সোহরাব হাসান: সাংবাদিক।
[email protected]
চৈত্র না আসতেই হঠাৎ করে দেশের রাজনীতিতে লু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। কে কার চেয়ে কত খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, আটঘাট বেঁধে সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছে সরকার ও বিরোধী দল। অন্তত জাতীয় সংসদে উভয় পক্ষের সাংসদদের বেফাঁস উক্তি শুনলে এবং অশালীন অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হয়, সত্যিই আমরা যোগ্য নেতৃত্বের উপযুক্ত নই।
সংসদে কী হচ্ছে? বহু সাধ্য-সাধনা, মান-অভিমানের পালা চুকিয়ে দীর্ঘ ১০ মাস পর বিরোধী দল সংসদে যোগ দেওয়ায় দেশবাসী আশা করেছিল, সেখানে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হবে। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের অভাব-অভিযোগ, দৈনন্দিন সমস্যা-সংকটের কথা তুলে ধরবেন। কিন্তু সংসদে আজ আমরা কী দেখছি? মৃত নেতাদের লাশ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাংসদেরা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে খুনি এবং জবাবে বিএনপির সাংসদেরা দেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানকে খুনি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এতে কারও সম্মান বাড়েনি, না জীবিতদের, না মৃতদের।
দুর্ভাগ্যজনক যে এই অপ্রাসঙ্গিক ও অহেতুক বিতর্কের সূচনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেত্রী নিজেই। তিনি বলেছেন, জিয়াউর রহমানের কবরে তাঁর লাশ নেই, সেখানে শুধু বাক্স রাখা আছে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। তাঁকে প্রথমে রাঙ্গুনিয়ায় , পরে ঢাকায় নিয়ে এসে সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেওয়া হয়। সেখানে লাশ থাকল কী না থাকল না তা নিয়ে দেশের মানুষ ভাবিত নয়। প্রধানমন্ত্রীর জানা থাকার কথা, ৩০ বছর পর কারও মৃতদেহের কোন চিহ্ন থাকে না, হাড় ছাড়া। দেশের মানুষের বহু সমস্যা আছে, ৪০ শতাংশ মানুষএখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে, তাদেরএকাংশ মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের সাংসদেরা জিয়ার লাশ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করে সেই সময়টি দরিদ্র জনগণের কল্যাণে ব্যয় করলে তারা উপকৃত হতো। জিয়াউর রহমান মারা গেছেন তিন দশক আগে। তার পরও যদি তাঁকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি করতে হয়, সেটি আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। এতদিন বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা ছিল বিএনপির রাজনীতির উপজীব্য। একই কাজ এখন আওয়ামী লীগ করছে। আওয়ামী লীগের চোখে জিয়া যত খারাপই হোন না কেন, মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই কবর দেওয়ায় তাঁর (জিয়ায়) কোনো ভূমিকা ছিল না।
২৮ বছর পর ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসন থেকে জিয়াউর রহমানের কবরে লাশ আছে কী নেই, সেই বিতর্ক তোলার কী যুক্তি থাকতে পারে? আমরা মনে করি, এর একটিই উদ্দেশ্য, বিএনপিকে আবার সংসদ বর্জনের দিকে ঠেলে দেওয়া। আবার রাজপথে হরতাল-অবরোধের যুগ ফিরিয়ে আনা। তাতে সরকারের কী লাভ হবে জানি না, তবে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা যে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। বিরোধী দলের সংসদে আসাকে সরকারি দল এভাবে ‘স্বাগত’ না জানালেও পারত। সরকারি দল ভাবতে পারে, সংসদে তাঁদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা মাত্র ৩৬-৩৭ জন। তাঁরা সংসদে এলেন কী গেলেন তাতে কিছু আসে-যায় না। এ ধরনের মানসিকতা শুধু গণতন্ত্রের জন্যই হুমকি নয়, ক্ষমতাসীনদের জন্যও আত্মঘাতি। বিএনপিকে এখন দুর্বল মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা হলফ করে বলতে পারি, সরকার যেভাবে চারদিকে ‘যুদ্ধফ্রন্ট’ খুলে বসেছে, তাতে এই দুর্বলতা বেশি দিন থাকবে না। অতীতে বাংলাদেশে মহাজোটের চেয়েও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেউ কেউ ক্ষমতায় এসেছিলেন। গায়ের জোরে আইন পাস করেছিলেন। সেসবের ফল ভালো হয়নি। বাংলাদেশে যে দল যত বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় সে দল তত বেশি স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। সুদূর অতীতের উল্লেখ করব না। নিকট অতীতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের প্রবল দাপটের কথা ভাবুন। ২০০১ সালে তারা কি কখনও ভেবেছিলেন, জনগণ এভাবে তাদের প্রত্যাখ্যান করবে? বরং ৫০ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে বিএনপি নেতারা আস্ফালন করেছিলেন। জনগণই যে শেষ বিচারক এ কথাটি ক্ষমতায় থাকতে কেউ স্বীকার করতে চান না।
সংসদে গত কয়েক দিনে দুপক্ষই ছিল মারমুখী। বলা যায়—কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। পরিস্থিতি এতটাই অসহনীয় যে স্বয়ং স্পিকার বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘মনে হচ্ছে দুই পক্ষই যুদ্ধে নেমেছে। আমি তো কারো টুঁটি চেপে ধরতে পারি না। তবে সংসদে কেউ কুরুচিপূর্ণ ও অসংসদীয় কথা বললে তা এক্সপাঞ্জ করা হবে।’ তার আগেই অবশ্য টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে সাংসদদের মহান কীর্তি কথা জেনে যায়।
দুই.
এ তো গেল সংসদের ভেতরের কথা। বাইরে কী হচ্ছে? প্রায় কাছাকাছি সময়ে নিহত হয়েছেন ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন মেধাবী ছাত্র। আবু বকর, ফারুক হোসেন ও মহিউদ্দিন। তাঁরা রাজনীতি করতেন কী করতেন না, তার চেয়ে বড় কথা অসুস্থ ছাত্ররাজনীতির বলি হয়েছেন। তিনজনই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। আবু বকরের বাবা দিনমজুর, ফারুক হোসেনকে তাঁর বাবা পড়াচ্ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে (প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের অনুরোধ জানাব ঋণের অর্থ মওকুফ করে দেওয়ার জন্য), আর মহিউদ্দিনের বাবা কৃষি বিভাগের একজন কর্মচারী, জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে যিনি চাকরি হারিয়েছিলেন।
যে কোনো সরকারের দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া এবং নিরাপত্তাহরণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। সেই বিবেচনায় শিবিরের যে সশস্ত্র ক্যাডাররা ফারুককে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তাদের গ্রেপ্তারে যেকোনো নাগরিকই খুশি হবেন। ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক—সেটাও আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু একটি হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মন্ত্রীরা যেভাবে অগ্রাসী প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, যেভাবে সারাদেশে গণগ্রেফতার অভিযান চালানো হচ্ছে, তা দেশকে কোথায় নিয়ে যায় বলা কঠিন। সারাদেশে শিবিরের শত শত কর্মী কি একজোট হয়ে ফারুককে হত্যা করেছে? জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আইন আদালতের বিষয়। তার সঙ্গে ফারুক ও মহিউদ্দিনে ঘাতকদের গ্রেফতার যুক্ত করা ঠিক হবেনা। যদি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের ক্যাডাররা ফারুককে হত্যা না করত, তাহলে কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো না? অপরাধীকে চিহ্নিত করতে হবে তার অপরাধের মাপকাঠিতে—কে কোন দলের কর্মী বা সমর্থক সেই দৃষ্টিতে নয়।
শিবিরের ক্যাডাররা ফারুককে হত্যা করেছে বলে সারাদেশে চিরুনি অভিযান হলেও আবু বকরের হত্যাকারীদের ধরতে অনুরূপ অভিযান দেখছি না কেন? ক্যান্টনমেন্ট থানায় এবিএম ফারুকের ঘাতকদেরই বা কেন ধরা হচ্ছে না? অভিযুক্তরা সরকারের সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নেতা বলে?
ছাত্রশিবির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালালে, অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিলে দেশের প্রচলিত আইনেই তাদের পাকড়াও করতে হবে। গয়রহ শত শত কর্মীকে গ্রেপ্তার কিংবা হুমকি-ধামকি বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।
তিন.
জোট আমলে যেসব স্থাপনার নাম বদল করা হয়েছিল তা পূর্বনামে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এই নাম বদলের সঙ্গে জনগণের ভাগ্য বদলের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকার যুক্তি দেখাতে পারে যে জোট সরকার গায়ের জোরে এসব প্রতিষ্ঠানের নাম বদল করেছিল। কিন্তু ২৮ বছর পর বিমানবন্দর থেকে জিয়াউর রহমানের নাম কর্তন করার পেছনে কি যুক্তি থাকতে পারে?। নামকরণটি হয়েছিল ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর। ফলে এ নামকরণে তাঁর (জিয়ার) কোনো ভূমিকা ছিল না। কাজটি করেছে জিয়া-পরবর্তী বিএনপির সরকার। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া তখনও রাজনীতিতে আসেননি। এখানে তত্কালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একটি ভূমিকা থাকতে পারে, যিনি বর্তমানে মহাজোট সরকারের অংশীদার। এত দিন জিয়ার নাম যদি কোনো সমস্যা তৈরি না করে থাকে, হঠাত্ করে নাম বদলের প্রয়োজন হলো কেন? শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে জিয়া বিমানবন্দরের নাম বদলের উদ্যোগ নেওয়া হলে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছিল। তখন অন্য একটি পত্রিকায় কলাম লিখে বলেছিলাম,‘ জিয়ার নামে একটি বিমানবন্দর থাকলে ক্ষতি কী, পুরো বাংলাদেশটাই তো বঙ্গবন্ধুর নামে আছে।’ ১৪৬ আসন পাওয়া আওয়ামী লীগ সে বারে জিয়ার নাম বদলাতে সাহস পায়নি, এবারে করেছে। ৩০০ আসনের সংসদে ২৩০ আসন পেলে কারো মাথা ঠিক থাকার কথা নয়, আওয়ামী লীগেরও নেই।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, সরকার জিয়ার নাম বদলে বিমান বন্দরে কার নাম যুক্ত করেছে? একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নাম। আওয়ামী লীগ নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করে। দলের নেতারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করার কথাও বলছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডারের নাম বদলিয়ে একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নাম যুক্ত করা কি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নয়? তাহলে ধর্মভিত্তিক জামায়াতে ইসলামী ও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট বিএনপির সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের চরিত্রগত পার্থক্য কোথায়?
দেশে হাজারো সমস্যা আছে। গ্রীষ্ম শুরু না হতেই ঢাকা শহরে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েছে। যানজটে নগরজীবন অচল। নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। শিল্পকারখানায়ও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো মরে যাচ্ছে। ছাত্রলীগ ক্যাডারেরা সারা দেশে ভর্তি-বাণিজ্য, টেন্ডার-বাণিজ্য চালাচ্ছে। সাংবাদিক পেটাচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধানে সরকারের কার্যকর কোনো অভিযান নেই। তারা ভাবছে, জামায়াত-শিবিরবিরোধী গরম স্লোগান দিলে বা চিরুনি অভিযান চালালেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমরা এত দিন জেনে এসেছি, ক্ষমতা মানুষকে দায়িত্বশীল ও সহনশীল করে। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের দিকে তাকিয়ে দেখছি, ক্ষমতা তাঁদের স্বৈরাচারী করে, পদের দায়ভার তাঁরা বহন করতে অক্ষম। প্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের সাত-আট বছর আগের পত্রিকা মিলিয়ে দেখতে অনুরোধ করব। সেই সময় বিএনপির নেতারা বিরোধী দলের প্রতি যে তাচ্ছিল্য ও উপহাসের সুরে কথা বলতেন, আজ আওয়ামী লীগের নেতারাও তা-ই করছেন। আল্লাহ তাদের হেফাজত করুন।
দিন বদলের সরকার গত এক বছরে জনগণের ভাগ্য খুব একটা বদলাতে পারেনি। এমনকি তারা জোট সরকারের বৈরী রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলানোরও চেষ্টা করছে না। এখন নাম বদলের মহোত্সবে নেমে পড়েছে। বিএনপি শেখ মুজিবুর রহমানকে ভয় পেত বলেই ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। ১৫ আগস্ট ঘটা করে নেত্রীর জন্মদিন পালন করে আসছে। আওয়ামী লীগও কি জিয়াকে ভয় পেতে শুরু করেছে? তাদের ভেতরকার অস্থিরতা আর তড়িঘড়ি করে বিমানবন্দরের নাম বদল দেখে তা-ই মনে হচ্ছে।