এক
আপনিই মিসির আলি?
একটু বিব্রত হেসে ভদ্রলোক জবাব দেন, জ্বী আমার নাম মিসির আলি।
দোড়গোড়ায় দাঁড়ানো আগুন্তক কিছুক্ষণ আবিশ্বাস মাখানো মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
তার এই দৃষ্টির সামনে আরো একটু জড়োসরো হয়ে যান মিসির আলি। কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাকে সুযোগ না দিয়ে আগুন্তক বলে উঠে,
জানেন, অনেক কষ্ট করে আপনার ঠিকানা জোগাড় করেছি। আপনাকে নিয়ে লেখা গল্পগুলো পড়েই বুঝতে পারতাম আপনার অনেক বুদ্ধি। আপনিই পারবেন আমাকে সাহায্য করতে....
কথার মাঝখানে আগুন্তককে থামিয়ে দেন মিসির আলি।
দেখুন, প্রথমেই একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে নেওয়া দরকার। আমার নাম মিসির আলি, আর আমি একটি কলেজে পড়াই। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে উপন্যাসের চরিত্র ভেবে বসলে ভুল করবেন। আমার সঙ্গে আপনার পরিচিত মিসির আলিকে মিলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। কারণ আমি নিন্তাই একজন ছাপোষা মানুষ। আপনার বইয়ের মিসির আলির মতো বুদ্ধিমান রহস্যভেদী নই।
একদমে কথাগুলো বলে একটু থামেন তিনি। এর আগেও এ ধরণের সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। প্রায়ই অতি উৎসাহী পাঠকেরা এসে হাজির হয়। কেউ কেউ আবার ভীষণ করকমের নাছোড়বান্দা। কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না; অনেকে অটোগ্রাফের বায়না করে; অনেকে আবার আরো এক ধাপ এগিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে চায়। অসহ্য...অসহ্য। এ ধরণের উটকো উৎপাতে রীতিমতো বিরক্ত মিসির আলি। সম্ভব হলে নিজের নামটাই বদলে ফেলতেন।
দরজায় দাঁড়ানো যুবকটিও এ ধরণেরই একটি উৎপাত; কোনো সন্দেহ নেই। ছুটির দিন দুপুরে খাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই দরজায় নক। মনে মনে চটে উঠলেও স্বাভাবিক সৌজন্যতাবোধে মিসির আলি যুবকের মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে পারছেন না। যদিও সেটাই ইচ্ছে করছে। ভাবলেশহীন চোখে তিনি যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকেন। চোখে বিন্দুমাত্র আমন্ত্রণের আভাষ সেই। মাথায় তিল পরিমাণ বুদ্ধি থাকলেও বোঝা উচিৎ এখন বিদেয় হলেই মিসির আলি খুশি হন।
'আপনি বোধ হয় রেস্ট নিচ্ছিলেন। আজকে তাহলে যাই, আবার দেখা হবে। স্লামালাইকুম স্যার।'
দরজা বন্ধ করে মিসির আলি ভেতরে আসেন। আগুন্তক যুবকটির সঙ্গে এতোটা কঠিন ব্যবহার না করলেও বোধ হয় চলতো। মনটা একটু খচ খচ করে।
দুই
এক সপ্তাহ পর ক্লাশের ফাঁকে কলেজের টিচার্স কমনরুমে বসে মিসির আলি চা সহযোগে পত্রিকা পড়ছিলেন। বেয়ারা এসে খবর দেয়, 'স্যার আপনের কাছে এক লোক আসছে।'
ততোক্ষণে বেয়ার পেছন পেছন রুমের ভেতরে চলে এসেছে সেদিনের সেই যুবক।
হাতে দড়ি বাঁধা এক হালি আনারস ঝুলছে।
মিসির আলি তাঁর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে নামটা মনে করার চেষ্টা করেন। নাহ্, বয়স হচ্ছে! কিছুতেই নামটা মনে পড়ছে না। আরে, যুবকের নামটাতো সেদিন জিজ্ঞেসই করা হয়নি।
'তোমার নাম কি?' প্রশ্নটা করেই মনে মনে লজ্জিত হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন মাস্টারি করে এই বদঅভ্যাসটা হয়েছে। যে কাউকে চট করে তুমি বলে ফেলেন। ত্রিশ বছরের এই যুবককে কোনো অবস্থাতেই তুমি করে বলা শোভন নয়।
বিগলিত হেসে যুবক জবাব দেয়, 'আনোয়ার। স্যার আমার নাম আনোয়ার। একটা প্রাইভেট ফারমে কাজ করি। আমি স্যার লক্ষীবাজারে একটা মেসে থাকি। আপনার বাসা থেকে খুব দূরে নয়।'
একটু থেমে আনোয়ার আবার বলতে শুরু করে, 'স্যার আমার একটা সমস্যা আছে। সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।'
তাকে থামিয়ে দিয়ে মিসির আলি বলেন, 'তোমার সমস্যা শুনে আমি কী করবো? তুমি কী সত্যি সত্যি আমাকে উপন্যাসের মিসির আলি ঠাউরে বসে আছো? আমি নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। গল্পের মিসির আলির মতো বুদ্ধি বা মেধা কোনোটাই আমার নাই। যদি সত্যিই বড় কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে ডাক্তার বা পুলিশের কাছে যাও। কিংবা তোমার আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে আলাপ করো।'
কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে আনোয়ার। 'তাহলে যাই স্যার। আবার দেখা হবে।' এ কথা বলে অস্বাভাবিক দ্রুততায় টেরিলের উপর আনারসগুলো রেখে দরজা গলে বেড়িয়ে পড়ে।
অবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখেন মিসির আলি। এবার দৃষ্টি ফেরান টেরিলের উপর রাখা আনারসগুলোর দিকে। কয়েকদিন ধরেই ভাবছেন, আনারস কিনবেন। কিন্তু প্রতিদিনই বাড়ি ফেরার পথে ভুলে যান। বাসা গিয়ে মনে পড়লেও আলসেমি করে আবার বের হওয়া হয় না। তাই আনারসও কেনা হচ্ছে না।
মিসির আলি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন, এই আনোয়ারের হাত থেকে খুব সহজে মুক্তি মিলবে না। কপালে অনেক ভোগান্তি আছে।
তিন
আত্মীয়-স্বজনদের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন মিসির আলি। এর পেছন অন্যতম কারণটি অর্থনৈতিক। এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া মানেই গুচ্ছের টাকা খরচ। উপহার কেনা, ট্যাক্সি ভাড়া করে যাওয়া-আসা। কোনো মানেই হয় না। তার চেয়ে বাড়িতে পোলাউ মাংস রেধে খাওয়া অনেক ভালো।
মিসির আলি কলেজে দর্শন পড়ান। এটি এমন একটি বিষয় ছাত্র-ছাত্রীরাও প্রাইভেট পড়তে আসে না। ফলে কলেজের বেতনটুকুই মিসির আলির ভরসা। তাই প্রতিটি পাই পয়সাই হিসেব করে খরচ করতে হয়।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে বাবুর্চির হাতের তেল-মশলা দেওয়া রান্না খেলেই তার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়। তাই এসব অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি তৃপ্তি করে খেতে পারেন না। আর খেতেই যদি না পারেন, তাহলে বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার কোনো মানে হয়?
কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সময় আসে যখন কিছুই করার থাকে না। যেমন আজ। বড় শালীর মেয়ের বিয়ে। না যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। তার পরেও ক্ষীণ একটু চেষ্টা চালিয়েছিলেন। মিন মিন করে স্ত্রীর কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন ছোট ছেলে রবিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। জবাবে স্ত্রী এমন দৃষ্টিতে তাকালো, আর কিছুক্ষণ সেই দৃষ্টির সামনে থাকলে ভষ্ম হয়ে যেতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অগত্যা প্যান্টের ভেতর সার্ট গুজে চুল আচড়ে ট্যাক্সির সন্ধানে মোড়ের সামনে এসে দাঁড়ালেন মিসির আলি। এ শহরে চেষ্টা করলে হয়তো হরিণ ছানা জোগার করা সম্ভব, কিন্তু একটা খালি ট্যাক্সি বা সিএনজি- অসম্ভব।
হন্তদন্ত হয়ে মিনির আলীর সামনে এসে দাঁড়ায় আনোয়ার। 'স্যার কী কোথাও যাচ্ছেন? কী খুঁজছেন, সিএনজি না রিক্সা?'
বেইলি রোড অফিসার্স ক্লাবে যাবো।
'একটু দাঁড়ান-' বলেই সামনে এগিয়ে যায় আনোয়ার এবং মিসির আলিকে অবাক করে দিয়েং একটি নীল রঙের ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে ফিরে আসে।
'স্যার, ভাড়া দিতে হবে না। আমি দিয়ে দিয়েছি।'
এবার বেশ বিরক্ত হন মিসির আলি। 'কেন তুমি ভাড়া দেবে কেন? কতো টাকা হয়েছে আমাকে বলো।' পকেটে হাত ঢোকান মিসির আলী। ততোক্ষণে তার স্ত্রী দু ছেলে নিয়ে এগিয়ে এসে ক্যাবের পেছনের দরজা খুলে ভেতরে উঠে বসেছে। আর এ সুযোগে বড় বড় পা ফেলে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় আনোয়ার।
চার
চুলায় ভাত চড়িয়েছেন মিসির আলি। ফ্রিজে রান্না করা গরুর মাংস আর সবজি আছে। গরম করে নিলেই হবে। চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে মিসির আলির স্ত্রী লুৎফা দুদিনের আন্দাজে মাংস রান্না করে রেখে গেছেন।
শালীর মেয়ের শশুরবাড়ি চট্টগ্রামে। সেখানেই বৌভাত হবে। এ যাত্রায় অনেক কষ্টে বৌকে বুঝিয়ে তিনি থেকে গেছেন। তা ছাড়া কলেজ খোলা। এ সময় কামাই করার কোনো মানেই হয় না।
আকাশে বিদু্ৎ চমকাচ্ছে। উঠে গিয়ে জানালাগুলো বন্ধ করে দেন মিসির আলি। একটু আফসোস হয়। একটু আগে যদি বৃষ্টিটা শুরু হতো তাহলে ভাত না চড়িয়ে খিচুরি রান্না করতেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে চুলা থেকে ভাত নামিয়ে আবার খিচুড়ি চড়িয়ে দেন। কিন্তু একা একা খিচুড়ি মাংস খাওয়াটা তেমন জমে না। কিন্তু কি আর করা!
বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে প্রথমে দরজায় নক করার শব্দ শুনতে পাননি মিসির আলি। কিছুক্ষণ পর নিশ্চিত হন, কেউ কড়া নাড়ছে। এই দুর্যোগের রাতে আবার কে এলো! দরজা খুলে মিসির আলী অবাক। চুপচুপে ভেজা হয়ে আনোয়ার দাঁড়িয়ে।
এই প্রথমবারের মতো আনোয়ারকে দেখে খুশি হয়ে উঠেন মিসির আলি।
এসো এসে ভেতরে এসো। এই তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে ফেল। আর আজকে তুমি আমার সঙ্গে খাবে। নিজ হাতে খিচুরি রান্না করেছি।
একা একা খেতে একেবারেই ভালো লাগেনা মিসির আলির। তাই আনোয়ারকে পেয়ে তিনি দারুন খুশি। মাথা মোছার পর একটি লুঙ্গি আর গেঞ্জিও এগিয়ে দেন তিনি।
না না স্যার লাগবে না।
আরে নাও। জামা প্যান্ট খুলে বারান্দায় ছড়িয়ে দাও।
কাপড় পাল্টে মিসির আলির সঙ্গে লাজুক মুখে খেতে বসে আনোয়ার। খাওয়ার পর একটি সিগারেট ধরিয়ে আনোয়ারের মুখোমুখি বসেন তিনি।
এবার বলো, কী সমস্যার কথা বলতে চাইছিলে তুমি। আমি লক্ষ্য করেছি। বেশ কিছুদিন ধরেই তুমি আমার বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করছো। আমার স্ত্রী-ছেলেরা যে বাড়ি নেই এটা জেনেই তুমি আজ এসেছো। তাই না? ঠিক আছে এবার তোমার সমস্যার কথা শোনা যাক।
কোনো ভুমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করে আনোয়ার।
আমরা অনেক ভাইবোন। চার ভাই পাঁচ বোন। ছোটবেলা থেকেই আমি আমার অন্য ভাইবোনের তুলনায় অনেক বেশি ভিতু। আমার ভাই বোনেরাও এটি নিয়ে আমাকে খুব খেপাতো। তাদের এই আচরণ কখনো কখনো নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পড়তো। যেমন আমাদের গ্রামের বাড়ির টয়লেট ছিল মূল বাড়ি থেকে বেশ দূরে। বিশাল উঠোনের অন্য প্রান্তে বাঁশঝাড়ের কাছে। আমি কখনেই একা একা টয়লেটে যেতে পারতামনা। হাতে-পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম।
তখন ক্লাশ ফাইভে পড়ি। পড়ার মাঝখানে ভিষণ পেশাব চেপেছে। আমার পিঠাপিঠি বোন শিউলিকে অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে টয়লেট পর্যন্ত আসার জন্য। একটা কুপি নিয়ে আমি টয়লেচটর ভেতর গেলাম। দরজাটা খোলাই রাখলাম, আর শিউলিকে অনুরোধ করলাম আমার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দরজার বাইরে অপেক্ষ করতে। কিন্তু একটা পরেই বুঝতে পারলাম শিউলি বাইরে থেকে টয়লেটের দরজার শিকল তুলে দিয়েছে। চরম আতঙ্ক নিয়ে আমি বুঝতে পারলাম শিউলি দৌড়ে উঠোন পেড়িয়ে ঘরে চলে গেছে।
এর পর আমার আর কিছু মনে নেই। পরে শুনেছিলাম, ঠিক সে সময় ঢাকা থেকে বড় মামা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তাকে ঘিরে বাড়িতে একটা আনন্দোর বন্যা বয়ে যায়। মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন রান্না ঘরে। আর ভাই-বোনদের লেখা-পড়ার অঘোষিত ছুটি হয়ে যায়। এতোসব কিছুর মধ্য আমার কথা কারোই মনে পড়ে না। রাতে খাবার সময় প্রথম মা আমার অনুপস্থিতি খেয়াল করেন। পরে টয়লেট থেকে অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করা হয়। এর পর আমি টাইফয়েডে পড়ি। দীর্ঘদিন রোগে ভুগে আস্তে আস্তে সুস্থ্য হয়ে উঠি আমি।
একটানা এতোটুকু বলে ডাইনিং টেবিল থেকে একগ্লাস পানি তুলেয়ক ঢক ঢক করে পুরোটা শেষ করে আনোয়ার।
স্যার কী বিরক্ত হচ্ছেন?
না না, তোমার গল্পতো খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।
আমার গল্পতো স্যার এখনো শুরুই হয়নি। অসুখ থেকে সেরে উঠার পর থেকেই আমার গল্প শুরু।
আনোয়ারের মুখে এই নিরীহ কথাটি শুনেই কেন যেন মিসির আলীর সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠে। জুন মাসের গরমেও কেমন শীত শীত লাগতে থাকে।
কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে আনোয়ার আবার বলতে শুরু করে।
টাইফয়েড আক্রান্ত অবস্থায় চারপাশে নানা রকম বিচিত্র জিনিস দেখতে থাকি আমি। হয়তো প্রবল জ্বরে আচ্ছন্ন থাকায় নানা রকম উদ্ভট আকৃতির দেখা পাচ্ছিলাম। কিন্তু জ্বর সেরে গেলেও নিজের ভেতর বিচিত্র ধরণের পরিবর্তন টের পাই। সব সময় মনে হয়, আমি একা নই; আমার স্বত্তার সঙ্গে আরো কেউ কেউ আছে। সাদা চোখে দেখা না গেলেও তাদের অস্বিত্ব অনুভব করি। মাঝে মাঝে এই অনুভব এতোটাই তীব্র হয়ে উঠে যে আমি ভয়ে কুকড়ে যাই। কিন্তু কারো সঙ্গেই এই দু:সহ অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে পারি না। এভাবেই চলতে থাকে আমার জীবন। তবে সেই ঘটনার পর আমার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ বেড়ে যায়। ফল পাই হাতেনাতে। পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হতে থাকে।
আগেই বলেছি, আমার অনেক ভাই-বোন। তাই রাতে একই ঘরে এক বিছানায় আমরা বেশ কয়েকজন ঘুমাতাম। এসএসসি পরীক্ষার পর বরিশালে খালার বাড়ি বেড়াতে যাই। আর সেখানেই ঘটে প্রথম ঘটনা।
বরিশাল শহর থেকে একটু দূরে খালার বাড়ি। মাছের ব্যবসায়ী খালুর অবস্থা বেশ ভালো। আনন্দেই দিন কাটছিলো। একদিন কী একটা কাজে হঠাৎ খালুকে ঢাকা যেতে হলো। সঙ্গে খালাও গেলেন। বাড়িতে আমার সমবয়সী খালাতোভাই আর আমি। রাতে খাওয়ার পর একটু তাড়াতাড়িই দুজন শুয়ে পড়ি। আমার এখনও সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে, সে রাতে শুধু আমরা দুজনই ছিলামনা। আমাদের সঙ্গে আরো কেউ কেউ ছিল। এদের কেউ এই জগতের বাসিন্দ নয়, এটাও স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম। চারপাশে কেমন যেন ফিসফিস, গোঙ্গানির শব্দ পাচ্ছিলাম আমি। খালাতো ভাই তখন ঘুমিয়ে কাদা। বিছানায় কাঠ হয়ে শুয়ে আমি দরদর করে ঘামছি। এক সময় আমিও ঘুমে ঢলে পড়ি।
পরদিন সকালে আমার পাশে শোয়া খালাতো ভাইয়ের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এ নিয়ে বিস্তর ঝামেলা হয়। ব্যপারটা থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারি পর্যন্ত গড়ায়। পরে পুলিশ খালুর ব্যবায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বীকে গ্রেপ্তার করে। বিলের ইজারা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই খালুর সঙ্গে তাদের বিরোধ চলছিলো। দু পক্ষের মধ্যে একাধিকবার এ নিয়ে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে।
আপাতত বিষয়টি মিটে গেলেও আমার ভেতর একটি বিরাট খটকা লেগেই থাকে। পুলিশ যাই বলুক, আমি জানি এই খুনের জন্য অন্য কেউ বা অন্য কিছু দায়ী, দায় অনেকটা আমারও আছে।
এ ঘটনার পর দীর্ঘদিন কেটে গেছে। কোথাও, কারো সঙ্গে একা রাতে থাকিনি। কোথাও বিছানা বা রুম শেয়ার করতে হলে সব সময় চেষ্টা করেছি এক সাথে অন্তত তিনজন থাকার। কারণ আমার মনে ততোদিনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, আমার সঙ্গে একা ঘরে কেউ নিরাপদ নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর মহসিন হলে ভাগ্যক্রমে সিঙ্গেল রুম পেয়ে যাই। বুক থেকে যেন পাষান ভার নেমে যায়। ডবল রুম পেলে নির্ঘাত আমাকে মেসে গিয়ে সিট ভাড়া করতে হতো, যেখানে এক ঘরে অন্তত তিন/চারজন থাকে। যাই হোক, ভালোভাবেই দিন কাটছিলো। এ সময় মারা গ্রাম সম্পর্কের এক চাচাতোভাই ঢাকা এলেন চাকরির খোঁজে। বাস লেট করায় রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় আমার হলে এসে উপস্থিত। পরদিন ছিল আমার কোর্স ফাইনাল। তাকে দেখেই আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। এখন এই আপদকে কিভাবে আমার রুম থেকে তাড়াই। এতো রাতে তাকে কোথায় পাঠাবো। কিংবা আমিইবা কোথায় যাবে। এদিকে পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে হবে। বসে বসে এসব সাত-পাঁচ ভাবছি, ততোক্ষণে আমার উটকো অতিথি প্যান্ট বদলে লুঙ্গি পরে আয়েশ করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। দীর্ঘ ভ্রমন ক্লান্তির কারণে একটু পরেই তার নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাই।
পড়া মাথায় উঠেছে। টেবিলে বসে বসে নিজের হাত কামড়াচ্ছি। রাতটা হলের বারান্দায় কাটাবো বলে স্থির করলাম। দরজাটা ভেজিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে মশার কামড় খেতে খেতে ঘুমে ঢুলতে থাকি।
সকালে রুমে ঢুকে পাথর হয়ে যাই। বিছানায় চোখ উল্টে পড়ে আছে আমার অতিথি। এক পলক দেখেই বুঝতে পারি, অনেক আগেই তার মৃতু হয়েছে। এবার আর অত সহজে পার পেলাম না। আমার কামড়ায় একজন বহিরাগত কেন এবং কিভাবে তার মৃতু্য হলো--এসব প্রশ্নের কোনো জবাবই ছিলনা আমার কাছে। কয়েক মাস হাজত খেটে অনেক ঝামেলার পর আইনের শাস্তি এড়ানো সম্ভব হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইতি টানতে হয়।
আবারও দম নেওয়ার জন্য থামে আনোয়ার। মিসির আলি এতোক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে। প্যাকেট থেকে বের করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
এরপর কী হলো?
এরপর আজ পর্যন্ত একা ঘরে কারো সঙ্গে রাতে থাকিনি। কিন্তু স্যার, এখন আমার সামনে বড় বিপদ। বাড়ি থেকে আমার জন্য মেয়ে দেখছে। বাবা-মা চাপাচাপি করছে বিয়ের জন্য। কিন্তু বিয়ের পরতো আর শোবার ঘরে বউ ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে থাকা সম্ভভ না।
এতোক্ষণে আনোয়ারের সমস্যা উপলব্ধি করতে পারেন মিসির আলি। একটু হেসে বলেন,
এ যুগে কেউ কি ভুত-প্রেত, অশরীরী কিছু বিশ্বাস করে? তুমি কী কোনো মানষিক চিকিৎসককে দেখিয়েছো?
দেখিয়েছি স্যার, কিন্তু জানি কোনো লাভ নেই। ডাক্তার কবিরাজ কিছু করতে পারবে না। ওদের হাত থেকে আমার মুক্তি নেই। এখন মাঝে মধ্যে ওদের সঙ্গে আমি যোগাযোগও করতে পারি। অবশ্য সেটা আমার জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। কিন্তু আমি জানি, আমার সঙ্গে একা ঘরে কেউই নিরাপদ নয়।
আনোয়ারের কথা শুনে আস্তে আস্তে শীতল আতঙ্ক ভর করতে থাকে মিসির আলির উপর। মিসির আলির চোখে চোখ রেখে আনোয়ার বলে উঠে,
আপনিতো মিসির আলি। আপনার অনেক বুদ্ধি। অনেক অলৌক বিষয়ের লৌকিক সমাধান দিয়েছেন আপনি। আজকে আপনার কাছ থেকে আমার সমস্যার একটা সমাধান নিয়ে যাবো। আজ রাতটা আমি আপনার সঙ্গেই কাটাবো।
কেউ যেন কাঠের চেয়ারের সঙ্গে পেরেক ঠুকে আটকে দিয়েছে মিসির আলিকে।
তিনি বলতে চেষ্টা করেন, গল্পের মিসির আলি অন্য কেউ; যার আছে অসাধারণ বুদ্ধি আর বিশ্লেষণ ক্ষমতা। আমার এসব কিছুই নেই।
কিন্তু ততোক্ষণে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন মিসির আলি। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। দরদর করে ঘামতে ঘামতে মিসির আলি এই মুহুর্তে কাল্পনিক চরিত্র ক্ষুরধার বুদ্ধির মিসির আলির অভাবটা তীব্রভাবে অনুভব করেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১১:৫৮