জোডিয়াক আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ এবং রহস্যময় সিরিয়াল কিলার হিসেবে পরিচিত। তিনি এতটাই সূক্ষ্ম এবং নিপুণভাবে প্রতিটি খুন করেছে যে এখন পর্যন্ত আমেরিকার পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে তবে তার নাগাল পাচ্ছে না! তিনি খুনগুলো করেছে মূলত গত শতাব্দীর ষাট এবং সত্তুর দশকে, জনশ্রুতি আছে জোডিয়াক এখনও জীবিত আছে। সিরিয়াল কিলার-রা প্রতিটি খুন সাধারণত একই কায়দায় করে থাকে এবং তারা মূলত প্রায় একই বৈশিষ্ট্যের লোকজনকে তাদের নিশানা বানায়। জোডিয়াকও তার ব্যতিক্রম নয়, তার নিশানায় ছিল মূলত তরুণ দম্পতি এবং নিঃসঙ্গ কোন ট্যাক্সি ড্রাইভার। তিনি খুনগুলো করে স্থানীয় পত্রিকাগুলো চিঠি লিখে জানাতেন এবং সেগুলো প্রকাশ করতে বলতেন, প্রকাশ না করলে বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার হুমকি দিতেন। জোডিয়াকের আসল নাম জানা যায়নি তবে তিনি চিঠিগুলোতে নিজেকে জোডিয়াক হিসেবেই পরিচয় দিত। সে সর্বমোট ৩৭টি খুন করেছে বলে স্বীকার করেছিল, এবং তার দুইজন ভিক-টিম জীবিত ছিল। ধারনা করা হয় জোডায়িক আমেরিকার পূর্ব পশ্চিম রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা, কারণ তার খুনগুলো মূলত এই রাজ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তবে ধারনা করা হয় এই রাজ্যের বাইরেও সে কিছু খুন করেছে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার নাম আসলে অবধারিতভাবেই জোডিয়াকের নামটি এসে যায়। আজকে আমি ক্যালিফোর্নিয়াতে আছি, এখান থেকেই আমার দ্বিতীয় দিনের যাত্রা শুরু করব।
ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য ঘিরে অনেক কিংবদন্তি, ভৌতিক গল্প এবং মিথ প্রচলিত আছে। তাছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার জীব বৈচিত্র্য, প্রকৃতি এবং ইতিহাস বেশ চমক-পদ যেটা তাকে আমেরিকার অন্যান্য রাজ্য থেকে ব্যতিক্রম করেছে। আমার এই লেখায় পাঠকদের সাথে ক্যালিফোর্নিয়াকে ঘিরে কিছু মিথ/কিংবদন্তী এবং ভৌতিক গল্প শেয়ার করব তবে তার আগে আজকের দিনের আমার ভ্রমণ শুরুর কথাটি বলে নেই।
এই রেস্ট এরিয়াতেই রাত্রি যাপন করেছি গতকাল রাতে।
আজ মে মাসের ৬ তারিখ, আমার ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। সকাল প্রায় আট-টার দিকে ঘুম থেকে উঠলাম। ঝকঝকে আকাশ, শীতল পরিবেশ। গতকালের বৃষ্টির রেশ এখনও যায়নি, রাস্তা ঘাট ভেজা। গাড়িতে খুব জায়গা ছিল না, কোনোমত ড্রাইভিং সীটে বসে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়েছি। ঘুম যে খুব ভাল হয়েছে সেটা বলা যাবে না। আমি রেস্ট এড়িয়ার ওয়াশরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আজকের দিনের ভ্রমণের প্রস্তুতি নিলাম। এই রেস্ট এড়িয়ার একটি বড় সমস্যা ছিল যে এখানকার পানি খাবার টিউবওয়েলগুলোর একটাও কাজ করেনি, গতকাল রাতে ভাত খেয়ে আর পানি খেতে পারিনি, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ।
পূর্বেই বলেছিলাম ক্যালিফোর্নিয়া অনেক বড় রাজ্য যেটা বাংলাদেশের প্রায় তিনগুণ, আমার যাত্রার সব চেয়ে বড় অংশ এই ক্যালিফোর্নিয়া পারি দিতে দিতেই চলে গেছে। আমি অরিগণ পারি দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি প্রান্তে আছি মূলত এখন, পুরো ক্যালিফোর্নিয়া লম্বালম্বি-ভাবে পাড়ি দিতে হবে। প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসকো, সান-জোস, লস এঞ্জেলস হয়ে তারপর আমার গন্তব্য আমেরিকার মরুভূমির রাজ্য এরিজোনা। তবে আজকে আমার টার্গেট সানফ্রানসিসকোতে ঢুকব, ম্যাপে দেখা যাচ্ছে সানফ্রানসিসকো ৩৯১ মাইল দূরে অবস্থিত।
বৃষ্টি ভেজা প্রাকৃতিক দৃশ্য।
ভ্রমণের একটি ধনাত্মক দিক হচ্ছে এটা আমাদের শিশু বয়সের সেই সবকিছু দেখে আশ্চর্য হবার বিরল অনুভূতিকে মনে করিয়ে দেয়। আমি ছুটে চলছি প্রবল বেগে গন্তব্যের দিকে, সকালের নরম রোধ আর শীতল বাতাস গায়ে মেখে ছুটে চলছি আর অভিভূত হচ্ছি। আঁকাবাঁকা রাস্তা, খোলা প্রান্তর, যেদিকে চোখ যায় সবুজের মাঠ, এখানে গাড়ি খুব বেশী নেই। তবে একটু পর পর বৃষ্টি নামছে, তবে আমার খারাপ লাগছে না। ক্যালিফোর্নিয়াকে আমার বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ মনে হয়েছে অরিগনের তুলনায়, মাঝে মাঝে শুধু খোলা মাঠ দেখা যাচ্ছে আবার পরক্ষনেই উঁচুনিচু পাহাড় বেয়ে এগিয়ে চলছি। প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য দেখে আমি হা করে তাকিয়ে আছি, কবি হলে এই মুহুত্যে একটি কবিতা লিখে ফেলতাম তবে আফসোস আমি নই তাই মুখে দিয়ে শুধু উহ আহ করছি! কবিতায় আমার দৌড় হল বড়জোর "গাছের পাতা নড়ে চড়ে তোমার কথা মনে পড়ে" পর্যন্তই।
যাইহোক কবিতার প্রসঙ্গ আসাতে একটি মজার ঘটনা শেয়ারে করছি। আমি এক ফেইসবুক কবিকে চিনতাম। কবি মাঝে মাঝেই ফেইসবুকে প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে উহ আহ করে কবিতা প্রসব করত তবে কবির কবিতাগুলো বেশ পাঠক খরায় ভুগত। একদিন কবি বেশ রুষ্ট হলেন এবং অভিমানে ফেইসবুকে ঘোষণা দিলেন তিনি আর তার মহা-মূল্যবান কবিতা লিখবেন না। এবার পাঠক-গন কবির প্রতি তুষ্ট হল এবং কবির এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে অনেকেই বলল ভাই আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আপনার কবিতা আর না লেখাই উচিৎ ইত্যাদি। কবি মনে মনে গোস্বা করল, কবি হয়ত ভেবেছিল তার কবিতা না লেখার সিদ্ধান্ত অনেককেই আহত করবে, এবং অনুনয় বিনয় করে পুনরায় তাকে লেখতে অনুরোধ করবে। কবির সেই আশায় গুরে বালি, ব্যথিত হৃদয়ে কবি অভিমানে ঘোষনা দিল যে যে তাকে কবিতা লেখতে নিরুৎসাহিত করেছে সবাইকে তিনি আন-ফ্রেইন্ড করে দিবেন। যাইহোক কবিকে হেয় করার জন্য এই ঘটনাটি আমি এখানে উল্লেখ্য করিনি, যে কোন সংস্কৃতি চর্চাকেই আমি শ্রদ্ধা-ভাবে দেখি, কবিতা লেখাতো খারাপ না! তবে দুঃখের বিষয় এর পর থেকে আমি আর সেই কবিকে কখনই কবিতা লেখতে দেখিনি! তাই আমিও প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে কবিতা লেখে পাঠকের মনে বিরক্ত উৎপাদন করতে চাই না। এদিকে আমার প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, চিন্তা করলাম রাস্তায় কোন ওয়ালমার্ট পরলে সেখানে গাড়ি থামিয়ে কিছু খাবার, পানি এবং জুস কিনব। এদিকে যাত্রা শুরুর আধা ঘণ্টার ভিতরে প্রচুর বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বৃষ্টি এত বাড়ছিল যে সামনে কিছু দেখা যাচ্ছিল না।
প্রাকৃতিক দৃশ্য।
ঐতিহাসিকভাবে ক্যালিফোর্নিয়া বেশ সমৃদ্ধ। এখানে ছোট করে ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসটি বলে নেই, ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। ১০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ১৫৪২ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ছিল নেটিভ আমেরিকানদের অধীনে। তারপর ১৫৪২ থেকে ১৭৬৯ সাল পর্যন্ত ছিল ইউরোপিয়ানদের দখলে, আবার ১৭৬৯ সাল থেকে ১৮২১ সালে স্প্যানিশরা ক্যালিফোর্নিয়াতে কলোনি স্থাপন করেছিল, পরবর্তী সময় যেমন ১৮২৩ থেকে ১৮৪৮ সাল মানে এই ২৫ বছর এটা মেক্সিকানদের দখলে ছিল। ১৮৫০ সালের পর থেকেই মূলত এটা বর্তমানের আমেরিকার অধীনে আছে। তবে স্প্যানিশদের আগমনের পর প্রচুর নেটিভ আমেরিকানরা মারা যায় যুদ্ধে এবং রোগে ভুগে।
কোন বস্তু যদি উপরের দিকে ছুড়ে মারা হয় সেটা একটু পরেই মাটিতে এসে আঁচড়ে পরবে অন্তত পদার্থ বিজ্ঞান আমাদের তাই বলে। ক্যালিফোর্নিয়াতে একটি লোককথা প্রচলিত আছে যে নিদিষ্ট কিছু রাস্তায় এখানে গ্রাভিটি কাজ করে না! অর্থাৎ আপনি পাহাড়ের কোন ঢালুতে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে থাকলে গাড়িটি ঢালু বেয়ে নীচে নামবে না বরং সেটা উপরের দিকে উঠতে থাকবে! ব্যাপারটা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি সশরীরে! এতটুকু পড়েই পাঠক আঁতকে উঠতে পারেন! পাঠকদের আমি আত্মস্থ করে বলছি আমি আমার পুরো জার্নিতে ক্যালিফোর্নিয়াতে এরকম কোন জায়গার অস্তিত্ব পাইনি! ব্যাপারটি খোলাসা করছি! দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে ঠিকই এমনই একটি পাহাড় আছে যেখানে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করলে গাড়ি ঢালু বেয়ে উপরে উঠে। আমি সরকারী স্কলারশিপ নিয়ে কোরিয়াতে গিয়েছিলাম আন্ডার-গ্রাজুয়েট করতে, প্রতি বছরই কোরিয়ান সরকার আমাদের সকল স্কলারশিপ প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেত। এরকমই এক বছরের খৃষ্টমাসের এক ছুটিতে আমাদের সবাইকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য করিয়ার বিখ্যাত দ্বীপ জেজুতে নিয়ে গিয়েছিলো। দ্বীপটাতে আমরা জাহাজে করে গিয়েছিলাম, বড় জাহাজে করে যেতে প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লেগেছিল। জেজুতে নিয়ে আমাদের বাসে করে সেই অদ্ভুত পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিল। ড্রাইভার গাড়ি স্টপ করে আমাদের বলল একটি অদ্ভুত জিনিষ দেখ। আমরা সবাই লক্ষ করলাম বাসটি ঢালু বেয়ে নীচে না নেমে উপড়ের দিকে উঠছে। অদ্ভুত এই ব্যাপারটির কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে তবে আমার আর এর ব্যাখ্যা খুঁজতে ইচ্ছে হল না, কারণ কিছু কিছু জিনিষ রহস্য চাদরে ঢাকা থাকলেই ভাল লাগে হয়ত!
ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট, সওগাত। এখানেই দুপুরের খানাখাদ্য খেয়েছিলাম।
এখন দুপুর দুইটার-মত বাজে, মাঝখানে একটি ওয়ালমার্টে নেমে কিছু পাউরুটি এবং পানি কিনেছিলাম। গাড়ির গ্যাস নেওয়ার দরকার ছিল তাই একটি গ্যাস স্টেশনে নেমে গ্যাস নিয়েছিলাম। গতকাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি, তাই গ্যাস স্টেশনেই গাড়ি থামিয়ে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিয়েছি। এখন ফ্রেশ লাগছে, গাড়ি ছুটে চলছে তীব্র গতিতে, বৃষ্টিও আর নেই। আমেরিকা প্রকৃতির বৈচিত্র্যের দেশ, এখানে ঠাণ্ডা বরফ থেকে শুরু মরুভূমি সব কিছুই আছে। গতকাল পর্যন্ত শীতের রাজ্য অরিগনে ছিলাম আর আজ গরমের রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়াতে আছি। তবে ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া খুব গরমও নয় আবার ঠাণ্ডাও নয়। ওদিকে আমার প্রচণ্ড খুদা পেয়েছে, পেটে কিছু খানা খাদ্য চালান করা দরকার।
খাসীর বিরিয়ানি।
আমি ম্যাপে সার্চ দিয়ে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট খুঁজে পেলাম, নাম সওগাত। ভাবলাম আজকের আহার এই রেস্টুরেন্টেই সেরে নেই। ছুটে চললাম সওগাত রেস্টুরেন্টের দিকে, রেস্টুরেন্টটি হাইওয়ে থেকে প্রায় ৫ বা ৬ মাইল দূরে দেখাচ্ছে। হাইওয়ের কাছাকাছি আরও কিছু রেস্টুরেন্ট ছিল তবে সেগুলোর রেটিং খুব একটা সুবিদার ছিল না, তবে সওগাতের গুগল রেটিং লা-জবাব! খাদ্যের ব্যাপারে আমি বরাবরই হুশিয়ার, তাই রেস্টুরেন্টটি একটু ভিতরে হলেও আমি এটাকেই বেছে নিলাম, তার উপর আমি ভোজন রসিক আদম, খানা খাদ্য ভাল হলে আমার মন তৃপ্ত হয়, আর তৃপ্ত থেকেইতো সুখ আসে!
যাত্রা পথে এক কাপ চা, মনে প্রাণে তৃপ্তি এনে দেয়!
প্রথমে আমার ইচ্ছে ছিল বাফেটে খাব তবে রেস্টুরেন্টের ইন্ডিয়ান মেয়েটি বলল বাফেটের সময় শেষ হয়ে গেছে। অগত্যা আমি খাসীর বিরিয়ানি অর্ডার করলাম। সময়মত খাবার সার্ভ করল অভিনব কায়দায়, বাটিতে নান দিয়ে মোড়ানো ছিল পুরো বিরিয়ানি, বিরিয়ানির সুভাসে মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছিলাম, সাথে ছিল রাইতা। কথায় আছে "ঘ্রাণে অর্ধ-ভোজন", আমিও দেরি না করে রাইতা মিশিয়ে চোখ বুজে এক চামচ বিরিয়ানি পেটের ভিতর চালান করে দিলাম, বিরিয়ানী জিহ্বার সড়ক গলে যখন পেটে গেলে তৃপ্ত হলাম। বিরিয়ানিটি নিয়ে ঠকিনি, পয়সা উসুল টাইপ, নিমিষেই দানারদান বিরিয়ানি পেটে চালান করে দিলাম। দুপুরে রাইস জাতীয় কিছু খেয়ে গাড়ি চালাতে বেশ অসুবিধা হয় আমার, ঘুম চলে আসে তাই এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম গন্তব্যে।
এবার মাঝখানে আর কোন বিরতি নয় বরং সরাসরি সানফ্রানসিসকোর বিখ্যাত সেই গোল্ডেন গেইট ব্রিজে গিয়েই থামব বলে মনস্থির করলাম। ম্যাপে দেখাচ্ছে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সানফ্রানসিসকো পৌঁছে যাব। সানফ্রানসিসকোর দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম, পাল্লা দিয়ে রাস্তায় ট্রাফিক এবং শহুরে পরিবেশ বাড়ছিল। এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে আমার বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল, অনেক বড় বড় রাস্তা, রাস্তায় অনেকগুলো লেইন, যে যেভাবে পারে ওভারটেইক করছিল। আমি সাবধানে দেখে দেখে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, কারণ আমার গাড়ি ফুল লোডেড, হঠাৎ ব্রেক কষলে এক্সিডেন্ট হবার সম্ভাবনা আছে। এই নিয়ে সানফ্রানসিসকো আমার দ্বিতীয়বারের মত যাওয়া হবে। তখন আমি ডেনমার্কে পিএইচডি করতাম, একটি কনফারেন্সে যোগ দিবার জন্য সানফ্রানসিসকো এসেছিলাম, সেবার টুরিস্ট বাস দিয়ে পুরো শহর ঘুরে ছিলাম।
সানফ্রানসিসকোর গোল্ডেন গেইট পার্কের ষ্ট্রো-লেকে ( Stow Lake) বসে দুজন নারী গল্প করছে, পাশে তাদের বাচ্চারা ট্রলারে ঘুমাচ্ছিল। তাদের গল্পের মাঝখানে একটি স্ট্রলার থেকে বাচ্চা গড়িয়ে পানিতে পড়ে গেল। বাচ্চার মা যতক্ষণে ব্যাপারটি লক্ষ করল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পানিতে পড়ে বাচ্চাটি অদৃশ্য হয়ে গেল, বাচ্চাটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এটি একটি লোকগল্প, জনশ্রুতি আছে সহস্র বছর পরও সেই বাচ্চার মার আত্ম বাচ্চাটিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কোন আগন্তুক রাতে সেই লেকের কাছে গেলেই মার আত্মটা এসে জিজ্ঞেস করে “তুমি কি আমার শিশুকে দেখেছ?” আগন্তুক সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারলে বাচ্চার মা তার সানডে মানডে ক্লোজ করে দেয়!
আমি সেই গোল্ডেন গেইট পার্কে যাইনি কারন আমার কোন ইচ্ছেই ছিল না সেই বাচ্চার মার আত্মটার সাথে মোলাকাত করার। আমি গাড়ি নিয়ে সরাসরি আমেরিকার বিখ্যাত সেই গোল্ডেন গেইট ব্রিজেই গিয়েছিলাম। অসাধারণ এই স্থাপত্যটি দেখতে লাখো মানুষ ছুটে আসে এখানে। আমেরিকার ইঞ্জিনিয়ার জসেপ বেয়ারমান স্ট্রাউস (Joseph Baermann Strauss) এর তত্ত্বাবধানে ১৯৩৩ সালে এই ব্রিজের কাজ শুরু হয় যা ১৯৩৭ সালে শেষ হয়।এটি সেই যুগের সব চেয়ে লম্বা ব্রিজ হিসেবেই স্বীকৃত ছিল। ব্রিজটিকে আমেরিকার শক্তি, উন্নয়ন এবং অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
আমি গোল্ডেন গেইট ব্রিজ থেকে কিছুটা দূরে প্রাইভেট একটি পার্কিং এড়িয়াতে গাড়ি পার্কিং করলাম ৫ ডলার দিয়ে। তারপর সেখান থেকে হেটে চলে এলাম এই ব্রিজের সামনে। ঘড়িতে তখন ছয়-টার একটু বেশী হবে, সূর্যের প্রখরতা কিছুটা কমে এসেছে, বইছে সুন্দর বাতাস। দেখলাম অনেক মানুষ এসেছে এই স্থাপত্য দেখতে, ব্রিজের কাছে গিয়ে এই অসাধারণ স্থাপত্যের কিছু ছবি তুললাম। এত দূর এলাম ভাবলাম এই বিখ্যাত ব্রিজের সামনে নিজের একটি ছবি না তুললে জীবনটা বৃথা হয়ে যাবে, সমস্যা হচ্ছে আমি সিঙ্গেল, ছবি তুলে দেবার জন্য কেউ নেই! সামনেই এক জোড়া কপোত কপোতী দেখলাম, একটি ছবি তুলতে অনুরোধ করতে সামনে পা বাড়াতেই দেখলাম কপোত-কপোতি চুমাচাট্রিতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে, পারেতো একজন আরেকজনের উপর শুয়ে পড়ে অবস্থা, শুধু খাট পালঙ্কের অভাব আরকি! আমিও আর গোলিয়োঁ কী রাসলীলাতে বাধা উৎপন্ন করলাম না। অবশেষে খুঁজে পেলাম আমারই-মতন এক হতভাগা সিঙ্গেলকে, ভদ্রলোককে অনুরোধ করার সাথে সাথে কিছু ছবি তুলে দিল। ফটোসেশোন পর্ব সমাপ্ত করে সানফ্রানসিসকোর ডাউন টাউনে কিছুটা ড্রাইভ করে দ্বিতীয় দিনের জার্নিটা এখানেই শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
সানফ্রানসিসকো ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
ভ্রমনের দ্বিতীয় দিনের ভিডিও ব্লগ
চলবে ....
আগের পর্বগুলো
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব দুই): যাত্রা শুরুর দিন
আমেরিকার অরিগণ থেকে এরিজোনায় রোড ট্রিপ (পর্ব এক): ভ্রমনের ইতিকথা