প্রতি বার বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন প্রচন্ড আশা জাগিয়ে আমাদের হতাশ করে - আমাদের বুকটা ভেঙ্গে যায় কষ্টে, আমরা অবাক হয়ে ভাবি কেনো সাকিব-তামিম-মুশফিকের মতো মেধাবী ক্রিকেটাররা আমাদের বারবার হতাশ করে!
এটা একবার নয়, বার বার ঘটছে। এবং খুব একটা ভুল হওয়ার আশঙ্কা না করেও বলা যায় এটা অদূর ভবিষ্যতেও ঘটতে থাকবে।
বিশ্বকাপ ফুটবল বাংলাদেশে আসে রীতিমতো ঝড় হয়ে। সারাদেশে কেউ যেন এড্রেনালিন হরমোন ঢেলে দেয় এই সময়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ কখনো এই বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। আগামী কয়েক দশকে পারবে তেমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আহা, বাংলাদেশ যদি মেসি-নেইমার-রোনাল্ডোদের সাথে বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলতে পারতো!
কিন্তু কেনো আমাদের ক্রিকেট এবং ফুটবলের এই দুরাবস্থা?
প্রিয় পাঠক, আপনি এ লেখাটি হয়তো পড়ছেন ঢাকায় বসে, কিংবা অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকা-ইউরোপে বসে, কিংবা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো জেলায় বসে। আপনি হয়তো একজন ছাত্র, কিংবা হয়তো একজন গৃহিনী, কিংবা একজন চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, কিংবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক। হয়তোবা আপনি একজন কর্মহীন বেকার। আপনি হয়তো একজন সংস্কৃতিকর্মী - গায়ক, গায়িকা, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মডেল, চিত্রশীল্পি। হয়তো আপনি একজন সাংবাদিক, লেখক, বা ফটোগ্রাফার।
আমাদের অবস্থান যেখানেই হোক না কেনো, আমাদের পেশা যেটাই হোক না কেনো, দেশের ক্রিকেট এবং ফুটবল দল এর কাছে আমাদের সবারই চাওয়া একটা - বিশ্বের সেরা দলগুলোর সম-মানের পারফরম্যান্স! আমরা চাই আমাদের ক্রিকেট দল বীর বিক্রমে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো দলগুলোকে গুঁড়িয়ে দিক (আহা - সত্যিই যদি সেটি ওরা করতে পারতো!), আমাদের ফুটবল দল নিয়মিত বিশ্বকাপে যেয়ে বিশ্বসেরা দলগুলোকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করুক।
কিন্তু আমরা সবাই জানি সেটি কখনো ঘটেনা। আমাদের ক্রিকেট দল আমাদের নিয়মিত মন খারাপ করে দেয়, নিজ দেশের ফুটবলারদের পরিবর্তে আমরা মেসি-নেইমার-রোনাল্ডোদের নিয়ে মেতে উঠি। আমাদের ঘরে ঘরে উড়ে ব্রাজিল-আর্জেনটিনার পতাকা।
আমাদের ক্রিকেট বা ফুটবল দলের এই ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণ(গুলো) কী?
এই প্রশ্নের উত্তর আরেকটা প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি।
প্রিয় পাঠক, আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতাগুলোর কারণ(গুলো) কী?
আপনার পেশা যাই হোক না কেনো আপনি সেটাতে কতোটুকু সফল, কতোটুকু তৃপ্ত? আপনার কাজ কতোটুকু বিশ্বমানের? আপনার পেশায় আপনি কি অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা-ভারতের একজনের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারবেন?
তামিম-সাকিব-মুশফিকরা আমার আপনার মতোই বাংলাদেশের আলো-বাতাস-পানি খেয়ে বড় হয়েছে, হচ্ছে। যে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবেশ বাংলাদেশে বিরাজমান সেটাই তাদের কাজ করার ভিত্তি। আপনি খেলোয়াড়দের যতোই কোটি টাকা বেতন/স্পন্সরশিপ দেননা কেনো, যতো বড় বিদেশী কোচ দিয়ে প্রশিক্ষণ দেননা কেনো - দিনের শেষে তারা বাংলাদেশেই থাকে। তাদের বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিতজন সবাই বাংলাদেশী। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ এর মধ্য দিয়েই তাদের দিন কাটাতে হয়। এই পরিবেশ-পরিস্থিতি এর মধ্য দিয়ে আপনি অনেক চেষ্টা করে যতোটুকু সফল হতে পেরেছেন, আমাদের ক্রিকেটার ফুটবলাররাও ততোটুকুই হয়েছেন এবং হচ্ছেন।
আমরা উঠতে বসতে রাজনীতিবিদিদের গালি দিই - এটা সত্য তারা এর বেশিরভাগই ডিজার্ভ করে - কিন্তু রাজনীতিবিদরা কিন্তু আমাদের থেকেই উঠে আসা মানুষ। রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে আমাদের নিজেদের দিকে আগে তাকানো উচিৎ। আমরা কি আমাদের নিজেদের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করছি?
আমরা বাংলাদেশীরা দিনের একটা বড় সময় ব্যয় করি অন্যের সমালোচনা করতে। রাজনীতিবিদরা খারাপ, আওয়ামীলীগ খারাপ, বিএনপি খারাপ। সিভিল সোসাইটি ধান্দাবাজ, প্রথম আলো খারাপ, ডক্টর ইউনুস খারাপ। পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তারা ঘুখখোর। ব্যবসায়ীরা মুনাফাখোর। এই লিস্টের শেষ নেই! (সমালোচনা নিয়ে কিছুদিন আগে একটা লিখেছিলামঃ Click This Link)
শেষ কবে কারো প্রশংসা করেছেন মনে আছে?
আমার মনে হয় আমাদের প্রশংসা করা শিখতে হবে আরো বেশি। প্রশংসা করার মানুষ খুব বেশি না খুঁজে পেলে একটা কাজ করুণঃ নিজে এমন একটা কিছু করূন যাতে মানুষ আপনার প্রশংসা করবে! মুশফিক-সাকিব-তামিমরা হতাশ করছে? নিজে একজন বিশ্বমানের ছাত্র, ছাত্রী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিল্পী, ব্যবসায়ী হয়ে যান। তখন সবাই প্রশংসা করার মতো, গর্ব করার মতো একজন নতুন মানুষ পাবে।
কে না চায় তার দেশের দল বিশ্বসেরা পারফরম্যান্স করুক। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা আমাদের ক্রিকেট দল থেকে অনেক বেশি প্রত্যাশা করে ফেলছি। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে - বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট, কিংবা অলিম্পিকে - সাফল্য পেতে হলে আমাদের দেশের ওভারঅল পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে। আমাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে “প্রাণ” এর সঞ্চার করতে হবে। আমার মনে হয় আমাদের সবার জীবনে বড্ড বেশি “প্রাণ” এর অভাবঃ Click This Link
“প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষ কৌতুহলী হয়, আগ্রহী হয়, সবসময় কিছু একটা করতে চায়, যেকোনো জিনিসের ভালো দিকটা দেখে প্রথমে, নিজের ভুল/দোষ হলে সেটা স্বীকার নেয় সহজে, অন্যের সফলতা দেখে হিংসা করেনা, সবকিছুর পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়ায়না, অন্যরা কী করছে সেটা না ভেবে নিজেই এগিয়ে আসে যেকোনো কাজে, ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বসে থাকেনা, এবং আশেপাশের সবার মধ্যে নিজের প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করে। একজন সফল মানুষ আরেকজন সফল মানুষকে হিংসা করবেনা। যে ছেলেগুলো হরতাল-বিক্ষোভ এর সময় নির্বিচারে অন্যের গাড়ি ভাংগে, সেই ছেলেগুলোর প্রত্যেকের একটা করে গাড়ি থাকলে ওরা কখনো এই কাজটি করতো না। অসফল মানুষ স্বভাবতই কিছুটা হীনমন্যতাবোধে ভোগে, এবং সুযোগ পেলেই তার দুঃখ-কষ্টের কারণ অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়।”
ভালো ফুটবলার এবং ক্রিকেটার এর আগে আমাদের দরকার ষোল কোটি ভালো মানুষ, লক্ষ লক্ষ ভালো ছাত্র-ছাত্রী, হাজার হাজার ভালো শিক্ষক, দক্ষ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, পরিচালক। আমাদের সমালোচনা করার এবং সমালোচনাকারী মানুষের অভাব নাই - কিন্তু আমাদের দরকার বেশি বেশি প্রশংসা করার এবং প্রশংসাকারী মানুষ। ব্লগ-ফেইসবুকে দুনিয়ার সবার সমালোচনা করে করে নিজের ওয়াল এবং মানুষের নিউজ ফিড ভরিয়ে ফেলে নেগেটিভিটি ছাড়ানোর পাশাপাশি অন্যের প্রশংসা ছড়ান, নিজে ভালো কিছু করে অন্যকে আপনার প্রশংসা করার সুযোগ করে দিন।
যে দেশের সাধারণ মানুষ ভালো, ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকগণ মেধাবী, সাধারণ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-সাংবাদিক-পুলিশ-সরকারী কর্মকর্তারা দক্ষ, শিল্পী-পরিচালকরা উঁচু মানের, সেই দেশের ক্রিকেটাররা যখন তখন ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিতে পারে, আর সেই দেশের ফুটবল টিম প্রতি বিশ্বকাপে খেলতে পারবে - এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৪ রাত ১:১৭