ল্যানসেলট ও গুইনিভেরে। ইংল্যান্ডের লোককাহিনীর বিয়োগান্তক দুটি চরিত্র। ল্যানসেলট ছিল মধ্যযুগের একজন বীর নাইট আর গুইনিভেরে ছিল মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের লৌকিক উপাখ্যানের রাজা আর্থারের স্ত্রী । এরা দু’জনই এক সর্বনাশা প্রেমে জড়িয়ে যায়। যার জের ধরে রাজা আর্থারের রাজ্যটি ধ্বংস হয়ে যায়। ল্যানসেলট ও গুইনিভেরের করুন উপাখ্যানটি মধ্যযুগ থেকে আজ অবধি ইউরোপীয় সাহিত্যকে এক প্রবল ভাবাবেগে প্লাবিত করে রেখেছে। বিয়োগান্তক কাহিনী নিয়ে অমর কবিতা লিখেছেন কবি আলফ্রেড টেনিসন । নিমির্ত হয়েছে চলচ্চিত্র ...
রাজা আর্থারের সময়কার ইংল্যান্ডের মানচিত্র। রোমানরা ৪১০ খ্রিস্টাব্দ অবধি ব্রিটেন শাসন করেছিল। ব্রিটেনে রোমান শাসনের অবসানের পর ব্রিটেনে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেয়। সেই সুযোগে উত্তর ইউরোপ থেকে অ্যাঙ্গেল এবং স্যাক্সনরা বারংবার ব্রিটেন আক্রমন করতে থাকে । বহিরাগতদের প্রতিহত করার জন্য এক যোগ্য নেতৃত্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। ঠিক ওরকম এক সঙ্কটময় রাজনৈতিক ঘূর্নিপাকে উত্থান ঘটে অমিত সাহসী রাজা আর্থারের। বাডন- এ তারই সাহসী নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা আক্রমনকারী স্যাক্সনদের পরাজিত করে।
লোককাহিনীর রাজা আর্থার ঐতিহাসিক ব্যাক্তি ছিলেন কিনা তা নিয়ে অবশ্য বির্তক আছে। বর্ম পরিহিত কিং আর্থার যুদ্ধ করছেন - এই ছবিটা অবশ্য অনেক পরের । ১১৭০ খ্রিস্টাব্দে Chretien de Troyes নামে একজন ফরাসি কবি একটি রোম্যানটিক লোককাহিনীতে রাজা আর্থারকে প্রথম তুলে ধরেছেন । ওই লোককাহিনীতে রাজা আর্থার, তাঁর যুদ্ধবিগ্রহ এবং ক্যামেলট দূর্গের উল্লেখ করা হয়েছে। ক্যামেলট দূর্গেই ছিল রাজা আর্থারের রাজদরবার। তবে রাজা আর্থারের কাহিনী ঐতিহাসিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। উপস্থাপন করা হয়েছে কাল্পনিক রূপকথার মতো করে।
রানী গুইনিভেরে। এই ছবিটি এঁকেছেন মেরিডিথ দিলমান।
রানী গুইনিভেরে ছিলেন কামেলার্দ এর রাজকন্যা। কারও মতে রানী গুইনিভেরে ছিলেন রোমান বংশোদ্ভুত। যাহোক। কুড়ি হাজার সৈন্য নিয়ে রাজা আর্থার কামেলার্দ পৌঁছেছিলেন। বিশেষ সৌহার্দের সম্পর্ক ছিল। দূর্গে ভোজসভায় প্রথম গুইনিভেরে কে দেখেন রাজা আর্থার। গুইনিভেরে ছিল অপরূপা সুন্দরী। সুন্দরী এবং বিদূষী। ঐতিহাসিক জিওফ্রে অভ মনমাউথ এর মতে: রানী গুইনিভেরে ছিল the loveliest woman in all the island. রাজা আর্থার গুইনিভেরে কে দেখে মুগ্ধ হলেন । গুইনিভেরে কে বিয়ে করতে চান। গুইনিভেরের বাবা কামেলার্দ- এর রাজা রাজি।
রাজা আর্থার। রানী গুইনিভেরে ছিল রাজা আর্থারের অনুপ্রেরণার উৎস।
রাজা আর্থার-এর সময় যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। রাজা আর্থারকে যুদ্ধবিগ্রহে সাহায্য করত নাইটরা। আমরা জানি, A knight is a member of the warrior class of the Middle Ages in Europe who followed a code of law called "chivalry". রাজা আর্থার ক্যামেলট দূর্গে বড় একটি গোল টেবিলে নাইটদের সঙ্গে মিলিত হতেন । একে বলা হত ‘রাউন্ড টেবিল’। গোল টেবিলে একসঙ্গে দেড়শ নাইট বসতে পারত। রাজা বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে গোল টেবিলটি পেয়েছিলেন।
রাউন্ড টেবিল। রাউন্ড টেবিলে কেউই প্রধান ছিল না। প্রত্যেক নাইটের অধিকার ছিল সমান। নাইটরা ছিল রাজা আর্থারের অতি বিশস্ত। সহজে বিশ্বাসঘাতকতা করত না।
যুদ্ধ ছাড়াও রাজা আর্থারের সময় নাইটরা ‘হলি গ্রেইল’-এর সন্ধানে অভিযানে বের হত। ‘হলি গ্রেইল’ একটি পাত্র। যে পাত্রে যিশু ‘অন্তিম ভোজনে’ (Last Supper) পান করেছিলেন। শুধু তাইই নয় হলি গ্রেইলে যিশুর রক্ত রাখা হয়েছিল। সেই পবিত্র পাত্রের সন্ধান করত মধ্যযুগের নাইটেরা।
ল্যানসেলট। গোল টেবিলের অন্যতম নাইট ছিলেন ল্যানসেলট। ল্যানসেলট সম্বন্ধে লোককাহিনীতে বলা হয়েছে: ল্যানসেলট ছিল রাজা আর্থারের অনুগত, জ্ঞানী, দয়ালু ও শক্তিশালী ।
একবার মালিয়াগান্ট নামে এক লোভার্ত তস্কর রানী গুইনিভেরে কে অপহরণ করেছিল । রাজা আর্থার রানীকে উদ্ধার করতে অভিযানে বের হন।শেষ পর্যন্ত ল্যানসেলট রানীকে মালিয়াগান্ট-এর কবল থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। তখনই সম্ভবত ল্যানসেলট রানী গুইনিভেরে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। আর রানীও ল্যানসেলট -এর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। অবশ্য প্রথম প্রথম গুইনিভেরে এড়িয়ে। পরে ল্যানসেলট এর বলিষ্ট মাধুর্যের কাছে নিজেকে সমর্পন করে রানী। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা পরে ভালোবাসার রূপ ধারণ করে। পরিস্থিতির কারণে দুপক্ষই সেটি গোপন রাখার চেষ্টা করে। ল্যানসেলট এর প্রতি রানী গুইনিভেরের দূর্বলতার বিশেষ কারণ ছিল। একজন লেখকের মতে: She (রানী গুইনিভেরে) is childless in a marriage to a man she respects but doesn't love and in love with a man she can never have. রানীর এই তৃষ্ণার কারণে দুজনের প্রেম ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে।
চিত্রশিল্পী ড্রাপার- এর আঁকা ল্যানসেলট ও গুইনিভেরে
ক্যামেলট দূর্গে রাজা আর্থার এক ভোজসভায় আয়োজন করেছিলেন। নাইটরা যোগ দিয়েছিল। ল্যানসেলট ও গুইনিভেরে কে না দেখে নাইট মেলিয়াগাউন্ট সন্দেহ করে। সে অলিন্দে বেরিয়ে আসে। ফুটফুটে জোছনা। দুজনে গল্প করছিল।
তোমরা এখানে? নাইট মেলিয়াগাউন্ট তীক্ষ্মস্বরে জিগ্যেস করে।
হ্যাঁ। বলে ল্যানসেলট ।
কি করছিলে?
আমরা টলটলে জোছনা পান করছিলাম। গুইনিভেরে বলে।
স্যার মেলিয়াগাউন্ট চোখে বিমূঢ় দৃষ্টি। হয়তো ভাবছিল জোছনা পান কি করে সম্ভব।
গুইনিভেরে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে।
ল্যানসেলট ও গুইনিভেরে
প্রেম বিষয়টি সম্ভবত লুকোনো যায় না। চারিদিকে গুঞ্জন। রাজা আর্থারের কানেও যায়। রাজা আর্থার বিশ্বাস করেন না। রানী গুইনিভেরে কে ভালোবাসেন। তবে তলে তলে খোঁজখবর নিতে লাগলেন। রাজা আর্থারের দুজন ভ্রাতুষ্পুত্র ছিল। এদের একজন অ্যাগরাভাইন এবং অন্যজন হলেন মরড্রেড । তারা চরের কাছে সংবাদ পেল ল্যানসেলট কিছুক্ষণ আগে রানী গুইনিভেরে অন্দরমহলে প্রবেশ করেছে। তারা রানী গুইনিভেরে অন্দরমহলে হানা দেয়। সঙ্গে ১২ জন সশস্ত্র নাইট। রানী তখন বিছানায় শুয়ে ছিল । পাশে ল্যানসেলট । নাইটদের দেখে রানী চিৎকার করে ওঠে। চোখের পলকে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে ল্যানসেলট । মুহূর্তেই তরবারি কোষমুক্ত করে। দুপক্ষের মরণপণ লড়াই চলে। প্রায় তেরোচৌদ্দ জন নাইটকে একে একে পরাস্থ করে ক্যামেলট দূর্গ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় ল্যানসেলট । নাইটদের কয়েকজন নিহত ও আহত হয় (এ ধরনের দৃশ্য আমরা হলিউডি চলচ্চিত্রে প্রচুর দেখেছি। হালে,‘প্রিন্স অভ পারসিয়াতে’ও দেখলাম।)
মধ্যযুগের নাইটদের যুদ্ধবাজ জীবন আজও আমাদের আকর্ষন বোধ করে । মধ্যযুগের নাইটদের বলা হত knight in shining armour...
রানীর পরকীয়ার কথা শুনে রাজা আর্থার ক্রোধে ফেটে পড়লেন। রানী যে এমন একটি অবৈধ সম্পর্কে জড়াতে পারেন, সেটি তাঁর কল্পনারও বাইরে ছিল। মধ্যযুগে পরকীয়ার শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। অপরাধীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রানীর মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিলেন রাজা। রানীকে দূর্গে আটকে রাখা হল। ল্যানসেলট সব খবরই রাখত। সে ছিল প্রকৃত বীর, মৃত্যুকে পরোয়া করত না। রানীর মৃত্যুদন্ডের দিন চিতা সাজানো হল । ল্যানসেলট এসে রানীকে উদ্ধার করে। এ সময় বহু নাইট হতাহত হয়। রাজা আর্থার ল্যানসেলট -এর দূর্গ আক্রমন করে। করে ব্যর্থ হয়।
গুইনিভেরে। এই ছবিটি দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটির আঁকা
গুইনিভেরে অবশ্য রাজা আর্থারের কাছে ফিরে আসে। ল্যানসেলট-এর ওপর রাজা আর্থারের ক্রোধ তখনও পশমিত হয়নি। রানী গুইনিভেরে কে ক্যামেলট দূর্গে রেখে রাজা আর্থার ল্যানসেলট -এর সন্ধানে বের হন।
রাজা আর্থার।
রাজার ভ্রাতুষ্পুত্র মরড্রেড এবার রাজার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে। সে রাজ্য গ্রাস করতে উদ্যত হয়। এমন কী রানী গুইনিভেরে কে বিয়ে করতে চায়। রানী গুইনিভেরে গোপনে পালিয়ে টাওয়ার অভ লন্ডনে চলে যায় । রাজা আর্থার এরই মধ্যে ক্যামেলট ফিরে মরড্রেড কে হত্যা করে। ততদিনে রানী গুইনিভেরে লন্ডনের বাইরে একটি খ্রিস্টীয় মঠে (abbey) চলে যায়। হয়তো তীব্র অনুশোচনায় ভুগছিল।
ওদিকে ল্যানসেলট-এর অনুপস্থিতিতে গোলটেবিল দূর্বল হয়ে পড়ে। রাজ্যের পূর্বেকার সংহতি বিনষ্ট হয়। যা হোক। মঠবাসিনী সন্ন্যাসিনীর জীবন গ্রহন করে রানী গুইনিভেরে সান্ত¦না খোঁজে।
এর কিছুদিন পর রাজা আর্থার মারা যান।
রাজা আর্থারের কবরে ল্যানসেলট এর সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল রানী গুইনিভেরে।
রানী গুইনিভেরে মঠেই মারা যায়। রাজা আর্থারের কবরের ঠিক পাশেই রানী গুইনিভেরে কে সমাধিস্থ কার হয় ।
ল্যানসেলট ও গুইনিভেরের বিয়োগান্তক কাহিনী নিয়ে কবিতা লিখেছেন লর্ড টেনিসন:
স্বর্গীয় কান্নাহাসির সঙ্গে যে আত্মা
রক্ষা করে আনন্দ ও যন্ত্রনার
ভারসাম্য , সেরকম চরাচরের কুমারী বসন্তের মতো
এসেছিল রৌদ্রময় বৃষ্টির ভিতরে।
সবর্ত্রই উদ্বায়ী স্ফটিকে মধ্যিখানে
স্বর্গের নীল দ্বীপ হাসে ।
আর দূরে, অজানা ঘন অরণ্যে
এলম গাছের শীর্ষরা যেনবা
মধুরতমা বায়ূকন্যার কাছ থেকে
পেয়ে যায় কিছুটা সবুজ।
পুরো কবিতার লিঙ্ক
Click This Link
কিন্তু, ল্যানসেলট-এর কি হয়েছিল?
ল্যানসেলটও সন্ন্যাসীর জীবন বেছে নিয়েছিল ...
একটি ব্রিটিশ শিশু রাজা আর্থারের দূর্গে দাঁড়িয়ে অতীতের দিকে তাকিয়ে...
ছবি। ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
Click This Link
http://www.legendofkingarthur.co.uk/
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১২