গুরুতর হবে। পদাবনতি হলো, just a slap on the wrist.

শাস্তি পেয়েছেন এমন দুইজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। একজন ফ্যাকাল্টির ডিন, উনার ১৯৭৯ সনে করা থিসিসে অন্যের গবেষণার তথ্য সংযোজন করে যথাযথভাবে সাইটেশন(citation) করতে 'ভুলে গিয়েছিলেন'। ২০১০ এ এটা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় প্রথমে সাসপেন্ড হন, পরে তদন্ত চলাকালীন সময়ে তিনি নিজেই চাকরিতে ইস্তফা দেন। ৩০ বছর পর ধরা পড়েছিল জালিয়াতি।

দ্বিতীয় ঘটনাটি একজন নবীন গবেষকের। সে নানাভাবে তথ্য সংগ্রহ করে এদিক সেদিক করে ভেজিটেবলসের চোখে ধুলো দিয়ে থিসিস রেডি করে ফেলে। কিন্তু পরে গবেষণালব্ধ তথ্য ডিফেন্স করতে গিয়ে অন্য পরীক্ষকদের প্রশ্নবাণে অসহায় আত্মসমর্পণ করে পিএইচডি অসম্পূর্ণ রেখেই বিদায় নিতে বাধ্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আবার ফিরে আসার সুযোগ দেয়নি।

নবীন গবেষকদের জন্য ঢাকায় নীলক্ষেত হচ্ছে এই ধরনের থিসিসের breeding ground. প্রফেসর/সুপারভাইজার/পরীক্ষকের অকর্মণ্যতাও এইসব 'ড. বাকু শাহ' তৈরিতে ভুমিকা রাখছে। গবেষকদের পাশাপাশি সুপারভাইজার/অধ্যাপক/পরীক্ষকদের নিজেদের দ্বায়িত্বও সৎভাবে পালন করা উচিত এবং তাঁদেরও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা জরুরি অথবা এ ধরনের দ্বায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় অব্যহতি নেয়া উচিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:০০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দরখাস্ত - বরাবর: জনাব, কাল্পনিক ভালোবাসা / জাদিদ সাহেব

লিখেছেন ঠাকুরমাহমুদ, ১২ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:৫৩



বরাবর:
জনাব, কাল্পনিক ভালোবাসা / জাদিদ সাহেব
চিফ এক্সিকিউটিভ এডমিন
সামহোয়্যারইন ব্লগ

তারিখ: ১১-১১-২০২৪ইং

বিষয়: ব্লগার সোনাগাজী নিকের ব্লগিং ব্যানমুক্ত করার জন্য অনুরোধ।


জনাব, কাল্পনিক ভালোবাসা / জাদিদ সাহেব,
আপনাকে ও সামহোয়্যারইন ব্লগের সকল ব্লগারদের প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সময়ের স্রোতে ক্লান্ত এক পথিক তবু আশায় থাকি …

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ১২ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:০৫


হালকা হাওয়ায় ভেসে আসে গত সময়ের এলবাম
মাঝে মাঝে থেমে যায়, আবার চলে তা অবিরাম
সময় তো এক নদীর মতো, বহমান অবিরত,
জল-কণা আর স্মৃতি বয়ে নেয় যত তার গত।

একটু... ...বাকিটুকু পড়ুন

মত প্রকাশঃ ইতিহাস কি বিজয়ীরাই লেখে?

লিখেছেন জাদিদ, ১২ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৩২

"বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার সমস্যা" -বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আলী রীয়াজ একবার বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের সঙ্গে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক আছে। সে ক্ষমতায় যারা বিজয়ী হয়, তারাই ইতিহাস রচনা করে। পরাজিতরা ইতিহাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধু নাম আর কেউ মুছতে পারবেনা।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১২ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০


২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপনণের পরপরই ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘মহাকাশে আজ উড়ল বাংলাদেশের পতাকা। আজ থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

“বঙ্গভবন থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানো উচিত হয়নি “এই কথা রিজভী কোন মুখে বলে ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ১২ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫১



অবাক হয়ে রিজভীর কথা শুনছিলাম উনি কি নিজেকে মহান প্রমান করার জন্য এই কথা বললেন নাকি উনি বলদ প্রকৃতির মানুষ সেটাই ভাবতেছি। উনি নিশ্চই জানেন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×