‘এমপি শাওনের অতীত খারাপ থাকতে পারে কিন্তু পুলিশ নিশ্চিত, ইব্রাহিম খুনের ঘটনায় তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন।’ বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগের কর্মী ইব্রাহিম আহমেদ হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই এভাবে সরকারি দলের সাংসদের পক্ষে সাফাই গাইলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক। গতকাল ডিএমপি সদর দপ্তরে মাসিক অপরাধ সভা চলাকালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। এর আগে ইব্রাহিম খুনের দুই দিন পর তিনি এ বিষয়টিকে ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন।
পুলিশ কমিশনারের এই সংবাদ সম্মেলনের ১৬ ঘণ্টা আগে বুধবার রাতে কঠোর গোপনীয়তায় গোয়েন্দা পুলিশ সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরীকে (শাওন) গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সাংসদ নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও অনেক প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেননি। ইব্রাহিমের পরিবারের পক্ষ থেকে এই জিজ্ঞাসাবাদকে ‘লোক দেখানো’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এএসএম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে এভাবে মন্তব্য না করাই ভালো। অতীতে আমরা বহু রকম তদন্ত দেখেছি। এসব নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। এ কারণে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্ষেত্রে তদন্ত শেষ না করে কোনো কিছু বলা ঠিক নয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন সাবেক পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সরাসরি খুনের মামলায় না জড়ালেও এ ঘটনায় সাংসদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১০৭ ধারায় অপরাধে সহায়তা করা এবং ২০১ ধারায় অপরাধীকে গোপন করার জন্য অপরাধের সাক্ষ্য অদৃশ্য করে দেওয়া বা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করার অভিযোগ আনা যেতে পারে।
পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী গত ১৩ আগস্ট বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন ইব্রাহিম। এরপর সাংসদ নুরুন্নবীসহ অন্যরা তাঁকে প্রথমে সদরঘাটের সুমনা ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাত আটটার দিকে ইব্রাহিমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করলে সাংসদ ও তাঁর সহযোগীরা লাশ ফেলে পালিয়ে যান। ওই দিন সারা রাত ইব্রাহিমের পরিবারের সদস্যরা কেউই জানতে পারেননি ইব্রাহিম কীভাবে, কোথায়, কার হাতে গুলিবিদ্ধ হলেন। স্বজনদের অন্ধকারে রেখেই প্রভাব খাটিয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় গাড়িচালক কামাল হোসেনকে দিয়ে রাতেই অপমৃত্যু মামলা করান নুরুন্নবী। পরে তদন্তে মামলাটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করে। এর আগে ইব্রাহিমের ভাই মাসুম আহমেদ সাংসদ নুরুন্নবীসহ আটজনকে আসামি করে আদালতে হত্যা মামলা করেন। গোয়েন্দা পুলিশের করা মামলাটির তদন্ত এখনো চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা ডিএমপি কমিশনারের কাছে জানতে চান, পুলিশ সাংসদ নুরুন্নবীকে খুনের মামলা থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে কেন? জবাবে কমিশনার বলেন, ‘আমরা কেন তাঁকে রক্ষার চেষ্টা করব। একটা অপমৃত্যু মামলা হয়েছে কিন্তু পুলিশ হত্যা মামলার মতোই তদন্ত করেছে। আমরা ক্লিয়ার, এই হত্যাকাণ্ডে নুরুন্নবী জড়িত নন। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। যিনি কোনোভাবেই ঘটনায় সম্পৃক্ত নন, তাঁকে আমরা জড়াব কেন। আগে তাঁর অনেক অপকর্মের ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে পারে কিন্তু এ ঘটনায় তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
প্রশ্ন করা হয়, যদি সাংসদের সম্পৃক্ততাই না থাকে, আর এটা যদি পরিকল্পিত খুন না হয়, তাহলে সাংসদ কেন গুলিবিদ্ধ ইব্রাহিমকে আশপাশের কোনো হাসপাতালে না নিয়ে শহরের এক কোণে সদরঘাট এলাকার সুমনা ক্লিনিকে নিয়ে গেলেন? কেন সাংসদ ও তাঁর সহযোগীরা ইব্রাহিমের লাশ ঢাকা মেডিকেলে ফেলে পালালেন? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি কমিশনার।
ইব্রাহিম খুনের দুই দিন পর রাজারবাগে এক অনুষ্ঠানে এই মৃত্যুকে দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন কমিশনার। ঘটনার শুরুতেই তিনি কীভাবে এটাকে দুর্ঘটনা বলেছিলেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, মামলার সূত্র ধরেই তিনি এ মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে মনে করেছিলেন।
ইব্রাহিমের বাবা-মা-স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কেন চালকের অপমৃত্যু মামলা নিল পুলিশ? এর জবাবে কমিশনার বলেন, ‘যে কাছাকাছি থাকবে সে মামলা করবে।’ সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন, তাহলে তো একজন খুনি খুন করে থানায় গিয়ে মামলা করতে পারে। কমিশনারের জবাব, ‘যদি খুনিই মামলার বাদী হয়, তবে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’ সাংবাদিকেরা জানতে চান, তাহলে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই কেন ভুয়া মামলার সূত্র ধরে মন্তব্য করলেন? এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব দেননি কমিশনার।
ইব্রাহিম খুনের পর পুলিশের তৎপরতা বর্ণনা করে কমিশনার বলেন, ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ডের আলামত হিসেবে নুরুন্নবীর অস্ত্র, গাড়ি জব্দ ও পরীক্ষা করা হয়েছে। গাড়ির ভেতরে রক্তের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে কিন্তু তাতে নুরুন্নবীর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কমিশনার জানান, ১৩ আগস্ট ঘটনার পরপরই তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন, আলামত জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন, মতিঝিলের উপকমিশনারকে ইব্রাহিমের বাসায় পাঠিয়েছেন। অথচ ১৩ আগস্ট সারা রাত ইব্রাহিমের পরিবারের কেউ জানতই না, কীভাবে ইব্রাহিম গুলিবিদ্ধ হলেন, কে কোথায় তাঁকে গুলি করল।
গাড়ি তাঁর, অস্ত্রও তাঁর তবুও নুরুন্নবীকে সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, ‘আমি পুলিশ কমিশনার হয়েই ওসিদের নির্দেশ দিয়েছি সন্দেহের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। গাড়ি আর অস্ত্র নুরুন্নবীর হতে পারে কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গাড়ি-অস্ত্র তাঁর হলেই তো প্রমাণ হয়ে যায় না যে তিনি খুনটা করেছেন। কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বৈধ অস্ত্রের অপব্যবহার করেন, তাহলে সেটা অপরাধ হতে পারে। কেউ অস্ত্র ভাড়া দিলে, অস্ত্র দিয়ে কাউকে ভয় দেখালে সেটা অপরাধ হতে পারে।’ সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন, তাহলে বিনা তথ্যপ্রমাণে শুধু সন্দেহের বশে পুলিশ কর্মকর্তা গৌতম হত্যা মামলায় কেন দুই জোড়া হায়দার-জাকিরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হলো। কিছুটা বিব্রত হয়ে কমিশনারের উত্তর, ‘পরবর্তীতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যদি মনে করেন, কাউকে গ্রেপ্তার করে রাখলে কিছু তথ্য পাওয়া যাবে, তাহলে তিনি সেটা করতেই পারেন। এ বিষয়টি আমার জানা নেই।’
সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যদি এ রকম ঘটনা ঘটত, তাহলে পুলিশ কী করত? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনারের পাল্টা প্রশ্ন, ‘আন্দাজে বললে তো আর হবে না। আপনারা এমন একটা উদাহরণ দেখান যে ঘটনার পর সন্দেহের বশে বৈধ অস্ত্রের মালিককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’ এ সময় সাংবাদিকেরা জানান, ওয়ার্ড কমিশনার মনোয়ার হোসেন ডিপজলের বাসায় লাইসেন্স করা অস্ত্র ছিল, তার পরও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কমিশনার বলেন, তখন ভিন্ন প্রেক্ষাপট ছিল।
ইব্রাহিম খুনের পরপরই সাংসদ নুরুন্নবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে নুরুন্নবীর সঙ্গে পুলিশের অনবরত কথা হয়েছে। সাংসদই ফোন করে পুলিশকে ঘটনা জানিয়েছেন।’ তাহলে নুরুন্নবী গণমাধ্যমকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেলেন কেন? কমিশনার বলেন, ‘এটা আপনারা তাঁকেই জিজ্ঞেস করুন।’ এ সময় কমিশনার শহীদুল হক একজন উপকমিশনারকে বলেন, ‘এমপিকে বলে দিন তিনি যেন তাঁর জিজ্ঞাসাবাদের সব কথা গণমাধ্যমকে বলেন।’
সাংবাদিকেরা বলেন, সাংসদের গাড়িচালক কামালের করা অপমৃত্যু মামলা তো মিথ্যা মামলা ছিল এবং কামাল তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, সাংসদের নির্দেশে তিনি এই মামলা করেছেন। তাহলে মিথ্যা মামলার নির্দেশদাতা হিসেবে সাংসদকে কেন অভিযুক্ত করা যাবে না? এ প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, ‘সাংসদকে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন কামাল। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই সাংসদ মামলা করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’
সাংসদের পিস্তল থেকে আঙুলের ছাপ কারা মুছে দিল? কমিশনার বলেন, ‘পিস্তলটি নিয়ে টানাহেঁচড়া হয়েছে, এ কারণে ছাপ না-ও থাকতে পারে। তবে ছাপ মোছা হয়নি। গুলির ঘটনার পর সাংসদ গাড়িতে আসার আগেই চালক কামাল পিস্তলটি গাড়ির সিটের পেছনের পকেটে যে অবস্থায় ছিল, সেভাবে রেখে দেন। ফলে সাংসদ কিছু বোঝেননি।’
নুরুন্নবী সংসদে কেন অস্ত্র নিয়ে গেলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, ‘সংসদ ভবনে তো কেউ অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে পারেন না। সাংসদও পারেন না। অস্ত্র গাড়িতেই রেখে যেতে হয়।’
পুলিশ কমিশনার পাল্টা অভিযোগ করেন, সাংবাদিক ও ইব্রাহিমের স্ত্রীর পুলিশের প্রতি আস্থা নেই। এ কারণে এ রকম ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। কমিশনার শহীদুল হক বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিক) যদি কোনো প্রি-আইডিয়া (পূর্বধারণা) নিয়ে থাকেন, তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই।’
সাংবাদিকেরা জানতে চান, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়ার মতো নুরুন্নবীর গাড়িচালক কামাল হোসেন ঘটনার শিকার হচ্ছেন কি না? কমিশনার বলেন, ‘জজ মিয়ার সঙ্গে তুলনা করাটা নেহাত আপনাদের ব্যক্তিগত ধারণা। একজন এমপি মার্ডার করে পার পেয়ে যাবেন, সেই ধরনের চাকরি আমরা করি না।’
নিজস্ব প্রতিবেদক,প্রথম আলো