বই পড়ার গুরুত্বঃ
সৈয়দ মুজতবার আলীর বই প্রীতির কথা আমরা সবাই জানি। তাইতো সহজেই তিনি বলতে পেড়েছেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।‘ বই পড়ার গূঢ়ার্থ অনুধাবন করার নিমিত্তে তিনি তাঁর ‘বইকেনা’ গল্পে একজন রাজা ও হেকিমের গল্প বলেছিলেন।
“এক রাজা তাঁর হেকিমের একখানা বই কিছুতেই বাগাতে না পেরে তাঁকে খুন করেন। বই হস্তগত হল। রাজা বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে বইখানা পড়ছেন। কিন্তু পাতায় পাতায় এমনি জুড়ে গিয়েছে যে, রাজা বার বার আঙুল দিয়ে মুখ থেকে থুথু নিয়ে জোড়া ছাড়িয়ে পাতা উল্টোচ্ছেন। এদিকে হেকিম আপন মৃত্যুর জন্য তৈরি ছিলেন বলে প্রতিশোধের ব্যবস্থাও করে গিয়েছিলেন। তিনি পাতায় পাতায় কোণের দিকে মাখিয়ে রেখেছিলেন মারাত্মক বিষ। রাজার আঙুল সেই বিষ মেখে নিয়ে যাচ্ছে মুখে।
রাজাকে এই প্রতিহিংসার খবরটিও হেকিম রেখে গিয়েছিলেন কেতাবের শেষ পাতায়। সেইটে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজা বিষবাণের ঘায়ে ঢলে পড়লেন।“
পৃথিবীর অন্যতম বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটি ঘটনা পড়লেই বুঝা যাবে বই পড়া আমাদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রতিদিন কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। কারণ তিনি জানতেন বই পড়া ছাড়া কোনভাবেই জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। বই ছিল তার একমাত্র বন্ধু। বই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। শহীদুল্লাহ একদিন পাঠাগারের এক কোনায় বসে বই পড়ছেন পড়ছেন তো পড়ছেনই, বইয়ের মাঝে ডুবে একাকার হয়ে আছেন। তিনি পাঠাগারের এক কোনায় বসে পড়তে থাকায় পাঠাগার কর্তৃপক্ষ পাঠাগার বন্ধ করার সময় হলে তাকে লক্ষ্য না করে পাঠাগার বন্ধ করে চলে গেলেন। কিন্তু শহীদুল্লাহ বিরামহীনভাবে পড়ছেন, কোন সময় পাঠাগার বন্ধ করা হলো তা তিনি টেরই পেলেন না।
যত বড়ই বই হোক না কেন, শহীদুল্লাহ একবারে শেষ না করে কোনোভাবেই উঠতেন না। যা হোক পরদিন রীতিমত পাঠাগার খোলা হলো। খোলামাত্র পাঠাগার কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে তিনি পড়লেন। কর্তৃপক্ষ তাকে দেখে তো হতবাক। শহীদুল্লাহকে তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনি পুরো রাতদিন পাঠাগারে বন্দি ছিলেন? তখন শহীদুল্লাহর বই পড়ার ধ্যান ভেঙে গেল এবং মুখ খুলে বললেন—অবচেতন মনে—‘না তো, আমি বই পড়ছিলাম।‘
পল্লী কবি জসীমউদ্দিন বলেছেন, ‘বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক।‘ জ্ঞান আর আনন্দ ছাড়া মানব জীবন নিশ্চল হয়ে পড়ে। জীবনকে সুন্দর ভাবে বিকশিত করতে হলে, সুবাসিত করতে হলে জ্ঞানার্জন করতে হবে। আর জ্ঞানার্জন করতে হলে বই পড়ার কোন বিকল্প নাই। পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞানের কথা যেন বইয়ের মাঝে লুকিয়ে আছে। তাই জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে হলে বই পড়তেই হবে। নিজেকে জানতে হলে, পৃথিবীকে জানতে হলে বই পড়তে হবে। তাই হয়তো অ্যামেরিকান বিখ্যাত অভিনেতা Will Rogers বলেছেন, ‘A man only learns in two ways, one by reading and the other by association with smarter people.’
একটা সভ্যতাকে, একটা শতাব্দীকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য মহা কোন পরিকল্পনা করার দরকার নেই। ঐ সভ্যতার সবগুলো বইও পুড়ে গেলার কোন প্রয়োজন নাই। শুধু মানুষকে বই পড়া থেকে বিরত রাখতে পারলেই তা হয়ে যাবে। তাইতো অ্যামেরিকান লেখক Ray Bradbury বলেছেন, ‘You don’t have to burn books to destroy a culture. Just get people to stop reading them.’ এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বই পড়া কত গুরুত্বপূর্ণ। তাই চলুন সবাই আমরা বই কিনি, বই পড়ি আর প্রিয়জনকে বই উপহার দেই।
বই পড়া যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা নিচে তুলে ধরা বিভিন্ন মনীষীদের উক্তিগুলো পড়লে আরও বেশী অনুধাবন করা যায়।
১. ভালো খাদ্য বস্তু পেট ভরে কিন্ত ভাল বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। - স্পিনোজা
২. ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সাথে কথা বলা। - দেকার্তে
৩. অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল। - নেপোলিয়ান
৪. প্রচুর বই নিয়ে গরীব হয়ে চিলোকোঠায় বসবাস করব তবু এমন রাজা হতে চাই না যে বই পড়তে ভালবাসে না. - জন মেকলে
৫. আমি চাই যে বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়। - নর্মান মেলর
৬. একটি ভালো বইয়ের কখনোই শেষ বলতে কিছু থাকে না। - আর ডি কামিং
৭. একটি বই পড়া মানে হলো একটি সবুজ বাগানকে পকেটে নিয়ে ঘোরা। - চীনা প্রবাদ
৮. একজন মানুষ ভবিষ্যতে কী হবেন সেটি অন্য কিছু দিয়ে বোঝা না গেলেও তার পড়া বইয়ের ধরন দেখে তা অনেকাংশেই বোঝা যায়। - অস্কার ওয়াইল্ড
৯. বই হলো এমন এক মৌমাছি যা অন্যদের সুন্দর মন থেকে মধু সংগ্রহ করে পাঠকের জন্য নিয়ে আসে। - জেমস রাসেল
১০. আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাট বাধা সমুদ্র সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হলো বই। - ফ্রাঞ্জ কাফকা
১১. পড়, পড় এবং পড়। - মাও সেতুং
১২. জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন- বই, বই এবং বই। - ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
১৩. বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো। - রবীন্দ্রনাথ
নবীন ও ভার্চুয়াল লেখকদের মূল্যায়নঃ
একুশকে ঘিরে বইমেলা। তাই একুশ পার হয়ে যাওয়ার পরই বইমেলায় এক ধরণের ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠে, যা অনুরণিত হতে থাকে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত। এই অনুরণন মূলধারার লেখকদের মনে যতটা না আঘাত হানে, তার চেয়ে বেশী আঘাত হানে বিভিন্ন ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের বা নবীন লেখকদের মনে। এর বহুবিদ কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হল ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের কিংবা নবীন লেখকদের বই মূলত বিক্রি হয় বইমেলায়। বছরের বাকী সময়টায় টুকটাক বিক্রি হলেও সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। কিন্তু যারা ইতিমধ্যেই বিখ্যাত বা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তাদের লেখা হয়তো বছর জুড়েই কিছু না কিছু বিক্রি হয়। তাই তারা ভাঙনের সুরটা ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের মতো অতো প্রকট অনুভব করেন না। তাছাড়া সাধারণত মূল ধারার লেখকদের কিংবা জনপ্রিয় লেখকদের বই ছাপাতে কোন পয়সা খরচ করতে হয় না। প্রকাশকরা নিজেদের পয়সায়ই সব করে দেন। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের বা নবীন লেখকদের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। তারপরও ভার্চুয়াল জগতের লেখকরা বা নবীন লেখকরা অবহেলিত থেকে যান। তাদের বইগুলো অনেক পাঠকের বুক শেলফেই শোভা পায়। বালিশের ওপর, বিছানার ওপর, চেয়ারের ওপর কিংবা ডাইনিং টেবিল অথবা টি-টেবিলের ওপর বিখ্যাত বা জনপ্রিয় লেখকদের বই-ই পড়ে থাকতে দেখা যায়, যা হয়তো কিছু অংশ পড়া শেষে বাকী অংশ পড়ার অপেক্ষায় পড়ে আছে।
মূলধারার লেখকদের একটা সাধারণ প্রবণতা, তারা মনে করেন ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের বইয়ের মান তেমন ভালো না। কিন্তু বাস্তবতা হল, না পড়েই তাদের মধ্যে অনেকের এই ধারণা হয়েছে। অনেক জনপ্রিয় প্রকাশকও এমনটি মনে করেন। এটা আসলে অন্যায়। এভাবে ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের কিংবা নবীন লেখকদের অবমূল্যায়ন করা ঠিক না। জনপ্রিয় লেখকদের, মূলধারার লেখকদের এবং বিভিন্ন প্রকাশনার উচিৎ ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের কিংবা নবীন লেখকদের বই বেশী বেশী পড়া। পড়া শেষে পারলে তাদের বই নিয়ে মূল্যায়ন করা, যদি সেগুলোতে কোন ভুলত্রুটি থাকে, তা গঠনমূলক সমালচনার মাধ্যমে প্রকাশ করা। তাতে ভার্চুয়াল জগতের লেখকরা কিংবা নবীন লেখকরা নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নেয়ার অবকাশ পাবে, তারা উৎসাহ পেয়ে নতুন নতুন লেখায় নিজেদের মনোনিবেশ করবে। অনেক পাঠক এতে করে উৎসাহিত হবে ঐ সব লেখকদের বই কিনে নিয়ে পড়ার জন্য। তাতে বরং আমাদের বাংলা সাহিত্য আরও বেশী সমৃদ্ধ হবে।
সাধারণ পাঠক যারা ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের কিংবা নবীন লেখকদের বই কিনেন, তাদেরও একটা দায়িত্ব বোধ থাকা উচিৎ। তাদের উচিৎ বইগুলোকে শেলফে সাজিয়ে না রেখে সময় করে পড়ে নেয়া। সময় সুযোগ হলে এই সব বই থেকে পড়ে যেগুলো ভালো লেগেছে সেগুলো সম্বন্ধে ভার্চুয়াল জগতেই অল্প বিস্তর যে যেমন পারে আলোচনা বা সমালোচনা করা। এটাও ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের কিংবা নবীন লেখকদের জন্য বিরাট অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করবে। আর আমরা যদি এভাবে এগিয়ে যেতে থাকি, তখন অনেক প্রকাশকই ভার্চুয়াল জগতের লেখকদের বা নবীন লেখকদের লেখা ছাপানোর জন্য এগিয়ে আসবে। তখন আমরা অনেক ভালো ভালো লেখক পেতে শুরু করবো।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ৯:২৯