Amidst the tens of thousands of names of monarchs that crowd the columns of history ...the name of Asoka shines, and shines almost alone, a star.
ইতিহাসের লক্ষ-কোটি নৃপতির নামের ভিড়ে অশোক নামটি একাকী একটি নক্ষত্রের মতন জ্বলজ্বল করছে ।
অশোক তাঁর প্রজাদের সন্তানতুল্য মনে করতেন। খৃঃ পূঃ ২৬২-২৬১ অব্দে সংঘটিত কলিঙ্গ যুদ্ধটি অশোকের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব সম্পূর্ণরূপে পালটে দেয়; তিনি অহিংস শান্তিবাদী বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেন। যে কারণে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপর লিখেছেন, ‘অশোকা ওয়াজ সারটেইনলি অ্যাট্রাক্টেড টু বুডইজম অ্যান্ড বিকেইম আ প্রাকটিসিং বুড্ডিস্ট।’ (আ হিস্ট্রি অভ ইন্ডিয়া; প্রথম খন্ড; পৃষ্ঠা;৮৫ ) অশোক তাঁর ধর্মীয় নীতিকে ‘ধম্ম’ বলে অবহিত করেছেন। এবং এই ধম্ম প্রচারে তিনি ‘অনারম্ভ প্রাণায়াম’ (প্রাণিহত্যা না করা) এবং ‘অভিহিশ ভূতানাম’ (জীবিত প্রাণির ক্ষতি না করা) নীতি গ্রহন করেন এবং পাথরের স্তম্ভের ওপর ধর্মীয় বাণী খোদাই করে প্রচার করার আদেশ দেন। তবে অশোকের এই ধম্ম প্রচারের ভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনও সম্ভব ... এই পোস্টে এই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
সম্রাট অশোকের সময়কার প্রাচীন ভারতের মানচিত্র। পশ্চিমে আফগানিস্তান; পুবে বাংলাদেশ; উত্তরে আসাম; দক্ষিণে কেরালা এবং অন্ধ্র প্রদেশ ছিল অশোকের বিশাল সাম্রাজ্যটির সীমানা। এর মধ্যে অনেক রাজ্য ছিল। তবে সবচে শক্তিশালী রাজ্য ছিল মগধ। মগধের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র (বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্য )। অশোকের রাজপ্রাসাদটি পাটলিপুত্র নগরীতে অবস্থিত ছিল।
অশোক সম্বন্ধে জানার উৎস প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য এবং পুরাতত্ত্ব। সাহিত্য বলতে ‘দিব্যবদান’ এবং সিংহলী ইতিবৃত্ত বোঝায়। ‘দিব্যবদান’ সংস্কৃত ভাষায় লেখা এবং এর অন্তর্ভুক্ত ‘অশোকাবদান’ (অশোকের জীবনী) । সিংহলী ইতিবৃত্ত দুটি: দীপবংশ এবং মহাবংশ। এই দুটি গ্রন্থই পালি ভাষায় লেখা। সে যাই হোক। অশোকের জন্ম খৃঃ পূঃ ৩০৪ অব্দে। পিতার নাম বিন্দুসার। পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠাতা । পিতার মৃত্যুর পর অশোকের বড় ভাই সুমন মগধের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু, বিচক্ষন মন্ত্রীরা এবং উচ্চপদস্থ রাজন্যবর্গ সুমনকে যোগ্য মনে করতেন না। রাজন্যবর্গ অশোককে মগধের সিংহাসনে বসাতে ইচ্ছুক ছিলেন। কাজেই দু'পক্ষের যুদ্ধ বাঁধল। তিন বছরের যুদ্ধের পর খৃঃ পূঃ ২৭২ অব্দে অশোক মগধের সিংহাসনে বসলেন।
মৌর্যযুগের রিংস্টোন। পাথরের ওপর খোদাই করা সূক্ষ্ম কারুকাজ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর ভারতবর্ষের শিল্পকলায় উন্নতির চিহ্ন বহন করছে।
অশোক ছিলেন দক্ষ শাসক । তিনি যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মৌর্য সাম্রারাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করলেন। অশোকের রাজত্বকালে মৌর্য শাসন ছিল এককেন্দ্রিক । অশোক ছিলেন কেন্দ্রের মাঝমধ্যিখানে। রাজকীয় কর্মচারীরা অশোকের কাছেই কেবলমাত্র দায়বদ্ধ থাকত, রাষ্ট্রের কাছে নয়।
বাংলাদেশ-ফরাসি যৌথ প্রত্নতাত্ত্বিক দল বাংলাদেশের বগুড়ার মহাস্থানগড়ে মৌর্যযুগের প্রাচীর খুঁড়ে বের করেছে
মৌর্য শাসনের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ছিল গুপ্তচর সংস্থা। কৌটিল্য ছিলেন অশোকের পিতামহ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী/উপদেস্টা। কৌটিল্যের লেখা অর্থশাস্ত্র বিখ্যাত বই। এ বইতে তিনি রাষ্ট্র্রের স্বার্থে গুপ্তচরবৃত্তির প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করেছেন। কৌটিল্যের উপদেশ দিল: গুপ্তচররা সন্নাসী, ভবঘুরে, গৃহী, বণিক, ছাত্র, চিকিৎসক, নারী ও যৌনকর্মীর ছদ্মবেশে কাজ করবে। গুপ্তচরের মাধ্যমে অশোক সাম্রাজ্যের দূরবর্তী প্রান্তের খুঁটিনাটি বিষয় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন ।
অশোকের চিত্তাকর্ষক জীবনের ওপর বলিউডে ছবি হয়েছে। সেরকমই একটি ছবির পোস্টার ।
ক্ষমতা লাভের আট বছরের মাথায় অশোক উড়িষ্যায় সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। উদ্দেশ্য সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ। উড়িষ্যার কলিঙ্গ অঞ্চলের দায়া নদী; সেই দায়া নদীর তীরে ধৌলি পাহাড়ের পাদদেশে দু'পক্ষের ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সমসাময়িক বৌদ্ধ সাহিত্যে লেখা আছে ...
ছিন্নভিন্ন মৃত সৈন্যের রক্তে দায়া নদীর জল রক্তিম হইয়া উঠিয়াছিল। কলিঙ্গ যুদ্ধে অশোক জয়লাভ করিলেন বটে তবে অজস্র মৃত্যু ও রক্তপাত দর্শন করতঃ তাঁহার পাষান হৃদয় গলিয়া গেল। তাঁহার লৌহহৃদয় ভাঙিয়া গেল। তিনি গভীর আত্মগ্লানিতে ভুগিতে লাগিলেন। রক্তপাত দর্শনে তাঁর মন করুণার্দ্র হইয়া উঠিল। তিনি যুদ্ধবিগ্রহে বিতৃষ্ণ হইয়া ভাবিলেন আর যুদ্ধ নহে। এইরূপ ভাবিয়া তাঁহার হৃদয়ে হাহাকার ধ্বনি উঠিল। তাঁর সান্ত্বনা দরকার। বুদ্ধের অহিংসবাণীতে তিনি সান্ত্বনা লাভ করিলেন। তিনি বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হইলেন ...
এই কাহিনি আমরা কমবেশি জানি। তবে সম্রাট অশোককে পশ্চিমে আফগানিস্তান; পূবে বাংলাদেশ; উত্তরে আসাম; দক্ষিণে কেরালা এবং অন্ধ্র প্রদেশ অবধি বিস্তিৃত এক সুবিশাল সাম্রাজ্যের পরিচালনা করতে হয়েছিল। আগেই একবার বলেছি অশোক তাঁর ধর্মীয় নীতিকে ‘ধম্ম’ বলে অবহিত করেছেন।এবং পাথরের স্তম্ভের ওপর ধর্মীয় বাণী খোদাই করে প্রচার করার আদেশ দেন। এখানে লক্ষণীয়:
১. পাথরের স্তম্ভের ওপর খোদাই করে প্রচার করা ধর্মীয় বাণী অশোকের নিজস্ব; মহামতি বুদ্ধের নয়।
২. সম্রাট অশোক ধম্ম গ্রহন করার পরও গুপ্তচর সংস্থা বিলোপ করেন নি।
অশোক স্তম্ভের ওপর অশোকলেখ। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোকের নির্দেশে পাথরের স্তম্ভের ওপর খোদাই করে ধর্মীয় অনুশাসন প্রচার করা হয়েছিল। এই পাথরের স্তম্ভগুলি অশোকস্তম্ভ নামে পরিচিত। আর লেখাগুলিকে বলা হয় অশোকলেখ।
বৌদ্ধ সাহিত্য যদিও একজন নিষ্ঠুর রাজার কথা রয়েছে যিনি একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের পর বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং ভারতবর্ষ জুড়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যায়বিচার, শান্তি ও পূণ্য - তবে অশোক সম্বন্ধে উনিশ শতক অবধি সুনিদিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্যের বড় অভাব ছিল। আমি আগেই বলেছি অশোক সম্বন্ধে জানার উৎস প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য এবং পুরাতত্ত্ব। সাহিত্য বলতে ‘দিব্যবদান’ এবং সিংহলী ইতিবৃত্ত বোঝায়।এগুলি তে লাগামহীন কল্পনার উপাদান থাকায় ঐতিহাসিকদের কাছে গ্রহনযোগ্য ছিল না। উনিশ শতকে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে পাথরের স্তম্ভের ওপর অশোকলেখ আবিস্কৃত হয়।১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা টাকশালের কর্মচারি এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত জেমস প্রিনসেপ সর্বপ্রথম অশোকলেখর পাঠোদ্ধার করেন।( কলকাতার গঙ্গাপাড়ের প্রিনসেপ ঘাটটি এঁর নামেই রাখা হয়েছে।)
অশোকলেখ।বেশির ভাগ অনুশাসনের ভাষা প্রাকৃত; লিপি ব্রাহ্মী। তবে দুটি অনুশাসন খরোষ্ঠী ভাষায় লেখা। কয়েকটি অনুশাসন আবার লেখা হয়েছিল গ্রিক এবং আরমীয় ভাষায় ।
একটি অশোকলেখ পাঠ করা যাক-
‘ধম্মা সাধু, কিয়াম কু ধাম্মে তি? আপাসিনাভে, বাহু কায়ানে, দায়া, দানে, সাসি, সোচায়ে।’
এই বাণীটি মৌর্য সম্রাট অশোক- এর একটি ধর্মীয় বাণী। তবে ভাষাটি প্রাকৃত না পালি তা আমি বলতে পারছি না। তবে এর বাংলা মানে হল:
‘ধর্ম উত্তম, কিন্তু, ধর্মে কি রয়েছে? ধর্মে রয়েছে অল্প পরিমান অশুভ, বেশি পূণ্য, দয়া, বদান্যতা, সত্যবাদিতা এবং শুদ্ধতা।’
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক তাঁর ধম্ম প্রচারে ‘প্রাণিহত্যা না করা’ এবং ‘জীবিত প্রাণির ক্ষতি না করা’ ইত্যাদি নীতি গ্রহন করেছিলেন। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে অশোক এই বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এইরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
অশোকের সময় মৌর্য রাষ্ট্রের শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। অর্থশাস্ত্রের প্রনেতা কৌটিল্যকে যে সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি অশোককে তাই হতে হয়েছিল। এই সমস্যাটি ছিল বিভিন্ন শ্রেণির স্বার্থের সংঘাত এড়ানো। এই ক্ষেত্রে অশোকের অন্যতম হাতিয়ার ছিল -তাঁর ‘ধম্ম’ । ধম্মের মধ্যে শাসক এবং প্রজা সাধারণ অভিন্ন কাতারে এসে মিলেছিল।
মধ্যপ্রদেশের ভূপাল-এর বৌদ্ধদের পবিত্র তীর্থ সাঁচী স্তূপ।অশোকের অন্যতম কীর্তি। এটিই ভারতবর্ষের সবচে পুরনো পাথরের স্তূপ ।
মৌর্যযুগে জীবনধারায় মৌলিক পরিবর্তন ঘটছিল। এই জীবনধারা আগে ছিল যাযাবর এবং পশুচারণ ভিত্তিক। নতুন আর্যসংস্কৃতি ছিল অপেক্ষাকৃত স্থির এবং নগরকেন্দ্রিক। নগরজীবন সংহত করার জন্যে প্রয়োজন ছিল সুর্নিদিষ্ট সামাজিক সংগঠনের ।
সাঁচী স্তূপ এর উত্তরের অলঙ্কৃত তোরণদ্বার
তাছাড়া মৌর্যসমাজটি ছিল জটিল। এই সমাজে বণিক শ্রেণি নতুন স্বীকৃতি অর্জন করতে চেয়েছিল। ব্রহ্মণরা এই জটিলতা অবসানের জন্যে সমাজে জাতিভেদ প্রথা কঠোর করার উদ্যেগ নিয়েছিল। অপরদিকে বৌদ্ধধর্মে একটি বিশ্বজনীন এবং সামাজিক সচেতনার দিক রয়েছে। যেটি অশোক উপলব্দি করেছিলেন। কৃতকর্মের জন্য ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের জন্য বুদ্ধের বাণীকেই অশোক শ্রেষ্ঠতর সমাধান বলে মনে করেছিলেন। যে কারণে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার তাঁর A History of India বইতে লিখেছেন:
Dhamma was aimed at building up an attiude of mind in which social responsibility, the behaviour of one person towards another, was considered of great relevance.’ (page 86)
তাছাড়া, আমি আগেই বলেছি, মৌর্যসাম্যারাজ্যটি ছিল কেন্দ্রীয় শাসনভিত্তিক। কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য অনিবার্য আমলাতন্ত্র, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং একজন শক্তিশালী শাসক। কাজেই কেন্দ্রীয় শাসনকে সংহত করতে অশোক-এর সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। এক: কৌটিল্যের নির্মম নীতি গ্রহন; দুই: নতুন ধর্মমত প্রচার। অশোক একটি নতুন ধর্মমত প্রচার করে সেই ধম্মের মাধ্যমে সাম্রারাজ্যের সংহতি জোরদার করতে চেয়েছিলেন। (বহুবছর পর মুগল সম্রাট আকবরও তাই করেছিলেন।) রাজনৈতিক দিক থেকে এই ধর্মমত গ্রহন করে অশোক জনগনের উদার সহনশীল অংশের সমর্থন লাভ করতে চেয়েছিলেন। এই অংশে বণিক শ্রেণি থাকায় তাদের সমর্থন অশোকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন,
সাংস্কৃতিক দিক থেকেও মৌর্য সাম্রারাজ্যের অভ্যন্তরে বহুতর বৈষম্য ছিল। তাই অশোক নতুন ধর্মমত গ্রহন ও প্রচারের মধ্যে একটি প্রয়োজনীয় বন্ধনগ্রন্থি খুঁজে পেয়েছিলেন।( প্রাচীন ভারতের ইতিহাস; প্রথম খন্ড ;পৃষ্ঠা ২১৫)
ওই একই কারণে ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার লিখেছেন:
Buddhism of his age was not merely a religious belief; it was in addition a social and intellectual movement at many levels, influencing many aspects of soceity . ( A History of India.Vol.1; page, 85)
ছবি: ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায়; প্রাচীন ভারতের ইতিহাস; প্রথম খন্ড
Romila Thapar; A History of India.Vol.1
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ৯:৪০