সম্প্রতি আমেরিকান লেখক, দার্শনিক এলবার্ট হাবার্ড একটা দুর্দান্ত উদ্ধৃতি পড়লামঃ "To avoid criticism do nothing, say nothing, be nothing". অর্থ্যাৎ, সমালোচনা এড়াতে চাইলে কিছু করো না, বলো না, হয়ো না। যার জীবনে কোনো অর্জন নেই, যে পৃথিবী ধ্বংস হলো কি গড়লো এটা নিয়ে মাথা ঘামায়না তাকে নিয়ে কেউ সমালোচনা করার তেমন কিছু খুঁজে পায়না। যখনি আপনি কিছু করতে যাবেন, কিছু একটা বলতে যাবেন, কিছু একটা হতে যাবেন, পৃথিবী দুইভাগ হয়ে যাবে। একদল আপনাকে প্রশংসা করবে, আপনি আরো এগিয়ে যান সেই কামনা করবে, আর আরেকদল আপনার মুন্ডুপাত করবে। জীবনের বাস্তবতায় স্বাগতম!
পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষটির বিরুদ্ধেও অনেক সমালোচনা হয়। সত্যিকথা বলতে কি, "সবচেয়ে ভালো মানুষ" নামে কিছুর আসলে অস্তিত্ব নেই। আপনার কাছে যিনি অনেক ভালো মানুষ, অনেক শ্রদ্ধার পাত্র, অন্যের কাছে তিনি হয়তো ততোটাই বাজে লোক।
আমরা মানুষেরা আমাদের পরিবেশের দ্বারা তৈরি। আমরা যে পরিবেশে বড় হয়েছি, আমাদের বাবা-মা আমাদের যে শিক্ষা আর মূল্যবোধ শিখিয়েছেন, আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যা শিখেছি, চারদিকের পরিচিত আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধব থেকে আমরা যে জ্ঞ্যান লাভ করেছি, বই-পত্র-টেলিভিশন-সিনেমা ইত্যাদি থেকে আমরা সংস্কৃতি-চেতনা শিখছি, সেসব ব্যবহার করে আমরা আমাদের চারপাশকে বিচার করি, মূল্যায়ন করি। এবং প্রত্যেক মানুষের বড় হয়ে উঠা, শিক্ষার বিষয়বস্তু একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন। ফেইসবুক, টুইটারের কল্যানে মানুষের "সামাজিক গ্রাফ " দেখা যায় এখন। এই সামাজিক গ্রাফ থেকেই মানুষ তার বিচার-বিবেচনা তৈরি করে, পৃথিবীকে দেখার লেন্স বানায়।
আমি অনেক মেধাবী এবং গুনী মানুষকে চিনি যারা শুধু উটকো সমালোচনার ভয়ে নিজের নিরাপদ বলয়ের বাইরে বের হননা। "কী দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে, ভালোই তো আছি" - এটা হচ্ছে তাদের চিন্তা। এবং তাদেরকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। যোগাযোগ মাধ্যমের উন্নতির সাথে সাথে আমাদের সমালোচনার বারুদও অনেক তাড়াতাড়ি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আপনি হয়তো কোনো গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্যে একটা স্কুল করে দিলেন। দুইটা পত্রিকায় আপনাকে নিয়ে বিশাল প্রশংসাসূচক লেখা ছাপা হতে না হতেই অন্য তিনটা পত্রিকায় আপনার নামে যাবতীয় কুৎসা ছড়ানো হবে। পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, কর্পোরেট শক্তির ইন্ধনে আপনি যে স্কুলের নাম করে তলে তলে বিশাল ষড়যন্ত্র করে বসে আছেন সেটা নিয়ে অনেক কেচ্ছা কাহিনী ছাপানো হবে। অথচ আপনি শুধু ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার একটা ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন, এই যা।
আমি যখন প্রথম বিদেশে পড়তে আসি তখন এখানকার একজন বাংলাদেশী অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন বাংলাদেশে একজন মানুষের ক্ষতি করা অনেক সহজ কিন্তু কারো উপকার করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। তাঁর কথাটি ভালো করে বুঝিনি তখন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কেনো তিনি ওরকম একটি কথা বলেছিলেন। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা চারদিকের নেগেটিভ জিনিসে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে এখন আর মানুষের ভালোত্বে বিশ্বাস করি না সহজে। কেউ যে বিনা কারণে ভালো হতে পারে, স্বার্থহীন হতে পারে এটা বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হয়।
আমি সবসময় যে উপমাটার কথা ভাবি আমাদের বিচার-বিবেচনা নিয়ে সেটা হলোঃ আমরা আমাদের চারপাশকে হয় গাফফার চৌধুরী কিংবা শফিক রেহমানের দৃষ্টিতে দেখি। এই দুইজন মেধাবী মানুষ বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের আইকন সমর্থক। "সূর্য পূর্বদিকে উঠে" এটা নিয়ে রচনা লিখতে দিলে এরা খুব সুন্দর করে প্রমান করতে পারবে সূর্য পূর্বদিকে উঠাটা কিভাবে হাসিনার/খালেদার কৃতিত্ব কিংবা আওয়ামীলীগ/বিএনপির ষড়যন্ত্র। কোনো কিছু সাদাকালো চোখে দেখার ক্ষমতা এরা হারিয়ে ফেলেছেন। স্পেইডকে স্পেইড বলার ক্ষমতা আর এদের নাই। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে আমাদেরও সবসময় একটা পক্ষ নিয়েই পৃথিবীটাকে দেখতে হবে। হয় আওয়ামীলীগ, না হয় বিএনপি, না হয় জামাত, না হয় সমাজতন্ত্র।
আমাদের একদল ডক্টর ইউনুসকে শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি তিনি মানুষের ভালো করতে চান। ভালো করতে পারছেন কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য মহৎ সেটা আমরা বিশ্বাস করি। আবার আরেকদল বিশ্বাস করি তিনি পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, কর্পোরেটবাদী, সামন্ততান্ত্রিক বিশ্ব মোড়লদের প্রতিনিধি। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র্য দূর করার নামে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের কাছে পাচার করা। আমাদের একদল মানুষ জাফর ইকবাল স্যারের নামে পাগল, আবার আরেকদল তাঁকে ইসলাম এর শত্রু, আওয়ামীলীগের দালাল মনে করে। অনেকে প্রথম আলোকে একটা সৎ পত্রিকা মনে করি, অন্তত সৎ থাকার চেষ্টা করে বলে মনে করি। আরেকদল ভাবি প্রথম আলো সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার। একইভাবে বড় বড় বহুজাতিক কম্পানীগুলোকে আমরা মনে করি শয়তানের দোসর, তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের গরীব মানুষদেরকএ শোষণ করে সব টাকা বিদেশে পাচার করা।
আমাদের অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয় আমেরিকা, ভারত এবং অন্যদের চক্রান্তের কথা ভেবে ভেবে। আজকে আমেরিকা যে এতো উন্নত হয়ে উঠেছে এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সব টাকা শোষণ করে হয়েছে। এবং অন্যান্য গরীব দেশেরও। আচ্ছা আমেরিকা না হয় বিশ্ব মোড়ল। সুইজারল্যান্ড এর কথা ধরি। কিংবা ফিনল্যান্ড। অথবা নিউজিল্যান্ড। এরা এতো উন্নত হয়েছে কোন দেশকে শোষণ করে? কখনোতো শুনিনি এই দেশগুলো অন্যে দেশকে মিয়ে মাথা ঘামাতে। কাউকে শোষণ না করে যে শুধুমাত্র একটা চমৎকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস, মানুষের ভালো কামনা করে যে উন্নত হওয়া যায় সেটা তো আমেরিকা আর ইংল্যান্ড কে বাদ দিয়ে বাদবাকী উন্নত দেশগুলোর দিইকে তাকালেই বুঝা যায়। জীবন যে কতো সুন্দর হতে পারে, জীবন-যাপন যে কতো আরামদায়ক হতে পারে আধুনিক সভ্যতার কল্যানে সেটা এসব উন্নত দেশে গেলে বুঝা যায়। আমরা কবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নিয়ে বেহুদা চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশটাকে সেরকম উন্নত করতে পারবো?
আমরা কেনো উন্নত হতে পারছিনা? আমাদের কেনো মনে হয় চারদিকের সবাই খারাপ, সবাই ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী? আমি আমার সাম্প্রতিক একটা লেখায় বলেছিলামঃ
"যেসব মানুষের নিজের উপর শ্রদ্ধা কম তারা বেশি (কু)সংস্কারে ভোগে। অর্থাৎ যেসব মানুষ আসলে নিজের যোগ্যতা নিয়ে খুশি নয়, নিজের উপর নিজের খুব বেশি শ্রদ্ধা নাই, আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে, তারা সাধারণত মানুষকে নিয়ে বেশি নেগেটিভ কথা বলে। অন্যের ভালো কিছু দেখলে তারা সহজে খুশি হতে পারেনা, তাদের প্রথম চিন্তাটি হয় নেগেটিভ। মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতে পারেনা এরা।"
আমরা যদি বিশ্বাস করি ইউনুস খারাপ তাহলে কেনো আমরা নিজেরা একটা নতুন মডেলের প্রতিষ্ঠান গড়ে ভালো কাজটি করে দেখাইনা? প্রথম আলো খারাপ; ঠিক আছে, তাহলে ভালো পত্রিকা কোনটি? একটাও না? আপনি নিজে একটা পত্রিকা বানিয়ে দেখিয়ে দিন ভালো পত্রিকা কেমন হতে পারে। ফোন কম্পানীগুলো খারাপ? দেশের গরীব মানুষের টাকা চুষে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে? চলেন আমরা নতুন একটা ফোন কম্পানী বানাই। কিংবা আমাদের সরকারকে চাপ দেই যাতে এমন আইন তৈরি করে যেটা দিয়ে মানুষের স্বার্থ রক্ষা হবে আরো ভালো করে। হাজার হোক সরকার তো আমাদের, ওরা তো আর বিদেশী শক্তি নয়।
দুঃখজনকভাবে একই কথা খাটে আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রেও। আমরা সবাই (এই লেখকসহ) রাজনীতিবিদদের ঢালাও সমালোচনা করি, কিন্তু আমরা কেউই নিজেরা রাজনীতিতে জড়াতে চাইনা। হাসিনা-খালেদার হাজার দোষত্রুটি সত্ত্বেও ওরাই কিন্তু রাজনীতি নামের কষ্টকর পেশাটি করে যাচ্ছে, এবং আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের জন্যে মোটামুটি সন্তোষজনক একটা জিডিপি বৃদ্ধির হার বজায় রেখেছে গতো দুই দশক ধরে। আমরা আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ বানাতে চাই, কিন্তু রাজনীতিবিদ বানাতে চাইনা। মেধাবী ছেলেমেয়েরা যদি রাজনীতিতে না যায়, তাহলে ছাত্রদল-ছাত্রলীগের ছাত্ররাজনীতিবিদ নামের অর্ধশিক্ষিত ছাত্ররা রাজনীতিতে যেয়ে দেশের ভবিষ্যতের আরো বারোটা বাজাবে। আমি জানি রাজনীতিতে যোগ দেওয়া অনেক কঠিন, বর্তমান রাজনীতিবিদ এবং ছাত্ররাজনীতির গুন্ডারা এটাকে আরো কঠিন করে রেখেছে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্যে। কিন্তু তাই বলে তো বসে থাকলে চলবেনা, একটা না একটা পথ বের করতেই হবে এটাকে সংশোধনের জন্যে। রাজনীতির বাইরে থেকে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যেতে হবে এই ট্রেন্ড পরিবর্তন করার।
যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। পৃথিবীতে "নিখুঁত" বলে কিছু নেই। মানুষও নিখুঁত হতে পারেনা। পরম শদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সাইদ স্যারকে নিয়েও কতো বাজে কথা শুনেছি। এবং এটা হবেই। এর একটা ভালো দিক হচ্ছে সমালোচনা আমাদেরকে, আমাদের কাজকে আরো শুদ্ধ করে। "নিখুঁতত্ত্ব" এর দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায় সমালোচনার মাধ্যমে। যতোদিন মানুষ থাকবে ততোদিন মানুষের ভিন্ন মত থাকবে। ঘটনাক্রমে এটা গণতন্ত্র নামক শাসন ব্যাবস্থার সৌন্দর্য্য! পৃথিবীর সব উন্নত দেশগুলোতে যে কার্যকর একটা গণতন্ত্র আছে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!
যারা সমালোচনার ভয়ে বসে না থেকে নিজের মনের কথা বলে ফেলে, দেশের জন্যে কিছু একটা করার চেষ্টা করে ফেলে, নিজে কিছু একটা হতে চেষ্টা করে তাদের নিয়ে প্রয়াত আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট একটা যুগান্তকারী কথা বলেছিলেনঃ
"It's not the critic who counts, not the man who points out how the strong man stumbled, or when the doer of deeds could have done better. The credit belongs to the man who is actually in the arena; whose face is marred by dust and sweat and blood; who strives valiantly; who errs and comes short again and again; who knows the great enthusiasms, the great devotions and spends himself in a worth cause; who at the best, knows in the end the triumph of high achievement; and who at the worst if he fails, at least fails while daring greatly, so that his place shall never be with those cold and timid souls who know neither victory nor defeat।"
অনুবাদঃ
যারা সমালোচনা করছে তারা গুরুত্মপূর্ণ না। যারা আঙ্গুল উঁচু করে দেখিয়ে দিচ্ছে শক্ত মানুষটি কিভাবে হোঁচট খাচ্ছে তারাও গুরুত্মপূর্ণ না। যারা বাইরে থেকে উপদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছে কিভাবে কাজটা আরো ভালোভাবে করা যেতো ওরাও গুরুত্মপূর্ণ না। সব কৃতিত্ব হচ্ছে তাঁর যিনি আসলে সত্যিকার মাঠে নেমে যুদ্ধ করছেন। যাঁর মুখ এবং দেহ ধূলা, ঘামে, এবং রক্তে রঞ্জিত। যিনি জীবন দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যিনি বারবার ভুল করছেন এবং জয়ের একেবারে শেষ মাথায় এসে পৌঁছাচ্ছেন। যিনি চরম উৎসাহ, আগ্রহ, সাধনা নিয়ে নিজেকে একটা অর্থপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করেছেন। যিনি বিজয়ী হওয়ার কৃতিত্বের কথা জানেন, কিংবা যদি জয়ী হতে নাও পারেন, অন্ততপক্ষে বীরের মতো চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অতএব, তাঁর স্থান কখনোই সেইসব ভীরু এবং দূর্বল মানুষের সাথে হবেনা যারা জয় কিংবা পরাজয় কোনোটার স্বাদ কখনো পায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১১ ভোর ৬:১৪