ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীটি সর্ম্পকে ধারাবাহিকভাবে লিখছি। গত পর্বে আমি দেখিয়েছি যে- ‘ফ্রিম্যাসোনারি গোষ্ঠীর সঙ্গে মধ্যযুগের ক্রসেড-যুগের নাইট টেম্পলার দের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।’ চতুদর্শ শতকে যাদের ওপর ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগে গির্জা এবং রাষ্ট্রের খড়গ নেমে আসে । তা সত্ত্বেও তাদের অনেকেই স্কটল্যান্ড এবং অন্যত্র পালিয়ে যেতে পেরেছিল। এ প্রসঙ্গে Born in Blood, The lost secrets of Freemasonry বইতে জন জে. রবিনসন লিখেছেন: ...some French Templars fled to Scotland after the suppression of the Order, fearing persecution from both Church and state. ফেরারি নাইট টেম্পলাররা স্কটিশ stonemason দের কুটিরে অর্থাৎ লজে আশ্রয় নেয়। তারা মেইসনদের আনুগত্য এবং virtues of chivalry শেখায়। কী ভাবে? মেইসনদের হাতিয়ারগুলি প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়ে। এভাবে নাইট টেম্পলার সংঘটি এক নতুর রূপ নেয়। স্কটল্যান্ডের রোজলিন নামে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে নির্মিত একটি গির্জায় সেই রূপান্তরের ছাপ স্পষ্ট। তারপর ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে ম্যাসনদের United Grand Lodge of England প্রতিষ্ঠিত হয়। রবিনসন মনে করেন, তার আগ পর্যন্ত নাইট টেম্পলারদের সংঘটি স্কটিশ stonemason দের মধ্যে টিকে ছিল। এরপর ইউরোপে সামাজিক পরিবর্তন আসে, ফলে নাইট টেম্পলারদের মেইসনিক লজেও আমূল পরিবর্তন আসে ...যা এই পর্বের আলোচনার বিষয় ...
নাইট টেম্পলার। ‘ আমাদের আলোচ্য ফ্রিম্যাসোনারি গোষ্ঠীর সঙ্গে মধ্যযুগের ক্রসেড-যুগের নাইট টেম্পলার দের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।’
মধ্যযুগের মেইসনদের (মেইসন= somebody who works with stone) সঙ্গে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। প্রথম কারণটি ওপরে উল্লেখ করেছি। দ্বিতীয় কারণটিও গত পর্বে উল্লেখ করেছি ... নাইট টেম্পলারদের সংঘটি মধ্যযুগের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করেছিল বলে অধ্যধিক সম্পদশালী হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাঙ্কের ওপর ইউরোপের ধনী অভিজাত এবং শাসকবর্গের আস্থা ছিল। সুতরায় নাইটরা হয়ে ওঠে ধনী ব্যাঙ্কার এবং এভাবে তারা প্রভূত অর্থের মালিক হয়ে ওঠে। এবং সে অর্থে তারা ইউরোপজুড়ে বিশাল বিশাল সব দূর্গ এবং ক্যাথিড্রাল নির্মান করেছিল এবং এর ফলে তারা প্রথম Stonemason দের সংস্পর্শে আসে। মেইসনদের বিশেষ কারিগরি জ্ঞান ছিল- যে জ্ঞানকে আধ্যাত্মিক ভাবা হত, হয়তো আজও ...জ্যামিতি তো কেবল গণিতের শাখা নয় ... সে অপার্থিব এক জগতের ইঙ্গিত দেয় ... এই জ্ঞানের সঙ্গে নাইট টেম্পলারদের নিজস্ব নিগূঢ় জ্ঞানের সংযোগ ঘটেছিল। যে জ্ঞানের সমন্বয়ের ফলে পরবর্তীকালে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর উদ্ভব বলে অনেকেই মনে করেন। জেরুজালেমের ‘টেম্পল মাউন্ট’-এ নাইট টেম্পলারদের আদি খ্রিস্টীয় ‘গুপ্তজ্ঞান’ আবিস্কারের ফলেই ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর সঙ্গে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর টেম্পল অভ সলোমনের প্রধান স্থপতি বা Master Mason হাইরাম আবিফ এর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়নি ...
পিরামিড- এর নকশা। এর পিছনে যে গাণিতিক এবং জ্যামিতিক জ্ঞান ছিল, সেই জ্ঞানকে প্রাচীন এবং মধ্যযুগে ঐশ্বরিক জ্ঞানের সমতূল্য মনে করা হত ...পরবর্তীকালে Illuminati ( যাদের সঙ্গে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর সম্পর্ক ঘনিষ্ট ) আরেক গুপ্তগোষ্ঠীর প্রতীক হয়ে ওঠে পিরামিডের ওপর ‘All-Seeing Eye’ যে প্রতীকটি ১৯৩৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ডলার বিলের ওপর ছাপা হয়েছিল!
মানবসভ্যতায় পাথর কেটে স্থাপত্য নির্মাণ বহু প্রাচীন ঐতিহ্য। এ ক্ষেত্রে প্রাচীন মিশরই পথিকৃৎ । বিশেষ করে প্রাচীন মিশরের পিরামিড যুগের মেইসনরা বিশেষ এক গাণিতিক জ্ঞান আয়ত্ম করেছিল, যাকে গূহ্য এবং নিগূঢ় মনে করা হত। পরবর্তী যুগের মেইসনরা পিরামিড নির্মাণকারী সেই আদি মেইসনদের শ্রদ্ধা করত। কারিগরি ও গাণিতিক জ্ঞান অনেকটা গুপ্ত উপায়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছিল। খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকে যে টেম্পল অভ সলোমন নির্মিত হয়েছিল -যার ‘মাস্টার মেইসন’ ছিলেন হাইরাম আবিফ -তাঁরও প্রেরণা ছিল প্রাচীন মিশরের মেইসনগণ; যাদের স্থাপত্য-জ্ঞান কেবল বিশুদ্ধ গানিতিক জ্ঞানই ছিল না, সেই জ্ঞানে ছিল গভীর রহস্যে আধার ...
মার্কিন এক ডলার বিলের ওপর পিরামিডের ছবি। (এই বিষয়টি পরবর্তী পর্বগুলিতে আলোচনা করা হবে ... )
প্রাচীন মেইসনদের নিগূঢ় এবং রহস্যময় কারিগরি জ্ঞান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মধ্যযুগ পৌঁছেছিল। মধ্যযুগের ক্যাথিড্রাল এবং দূর্গ নির্মাণকারী মেইসনরা সেই জ্ঞান প্রয়োগ করেছিল। এখানে ‘মেইসন’ শব্দটির উৎপত্তি সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলে নিতে চাই। তা হলো: The name may also come from the French word “Maçon,” which refers to a mason working in a Lodge allowed to work on Church property free from taxation or regulation by the King or the local government. The origins of the word may also stem from the French term "frere Macon" which translated literally into "brother Mason."
কর্মরত মধ্যযুগের মেইসন। এদের জ্ঞানের ভিত্তি ছিল প্রাচীন পিরামিড যুগের স্থাপত্যকৌশল যা সলোমন টেম্পলের প্রধান স্থপতি হাইরাম আবিফ এর ‘নিগূঢ় জ্ঞানে’ সমৃদ্ধ হয়ে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিডের গভীর প্রজ্ঞায় জাড়িত হয়ে তাদের কাছে পৌঁছেছিল ...
মধ্যযুগের ইউরোপে ক্যাথিড্রাল নির্মাণের যুগে মেইসনরা ছিল স্বাধীন। এর অর্থ- তারা ইউরোপের যে কোনও অঞ্চলে সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যেতে পারত । এই কারণে তাদের বলা হত Freemason. তাদের বিশেষ কারিগরি জ্ঞান থাকলেও তারা ছিল শিক্ষাবঞ্চিত; তারা লিখতে-পড়তে জানত না। সে জন্য তারা নিজেদের মধ্যে বিশেষ সঙ্কেত ব্যবহার করত। এর অন্যতম অন্যতম হল করমর্দন বা handshake । কেননা...when he arrived at a new site, to prove that he was properly trained and had been a member of a lodge ...অবশ্য তাদের করমর্দন ছিল ভিন্ন ধরনের। এর কারণ আছে। আমি প্রথম পর্বে লিখেছি যে ... হাইরাম আবিফ-এর হত্যাকান্ডটি ঘটেছিল দুপুর বেলায়। খুনিরা তাঁর মৃতদেহ রাবিশের নীচে লুকিয়ে রাখে এবং রাত্রে অত্যন্ত গোপনে নিকটবর্তী এক পাহাড়ে সমাহিত করে। পরের দিন খুনিরা ধরা পড়ে এবং ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে রাজা সলোমনের কানে যায়। তিনি করিগরদের নিয়ে পাহাড়ে যান। তারপর কারিগররা হাইরাম আবিফ কে কবর থেকে টেনে তুলতে ব্যর্থ হলে রাজা সলোমন প্রবল বিক্রমে সিংহের থাবায় হাইরাম আবিফ কে কবর থেকে টেনে তোলেন এবং যাদুকরী শক্তিতে নবজীবন দান করার চেষ্টা করেন । ...এই টেনে তোলার বিশেষ ধরণের কারণেই মেইসনদের করমর্দন ছিল ভিন্ন ধরনের। আমাদের মনে রাখতে হবে মধ্যযুগের মেইসনদের কাছে রাজা সলোমন এবং হাইরাম আবিফ ছিলেন আদর্শস্থানীয়। রাজা সলোমনের ‘গ্রিপ’ ভিন্ন ছিল বলেই মেইসনদের ‘গ্রিপ’ও ভিন্ন ধরনের। বর্তমান কালেও ফ্রিম্যাসনদের handshake ভিন্ন ধরনের যা ওই গোষ্ঠীর বাইরে সাধারণ মানুষ ব্যাপক কৌতূহল ও বিস্ময় সৃষ্টি করে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফ্রিম্যাসন গোষ্ঠীর একজন সদস্য জর্জ বুশ এর handshake ...
স্কটল্যান্ডের জেডবরো ক্যাথিড্রাল । মধ্যযুগের মেইসনদের এক অনন্য সৃষ্টি। একটু আগেই উল্লেখ করেছি ... পিরামিড যুগের প্রাচীন মেইসনদের নিগূঢ় এবং রহস্যময় কারিগরি জ্ঞান প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মধ্যযুগ পৌঁছেছিল। মধ্যযুগের ক্যাথিড্রাল এবং দূর্গ নির্মাণকারী মেইসনরা সেই জ্ঞান প্রয়োগ করেছিল।
মধ্যযুগের ফ্রিম্যাসনদের বলা হত operative mason. এর অর্থ তারা কর্মরত। তারা বাস করত কুটিরে। এই কুটিরগুলোকে বলা হত ‘লজ’; সাদামাটা লজগুলি তৈরি করা হতো নির্মীয়মান ক্যাথিড্রাল বা দূর্গের আশেপাশে। ফ্রিম্যাসনরা ছিল দরিদ্র; তবে জ্ঞানী। তাদের হৃদয়ে ছিল জ্ঞানের আলো। তারা লজে বসে নানা বিষয়ে আলোচনা করত। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মহাবিশ্বের 'মাস্টার ম্যাসন' ঈশ্বর, গণিত এবং তার অপার বিস্ময়। কখনও প্রাচীন পিরামিডের স্থাপত্য কৌশল ... কখনও-বা খ্রিস্টপূর্ব দশম শতকে জেরুজালেমে নির্মিত টেম্পল অভ সলোমন -এর ‘মাস্টার মেইসন’ হাইরাম আবিফ ...
জেডবরো ক্যাথিড্রাল ।
মধ্যযুগের ফ্রিম্যাসনদের সমাজে গোপন কৃত্য (রিচুয়াল) ছিল বলে মনে করা হয়। (এই গোপন কৃত্য এদের মধ্যে আগে থেকেই প্রচলিত ছিল, নাকি বিষয়টি নাইট টেম্পলাররা প্রচলন করেছিল সে বিষয়ে প্রকৃত তথ্য জানা যায়নি। অনুমান করা হয় মেইসনরা প্রাচীনকাল থেকেই নিজেদের একটি আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে ভাবতে অভ্যস্থ ছিল ...) ...সেই যাই হোক। মধ্যযুগের ফ্রিম্যাসনদের সমাজে তিনটি ডিগ্রি ছিল। যেমন, (১) Entered Apprentice – দীক্ষার প্রাথমিক স্তর। (২) Fellow Craft – এটি মধ্যবর্তীকালীন ডিগ্রি, এসময় নানা ধরণের শিক্ষালাভ হয় (৩) Master Mason– এই ডিগ্রি না-হলে গোষ্ঠীর অন্যান্য গোপন কৃত্যে অংশ নেওয়া যায় না। Master Mason হওয়াই একজন প্রাথমিক ফ্রিম্যাসনারি সদস্যের মূল লক্ষ।
জেডবরো ক্যাথিড্রাল ।
মধ্যযুগের মেইসনরা ষোড়শ শতকে গঠন করেছিল সংঘ বা guild; সেই গিল্ডে ছিল গনতন্ত্র এবং সাম্য। মাস্টার মেইসনকে গনতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত করা হত। গিল্ডের সদস্যরা সহযোগী কারিগরদের (এদের বলা হয় ‘ Fellow Craft’) ভালোমন্দের খোঁজখবর নিত। কেনন, তৎকালীন মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রটি কল্যানমূলক ছিল না। কোনও মেইসন অসুস্থ হলে বা মৃত্যুবরণ করলে কোনও ধরণের রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছিল না। সুতরাং মেইসনদের গিল্ড তহবিল গঠন করেছিল।
ফ্রিম্যাসনদের প্রতীক।
পরবর্তীতে মেইসনদের লজে যোগ দিয়েছিল একদল স্বশিক্ষিত এবং জ্ঞান অনুরাগী আলোকিত মানুষ। পরবর্তীকালে যাদের বলা হয় speculative mason. এই আলোকিত মানুষগুলি gentlemen masons নামেও পরিচিত ছিল। কিন্তু মেইসনদের লজে সেই সব স্বশিক্ষিত এবং জ্ঞান অনুরাগী আলোকিত মানুষদের যোগ দেওয়ার কি কারণ? মেইসনদের লজগুলি ছিল অনেকটা আজকের যুগের ‘পাঠচক্রের’ মতো, যেখানে জ্ঞানচর্চা হত। ফ্রিম্যাসনদের প্রতীক ছিল কম্পাস এবং স্কয়্যার; এবং এর মানে সহজেই বোঝা যায়। মাঝখানের ইংরেজি 'G’ অক্ষরটি God এবং Geometry এ দুটি শব্দের প্রতীক। ফ্রিম্যাসনরা মনে করে ঈশ্বর হলেন মহাবিশ্বের Grand Architect এবং জ্যামিতির জ্ঞান ব্যতীত স্থাপত্যবিদ্যা সম্ভবপর নয়। এ কারণেই উনিশ শতকের একজন প্রখ্যাত ফ্রিম্যাসনারি লেখক অ্যালবার্ট পাইক-এর একটি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিড- এর উক্তি।
মধ্যযুগের একটি ম্যাসনিক লজ। চতুর্দশ শতকের পর ইউরোপে গির্জা এবং ক্যাথিড্রাল নির্মান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ফ্রিম্যাসনদের লজগুলির সঙ্গে আর stonemasons’ craft-এর সম্পর্ক রইল না।অবশ্য এখানেই মিলিত হতেন ষোড়শ - সপ্তদশ শতকের স্বশিক্ষিত এবং জ্ঞান অনুরাগী আলোকিত মানুষ। যাঁরা মগ্ন হতেন তাত্ত্বিক আলোচনায়। সে জন্য তাদের বলা হত speculative mason.যাঁরা নিজেদের অজান্তেই বদলে দিচ্ছিলেন মানবিক চিন্তার জগৎ ...
মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপ ছিল খ্রিস্টীয় গির্জার কঠোর নিয়ন্ত্রনে। তারা এক বিশেষ ধরণের ‘সত্য’ লালন করত। সেই সত্যের বাইরে তারা কোনও ভিন্নমত সহ্য করত না। কিন্তু মানবমন কৌতূহলী বলেই সে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে নেড়েচেড়ে দেখতে চায়। কাজেই ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের ইউরোপের একদল স্বশিক্ষিত জ্ঞান অনুরাগী মানুষ বাস্তব জগতের বাস্তব ব্যাখ্যায় অনুসন্ধানে ব্রতী হয়। ইউরোপের ওই যুগটি Age of Enlightenment বা ‘জ্ঞানদীপ্তির যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত। যে যুগে গির্জেপিতাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশ্বজগৎ দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটি আমূল বদলে গিয়েছিল । জ্ঞানদীপ্তি যুগের সেইসব আলোকিতগণ সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব বোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়মিত মেইসন লজে যেতেন । অশিক্ষিত মেইসনরা যে নিগূঘ জ্ঞানের চর্চা করত, speculative mason-রা সেই জ্ঞানের বিষয়টি বুঝতে চাইলেন ঐতিহাসিক এবং যৌক্তিক চিন্তার প্রেক্ষাপটে। এভাবে প্রাচীন প্রজ্ঞা এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় ঘটেছিল। এবং ইউরোপে একটি সমাজবিপ্লব হয়ে উঠল আসন্ন!
স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) আলোকিতগণের একজন ...
জ্ঞানদীপ্তির যুগে নিউটন গীর্জা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সত্য অস্বীকার করে নিজস্ব বুদ্ধি এবং যুক্তিবোধের ওপর প্রকৃতি ও বিশ্বজগৎকে বোঝার চেষ্টা করলেন। আলকেমি বিষয়ে নিউটনের গভীর কৌতূহল ছিল । তিনি ‘ফিলসোফারস স্টোন’ (The philosopher's stone (Latin: lapis philosophorum) is a legendary alchemical substance said to be capable of turning base metals (lead, for example) into gold (chrysopoeia) or silver.) নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে নির্মিত জেরুজালেমের টেম্পল অভ সলোমন-এর নকশার বিন্যাসে ‘ফিলসোফারস স্টোন’- তৈরির ইঙ্গিত রয়েছে। নিউটন এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলেও একটি বিষয় আমাদের কাছে পরিস্কার যে ... টেম্পল অভ সলোমন-এর স্থাপত্যরীতি এবং এর প্রধান স্থপতি বা ‘মাস্টার মেইসন’ বারবার ইউরোপের ইতিহাসে আলোচিত হয়েছেন ...
টেম্পল অভ সলোমন। নিউটন নানা ভাবে এই প্রাচীন উপাসনালয়ের জ্যামিতিক বিন্যাস বিশ্লেষন করার চেষ্টা করেছিলেন ...
ইউরোপীয় রাজনীতির ওপর জ্ঞানদীপ্তির যুগের অনিবার্য প্রভাব পড়েছিল। ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে স্বৈরাচারী ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চালর্সকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়; এরপর পার্লামেন্ট বা আইনসভার ভূমিকা হয়ে ওঠে মূখ্য, রাজতন্ত্রের ক্ষমতা খর্ব করে ইংল্যান্ডে রিপাবলিক গঠন করা হয়। রাজা চতুদর্শ লুই শাসিত ফ্রান্স এবং ইউরোপরে অন্যত্রও নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের ভিত কেঁপে ওঠে। একই সঙ্গে জ্ঞানদীপ্তির যুগের আলোকিতগণের ওপর নেমে আসে রাষ্ট্রের নির্যাতন। স্বাধীন চিন্তা গির্জা এবং গির্জার পৃষ্ঠপোষক রাজতন্ত্রের অন্তরায় বলে গির্জা রাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেয় । গির্জার নির্যাতন, যাকে ‘ইনকুইজিশন’ বলে, সেটি অবশ্য আরও আগে থেকেই অব্যাহত ছিল। জ্ঞানদীপ্তির যুগের আলোকিতগণ রাষ্ট্র ও গির্জার পৃথকীকরণের সঙ্গত দাবি তুলেছিল। এখান তারা লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাইল । ফ্রিম্যাসনদের লজ হয়ে উঠেছিল তাদের নিরাপদ আশ্রয়। এর আগেই ফ্রিম্যাসনদের গনতন্ত্র এবং সাম্যের বোধ তাদের আকর্ষন করেছিল।
ইংল্যান্ডে ফ্রিম্যাসনদের প্রথম গ্রান্ড লজ।
১৭১৭ সালের ২৪ জুন লন্ডনে প্রথম ফ্রিম্যাসনদের গ্রান্ড লজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আইজাক নিউটনের এক বন্ধু। গ্রান্ড লজ-এর
প্রথম গ্রান্ড মাষ্টার হন আন্থনি সেয়ার। ( ২য় পর্ব থেকে তুলে ধরছি ... ইউরোপে দ্বাদশ শতকে নাইট টেম্পলাররা একটি অত্যন্ত সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল। নাইট টেম্পলারদের প্রধান কে বলা হত গ্র্যান্ড মাষ্টার।) ... সেই যাই হোক। ১৭১৭ সালে আধুনিক ফ্রিম্যাসন গোষ্ঠীর যাত্রা শুরু। তাদের লিখিত চার্টারে প্রথম ধারাটি ছিল ধর্মীয় সহনশীলতা। গনতান্ত্রিক উপায়ে গ্রান্ড মাষ্টার নির্বাচিত করা হত (কেননা,মধ্যযুগের মেইসনরা গনতান্ত্রিক উপায়ে তাদের মাস্টার মেইসন নির্বাচিত করত) যা ইউরোপীয় সমাজে প্রভাব ফেলেছিল। তবে খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর প্রধান স্থপতি বা Master Mason হাইরাম আবিফ এর স্মৃতি লজের সদস্যদের (কৃত্যের রিচুয়াল) মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে ওঠে। (প্রথম পর্ব দেখুন)
এসব কারণেই পরবর্তীকালে ফ্রিম্যাসনারী গোষ্ঠীতে এক প্রতীকময় ভাষা তৈরি হয়, যা গোষ্ঠীর বাইরে সাধারণ মানুষের কাছ গুপ্ত এবং রহস্যময় বলে মনে হয়।
রিম্যাসনারি: কেবল বিশ্বের প্রাচীনতম গুপ্ত গোষ্ঠীই নয় এর ঐতিহ্য অত্যন্ত জটিল এবং সঙ্কেতবহুল।
ফ্রিম্যাসনদের ওপর যথাসময়ে গির্জার খড়গ নেমে এসেছিল । দীর্ঘকাল ধরেই রোমান ক্যাথলিক চার্চ ফ্রিম্যাসনদের কট্টর সমালোচনা করে আসছিল। ফ্রিম্যাসনদের গোষ্ঠীতে যোগদানের ওপর ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়; বলা হয় যে- কোনও ক্যাথলিক ওই অশুভ সংঘে যোগ দিলে তাকে বহিস্কার করা হবে। ফ্রিম্যাসনদের ওপর গির্জার এই অক্রোশ পরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকে। পাঠ করুন- A 1983 statement from the Sacred Congregation for the Doctrine of the Faith approved by Pope John Paul II stated "The faithful who enroll in Masonic associations are in a state of grave sin and may not receive Holy Communion." and "... membership in them (Masonic associations) remains forbidden."
চলবে ...
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের লিঙ্ক
Click This Link
Click This Link
ছবি। ইন্টারনেট ।
তথ্যসূত্র: শেষ পর্বে সংযোজিত করা হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১২ দুপুর ১:০৫