মাধবপুরের পৌষমেলায় যখন মকবুল ঝর্নাকে দেখল, তার মাত্র দু-মাস পরেই খুনের ঘটনাটা ঘটল । ঝর্নার ভাইয়েরা সুতির হাটের সরকারি দলের উপরের সারির নেতা; তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকা খুবই স্বাভাবিক। ঝর্নার তিন ভাই-আজম, আজগর এবং হেমায়েত; এরা পেশাদার ডাকাত বা খুনি না-বলেই সে আগ্নেয়াস্ত্র কালেভদ্রে ব্যবহৃত হয় । এই শীতে অবশ্য সে আগ্নেয়াস্ত্র একবার গর্জে ওঠার একটা ছুতো তৈরি হল ...
সুতির হাটের মাইল খানেক দক্ষিণেই মাধবপুর; সেই মাধবপুরের স্বর্ণামতী নদীর পাড়ে প্রতি বছরই শীতকালে পৌষমেলা বসে । পৌষমেলাটি অত্র অঞ্চলে অতি বিখ্যাত মেলা। আশেপাশের গ্রাম থেকে মেলায় লোকজন আসে । সেরকমই শীতের ঝলমলে অপরাহ্নের মাধবপুরের পৌষমেলায় আতনবুড়ির সঙ্গে ঘুরছিল ঝর্না। আতনবুড়ির ফরসা মুখে অজস্র বলিরেখো, মাথায় শনের মতো সাদা চুল, শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে; বয়স বোঝা যায় না। ঝর্না অবশ্য সদ্য আঠারো পেরিয়েছে। আতনবুড়ি থাকে সুতির হাটের উত্তরে ভাদাই খালের পাড়ে এক কুঁড়েঘরে । প্রতিদিনই আতনবুড়ির জন্য এটা-ওটা রান্না করে নিয়ে যায় ঝর্না। ঝর্নাদের আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছ্বল। ঝর্নার তিন ভাই-ই কন্ট্রাক্টরি করে।
তো, মকবুলের বাড়ি বাঘুতিয়ায়। অতি সুদর্শন সে। পরনে কলো জ্যাকেট। মাথা কালো মাঙ্কি টুপি। মকবুল মেলায় ঘুরছিল তার এক ভাগ্নের সঙ্গে। মকবুলের এই ভাগ্নের নাম রবিন। রবিন- এর বয়স ১২। মহিষখোচার বনেছি খানমজলিস বাড়ির সন্তান রবিন। রবিন দেখতে ফর্সা এবং নাদুসনুদুস। রবিন আজ একটা হলুদ রঙের সোয়েটার পড়েছিল। ওর মাথায় নীল রঙের একটা ক্যাপ। স্কুলের মাঠে নিয়মিতই ক্রিকেট খেলে রবিন।
মকবুল ভাগ্নের জন্য মধু ময়রার স্টল থেকে জিলাপি কিনছিল। ঠিক তখনই ঝর্নার ওপর চোখ পড়তেই মকবুল স্থির হয়ে যায়। ঝর্নার গায়ের রং শ্যামলা। চোখ দুটি অবশ্য ডাগর ডাগর। তাছাড়া মেয়েটির নাক-মুখের ছিরিছাঁদ ভালোই। ঝর্নার মাথায় এই শীতের দিনে একটা ঘিয়ে রঙের চাদর ছিল বলে মুখে একটা পবিত্র ভাব এসেছিল হয়তো-বা । মকবুল তাতেই মুগ্ধ। ঝর্নাও মকবুলকেও আড়চোখে দেখছিল। রোজ ও কত ছেলেকেই তো দেখে। তবে এই মুহূর্তে মকবুলকে দেখে শরীরে একটা আলাদা কাঁপন টের পায় ঝর্না। ওর হাতে একটা সদ্য কেনা মাটির পাখি ছিল। ওটা হাত থেকে পড়ে যেতে চায়। ঝর্না শেষ মুহূর্তে আঁকড়ে ধরে।
যা হোক। মেলার ভিড়ে মকবুল ও রবিন হারিয়ে যায়। কাজেই সুতির হাট ফেরার পথে স্বর্ণামতী নদীর বাতাস বড় দুঃখ দিল ঝর্নাকে। মকবুলও তেমনই সূক্ষ্ম যন্ত্রণা বোধ করেছিল হয়তো-বা ...
সে যাইই হোক। পৃথিবীর এইসব প্রেম হয়তো-বা মহাকালেরই ইঙ্গিত -নইলে পরদিনই কেনই-বা আতনবুড়ি বলবে-ওলো ঝর্না?
কি?
অখন একবার মহিষখোচায় যাই চল।
মহিষখোচায় যাইবা? ক্যান? চালভাজা খেতে খেতে মুখ তুলে অবাক হয়ে বলে ঝর্না। এই সকালে ওরা দু'জন আতনবুড়ির উঠানে বসে রোদ পোহাচ্ছিল।
মহিষখোচার বুলবুলিরে লইয়া একখান মন্দস্বপ্ন দেখছি। খনখনে কন্ঠে আতনবুড়ি বলে।
মন্দস্বপ্ন? কি দেখলা?
বুলবুলির পোলায় তারা দিঘিত ডুইবা মইরা গেছে।
আয় আল্লা, কও কি? ঝর্না আর্তনাদ করে ওঠে।
হ। বলে আতনবুড়ি থুতু ফেলে।
ঝর্নার বুক কাঁপে। আতনবুড়ির স্বপ্ন সত্যি হয়। ও চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, চল, যাই।
চল। বলে ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ায় আতনবুড়ি।
মহিষখোচার খানমজলিস বাড়ির ছোট বউ বুলবুলি । ঝর্না জানে-আতনবুড়িকে বিশেষ খাতির করে ওই মাঝবয়েসি ফরসা থলথলে মহিলাটি। তার কারণ আছে। আজ থেকে ১২/১৩ বছর আগে ছোট বউকে বন্ধ্যা মনে করে বাপের বাড়ি বাঘুতিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মহিষখোচার খানমজলিস বাড়ির বড়কর্তা আজমল খানমজলিস। বাপের বাড়িতে বড় দুঃখের দিন কাটছিল বুলবুলির। এই আতনবুড়ি তখন বুলবুলির কাছে গিয়ে নানা রকম সান্ত্বনা দিত। নানা রকম জরিবুটি জানত আতনবুড়ি; কড়ি চালান দেয়। এসব করে কীভাবে যেন বুলবুলি গর্ভবতী হয় ।সন্তান প্রসবের সময় নানা রকম ধকল গিয়েছিল বুলবুলির ওপর । সেসবও প্রায় এক হাতেই সামলেছিল আতনবুড়ি। সে যা হোক, বুলবুলি মা হওয়ার পর আজমল খানমজলিস ছোট বউকে গ্রহন করেছিলেন। তবে তার আগে বছর খানেক অপেক্ষা করেছিলেন। নাতীর মুখে ছোট ছেলের মুখের ছাঁচ দেখেই তবে বুলবুলিকে গ্রহন করেছিলেন আজমল খানমজলিস। (ভাগ্যিস ছোট খানমজলিস শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত যেতেন!) ... নাতীর মুখ দেখার পর অন্ধ হয়ে যান আজমল খানমজলিস । বুলবুলির সেই সন্তান রবিন এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। সেই রবিন দিঘিত ডুইবা মরব? এই ভেবে ঝর্না বিষন্ন বোধ করে।
ঝর্নার হাতে একটা মোবাইল। বড় ভাবীকে ফোন করে ও। বলে, হেলো, ভাবী। আমার আইতে দেরি হইব।
ক্যান? তর আইতে দেরি হইব ক্যান?
পৌষমেলায় যামু।
কার লগে? আতনবুড়ি?
হ।
কাইল না একবার গেলি?
গেছি তো কি হইছে?
বুঝছি।
কি বুঝছো? কও কি বুঝছো? কও কি বুঝছো?
কাইল রাত্রে তুই অত ছটফোট করলি ক্যান?
আমি ছটফোট করছি? কে কইল?
হ করছোস।
তুমি কেমনে জানলা আমি ছটফোট করছি? আমি তো মায়ের ঘরে ঘুমাইছি?
আমি বারান্দার বেইনচে বইসা ছিলাম।
এই শীতের মধ্যে?
হ।
ক্যান, বড় ভাইয়ে তোমারে বুকে টাইনা নেয় নাই?
যাঃ, ছেড়ি! বড় ভাবী কৃত্রিম কোপে ফোঁস করে ওঠে। তারপরে বলে, তরে বলব ক্যান তর বড় ভাইয়ে আমারে বুকে টাইনা নিসে না না-নিসে ? বলে বড় ভাবী মোবাইল অফ করে দেয়।
এত দুঃখের মধ্যেও ঝর্না হাসে। বড় ভাবী-আজম ভাইয়ের বউ দিলারা আর মেজ ভাবী-হেমায়েত ভাইয়ের বউ নাজমার সঙ্গে ঝর্নার খুব ভাব। তারা ঝর্নার সুখদুঃখের খবর নেয়। ছোট ভাবী -আজগর ভাইয়ের বউ স্বপ্না ঝর্নার দুই চোখের বিষ। বিয়ের পর থেকেই ছোট ভাবীর সঙ্গে ঝর্নার বনিবনা হয় নাই। ছোট ভাবী খালি ঝর্নার খুঁত ধরে। কয়, ঢঙ্গি। ছোট ভাবীর জ্বালায় বাড়ি থাকতে ভালো লাগে না ঝর্নার। ঝর্না সারাদিনই পাড়া বেড়ায়। সকাল হলেই কখনও আতনবুড়ির কুঁড়ে ঘরে চলে আসে । ঝর্নার মা-বাবা বেঁচে নেই। ভাইয়ের সাধারণত ঘরে থাকে না। সেই সঙ্গে বড় এবং মেঝ ভাবীর প্রশ্রয় আছে। ঝর্না এই স্বাধীনতাটুকু ভোগ করে।
ভাদাই খালের পাড় ধরে হাঁটতে-হাঁটতে ঝর্না গভীর কষ্ট অনুভব করে। ওর মনে মকবুলের মুখটা ভাসছিল। হঠাৎ ওর শীত করে। ও মকবুল-এর ওম চায়। আজও একবার মাধবপুরের পৌষমেলায় যাবে ঝর্না। যদি মকবুল একবার আসে। সে কি আসবে না?
সুতির হাট আর মহিষখোচা পাশাপাশি গ্রাম। মধ্যেখানে স্বর্ণামতী নদী সরু হয়ে বেঁকে গেছে। এই শীতে নদীতে পানি নেই। ধূধূ চর কেবল। চরাচরে সকালবেলার রোদ আর কুয়াশা ছড়িয়ে আছে।
মহিষখোচায় খান মজলিসদের পুরনো দালানটি কালো পানির বিশাল এক দীঘির পাড়ে । দীঘির নাম-তারা দীঘি। দীঘির দক্ষিণ পাশে শিমূল বনের ভিতরে একটি পুরনো মন্দির চোখে পড়ে। এখন এই নির্জন সকালে ঘন কুয়াশার আড়ালে অবশ্য আবছা দেখায়।
ঝর্নাকে দেখে অবাক হয়েছে বুলবুলি। যদিও নিজে ঢ্যাবঢ্যাবা ফর্সা বলেই হয়তো শ্যামলা রঙের ঝর্নাকে ভালো লাগে বুলবুলির। কেন যেন একবার বুলবুলির মনে হল ছোট ভাইয়ের বউ হিসেবে ঝর্না কে মানাবে ভালো ।
ওদের দোতলায় নিয়ে এল বুলবুলি । দোতলায় উঠে টানা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই শীতল বাতাস জড়িয়ে ধরে ঝর্নাকে। রোদ ঝলমলে তারা দীঘি চোখে পড়ে। কুয়াশা অনেকটা সরে গেছে। দীঘি পাড়ে মন্দির দেখে ঝর্না কেঁপে ওঠে। মন্দিরের ওপাশে স্বর্ণামতী নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সর্ষে ক্ষেত। ক্ষেতের মাঝখানে ইট বিছানো উঁচু রাস্তা। কে যেন সাইকেল চালিয়ে আসে। কে?
বাঘুতিয়া থেকে ভোর-ভোর রওনা হয়ে সাইকেল চালিয়ে মহিষখোচা পৌঁছল মকবুল । আজ অনেক ভোরে উঠে মকবুলের মা মেয়ের জন্য চিতই পিঠা বানিয়েছে। পিঠা ভরতি টিফিন ক্যারিয়ার বুলবুলিকে দিয়ে একবার আমতলী যাবে মকবুল। মুন্সিরহাটে গেঞ্জি আর থ্রি পিসের দোকান আছে মকবুলের। আমতলীর রহমত আজই ওকে দুশো পিস গেঞ্জি দেওয়ার কথা। সর্ষে ক্ষেতের পাশ দিয়ে সাইকেল চালাতে- চালাতে একটা স্কুলের সামনে চলে আসে মকবুল । চন্দ্রনাথ সরকার হাই স্কুল। রবিন এই স্কুলেই পড়ে। ক্লাস চলছে। রবিনেরও এখন ক্লাসে থাকার কথা। কয়েক শ ছাত্র/ছাত্রী নিয়ে স্কুলটা এই মুহূর্তে নির্জন হয়ে আছে। সে নির্জনতা খান খান করে ভাঙতেই যেন মকবুল ঘন্টি বাজায়। তবু তার বিষন্নতা কাটে না। আজও মাধবপুরের পৌষমেলায় যাবে মকবুল । যদি ঝর্না একবার আসে।সে কি আসবে না?
নীচের উঠানে একটা নিমগাছে সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে ওপরে উঠে এল মকবুল। বুলবুলির ঘরটায় জানালা দিয়ে রোদ ঢুকে ঝলমল করছিল । ঘরের চৌকাঠে পা দিয়েই যেন সুন্দর একটা শঙ্খচূড় সাপ দেখে চমকে উঠল মকবুল। ওর উষ্ণ রক্তে মুহূর্তেই কিছু তিতা নুন ছড়িয়ে যায়। বুলবুলি তার ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। এবং মুহূর্তেই বুলবুলি যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারে। ঝর্নার সঙ্গে মকবুলের কি আগে কোথাও দেখা হয়েছিল? কোথায়? মকবুলকে দেখে আতনবুড়িও ফোকলা দাঁতে হাসে। তারপর ঝর্নার কনুইয়ে চিমটি কাটে। ঝর্না বেশ ব্যথা পায়। ও মকবুলকে দেখেই মাথা নীচু করে ফেলেছে।
আয় রে মকবুল, আয়। বয়। বুলবুলি বলে। ঘিয়ে রঙের একটা কার্ডিগেন পরে ছিল বুলবুলি। এখন আঁচল টেনে ফুলে থাকা বুক দুটি ঢাকে।
মকবুল ঘরে ঢোকে। তারপর টিফিন ক্যারিয়ারটা বুলবুলিকে দিতে দিতে বলে, চিতই পিঠা। মায়ে পাঠাইছে।
হ। মায়ে ফোন করছিল। তখন তুই রাস্তায় ছিলি। বলে টিফিন ক্যারিয়ার নেয় বুলবুলি।
মকবুল কি করবে বুঝতে পারে না। ও একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে। আতনবুড়ি আর ঝর্না বসেছিল বিছানার ওপর। বিছানা না বলে বরং পালঙ্ক বলাই ভালো। মধুবর্ণের বার্মাটিকের তৈরি পুরনো পালঙ্ক। বার্মাটিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শোনা যায়, এককালে মহিষখোচার খানমজলিসরা বার্মার সঙ্গে গন্ধদ্রব্যের ব্যবসা করত।
বুলবুলি মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলে, চল গো বুড়িমা, আমরা বারান্দায় রোদে গিয়া বসি। এই ঘরে শীত বেশি। বলে আতনবুড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে। তারপর অশ্লীল ভঙ্গিতে হাসে।
ওরা বেড়িয়ে যেতেই ঘরে নির্জনতা গাঢ় হয়ে ওঠে। তবে তারা দীঘির দিক থেকে হইচই শোনা যায়। কারা যেন সাঁতার কাটছে। রবিন তো স্কুলে। তাহলে কারা? আতনবুড়ির স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই ঝর্না কেঁপে ওঠে। ঝর্না চুপ করে থাকে। তার কনুই ভীষণ জ্বলছিল। এত জোরে কেউ চিমটি কাটে? মাগী বুড়ি। মকবুল কিছু বলতে যাবে। কথা জড়িয়ে যায় তার। তবে একটু পর তাদের মধ্যে কিছু কথা হয় অবশ্য।প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়েও আজকাল মোবাইল পৌঁছে গেছে। ঝর্নাকে মকবুল ওর মোবাইল নাম্বার বলে। ঝর্না সে নাম্বারে একটা মিসকল দেয়।
সুতির হাট ফেরার পথে স্বর্ণামতী নদীর চরে হাঁটতে-হাঁটতে ঠিক আলীম আলী বিশ্বাস ব্রিজের নীচে আতনবুড়ি এক আশ্চর্য কথা বলে। তখন শীতের নদীর বাতাসে ঝর্নার শরীর একবার কেঁপে ওঠে।
আমি আর বেশিদিন বাঁচুম না লো ঝর্না।
কি কও তুমি, আয় আল্লা। ঝর্নার পা দুটি হঠাৎ ভারী ঠেকে।
হ। আমার মউতের ডাক আইছে।
ঝর্নার তখন কত কথা যে মনে পড়ে। আতনবুড়ি অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত ধাই। ঝর্নার জন্মও তারই হাত দিয়েই হয়েছে। এখন আতনবুড়ি মারা গেলে ঝর্না যাবে কোথায়? প্রশ্নটি ঝর্না করে বসে। আতনবুড়ি হাসতে-হাসতে বলে, ক্যান, আমি মইরা গেলে তর কি হইব? মবকুলে আছে না? ওরে তুই বুকে জড়াইয়া রাখবি।
ঝর্না লজ্জ্বা পায়।
পরদিনই মকবুল ভাদাই খালের পাড়ে একটা গাবগাছে সাইকেল রেখে আতনবুড়ি কুঁড়েঘরে ঢোকে। ঝর্না চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষ করছিল । সকাল থেকে মকবুলকে মিসকল দিয়ে অস্থির করে ফেলেছে। আতনবুড়ি পাড়া বেড়াতে গেছে। অত্র অঞ্চলের কয়েক ’শ শিশু আতনবুড়ির হাতে ভূমিষ্ট হয়েছে। নিয়মিত শিশুদের মায়ের খোঁজখবর নেয় আতনবুড়ি । আতনবুড়ির নির্জন কুঁড়েঘরে ঝর্নার সঙ্গে মকবুরে মিলনের পরামর্শটি আতনবুড়িই দিয়েছে । তাছাড়া, দিলারা ভাবীকে সব খুলে বলেছে ঝর্না। দিলারা ভাবী বলছে, তর কুনও অসুবিধা নাই রে ঝর্না, তুই আরামে কর। অষুধপত্র যা দেওনের আমিই দিমুনে। এই কথা শুনেও ঝর্নার শরম লাগে না; যেন এইই স্বাভাবিক। এবং ঝর্নার এও মনে হয় যে একটার পর একটা ঘটনা সাজিয়ে মকবুলের সঙ্গে মিলনের ব্যবস্থা যিনি করে দিয়েছেন, তিনি দৃশ্যের আড়ালে বসে থেকে সবই দেখছেন ...
তারপর সাঁতার কাটার সময় তারা দীঘিতে ডুবে রবিনের মৃত্যু হয় ...কামার্ত ঝর্নাকে আরও তীব্রভাবে আঁড়কে ধরে শোকার্ত মকবুল ...
মাঘের এক কুয়াশা জড়ানো সকালে ভাদাই খালের পাড়ে সেই শিশিরে ভেজা গাবগাছে সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখে মকবুল; তারপর পায়ে পায়ে আতনবুড়ির কুঁড়েতে ঢোকে, এবং অবিলম্বেই সে টের পায় যে আতনবুড়ি বেঁচে নেই। কুঁড়েঘরের মাটির মেঝেতে ছেঁড়া কাথা বিছানো। তার ওপরে ময়লা কম্বলের নীচে আতনবুড়ির নিথর দেহটি পড়ে ছিল । মকবুলের কান্না পায়। সে পাগলের মতো আতনবুড়ির মুখে, কপালে ও ঘাড়ে হাত বোলায়। কি শীতল আর ঠান্ডা শরীর! বুকের ওপর কান পাতে। না, শ্বাস পড়ছে না। বরং নির্জনে মকবুলের দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে তার। মাথা কাজ করছিল না। কাঁপা- কাঁপা হাতে জ্যাকেটের ভিতর থেকে মোবাইল বের করে সে । ওপাশ থেকে যান্ত্রিক আওয়াজ পায়। ঝর্না বলে, হেলো। আইজ ভোরে মেজ ভাবীর আম্মা মারা গেছে। আমরা সবাই অখন রামকান্দা যাইতেছি।
আচ্ছা। বলে ফোন অফ করে দেয় মকবুল। আতনবুড়ির মৃত্যুসংবাদ ঝর্নাকে দেয় না। তার বদলে এখানে-ওখানে ফোন করে মকবুল। আতনবুড়ি কে দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে।
তারপর ঝর্না এবং মকবুলের গোপন প্রণয়ের কথা অত্র অঞ্চলে রটে যায়। সেসব কথা আজম, আজগর এবং হেমায়েত- এর কানেও যায়। তারা ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে এই কারণেই যে বাঘুতিয়ার মকবুলের সঙ্গে ঝর্নার বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না। বিশেষ করে ঝর্নার ছোট ভাবী স্বপ্না সুযোগ বুঝে তার স্বামীর কানে বিষ ঢালতে থাকে। বলে যে, মকবুলের এক বোনের বিয়ে ভালো ঘরে হলেও মকবুলরা ছোট জাত। তাছাড়া মকবুলের ব্যবসাপাতির অবস্থা ভালো না। যে মুন্সিরহাটে গেঞ্জি বেচে, কি তার ভবিষ্যৎ? তাছাড়া আপনের মনে নাই গেল ইলেকশনে টাকা ঢাইলাও মকবুলের বাপরেও দলে টানতে পারেননি।
এসব কথায় আজম, আজগর এবং হেমায়েত ক্রদ্ধ হলেও আবার খানিকটা ধন্ধেও পড়ে যায়। হাজার হলেও ঝর্না স্নেহের বোন। বোনকে বোঝানোর দায়িত্ব আজগর-এর ওপর পড়ে। আজগর ঝর্নাকে নানা কথা বলে। ঝর্না ভাইয়ের মুখের ওপর কথা শুনিয়ে দেয়। হয়তো তার ভিতরে একটি ভ্রুনের আবছা অস্তিত্ব টের পাচ্ছিল বলেই কিংবা একটার পর একটা ঘটনা ঘটিয়ে যিনি মকবুলের সঙ্গে মিলনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন-তার ওপর ঝর্নার আস্থা ছিল ।
তারপর একরাতে বিছানায় লেপের তলায় ঢুকে ব্লাউজ খুলতে খুলতে বউয়ের ব্রায় আলতো স্পর্শ করে হেমায়েত। ঠিক তখনই স্বপ্না বলে, মকবুলের লগে আপনের বইনে যা শুরু করছে । ঝর্নার পেট বাধতে বেশি দিন নাই। কিছু করলে জলদি করেন।
স্বপ্নার স্তনের ওপর হেমায়েতের হাত থমকে যায়। তার অবশ শরীরে আগুনের হলকা টের পায়। তার ঘনিয়ে-ওঠা কাম নিভে যায়। এমনিতেই সরকারী ব্যাঙ্কের সিডিউল জমা নিয়ে টেনশন ছিল। বাদল গ্রুপের ক্যাডাররা ভীষণ ঝামেলা করছে । বাঘুতিয়ার মন্ডল বাড়ির ছেলে বাদল মন্ডল; উঠতি মস্তান, সেও সরকারি দল করে। সম্পর্কে বাদল মন্ডল মকবুলের চাচাতো ভাই। মকবুলের কথায় মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এ ছাড়া হেমায়েতের বড় মেয়েটার বয়স তিন বছর হলেও এখনও ঠিকঠাক কথা ফোটেনি। ঢাকায় নিয়ে যেতে বললেন উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্সের সোবহান ডাক্তার। ওদিকে স্বপ্নার বাপের বাড়ির জমিজমা ভাগাভাগি হচ্ছে। স্বপ্নার ভাইয়েরা বোনদের সম্পত্তির ভাগ দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে, বিয়েতে নাকি অনেক খরচ হয়েছে ...ইত্যাদি।
দ্রুত একটা চরম সিদ্ধান্ত নেয় হেমায়েত।
স্বপ্না বলে , ঝর্নায় সকালে আতনবুড়ির বাড়িত যায়। ও বাড়িত মকবুলে সেখানে আসে।
পরদিন সকালে ঝর্না বেরিয়ে গেলে হেমায়েত মোটর সাইকেলে স্টার্ট দেয়। তার আগে অবশ্য আগ্নেয়াস্ত্র জ্যাকেটের পকেটে গুঁজে নেয়। খানিক বাদে খোলা মাঠের পাশ দিয়ে হু হু করে মোটরসাইকেল ছুটছে। খোলা মাঠে শীতের বাতাস। কৃষকেরা আমনের চারা বুনছে। নিজেকে পাথরের মতো ভারী ঠেকে হেমায়েতের।
মকবুল তখনও আতনবুড়ির কুঁড়েঘরে আসেনি। কয়েকবার তাকে মিসকল দিয়েছে ঝর্না । মকবুলের ফোন বন্ধ। কি হইল তার? ঝর্না কুঁড়েঘরের মেঝের ওপর ছেঁড়া কাঁথার ওপর বসেছিল। খানিকবাদে ও মোটলসাইকেলের শব্দ পায় ঝর্না। আয় আল্লা। কে আইল আবার? ওর শরীরের রক্ত জমে ওঠে। ঝর্না দ্রুত উঠে কুঁড়েঘরের বাইরে বেড়িয়ে আসে।
হেমায়েত ততক্ষণে কুঁড়ের সামনে মোটরসাইকেল থামিয়েছে। গম্ভীরকন্ঠে বলে, তুই এইখানে কি করছ?
আমার আছে।
এই হারামজাদী! এইখানে কি কাম তর! গর্জে ওঠে হেমায়েত।
ঝর্না ওর গালের দু-পাশে, কানের লতিতে উষ্ণতা টের পায়। রাগে শরীর কাঁপছে ওর। চিৎকার করে বলে, এই কুত্তার বাচ্ছা, আমারে গালি দিবি না কইলাম।
হেমায়েত মোটরসাইকেল থেকে না-নেমেই জ্যাকেটের পকেট থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বার করে বোনের দিকে তাক করে।
তারপর গুলির প্রচন্ড শব্দে মাঘ মাসের এই নির্জন কুয়াশা জড়ানো সকালে ভাদাই খালের পাড়ের সেই শিশিরে ভেজা গাবগাছে বসে থাকা কয়েকটি ভয়ার্ত কাক আকাশের দিকে উড়ে যায় ...