প্রথম পর্ব Click This Link দ্বিতীয় পর্ব Click This Link
নয়
রাত অনেক হলো।
অভিজাত পাড়া গুলশান ঘুমিয়ে। তবে ঢাকাতো চব্বিশ ঘন্টার শহর। এখানে চব্বিশ ঘন্টা সব কিছু পাওয়া যায়। ঢাকার মেট্রোপলিটন পরিচয় রক্ষার জন্যই হয়তো রাতের নিস্তব্ধতা চীরে রাস্তা দিয়ে হুস-হাস শব্দে দ্রুত গতির গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। শব্দনিরোধক কামড়ায় বসেও দ্রুত গতির যানের শব্দ পাচ্ছেন ডিআইজি মাসুদ ইব্রাহিম। চিন্তাকিষ্ট মুখে একটু পর পর হুইস্কির গাসে চুমুক দিচ্ছেন। সাধারণত তিন পেগেই নেশা হয় মাসুদের।
কিন্তু আজ যে কী হলো!
এটা চতুর্থ পেগ চলছে।
হুইস্কির কোনো আসর টের পাচ্ছেন না। মুখোমুখি বসা মন্ত্রীর হাতের জ্বলন্ত সিগারটিতে দু-একটা টান পড়েছে পড়েনি। এর পর বোধ হয় আঙ্গুলের ফাকে ধরা বস্তুটির কথা ভুলেই গেছেন তিনি। পুড়ে পুড়ে লম্বা ছাই জমেছে সিগারের মাথায়। কিছুটা বেঁকে গেছে। এই বুঝি কার্পেটে ছাই পড়লো! একটু টেনশন নিয়ে মন্ত্রীর হাতের দিকে তাকিয়ে থাকেন ডিআইজি।
পদমর্যাদার বিচারে গভীর রাতে মন্ত্রীর সঙ্গে বসে সুরা পান করার কথা নয় পুলিশের একজন ডিআইজির। মাসুদ মন্ত্রীর সঙ্গে বসে আছেন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু হিসেবে। এর বাইরেও মন্ত্রীর সঙ্গে আরেকটি বিষয়ে সম্পর্ক আছে ডিআইজির। সেটি অবশ্য বৈষয়িক সম্পর্ক। এরা দুজনই অলিখিতভাবে একটি গোপন ব্যবসার অংশীদার। অন্য সব সম্পর্ক ছাপিয়ে এই সম্পর্কটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
একটা ছোট্ট ঝামেলা নিয়ে চিন্তিত দুজন। না, একটু ভুল হলো বোধ হয়। প্রথমে ঝামেলাটি ছোট্ট ছিল। সমাধানও ছিলো হাতের নাগালে। কিন্তু আস্তে আস্তে কেমন করে যেন পুরো ব্যপারটি তালগোল পাকিয়ে গেছে। যেটিকে কোনো ঝামেলাই মনে হয়নি, সেটিই এখন সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে। প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেল পুরো পুলিশ প্রশাসন সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করে এবং পুলিশের বাইরে আন্ডারগ্রাউন্ডের শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীদের কাজে লাগিয়েও বাগে আনা যায়নি তন্ময় চৌধুরীকে। এই দুই টাকার এক সাংবাদিকযে এতোটা ভোগাবে কে জানতো! অথচ এই মুহুর্তে তাদের অস্তিত্বেও জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই ছোকরা। যথেষ্ট পরিমাণ নিকোটিন এবং অ্যালকোহল এই দুই অংশীদারের দুশ্চিন্তাকে সাময়িকভাবেও দূর করতে পারছে না।
নি:শব্দে মুখোমুখি কিছুক্ষণ বসে থাকে দুজন। কামড়ায় তৃতীয় ব্যক্তি প্রবেশ করেন। ডিআইজির অভ্যর্থনায় বোঝা যায় ইনিও এতের ব্যবসার আরেকজন পার্টনার। অবশ্য ঘনিষ্ট কেউ না হলে গুলশানের এই অভিজাত গেস্ট হাউজে মন্ত্রীর গোপন বৈঠক সম্পর্কে জানার কথা না। সম্ভবত মন্ত্রীর স্ত্রীও জানেন না তিনি এখন কোথায় কী করছেন। কাজের ফাঁকে মাঝে মধ্যেই এখানে এসে একান্তে কিছুটা সময় কাটিয়ে যান। বেনামে করা নিজের এই গেস্ট হাউজটিতে মন্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য সকল ব্যবস্থাই করা থাকে।
এই মাত্র যোগ দেওয়া তৃতীয় ব্যক্তিটি সংক্ষেপে একটু আগে ঘটে যাওয়া নিউজ এডিটরের বাড়ির ঘটনাটি জানায়। সদ্য পাওয়া তথ্যগুলো মন্ত্রী এবং ডিআইজির কপালে আরো কয়েকটা ভাঁজ যুক্ত করে। আজকের দিনটাই কী দু:সংবাদের। আবু সাঈদকে সরিয়ে দেওয়া এবং সে ঘটনায় হাফিজুর রহিমকে ফাসিয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তীতে ছিলো সবাই। তন্ময়কে কব্জা করাটাকে ভেবেছিলো দুই মিনিটের মামলা। রাতে তাকে ঘরে না পেলেও কোনো চিন্তা হয়নি; সকালে কোথায় পাওয়া যাবে এটাতো জানাই ছিলো। কিন্তু হাসপাতাল থেকে যেন একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তন্ময়। এর পর সারা দিনেও তার টিকির নাগাল পাওয়া যায়নি। সব শেষে রাত একটায় তাকে দেখা গেছে তারেক আহমেদের বাড়িতে।
মন্ত্রীর মোবাইল ফোনটি কেঁপে উঠে। স্ক্রিনে শমসেরের নাম দেখে দ্রুত রিসিভ করেন।
বলো শমসের।
পাখি উড়ে গেছে বস্।
মানে, তোমরা সেখানে কি.. .. ছিড়তে গিয়েছো?
সকল শিষ্ঠাচার ভুলে খিস্তি করে উঠেন মন্ত্রী। তার এই ভাষাজ্ঞানলুপ্ততা ঘটনার গুরুত্বেও বার্তা বয়ে আনে ডিআইজির কাছে।
একটা কাজও যদি তোমরা ঠিক মতো করতে পারতে। তোমাদের মতো দুজন স্কিল্ড লোককে একটা আনাড়ি এভাবে একের পর এক ঘোল খাওয়াচ্ছে, এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?
ওই প্রান্ত থেকে একটা কিছু বলে শমসের। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে মোবইল ফোনটা দেয়ালে আছড়ে মারেন মন্ত্রী। দরজার বাইরে খান মজলিশ তৈরিই ছিলো। দ্রুত ঘওে ঢুকে মন্ত্রীর ভাঙ্গা মোবাইলটি কুড়িয়ে নিয়ে নিজের মোবাইলে মন্ত্রীর সিম কার্ডটা ভরে দেয়। বোঝা যায়, আগেও বেশ কয়েকবার তাকে এই কাজ করতে হয়েছে। মন্ত্রীর চোখের ইশারায় কামড়ার বাইরে চলে যান খান মজলিশ।
সুরাপাত্রে বড় একটি চুমুক দিয়ে মেজাজ বশে আনার প্রয়াস চালান মন্ত্রী। কামড়ার নতুন সদস্যের দিকে ফিরে বলেন,
ঘটনাটা কোথায় গড়ােচ্ছ বুঝতে পারছেন? আপনার ওই রিপোর্টার যদি কোনোভাবে তথ্যগুলো ফাঁস করে দেয় তাহলে শুধু আমি নই, আপনি এবং এই ডিআইজিসহ কমপক্ষে দুজন সেক্রেটারি এবং আরো ডজনখানেক পুলিশের বড় কর্মকর্তা ফেসে যাবে। আপনার সঙ্গেতো সে আছে প্রায় দশ বছর। আপনি কোনো ধারণ দিতে পারেন, কোন গর্তে লুকাতে পারে বদমাশটা।
একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নেন সম্পাদক আব্দুস সালাম। একটু বিব্রত বোধ করেন তিনি। তন্ময়ের কাছে যে নাকানিচোবানি খেতে হচ্ছে, তার জন্য যেন তিনি নিজেও দায়ী।
পত্রিকায় যখন একের পর এক ইয়াবা নিয়ে স্টোরি ছাপা হতে শুরু করলো, তখন উপায়অন্তর না দেখে সম্পাদককে চক্রে টেনে নেন মন্ত্রী। এ জন্য সম্পাদকের প্রাবাসী শালার অ্যাকাউন্টে আট অঙ্কের টাকা জমা রাখতে হয়েছে। এর পরই হঠাৎ করে মাদক নিয়ে নিউজ করার উৎসাহ কমে যায় প্রথম সারির এই জাতীয় দৈনিকটির। নারী নির্যাতন, চিকিৎসা সেবা, নারী ও শিশু পাচারের মতো চালু ইস্যুগুলোকে হাইলাইট করতে থাকে সুকৌশলে। এর আড়ালে সারা দেশে ভয়াবহ থাবা বিস্তার করে নীল নেশা। মন্ত্রী, পুলিশ, আমলা আর মিডিয়ার আশীর্বাদে মাদক ব্যবসায়ীরা হয়ে উঠে বেপরোয়া। চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়তে থাকে এর সঙ্গে জুড়িত রুই-কাতলাদের ব্যাংক ব্যালেন্স।
হাতের গ্লাসটিতে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে আব্দুস সালাম বলেন, সকাল থেকে তন্ময়ের সঙ্গে ছিল ফটোগ্রাফার আমিনুল। সারা দিনেও তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। আমার মনে হয় এটাকে ধরলে আসলটির খোঁজও পাওয়া যাবে। কান টানলেই মাথাটা কব্জায় চলে আসবে।
আমিনুল সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য তিনি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছেন।
এই তথ্য এতোক্ষণে দিচ্ছেন? সারা দিন ঘোড়ার ঘাস কেটেছেন? খেকিয়ে উঠেন মন্ত্রী। দ্রুত মোবাইল ফোনটা তুলে নেন। বোতাম টিপে ডায়াল করেন। আমিনুলের বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দেন তার পোষা মবিন আর শমসেরকে আর ফোন নম্বরটি পুলিশ বিভাগকে জানিয়ে দেন ডিআইজি।
সুসংবাদ বয়ে আনা ফোন কলের অপেক্ষায় নি:শব্দে পান করতে থাকে তিনজন। সামনে রাখা কাজু বাদামের পেটটি অবহেলায় পড়ে থাকে।
দশ
রাত দেড়টা।
পত্রিকার নগর সংস্করণ এই মাত্র ছাড়া হয়েছে। বহুল প্রচারিত দৈনিকগুলো প্রতিদিন দুটি সংস্করণ প্রকাশ করে। প্রথমটি সারা দেশের জন্য, আর দ্বিতীয়টি আরো নিউজ আপডেটসহ নগর সংস্করণ। ন্যাশনাল এডিশন, অর্থাৎ প্রথম সংস্করণটিতে কোনো ভুল-ভ্রান্তি থাকলে তা দ্বিতীয় সংস্করণ বা নগর সংস্করণে শুধওে নেওয়া হয়। তাই নগর সংস্করণটির ট্রেসিং ছাপাখানায় পাঠানোর আগ পর্যন্ত নাইট ডিউটির দায়িত্বরতদের ছুটি নেই।
নগর সংস্করণটি ছেড়ে দিয়ে নাইট ডিউটির রিপোর্টার আর ডেস্কের সাব এডিটরেরা ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুই হয়নি এমন একটা চেহারা করে নিউজ রুমে ঢোকে আমিনুল। একটি কম্পিউটারের সামনে বসে ইন্টারনেটে চ্যাট করতে থাকে। ফটোগ্রাফারেরাও পালা করে রাতের ডিউটি করে। তাই এতো রাতে আমিনুলের উপস্থিতি কারো কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় না।
লোক দেখানো চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত থাকলেও একটি হাত দিয়ে শরীফের ডেস্কের ড্রয়ারটি খোলার চেষ্টা চালাতে থাকে আমিনুল। প্রায় বিশ মিনিট চেষ্টার পর সফল হয়। অফিসের ড্রয়ারের এই তালাগুলো আসলে খুব পলকা। নিম্নমানের এ তালাগুলোকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় আমিনুল। ড্রয়ার খুলেই উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। তন্ময় তাকে বলেছে, এ ড্রয়ারে কতোটা অমূল্য বিস্ফোরক রাখা আছে। এ তথ্যগুলো সামনে এলে সারা দেশে উলটপালট হয়ে যাবে। দাবানলের মতো মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়বে তা সাধারণ মানুষের মাঝে।
বাদামি কাগজের প্যাকেটটা বের করে দ্রুত ক্যামেরার ব্যাগে ভরে ফেলে আমিনুল। গলাটা বার বার শুকিয়ে আসে। চকিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে তরতর কওে সিড়ি বেয়ে নেমে যায়।
নীচে রমিজের দোকানে বসে আয়েশ কওে এক কাপ চার সঙ্গে সিগারেট জ্বালায়। হাতে কিছুণ সময় আছে। তনু ভাই এখনো একরামুলের খোঁজ পান নাই। ওই শালাকে পেটানোর পর শাহজাহানপুর থেকে তনুভাইকে তুলে নিতে হবে। আজ রাতটা পুরান ঢাকায় একটা ডেরায় কাটাতে হবে। কাধের ব্যাগটা নামিয়ে রমিজের পাশের টুলে রেখে একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে নেয়। সারা দিন যে ধকলটা গেল! ওহ। পুরো শরীর ব্যথা হয়ে গেছে।
মালটা হাতে এসেছে। তনুভাইয়ের ধারণা এই প্যাকেটের ভেতরের কাগজগুলোর জন্যই সারাদিন এতো জলঘোলা হয়েছে। কী আছে এর ভেতর? খুলে দেখারও সাহস হয়না আমিনুলের। দোকানের কাউন্টারের ভেতর রাখা ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুণ। যাক্, বিরাট একটা কাজ হয়েছে। সুখবরটা তন্ময়কে জানানোর জন্য মোবাইল ফোনের বোতাম টেপে আমিনুল। চারজনের দলটিকে এগিয়ে আসতে দেখে মুহুর্তে একটা কিছু সন্দেহ হয়। সেকেন্ডে ভগ্নাংশে করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় আমিনুল। গত কয়েক ঘন্টায় তার বয়স এবং বুদ্ধি যেন দশগুণ বেড়ে গেছে।
এদিকে মোবাইল ফোনটি ততোণে তন্ময়কে ফোন করা শুরু করেছে। প্রথম রিংয়েই রিসিভ তন্ময়। মুহুর্ত নষ্ট না করে আমিনুল বলে উঠে, বস্ আপনের সিমটা ভরেন।
চারজন ততোণে আমিনুলের খুব কাছে চলে এসেছে। প্রথমেই তারা হাত থেকে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেয়। দুপাশ থেকে দুজন আমিনুলের দুহাত শক্ত কওে ধওে ফেলে। ফ্যাল ফ্যাল কওে তাকিয়ে থাকা রমিজের দিকে ফিওে আমিনুল বলে, তনুভাইকে ফোন কওে বলে দিস, আমার ফিরতে দেরি হবে। তন্ময়ের সংপ্তি নামটি এদেও যেন জানা না থাকে, মনে মনে খোদার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে আমিনুল।
প্রতিদিনের চায়ের আড্ডা বসে রমিজের দোকানে। সাইড বিজনেস হিসেবে মোবাইল ফোনের ফ্যাক্সি লোড করে রমিজ। সে সূত্রে এ অফিসের সবার মোবাইল নম্বর তার জানা। চারজন লোক আমিনুলকে ধওে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়ার দৃশ্যটির দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রমিজ। অফিসের সামনে থেকে এভাবে একজন সাংবাদিককে তুলে নেওয়া সোজা কথা না!
আমিনুলের শেষ কথাটি মনে পড়তেই ব্যস্ত হয়ে উঠে রমিজ। তন্ময়ের নম্বওে ডায়াল করে। আমিনুলকে ধওে নিয়ে যাওয়ার কথা জানায়।
আমিনুল কি তোমার দোকানে কোনো প্যাকেট রেখে গেছে?
তন্ময়ের এই প্রশ্নের পর আমিনুলের রেখে যাওয়া ব্যাগটার দিকে দৃষ্টি পড়ে রমিজের। হ, তনুবাই, আমিনুলবাই ক্যামরার ব্যাগ রাইখা গেছে।
তাকে সিম ভরতে বলার রহস্য এবার পরিষ্কার হয়। আমিনুলকে যারা ধরেছে তারা হয় ডিবির দুর্নীতিবাজ চক্রটি অথবা মন্ত্রীর ভাড়াটে গুন্ডা। ধরা পড়ার মুহুর্তে আমিনুল ফোন করে তন্ময়কে নিজের সিমটা ভরতে বলেছিলো যাতেকওে রমিজ সহজেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। কারণ চায়ের দোকানে রেখে যাওয়া মূল্যবান কাগজগুলোর তথ্য জানাতে রমিজকেই ব্যবহার করতে হয়েছে আমিনুলকে। আর এ খবর জানাতে তন্ময়ের মোবাইল ফোনেই কল করবে রমিজ।
গাড়ির ভেতর ড্রাইভার ছাড়াও আরো দুজন ছিল। ড্রাইভারও এদেরই লোক। সে হিসেবে আমিনুলকে ধরতে মোট সাতজনের দল এসেছে। নিজেকে কেউকেটা মনে হয়। রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত গতিতে গাড়ি চলছে। কালো কাচের বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে গাড়িটা মিরপুরের দিকে যাচ্ছে বলেই আমিনুলের ধারণা। ফার্মগেট এসে বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছে, এরপর রোকায়ে সরণী ধওে সোজা ছুটে চলছে। গন্তব্য মিরপুর, কোনো সন্দেহ নেই। গন্তব্য জেনেই বা লাভ কী! প্রথম চোটেই মোবাইল ফোনটি হাতছাড়া হয়েছে। এখন কোথায়, কোন গর্তে নিয়ে আটকে রাখবে কে জানে!
আশ্চর্য হয়ে আমিনুল আবিষ্কার করে, এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতেও তার ততোটা ভয় করছে না। অবশ্য এখন পর্যন্ত ভয়ের কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু রাত প্রায় দুটোর সময় অচেনা একদল লোক যদি জোর করে ধরে মাইক্রোবাসে করে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, তাহলেতো সেটা চিন্তারই কথা। কই, সেরকম চিন্তাওতো হচ্ছে না! এনে হয় সারা দিনের ধকলে নার্ভগুলো ভোতা হয়ে গেছে, ভয়, দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের কোনো অনুভুতিই কাজ করছে না।
রমিজের দোকান থেকে তন্ময় ক্যামেরার ব্যাগটা সংগ্রহ করে নেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। রমিজের দোকানে যদি আরেকটা দল তন্ময়ের জন্য ফাঁদ পেতে থাকে? সে েেত্র কী হবে? চিন্তায় পড়ে যায় আমিনুল। অবশ্য আমিনুলকে যেভাবে ধওে আনা হয়েছে, সে ঘটনার বিবরণ পেলে নিশ্চই সাবধান হয়ে যাবে তন্ময়। অনুসন্ধানী সাংবাদিক তন্ময় চৌধুরীর উপস্থিত বুদ্ধিও উপর আমিনুলের ব্যপক আস্থা। এর আগেও বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টে তন্ময় ুরধার বুদ্ধিও ছাপ রেখেছে। আর সেজন্যইতো এতো অল্প বয়সে দেশের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত দৈনিকের সবচেয়ে নামকরা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছে।
সারা দিনে এই প্রথম ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার ফুরসত মিলেছে। বসে বসে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করে আমিনুল। নিউজ এডিটর মাদক ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে জড়িত এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি আমিনুল। তারেক ভাইয়ের সঙ্গে প্রায় ১৫ বছর ধওে কাজ করছে। কই কখনো তো মনে হয়নি তিনি কোনো ধরণের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। তন্ময় চোখে আঙ্গুল দিয়ে একের পর এক যুক্তি সাজিয়ে পুরো ব্যপারটা ব্যখ্যা দেওয়ার পরও বিশ্বাস করেনি। পওে তারেক ভাইয়ের বাড়িতে মবিন আর শমসেরের উপস্থিতি তারেক আহমেদেও প্রতি আমিনুলের বিশ্বাসের ভিতটা পুরোপুরি ধ্বসিয়ে দিয়েছে। এ চক্রের সঙ্গে আর কারা জড়িত, সেটা ভারতে থাকে আমিনুল। তবে ভাবনা-চিন্তার ব্যপারটা তার খুব একটা আসে না। বরাবরই সেটা তন্ময়ের উপর ছেড়ে দেয়। মাইক্রোবাসের সিটে বসে ঘুমে ঢলে পড়ে আমিনুল।
এগারো
ডিবির এসআই একরামুল গত চব্বিশ ঘন্টায় কিছু মুখে গুজার সময় পায়নি। পুরো দিনটা কেটেছে দৌড়ের উপর।
হাফিজুর রহিম পুরো ব্যপারটাকে ভীষণ ঘোড়ালো করে তুলেছিলো। এএসপি আকবর আর সে মিলে এখন পুরো বিষয়টা নিজেদেও মতো কওে সাজাচ্ছে। সারা দিন পেটে একটা দানা না পড়লেও কোনো অনুযোগ করেনি এনামুল। এর পেছনে দুটো কারণ কাজ করছে। প্রথমটি হচ্ছে, টাকা। একরামুল জানে, এই কাজের বিনিময়ে পকেটে আসবে অনেকগুলো কড়কড়ে নোট। খাবার না জুটলেও সারাদিনই আসন্ন টাকার গন্ধটা উপভোগ করেছে। এই গন্ধটা তার কাছে যে কোনো সুস্বাদু খাবারের চেয়ে অনেক বেশি উপদেয়। দ্বিতীয় কারণটা হলো ঘটনার গুরুত্ব। আবু সাঈদ এবং হাফিজুর রহিমের স্ত্রীকে হত্যা করা, হাফিজুর রহিমের গ্রেপ্তার এবং তন্ময়ের পেছনে পুরো পুলিশ ফোর্সকে লেলিয়ে দেওয়ার বিষয়গুলোই এ ঘটনাটির গুরুত্ব নিরূপণের জন্য যথেষ্ট। তার উপর সকাল থেকে মন্ত্রী নিজে একটু পর পর ফোন দিয়ে কাজের অগ্রগতি জানতে চাইছেন। মন্ত্রীর ফোন রিসিভ করতে করতে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে উঠেছে আকবর খান।
দীর্ঘ দিনের চাকরি জীবনে ছোট-বড় নানা জাতের দুর্নীতি করে বিস্তর টাকা কামিয়েছে একরামুল। ঢাকা শহওে তার জায়গা সম্পত্তির কোনো অভাব নেই। তবে এবারের ঘটনা একেবারে আলাদা। এট তো বারাট দাঁও। প্রস্তাবটি পেয়ে প্রথমে একটু চমকে উঠলেও দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়েছে। জীবনে উন্নতির জন্য মানুষকেতো কতো কাজই করতে হয়। সে তুলনায় এটা তেমন কোনো কঠিন কাজ না। তা ছাড়া বিবেকের কথা ভেবে সে যদি কাজটা না কওে তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে এটা করানো হবে। সে ক্ষেত্রে মোটা ইনাম থেকে বঞ্চিত হবে সে। এসব সাত-পাঁচ ভেবে আবু সাঈদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি হাতে নিয়েছে। সরাসরি খুনটি অবশ্য নিজ হাতে করতে হয়নি। মন্ত্রীর পাঠানো দুই পেশাদার খুনি নিখুঁতভাবে খুব অল্প সময়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে আবু সাঈদকে। পুরো ব্যপারটি তত্বাবধান করে একরামুল। শমসের আর মবিনের মানুষ হত্যার দতা দেখে রীতিমতো মুগ্ধ একরামুল। এরকম ভাবলেসহীনভাবে অনায়াস দতায় যে মানুষ হত্যা করা সম্ভব, তা নিজের চোখে না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস হতো না।
একরামুলের মতো সকাল থেকে মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছে আকবর খান। কাজ মানে আকাজ। দিনকে রাত বানানো। নিখুঁত ঘটনা সাজাতে এবং ফাইলে চাহিদা অনুযায়ী কারিগরি ফলানোতে সিদ্ধহস্ত এই আকবর। এসব কাজে সে রীতিমতো একটি প্রতিভা। পাকা জহুরির মতো তাকে ঠিক ঠিক চিনে নিয়েছেন ডিআইজি। তার নির্দেশেই আকবরকে এ কেসটার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ধানমন্ডিতে একটা ফ্যাটের বুকিং দিয়েছিলো আকবরের স্ত্রী। কেসটা ঠিকঠাক শেষ করতে পারলে এককালীন দাম পরিশোধ করে ফ্যাটটাতে উঠে যাওয়া যেতো। সেখান থেকে আদনানের স্কুলটাও খুব কাছে, হেঁটেই যাওয়া যায়। এ কারণেই সুষমা তাড়া দিচ্ছে দ্রুত ওই ফ্যাটে উঠার জন্য। ব্যাচমেট রুশোর নতুন প্রিমিওটা দেখে স্ত্রীর খায়েস হয়েছে একটা নতুন গাড়ি কেনার। এই সুযোগে সেটাও সম্ভব হবে। একটা সিগারেট ধরিয়ে টেবিলে দু পা তুলে দিয়েছে আকবর। চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে থাকে।
স্যার..একরামুলের ডাকে সংবিত ফিওে পায়।
কী ব্যপার?
স্যার রাততো অনেক হলো, বাড়ি যাবেন না?
আওে দাঁড়াও দাঁড়াও, হাতের কাজটা একটু গুছিয়ে নেই। বুঝতেই পারছো, আজকের মধ্যেই যতোটা সম্ভব কাজ গুছিয়ে ফেরতে হবে। ব্যপারটা ক্রমেই ঘোড়ালো হয়ে উঠছে। আবু সাঈদ এবং মুনমুনের মৃত্যু নিয়ে মিডিয়াগুলো হৈচৈ শুরু করেছে। এদিকে ওই সাংবাদিকেরও কোনো পাত্তা নাই। তার কাছে নাকি কিসব কাগজপত্র আছে। সেগুলোও উদ্ধার করা জরুরি। সবকিছু মিলে ব্যপারটা একেবারে জট পাকিয়ে আছে। আমাদেরকে তাই খুব দ্রুত ফাইল গুছিয়ে ফেলতে হবে। ঠিক আছে?
ঠিক আছে স্যার। বিরসবদনে উত্তর দেয় একরামুল।
কাজ শেষে একরামুল যখন বাড়ির দিকে রওনা হয় তখন ঘড়িতে রাত দুটো। ফাকা রাস্তায় দ্রুতই শাহজাহানপুরের বাড়িতে ফিরে আসে একরামুল।
কলাপসেবল গেইটের তালায় চাবি ঢোকানো মাত্রই জমে যায় একরামুল। ঘাড়ের উপর চেপে বসা ধাতব স্পর্শটিতে মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে আসে। রিভলবারের নল দিয়ে খোচা মেরে একরামুলকে ভেতওে ঢোকায় তন্ময়। পুরান ঢাকার টপ টেরর বোমা লিটনের কাছ থেকে ধার করে এনেছে অস্ত্রটি। দীর্ঘদিন ক্রাইম বিটে কাজ করার সুবাদে ঢাকার আন্ডার ওয়ার্ল্ডের লিডারদের সঙ্গে ভালোই জানাশোনা আছে। সেই পরিচয়ের সূত্রটিই এখন কাজে দিচ্ছে।
মবিন আর শমসেরের পরিচয়ও তন্ময় বের করেন্তোর আন্ডারওয়ার্ল্ডের শুভাকাঙ্খীদের কাছ থেকে। রাজনৈতিক হত্যাকান্ড এবং হাঙ্গামার জন্য সাধারণত মবিন আর শমসেরকে ভাড়া করা হয়। যখন যে দল মতায় থাকে, সেই দলের হয়ে কাজ করে এই মানিকজোড়। এক একটি পলিটিক্যাল কিলিংয়ের জন্য অবিশাস্যরকম বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকে তারা। হাতলে তন্ময়কে ধরতে এই দুই পেশাদার খুনিকে কেন কাজে লাগিয়েছে মন্ত্রী? তন্ময়ের কাছে এটা এখন একটা বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্ন লিটনেরও।
’বস, আপনে কি মন্ত্রীর মাইয়ারে রেপ করছেন নি? হালায় আপনের পিছে শমু-মবুরে লাগাইছে কেলা?’ অপরাধ জগতে মবিন আর শমসের এ নামেই পরিচিত। ছোটখাট অপরাধে এদের কখনো দেখা যায়নি। পুলিশের খাতায় এই জুটির নামে কোনো রেকর্ড নেই। কারণ সব সময়ই এরা ‘সরকারের’ হয়ে কাজ করে। তন্ময়ও সেই কথাই ভাবছিলো। এখন আর কোনো কিছুই তাকে বিষ্মিত করছে না। এতোসব ঘটনার মধ্যেদিয়ে যেতে হচ্ছে, কোনো কিছুকেই অপ্রত্যাশিত লাগছে না।
ডিবি অফিসে আমিনুলের সোর্স আজহারের কাছ থেকে খবর পেয়েছে, এই কেসে হাফিজুর রহিমের সহকারী হিসেবে ছিল এসআই একরামুল। স্ত্রীর দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে রহিম অফিস ছেড়ে চলে যায়। আবু সাঈদ তখন একরামুলের তত্বাবধানে ছিল। সে অবস্থাতেই মৃত্যু হয় সাঈদের। সাঈদ হত্যার সঙ্গে একরামুলের সংশিষ্টতা বোঝার জন্য এর চেয়ে বেশি তথ্যের প্রয়োজন নেই। তারেক আহমেদের বাড়ি থেকে বের হয়ে তাই সোজা শাহজাহানপুরে এসেছে তন্ময়। তাকে নামিয়ে দিয়ে পাত্রিকা অফিসে গেছে আমিনুল। সে কি পারবে শরীফের ড্রয়ার থেকে প্যাকেটটা উদ্ধার করতে? এ চিন্তায় অস্থিও হয়ে আছে তন্ময়। ওই কাগজের প্যাকেটটাই এখন তার একমাত্র সম্বল। জানেনা এটার ভেতওে কী আছে। কিন্তু সে নিশ্চত, এটি হাতে পেলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য এটি হবে একটি মোম অস্ত্র।
পঁয়তালিশ মিনিট ধরে অন্ধকারে ঠায় দাঁড়িয়ে। শরীরে প্রতিটি লোমকুপে কমপে একটি করে মসা বসে আছে। থাপ্পর দিয়ে মারতে হচ্ছে না। শরীরের যে কোনো অংশে হাত বুলালেই চাপা পড়ে আট-দশটার মৃত্যু হচ্ছে। নিজের রক্তে চটচটে হয়ে গেছে হাতের তালু। প্রশিতি সেনা সদস্যের মতো কঠোর অধ্যাবসায়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তন্ময়। এক একটি সেকেন্ডের ব্যপ্তি বেড়ে যেন ঘন্টায় দাঁড়িয়েছে। সব রাতই ভোরে শেষ হয়। তেমনি এক সময় তন্ময়ের অপোর পালাও শেষ হলো।
একরামুলের ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে দোতলার ল্যান্ডিংয়ে নিয়ে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসা রুমাল দিয়ে সিড়িকোঠার অন্ধকারে হাত-পা বাঁধে। মুখে গুজে দেয় রুমাল। অমানষিক আতঙ্কে চোখদুটো ঠিকে বের হয়ে আসে একরামুলের। মুখে জোগা রুমাল নিয়ে গোঙ্গাতে থাকে। খুব শান্ত ভঙ্গীতে তার বাঁ হাতের কনে আঙ্গুলটি মুঠ করে ধওে তন্ময়। মট্ কওে চাপ দিয়ে আঙ্গুলের হাড়টা ভেঙ্গে দেয়। চাপা স্বওে গোঙ্গানি বেড়ে যায়। একরামুলের দু চোখ দিয়ে দরদও কওে পানি পড়তে থাকে।
একটা টু শব্দ করলে এভাবে সবগুলো আঙ্গুল ভেঙ্গে দেবো। এর পর কপালে ঠেকিয়ে গুলি। আমার জীবন তো এমনিতেই শেষ। মাদক ব্যবসার সহযোগী হিসেবে পুলিশ খঁজছে। এর সঙ্গে একটা খুনের অপরাধ যুক্ত হলে আর কতোটাইবা বেশি হবে।
তন্ময়ের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় একরামুল। একটু সময় দিয়ে মুখের বাঁধন খুলে দেয় তন্ময়। বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাঁপাতে থাকে একরামুল। বুকটা হাঁপড়ের মতো উঠানামা করে।
এখন ভালো মানুষের মতো এক এক কওে আমার সবগুলো প্রশ্নের জবাব দাও। প্রথম প্রশ্ন, পুলিশের কে কে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত? দ্বিতীয় প্রশ্ন, তারেক আহমেদ ছাড়া এই চক্রেও সঙ্গে সাংবাদিক মহলে আর কারা যুক্ত? তৃতীয় প্রশ্ন, মন্ত্রী ও আমলাদের মধ্যে কারা এর পেছনে আছে? চটপট উত্তর দাও।
চুপ করে থাকে একরামুল। মুখের ভেতর আবার রুমালটা গুজে দিয়ে এবার একরামুলের ডান হাতের কড়ে আঙ্গুল মুঠোয় পুরে তন্ময়। ওঁ ওঁ কওে শব্দ কওে দুদিকে মাথা নাড়তে থাকে একরামুল। রুমালটা সরিয়ে নেয় তন্ময়।
এবার মুখ খোলে একরামুল। তার জানা নামগুলো একে একে বলে যায়। সবার আগে জানায় নিজের পরিচয়। তন্ময়ের বুক পকেটে রাখা ডিজিটাল রেকর্ডারটি সক্রিয় হয়। মেমোরিতে নিয়ে নেয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো। বিষ্ময়ের বুঝি আরো বাকি ছিলো। দু-একটি নাম শুনে মুখটা হা হয়ে যায় তন্ময়ের। রাগে-ঘৃণায় ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে। তাকে গুটি বানিয়ে কী জঘন্য খেলায় মেতেছে সম্পাদক!
একরামুলকে ছেড়ে বেরুবার আগে আছড়ে তার মোবাইল ফোনটি নষ্ট কওে দিয়ে যায় তন্ময়। কোনো বাপের সঙ্গে একরামুল যোগাযোগ করার আগে অন্তত কিছুণ সময় পেতে হবে।
বেড়িয়ে আসতে আসতে মনে মনে ভাবে তন্ময়, যে কোনো বিষয়ে এক্সপার্ট ওপিনিয়নের কোনো বিকল্প নেই। বোমা লিটনের বাতলে দেওয়া তরিকা অ্যাপাই করে এতো সহজে একরামুলের পেট থেকে সবকিছু বের করা গেছে। লিটনের পরামর্শ ছাড়া ডিপি পুলিশের এই দুর্নীতিবাজ সদস্যটিকে কোনো ভাবেই বাগে আনতে পারতো না তন্ময়।
নীল আলো জ্বেলে নি:শব্দে বেজে উঠে মোবাইল ফোনটি। আমিনুলের ফোন। সবুজ বোতাম চেপে কলটি রিসিভ করে তন্ময়।
বস্ আপনের সিমটা ভরেন।
কোনো রকমে কথাটা বলেই লাইন কেটে দেয় আমিনুল। বোকার মতো কিছুণ ফোনটির দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়। ষষ্ঠ ইদ্রিয় সতর্ক বার্তা পাঠায়; বড় কোনো বিপদে পড়েছে আমিনুল। দ্রুত মোবাইল ফোনে নিজের সিম কার্ডটা ভরে অপো করতে থাকে তন্ময়।
বারো
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সানডিয়াগোর বিজনেস স্কুলের মাঠে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো জাফর। সামহয়্যারইন বগে এই মাত্র দেওয়া পোস্টটিতে চোখবুলিয়ে ঘাড়ের কাছে লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো তার। চার দিকে ঝকঝকে রোদ। মেঘমুক্ত আকাশ। চীর বসন্তের শহর সানডিয়াগোতে আজকের আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম। এসব কিছুই চোখে পড়ছে না জাফরের। বিস্ফোরিত চোখে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। বন্ধু তন্ময়ের অমঙ্গল আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠে জাফরের। কেমন আছে তন্ময়?
পকেট থেকে সেল ফোনটা বের কওে দ্রুত বোতাম টেপে। মার্কিন মুলুকে প্রত্যেক বিদেশী ছাত্রকে প্রতিটি পাই-পয়সা হিসেব করে খরচ করতে হয়। এ মুহুর্তে হিসাবের ধার ধারেনা জাফর। নিজের মোবাইল ফোন থেকেই আইএসডি কল কওে বসে। মাস শেষে একগাদা ডলার গুনতে হবে; সেটা গ্রাহ্য করে না। তন্ময়ের ফোন বন্ধ। জাফরের অস্থিরতা বাড়তে থাকে।
এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালি বগারদের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই পোস্টের তথ্যগুলো। বগকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাও এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে। ভোরের আলো ঠিকভাবে ফোটার আগেই বাংলাদেশে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।
কান্তিতে চোখ বুজে আসে তন্ময়ের। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শুরু হয়েছে। পশ্চিম আকাশ ফরসা হচ্ছে। মাইকে মুয়াজজিনের সুললিত কন্ঠে ভেসে আসছে.. .. আসসালাতুল খাইরুল মিনাননাউম.. .. ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম।
ল্যাপটপের পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়। এতোদিন এই বোমগুলো অবহেলায় পড়ে ছিল! ইস্, আগে যদি একবার অন্তত কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখতো! আবু সাঈদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ফাইলটিতে কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের নামের তালিকা পাওয়া গেছে। এদেও প্রত্যেকেই মরননেশা ইয়াবার চোরাই ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সবগুলো কাগজ ঘেটে এর অকাট্য প্রমাণও মিলেছে। কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা জমা করতো সাঈদ। ফাইলটিতে ব্যাংকের টাকা জমার রশিদগুলোও সুন্দরভাবে মাসওয়ারি সাজানো আছে। টাকার অঙ্ক দেখে মাথা ঘুরে যায় তন্ময়ের। যে অ্যাকাউন্টগুলোতে নিয়মিত টাকা দেওয়া হতো, সেসব অ্যাকাউন্টধারীর নাম ভিন্ন হলেও তন্ময় নিশ্চিত খুব সহজেই ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের সম্পর্ক আবিষ্কার করা যাবে।
এর বাইরে ইয়াবা চক্রের হোতাদের পরিচয় উন্মোচনের মোম অস্ত্র হিসেবে তন্ময়ের হাতে রয়েছে ডিবি পুলিশের এসআই একরামুলের জবানবন্দী। তন্ময়ের জেরার মুখে তোতা পাখির মতো গড়গড়িয়ে সবকিছু স্বীকার করেছে একরামুল। সাজানো দুর্ঘটনায় হাফিজুর রশিদের স্ত্রীকে হত্যা এবং আবু সাঈদকে হত্যার অভিযোগে রহিমকে ফাসানো, তন্ময়কে ইয়াবা চক্রের সঙ্গে জড়ানো, গোপন দলিলের খোঁজে তন্ময়ের বাড়ি ও অফিসে তলাসী এবং তন্ময়কে ধরার জন্য পুলিশের পাশাপাশি মন্ত্রীর পোষা সন্ত্রাসী মবিন ও শমসেরকে লেলিয়ে দেওয়া-- সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা করেছে একরামুল।
আমিনুলের তোলা ছবিগুলো বগের পোস্টটিকে সচিত্র করেছে। প্রায় সবগুলোই সন্ত্রাসী মবিন আর শমসেরের ছবি। তবে রাতের বেলা মবিন ও শমসেরের নিউজ এডিটর তারেকের ঘরে প্রবেশ এবং মন্ত্রী পাড়ায় মন্ত্রীর বাড়িতে দিনে-দুপুরে এই মানিকজোড়ের আগমনের ছবিও তুলেছে আমিনুল। এ ছবিগুলো বগে আপলোড কওে দিয়েছে। সাঈদের বাড়ি থেকে আনা ডক্যুমেন্টগুলোও দিয়ে দিয়েছে বগে। স্ক্যান করার সুবিধা নেই বলে এ কাগজগুলোর ছবি তুলে তা পোস্টেও সঙ্গে জুরে দিয়েছে তন্ময়। আমিনুলের অত্যাধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরাটা বেশ কাজে দিয়েছে। আরো আপলোড করেছে একরামুলের রেকর্ডেড ভয়েস।
বোমা লিটানের দেওয়া একটি অপরিচ্ছন্ন একচিলতে ঘরে বসে কাজগুলো করেছে তন্ময়। বিকট শব্দে মাথার উপর তীব্র গতিতে একটি ফ্যান ঘুরছে। সেটি মোটেও স্বস্তি দিতে পারছে না। বরং ঘরের গরম বাতাসটিকে আরো ছড়িয়ে দিচ্ছে। বসে বসে দর দর করে ঘামছে তন্ময়। গায়ের জামাটি ভিজে চুপচুপে। এখন ল্যাপটপের দায়িত্ব নিয়েছে বন্ধু ওহিদুল। তন্ময়ের বক্তবেটি পেন ড্রাইভে নিয়ে নিচ্ছে। সকালেই এটি প্রিন্ট কওে সবগুলো ছবি এবং একরামুলের স্বীকারোক্তির সিডির একটি সেট প্রতিটি পত্রিকা, রেডিও এবং টিভি চ্যানেলের অফিসে দিয়ে আসবে।
নোংড়া বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তন্ময়। এবার নিজের পরিচয়ে ফেরা যাক। মোবাইলে নিজস্ব সিমটি ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেটি বেজে উঠে। নিশ্চই বগে দেওয়া পোস্টের রিঅ্যাকশন। অদ্ভুত এক অভিমান ভর কওে তন্ময়ের মনে। কেন তাকে সারা দিন প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে? কী অপরাধ ছিলো তার। হাফিজুর রহিমের মতো সৎ পুলিশ অফিসারের কেন এই করুন পরিণতি হবে? আপন বড় ভাইয়ের মতো যাকে শ্রদ্ধা করতো সেই তারেক ভাইয়ের আসল চেহারাটি এতো কুৎসিত!
সারা দিন সিগারেট আর চা ছাড়া কিছুই জোটেনি। পেটের ভেতরটা মোচর দিচ্ছে। পুরান ঢাকার অন্ধকার গলিতে সূর্যেও প্রথম আলো আসতে শুরু করেছে। ঘুম ঘুম চোখে জানালায় তাকিয়ে থাকে তন্ময়। আরে, কী আশ্চর্য, জানালায় দুটো ঘুঘু পাখি এসে বসেছে।
শেষ
আপনাদের মন্তব্য/মতামতের অপেক্ষায় রইলাম। কেমন লাগলো জানাবেন প্লিজ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০০৯ সকাল ৯:০২