লিলিথ নামটি শুনে চমকে উঠেছিলাম। তাও আবার প্রথম রমনী হিসাবে !
সবসময় জেনে আসা এডাম ইভ বা আদম হাওয়ায় যখন জ্ঞানভান্ড পূর্ণ, লিলিথ যেন ঝড় উঠালো চেতনায়!
প্রথম নারী লিলিথ! হাওয়া নয়????
হজম করতে সময় লাগল। শুরু হলো অন্তর্জাল সন্ধান। উইকি, মিথ, ধর্মগ্রন্থ সব গোগ্রাসে গিললুম।কত অজানারে!!!
লিলিথ শব্দের প্রচলিত অর্থ রাত্রি।
লিলিথের অস্তিত্ব নিয়ে চালু রয়েছে বহু উপাখ্যান। ইহুদিদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘দ্যা বুক অব জেনেসিস’ এ বলা ছিল- প্রথম মানবী ইভ নয়, । ইভের আগেও আরেকজন নারী ছিলেন আদমের জীবনে। সৃষ্টিকর্তা আদমকে পৃথিবীর যে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন, তাকেও সেই একই মাটি দিয়ে একইসময়ে তৈরি করেছিলেন। হাওয়ার মত আদমের শরীরের কোন অংশ থেকে তাকে তৈরি করা হয়নি। তিনি ছিলেন আদমের প্রথম স্ত্রী’ – লিলিথ। যাকে ‘রহস্যময় এবং বিদ্রোহী বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
ইসলাম ধর্মগ্রন্থ অনুসারে সৃষ্টির আদিতে ছিলেন প্রথম মানব আদম (আঃ) এবং তারপর প্রথম মানবী হাওয়া (আঃ)। হাওয়াকে সৃষ্টিকর্তা তৈরি করেছিলেন আদমের পাঁজরের একটি হাঁড় থেকে। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থও একই কথা বলে। শুধু আদমকে তারা বলেছেন, ‘অ্যাডাম’ এবং হাওয়াকে বলেছেন ‘ইভ’।
ধারাবহিকতা এবং ক্রমানুসারে মৌলিকত্ব এবং রুপান্তরএসব কারণে ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে মিল এবং অমিল দুটোই উপস্থিত। তবে কোরআন শরিফ সবার শেষে নাজিল হওয়ায় এটা হচ্ছে আসমানী ধর্মগ্রন্থের সর্বশেষ রূপ। আদম এবং হাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু ইহুদিরাও দ্বিমত পোষণ করেন না, বরং সেখানে এর সাথে যোগ করা ছিল আরও বেশি কিছু। কিন্তু কোরআনে এই প্রসংগে তেমন কিছু আলোচিত হয়নি।
দি অালফাবেট পুস্তিকাটিতে বেন সিরা অরামিক ও হিব্রু বর্ণমালার ক্রম অনুসারে ২২টি করে প্রবচন উল্লেখ করে প্রতিটির উৎস ব্যাখ্যায় বিভিন্ন পূরাণ ও উপাখ্যান অবতারণার মাধ্যমে সেগুলিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার ঐ পুস্তিকা হতে আমরা আদমের প্রথমা স্ত্রী লিলিথের উপাখ্যান জানতে পারি। এই পুস্তিকাটি সিই ৮ম ও ১০ম শতকের মাঝে লিখিত বলে গ্রন্থ বিশারদগণ অভিমত দিয়েছেন যদিও এর কাহিনী যথেষ্ট পূর্বকার। কিন্তু ঠিক কতটা পূর্বকার তা তারা সুস্পষ্ট করে বলতে পারেননি।
Gershom Scholem.
তবে ব্যাবিলনে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত হিব্রুদের বাণ, অভিশাপ, অশুভ আছর বা কাল যাদু থেকে মুক্তির জন্য ব্যবহৃত জাদুকারী বাটি (Incantation bowl) প্রমান করে যে, লিলিথ বা লিলোথের সঙ্গে পরিচিতি ৬০০ সিইতে ইহুদি সমাজে ছিল। এতে ধারণা করা হয় ৬০০ বিসিইতে হিব্রুগণ তাদের ব্যাবিলনে নির্বাসন কালে বা নির্বাসনের পর লিলিথ উপাখ্যানের অবতারণা করে।
জাদুকারী বাটি, নমুনা-১
Gershom Scholem - এর মতে ৮ম ও ৯ম শতকের মাঝে লিখিত কাব্বালা নামে পরিচিত ইহুদি পূরাণ "জোহার" সংকলক কাব্বালিষ্ট রাব্বি মোজেস ডি লিয়ন (অনেকের মতে জোহার ২য় ও ৩য় শতকের মাঝে রাশবি নামে পরিচিত সিমোন বার ওচায় কর্তৃক লিখিত) এই পুস্তিকাটি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন (See, Major Trends in Jewish Mysticism, p. 174)।
তবে পূর্ব প্রচলিত কাহিনীর সাথে বেন সিরা উপস্থাপিত "লিলিথ" উপাখ্যানের কোন মিল নেই এবং আপাত দৃষ্টিতে এটিকে সে সবের সাথে একসূত্রে গাঁথার কোন প্রচেষ্টাও কখনও করা হয়নি। আর সত্যি বলতে কি, হাওয়া পূর্বাপর কাহিনী কিন্তু বেন সিরার নিকট নতুন কিছু ছিল না, এমনটা অবশ্য জেনেসিস রাব্বাতেও দেখতে পাওয়া যায়। যদিও সেখানে লিলিথের কোন উল্লেখ নেই।
জাদুকারী বাটি, নমুনা-২
বেন সিরার লিলিথ উপাখ্যান বর্ণনা ও বিশ্লেষণের পূর্বে প্রথমেই আমরা জেনে নেই হাওয়া পূর্বাপর এ কাহিনীর ধারণা কোত্থেকে এল বা এর ভিত্তি কি?
বুক অফ জেনেসিসে আমরা দেখতে পাই খোদা হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন আদমের পাঁজড় থেকে “Then the Lord God made a woman from the rib he had taken out of the man, and he brought her to the man.”-Genesis 2:22 (সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ কোরআনও এমনটাই বলে- তিনি আদমকে সৃষ্টি করলেন ও তার থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন-৭:১৮৯)
অথচ ইতিপূর্বকার এক আয়াত “So God created man -----------; male and female He created them.”-Genesis 1:27, ইতিমধ্যেই এ নির্দেশণা দিয়েছে যে একজন নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে। Book of Genesis-এর দু’টি অধ্যায়ের এ দু’টি আয়াতের অসঙ্গতি দূর করতেই মূলত: লিলিথ উপাখ্যান অবতারণার কারণ। পরবর্তীতে আমরা দেখব আলফাবেটে লিলিথের কাহিনী শুরু হয়েছে জেনেসিস, ২:১৮ আয়াত- “it is not good for man to be alone”; বর্ণনার মধ্য দিয়ে।
জাদুকারী বাটি, নমুনা-৩
দি অালফাবেট পুস্তিকাটির শুরুতে বেন সিরার অনন্য সাধারণ জন্মগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। তিনি নবী অরামিয়ার পুত্র বা পৌত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন। একজন পূর্ণ মানুষের মস্তিস্ক তথা মানসিক শক্তি ও প্রজ্ঞা নিয়ে পিতা ছাড়াই তার জন্ম হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে পুস্তকে উল্লেখিত প্রবচনগুলি তিনি তৈরী করেছিলেন যখন তার বয়স মাত্র এক বৎসর এবং তাকে একজন শিক্ষকের নিকট পাঠান হয়েছিল বর্ণমালা শেখার জন্যে। কথিত আছে, ঐ শিক্ষক যখন তাকে বর্ণমালা পাঠ করে শোনাতে যান, তখন বেন সিরা তাকে থামিয়ে দিয়ে ঐ বর্ণ যা তাকে শেখান হবে, তার সাথে সম্পর্কিত একটি প্রবচন শুনিয়ে দেন।
Shimon Bar Yochai.
খুব শীঘ্রই বেন সিরার প্রজ্ঞা ও খ্যাতির যশ: চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। যখন তার খ্যাতি এবং সুনাম পারস্য সম্রাট নেঁবু চাঁদ নেজ্জারের নিকট পৌঁছিল, তখন তিনি তাকে রাজদরবারে তলব করলেন।
বেন সিরা রাজদরবারে উপস্থিত হলে সম্রাট তাকে অনেকগুলো অগ্নিপরীক্ষায় ফেলেন। তখন তিনি ২২টি গল্পের মাধ্যমে সেসব পরীক্ষায় একে একে উত্তীর্ণ হন যা হিব্রু বর্ণমালার ক্রম অনুসারে দি অালফাবেটে তিনি উপস্থাপন করেছেন এবং তা তথাকথিত ২য় অালফাবেট হিসেবে পরিচিত।
অবশ্য এসকল গল্প-উপকথার প্রায় অর্ধেকটা নেয়া হয়েছে তালমুদ থেকে, বাকীগুলোর কিছু ক্রিশ্চিয়ান পূরাণ এবং ভারতীয় পঞ্চতন্ত্র থেকে গৃহীত বলে অনুমিত হয়, যদিও সেগুলোর সাথে বেন সিরার উপস্থাপনার মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক রয়েছে। যা হোক, লিলিথ উপাখ্যানটি ছিল সম্রাটের অগ্নিপরীক্ষায় পড়া বেন সিরার পঞ্চম প্রতিউত্তর। উপাখ্যানটি এই-
"সম্রাট নেঁবু চাঁদ নেজ্জারের কনিষ্ঠ পুত্র পীড়িত হয়ে পড়লে তিনি বেন সিরাকে ডেকে নিয়ে বললেন, "আমার পুত্রকে যথাশীঘ্র আরোগ্য করে তোল, বিফলে তোমার গর্দান যাবে।"
Moses de Leon.
বেন সিরা তৎক্ষণাৎ রোগীর শিয়রে বসে এক টুকরো পার্চমেন্টের উপর ডানা, হাত ও পা মিলিয়ে অদ্ভূত আকারের কয়েকটি চিত্র একে সেখানে কিছু লিখলেন। নেঁবু চাঁদ নেজ্জার সেগুলো এক নজর দেখে নিয়ে বললেন, "এরা কারা?"
বেন সিরা বললেন, "এই রক্ষাকবচ এর উপর এই ছবিগুলো হচ্ছে ঔষধ পথ্যাদির দায়িত্ব প্রাপ্ত ফেরেস্তা সেনয়, সানসেনয় ও সেমানজিলফ (Snvi, Snsvi, and Smnglof) এর। যখন আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছিল তখন সে ছিল একা। খোদা বললেন, "পুরুষ মানুষের একা থাকা ঠিক না।" -জেনেসিস ২:১৮। অত:পর তিনি আদমকে যেভাবে সৃষ্টি করেছিলেন তেমনিভাবে একজন নারীকে সৃষ্টি করলেন এবং তার নাম দিলেন লিলিথ (Lilith)।"
"আদম ও লিলিথের মধ্যে কোন বনিবনা ছিল না। সামান্য কারণে তাদের মধ্যে বিবাদ লেগেই থাকত। একদিন শোয়া নিয়ে তাদের মধ্যে তুমুল হট্টগোল হল। লিলিথ বলল, "আমি তোমার নীচে শোব না।"
আদম বলল, "You are fit only to be in the bottom position. তাছাড়া আমি তোমার থেকে শ্রেয়, সুতরাং আমি তোমার উপরেই থাকব।"
লিলিথ তার কথা মেনে নিল না। সে বলল, "আমরা কেউ কারো থেকে শ্রেয় নই বরং আমরা উভয়ে সমান।"
যখন লিলিথ দেখল আদমকে সে যুক্তি দিয়ে পরাভূত করতে পারছে না, তখন সে খোদার যাদুকরী নাম (Ineffable Name) পাঠ করে উড়ে বাতাসের মধ্যে মিলিয়ে গেল। আদম তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তার নিকট তার প্রার্থনা নিবেদন করল, "হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে সঙ্গী করে যে নারী দিয়েছিলে, সে তো পালিয়ে গেল।"
Title page of The Zohar.
তখন মহান প্রভু তিন ফেরেস্তা- সেনয়, সানসেনয় ও সেমানজিলফকে পাঠালেন লিলিথকে ফিরিয়ে আনতে। আর তিনি আদমকে বললেন, "যদি সে ফিরে আসে তো ভাল, অন্যথায় দিনে তার এক’শ সন্তানের ধ্বংস অনিবার্য।” জানিয়ে দিয়েছি"
এদিকে ঐ তিন ফেরেস্তা লিলিথের পশ্চাৎধাবন করে তাকে পাকড়াও করল লোহিত সাগরের সেইস্থানে যেখানে মিশরীয়দের ডুবে মরার জন্যে পূর্বনির্ধারিত ছিল। যা হোক, তারা লিলিথকে খোদার আদেশ শুনিয়ে তাকে ফিরে যেতে অনুরোধ করল, কিন্তু লিলিথ রাজী হল না। তখন তারা তাকে সমুদ্রের অতলে ডুবিয়ে দেবার ভীতি প্রদর্শণ করল।
"আমাকে নিস্তার দাও" -লিলিথ ক্ষিপ্ত হয়ে বলল। অন্য কাহিনী মতে লিলিথ এসময় ফেরেস্তাগণকে জানিয়েছিল সে ইতিমধ্যে আযাযিলের সাথে সহবাস করে ফেলেছে তাই সে আর এখন আদমের কাছে ফিরে যেতে পারে না। তখন ফেরেস্তাগণ তাকে জানাল যে, সে না ফিরলে প্রতিদিন তার এক’শ সন্তানের মৃত্যু অনিবার্য। এতে লিলিথও আদম সন্তানের অনিষ্ট করার হুমকি দিল, বলল, ”আমি দুগ্ধপোষ্য শিশুদের ব্যাধি সৃষ্টির নিমিত্ত হব। নিশ্চয়ই কোন শিশু পুত্রসন্তান হলে তার উপর আমার ক্ষমতা থাকবে জন্মের আট দিন পর্যন্ত, আর কন্যা হলে বিশ দিন।”
ফেরেস্তাগণ ঐসময় লিলিথকে একটি মাত্র শর্ত দিয়েছিল যে, তারা তাকে না নিয়েই ফিরে যাবে যদি কি-না সে আদম সন্তানের কোন অনিষ্ট না করার প্রতিজ্ঞা করে। লিলিথ দিনে তার এক'শ সন্তানের মৃত্যুকে মেনে নিয়ে তার প্রতিজ্ঞা থেকে ফিরে আসেনি বটে, তবে ফেরেস্তাদেরকে একেবারে নিরাশও করেনি। কেননা সে তাদের নিকট জীবন্ত ও চিরন্তন খোদার নামে প্রতিজ্ঞা করে বলেছিল, "যখনই কোন শিশুর রক্ষাকবচে আমি তোমাদেরকে বা তোমাদের নাম অথবা তোমাদের আকার দেখতে পাব, নিশ্চয়ই ঐ শিশুর উপর আমার কোন ক্ষমতা থাকবে না।"
প্রতিদিন লিলিথের এক'শ সন্তানের মৃত্যুর আদেশ ছিল। তদানুসারে দিনে তার এক'শ সন্তান মারা যায়। “আর ঠিক একই কারণে,” বেন সিরা বললেন, "আমরা শিশুদের রক্ষাকবচে ঐ ফেরেস্তাগণের নাম লিখি। যখন লিলিথ তাদের নামগুলো দেখে, সে স্মরণ করে তার প্রতিজ্ঞার কথা এবং ঐ শিশু আরোগ্য লাভ করে।"
এদিকে লিলিথ ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানানোর পর খোদা পরবর্তীতে আদমের বাম পাঁজড়ের হাঁড় থেকে হাওয়াকে (আদমের অধীনতার প্রতীক স্বরূপ) সৃষ্টি করেন যাতে সে সমতা দাবী করতে না পারে এবং যেন সে তার থেকে কখনও বিযুক্ত না হয়।
মা ও শিশুকে সুরক্ষায় ব্যবহৃত রক্ষাকবচ।
এ উপাখ্যান যতই রূপকথার মত শুনতে হোক না কেন, এটি কিন্তু বাইবেলের দু'টি আয়াতের ফাঁক পূর্ণ করা ছাড়াও হাওয়াকে আদমের মত্ একই ভাবে সৃষ্টি না করে কেন আদমের পাঁজড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল তা কিন্তু ব্যাখ্যা করে। উপরন্তু, লিলিথ নামটি একেবারে নতুন নয়, বাইবেলে একবার হলেও এ নামটি উল্লেখিত হয়েছে। অবশ্য সেখানে তাকে হায়েনা ও শৃগালের পর্যায়ভূক্ত করে খোদার গজবে নিপতিত ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীতে তার বসবাসের কথা বলা হয়েছে -
When the Holy One, blessed be He, will bring about the destruction of the wicked Rome, and turn it into a ruin for all eternity, He will send Lilith there, and let her dwell in that ruin, for she is the ruination of the world. And to this refers the verse, And there shall repose Lilith and find her a place of rest. -Isaiah 34:14.
সুমেরিয়ান (Sumerian) ভাষায় লিল (Lil) অর্থ হাওয়া (Air), শ্বাস (Breath) উভয়ই। অন্যদিকে ভাবার্থে হাওয়া বা বায়ূর উপাদান এবং আত্মার উপাদান সমার্থক হওয়ায় হিব্রুতে Lilith [Lamed (L), Yod (I), Lamed (L), Vav (O), Tau (Th)] উচ্চারণ লিলোথ (Liloth), যার অর্থ আত্মা (Spirit) সম্বলিত প্রানী।
সুমেরিয়ান লিলিথ।
প্রায় দেড়’শ বৎসর আগে বাগদাদের কাছে চার হাজার বছরের পুরোনো একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ভিতর লিলিথের দূর্লভ একটি মূর্তি খুঁজে পায় এক ইরাকি।
মন্দিরের ভূ-গর্ভস্থ কোন একটা চেম্বারের দেয়ালে আটকানো একটি ফলকে খোঁদিত ছিল লিলিথের মূর্ত্তি। আর ঐ মূর্তির পায়ের কাছে প্রাচীন কিউনিফর্ম লিপিতে লেখা ছিল- “রাতের রানী লিলিথ তার বড় বোন ইরেশকিগালকে (Ereshkigal- "Queen of the Great Earth") নিয়ে ব্যাবিলনের সব বেশ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে।” আর একথা সত্য যে, হাজার হাজার বৎসর পূর্বে প্রাচীন ব্যাবিলনে বড় বড় সব বেশ্যালয় গড়ে উঠেছিল। ইতিহাসের প্রথম এবং সব থেকে বড় ‘Sincity’ কিন্তু ওটাই।
যা হোক, প্রাপ্ত ফলকটি অত:পর স্থানীয় এক এন্টিক ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে তা চলে আসে লন্ডনের এক এন্টিক ব্যবসায়ী সিডনী বার্নির হাতে। বার্নির রিলিফে দেখা যায়, ভরা যৌবণা লিলিথ একটা সাপকে জড়িয়ে ধরে আছে, যার মাথাটা ঝুলে আছে তার কাঁধের ওপর। আর তার দু’দিকে দাঁড়িয়ে আছে তরুণীর পায়ের মত পা বিশিষ্ট দু’টো পেঁচা।
ভর সন্ধ্যায় লিলিথের মূর্তির দু’দিকে দু’টো মোমবাতি জ্বালালেই তাকে পূঁজারী হিসেবে গ্রহণ করে সে। চরম অশুভ বলে যুগের পর যুগ ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মগুরুরা তার সকল মূর্তি ধ্বংসের অধীন করে। ১৮২৭ সনে বার্নির হাতে লিলিথের মূর্তিটা না আসা পর্যন্ত এ যুগের মানুষ জানতই না তার স্বরূপ কেমন। যতদূর জানা যায়, লিলিথ তার কোনো পূঁজারীকেই সে বেশীদিন বাঁচতে দেয় না, যদি না অন্য কেউ ওই সময়ের মধ্যে স্বেচ্ছায় তাকে পুঁজা না করে বা ইতিপূর্বকার পূঁজারী চিরতরে তাকে ত্যাগ করে সৎ জীবন-যাপনের পথ বেঁছে না নেয়।
ইহুদিগণ বিশ্বাস করে লিলিথ রাতের প্রেত, গর্ভধারিণী ও নবজাতকের শত্রু। এ কারণে তারা প্রসূতি কক্ষের চারিকোণে সূত্র লেখে তাকে বিতাড়নের উদ্দেশ্যে। আর এসব সূত্র যা জাদুকারী বাটিতে লেখা হত, তাতে লিলিথকে এমনিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে-“(Lilith) who appear to human beings, to men in the likeness of women and to women in the likeness of men, and they lie with all human beings at night and during the day”-(Montgomery 117). “Hablas the lilith, grand daughter of Zarni the lilith” of “striking boys and girls”-(ibid, 168). বা “(Lilith) destroys and kills and tears and strangles and eats boys and girls” -(ibid, 193).
আর রাব্বানিক সাহিত্য লিলিথের স্বল্প যে পরিচয় দিয়েছে তা জাদুকারী বাটির লিলিথের চরিত্রের সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কয়েকটি সূত্র তার শারিরিক এমনই অবয়বের নির্দেশনা দেয়: “She has wings and long hair. Drawings of the liliths or demons on the incantation bowls bear out these details of physical appearance. “Rav Judah said in the name of Samuel: An abortion with the likeness of a lilith, its mother is impure because of the birth, for it is a child, but it has wings” (BT Niddah 24b).
অন্যদিকে, কাব্বালার মূল Zohar মূলত: লিলিথের দুষ্ট যৌণতাকে প্রাধান্য দিয়েছে। জোহারে বলা হয়েছে- “সে পুরুষকে প্ররোচিত করে স্বপ্নের মধ্যে এবং তাদের শুক্রাণু থেকে উৎপন্ন করে তার অশরীরিক প্রেত সন্তান। অমাবশ্যায় তার কামনা বাসনা চরমে পৌঁছে অর্থাৎ সে পূর্ণ ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়।”
স্বপ্নের মধ্যে লিলিথের পুরুষকে কামনায় উত্তেজিত করার নীতিকে রাব্বি অনিনা (b. Shab. 151b) যৌণ বিপদ উল্লেখ করে শূণ্য বাড়ীতে একাকী রাত্রিযাপনে এমনই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন, “It is forbidden to sleep in a house alone, and whoever sleeps in a house alone, a lilith seizes him.” অন্যদিকে জোহার স্বামী-স্ত্রীর সহবাসের পূর্বে এক বিশেষ রীতি পালনের পরামর্শ দিয়েছে। ঐ রীতি অনুসারে স্বামীকে খোদার প্রতি মনোনিবেশ করে নীচের আয়াতটি পাঠ করতে বলা হয়েছে:
“Veiled in velvet, are you here?
Loosened, loosened (be your spell)!
Go not in and go not out!
Let there be none of you and
nothing of your part!” -(Scholem 1965:157).
এতক্ষণ যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে পরিস্কার যে, লিলিথ আদমের মত মাটি থেকে সৃষ্ট ছিলনা। কেননা তার বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। সে ডানা বিশিষ্ট ও দ্রুত গতিশীল। উপরন্তু হিব্রুতে লিলিথ অর্থ হাওয়া বা আত্মা অর্থাৎ জ্বিণ। ফলে উপস্থাপিত বক্তব্যের সারসংক্ষেপ দাঁড়ায় এমন-
আদমকে সৃষ্টির পর তার একাকীত্ব দূর করতে ধ্বংস প্রাপ্ত জ্বিণ জাতির এক নারীকে দুনিয়া থেকে এনে আদমের সঙ্গী করে দেয়া হয় এবং তারা ইডেন উদ্যানে বসবাস করতে থাকে। ইবলিস হয়ত: তার জাতির কারো মাটির তৈরী মানবের সঙ্গী হওয়াকে মানতে পারেনি। ফলে তার প্ররোচনায় লিলিথ আদমের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং বিরোধের এক পর্য়ায়ে সে তার নিজস্ব বৈশিষ্টের গুণে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে দুনিয়াতে নিজ বাসস্থানে ফিরে আসে। তখন আদমের অনুরোধে খোদা ফেরেস্তা পাঠিয়ে তাকে পাকড়াও করেন। কিন্তু লিলিথ ভয়-ভীতিতেও ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায় খোদা এক পরিকল্পণা করেন। তিনি আদমের শরীরের একাংশ দিয়েই হাওয়াকে সৃষ্টি করেন (যাতে সে কখনও তার থেকে বিযুক্ত হবার বাসনা না করে।)। আর গন্ধম ফলের চরম নাটকীয়তা শেষে তাদের দু’জনকে দখল দারিত্বের একচ্ছত্র অধিকার দিয়ে জ্বিণ জাতির আবাসস্থলে (দুনিয়া তথা দৃশ্যলোক) পাঠিয়ে দেন। অবশ্যই একজাতিকে অন্য জাতির শত্রু করে এবং কর্মফলের পরিণামের ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে। যেমন-
আদমকে-‘তোমরা একে অন্যের শত্রু হিসেবে কিছুকালের জন্যে পৃথিবীতে নেমে যাও। আর (সেখানে) তোমাদের জন্যে আবাস ও জীবিকা রইল। সেখানেই তোমরা জীবন-যাপন করবে, সেখানেই তোমাদের মৃত্যু হবে আর সেখান থেকেই তোমাদেরকে বের করে আনা হবে।’-(৭:২৪-২৫).‘পরে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সৎপথের নির্দেশ এলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে সে বিপথগামী হবে না, And whoever turns away from My remembrance - indeed, he will have a depressed life, and We will gather him on the Day of Resurrection blind. -(২০:১২৩)
ইবলিসকে- ‘আর আমি সত্যিই বলছি যে, তোমাকে দিয়ে ও ওদের মধ্যে যারা তোমার অনুসারী হবে তাদেরকে দিয়ে আমি জাহান্নাম ভরিয়ে তুলব। -(৩৮:৮৪-৮৫)
এ বিষয়ে মজার একটা প্রশ্নোত্তর ছিল । পাঠকের জণ্য তা হুবহু তুলে দিলাম।
# একজন প্রশ্ন করল, “আরে ভাই আদমকে সৃষ্টি করারইবা দরকার কি ছিল! আর সৃষ্টি যখন করাই হল, তখন যুগলভাবে না করে একক আদমকেই বা সৃষ্টি করা হল কেন?”<
আমি বললাম, “ভাইরে আপনে “আদমের মত একই ভাবে মাটি থেকে লিলিথকে সৃষ্টি করলে তার ডানা এল কোত্থেকে, যখন আদমের কোন ডানা নেই? বা, আদম যেখানে জানে না সেখানে লিলিথ খোদার জাদুকরী নাম জানল ক্যামনে?” এমনি ধারার প্রশ্ন না করে, এ কেমন প্রশ্ন করলেন? আমারে বিপদে ফেলতে চান নাকি? যা হোক, করেই যখন ফালাইছেন কি আর করা, উত্তর তো একখান দেওন-ই লাগে, কি কন?”
“আপনে তো ম্যাকানিকেল ইঞ্জিনিয়ার, তো বলেন দেখি, আপনে যে উদ্দেশ্যে একটা মেশিন (জ্বিণ জাতি) তৈরী করলেন, তা আপনার ঐ উদ্দেশ্য পূরণ করল না, তখন আপনে কি করবেন?”
“বিয়োজন (খারাপ অংশগুলো তথা বাই প্রোডাক্ট ধ্বংস করা), সংযোজন (আগুনে তৈরী জ্বিণ লিলিথের সাথে মাটির আদম), অথবা প্রতিস্থাপন (জ্বিণ জাতির স্থলে মানব জাতি) নয় কি?
খোদা হয়ত: তাই করেছেন। এখন আপনে কি বলেন?”
Source:
• Qur'an;
• Bible (Old Testament);
• The Zohar-Shimon Bar Yochai ("Rashbi");
• The Alphabet- Ben Sira;
• Babylonian Talmud, Niddah 24b;
• Babylonian Talmud, Shabbat 151b;
• On the kabbalah and its Symbolism- Gershom Scholem, 1965: 157;
• Aramic Incantation Text from Nippur-James Montgomery, 1913.
• "Lilith" In Kabbalah- Gershom Scholem, 1974;
• Major Trends in Jewish Mysticism-Gershom Scholem.
>>>>>
মানুষ যেন লিলিথের গল্প বলে শেষ করতে পারছেন না। সেই প্রাচীন কাল থেকে ঘুরে ফিরে লিলিথের যতগুলো রূপ চালু রয়েছে সেখানে লিলিথ সবসময়ই রহস্যময় একজন নারী। কখনো পিশাচী, কখনো বিদ্রোহী স্ত্রী, ছলনাময়ী এবং আরো কত কি। লিলিথের যতগুলো রূপ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী রূপ হচ্ছে, মাথা অবনত না করার রূপ। লিলিথ আদমের অধীনতাকে অস্বীকার করেছিলেন কারণ যুক্তিতে তিনি আদমের সমান সমান। আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে লিলিথ যেন চিরকালের জন্য সেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন।
আধুনিক সময়ে লিলিথ উপাখ্যানকে মানুষ ব্যাখ্যা এবং ব্যবহার করেছে নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। অনেক নামকরা কবি সাহিত্যিকেরা লিলিথকে ব্যাখ্যা করেছেন নতুন রূপে। এদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি জনপ্রিয় আধুনিক লিলিথ গল্প বোধ হয় জুডিথ প্লাস্কোর লেখা ‘দ্যা কামিং অব লিলিথ’।
এখানে লিলিথের নারীচেতনাকে তুলে ধরা হয়েছে। লিলিথ যে আদমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে স্বাধীনতা চায় সেটাও মুখ্য হয়েছে এই গল্পে। তবে এই গল্পে একটা নতুনত্ব যোগ হয়েছে। এখানে লিলিথ নারী সঙ্গ পছন্দ করে এবং সে গোপনে আদমের স্ত্রী ইভের সাথে বন্ধুত্ব করে এবং একত্রে জ্ঞান অনুসন্ধান করে। স্বর্গে যে সাপ ইভকে প্ররোচিত করেছিল সে হচ্ছে এই ছদ্মবেশী লিলিথ।
এই রহস্যময় নারী যেন মানব সভ্যতার সাথে সাথে হেঁটে চলেছেন অনন্তকাল ধরে, আর আহত হয়ে দেখছেন পৃথিবীর মানুষ কে কি বলছে তার সম্বন্ধে? আধুনিক সময়ে এসে অনেকে লিলিথকে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে। অর্থাৎ লিলিথ সাম্যতায় বিশ্বাস করতেন। বৈষম্যের প্রতিবাদ করতে গিয়েই তিনি হলেন বিদ্রোহী। অন্ধকারে নির্বাসিত জীবন যাপনের কারণেই তিনি হলেন রহস্যময়ী।
@ লেখাটি - সংগৃহিত, সংকলিত, সংযোজিত, নব বিন্যস্ত।
কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল, উইিক, সহ সকল লেখকের নাম পাইনি,
কিন্তু তথ্য কয়েক স্থান থেকে সংগৃহিত। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৮:৫৯