somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: মোহনার দ্বিতীয় জীবন

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উখিয়ার জালিয়া পালং জায়গাটি বঙ্গোপসাগরের পাড় ঘেঁষে। গত বছর জালিয়া পালং-এ একটি পুরনো বাড়ি কিনেছে রাগীবের বন্ধু ইয়াসির । বাড়িটি রহস্যময় এবং অভিশপ্ত বলে দূর্নাম আছে । বিয়ের ছ’মাস পর সে বাড়িতেই মোহনাকে খুন করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে রাগীব। জালিয়া পালং-এর ওই বাড়ি ঘিরে অনেক অপমৃত্যুর কথা শোনা যায়। ইয়াসির ওর বউ কে নিয়ে একবার ও বাড়িতে গিয়েছিল । দু দিনও ওই অভিশপ্ত বাড়িতে থাকেনি লীনা। বাথরুমে কী যেন দেখেছিল। মোহনাকে খুন করার জন্য ঠিক এ ধরনের বাড়িই এখন দরকার রাগীবের।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। ঝলমলের রোদের ভিতর কক্সবাজার-টেকনাফ হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে একটি ২০১০ সালের কালো রঙের টয়োটা প্রাডো । ড্রাইভিং সিটে বসে রাগীব। দেখলেই বোঝা যায় ফুরফুরে মুডে আছে সে। সবই পরিকল্পনা মতো চলছে। এখন ইয়াসিরের জালিয়া পালং-এর ‘নার্গিস ভিলায়’ পৌঁছে বাকি কাজ শেষ করবে।
ইয়াসিরের সঙ্গে রাগীবের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের । রাগীব যখন মোহনাকে নিয়ে জালিয়া পালং যেতে চাইল, তখন ইয়াসির বলেছিল, অসুবিধে নেই। সোজা চলে যা। ও বাড়িতে একজন কেয়ারটেকার আছে। নাম রউফ মিঞা। আমি ওকে ফোন করে দেব। ওই সব ব্যবস্থা করে দেবে। ইয়াসির-এর বাবা জয়নুল শিকদার কনটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান । কনটেক্স গ্রুপের বাইং হাউজ পরিচালনা করে রাগীব।
চট্টগ্রাম থেকে আজ সকালে রওনা হয়েছে। কক্সবাজার অতিক্রম করার সময় ক্রর হাসল রাগীব। লায়লা কলাতলির কাছে ‘সি কুইন’ হোটেলে উঠেছে। আজ ভোরেও লায়লার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। মোহনা তখন চট্টগ্রামের হোটেলের রুমে ঘুমিয়ে ছিল। মোহনাকে খুন করার সময় লায়লাও কাছাকাছি থাকতে চায়। বিয়ের তিন মাস পর লায়লার সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কে জড়িয়ে যায় রাগীব । ঢাকার গুলশানের একটা পার্টিতে লায়লার সঙ্গে রাগীব-এর পরিচয় । সেই পার্টিতে রাগীবকে দেখে অস্থির হয়ে ওঠে লায়লা। একে ঠিক প্রেম বলে না, বলে infatuation ... এরই মধ্যে দু’জনার সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠেছে। লায়লার জন্যই এখন মোহনাকে মরতে হবে। লায়লার বয়স পঁচিশের মতো। গায়ের রং কিছুটা শ্যামলা হলেও টানটান সুন্দরী। লায়লার বাবা বাংলাদেশি হলেও মা ইরানি । লায়লা পড়াশোনা করেছে লন্ডনে। চৌকশ মেয়ে। টেনিস খেলে।
রাগীবের পাশের সিটে ঝিম মেরে বসে ছিল মোহনা । ফরসা মুখে কালো সানগ্লাস। চোখ রাস্তায়। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে আজ যানবাহনের দীর্ঘ সারি থাকলেও ঠিক যানজট নেই। ডানে মোড় নিল রাগীব। বেলা একটার মতো বাজে। দূর থেকে টিলা চোখে পড়ে। রাস্তা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। রাগীব গাড়ির স্পিড কমিয়ে আনে। দু’পাশে ঘন বাঁশঝাড়। নাড়িকেল আর সুপারি গাছের ফাঁকে ফসলের মাঠ। রাস্তার দু’পাশে কলাগাছ আর পানের বরজও চোখে পড়ে।
হঠাৎ রাস্তার বাঁ পাশে তাকাতেই মোহনার বুক ছ্যাঁত উঠল। রাস্তার পাশে একটা স্কুল। স্কুলের সামনে একটা টি স্টলে। টিস্টলের বেঞ্চে বসে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে কথা বলছে ইজাজ। মোহনা জানে ইজাজ এখন উখিয়ার জালিয়া পালং-এ থাকে । একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। রাগীব যখন বলল, আমরা উখিয়ার জালিয়া পালং-এ যাব। তখন ভবিতব্যের কথা ভেবে কেঁপে উঠেছিল মোহনা। মনে হয়েছিল ইজাজের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ইজাজ কবি। ও সমুদ্র ও পাহাড় ভালোবাসে। জালিয়া পালং জায়গাটা সমুদ্রের পাড়ে। এখানে ছোটখাটো পাহাড়ও আছে। ... ইজাজ ঢাকা শহরকে মৃত ঘোষনা করে শহরটাকে এড়িয়ে চলে। বছর খানেক আগে অবশ্য একবার বই ছাপাতে গিয়েছিল ঢাকায়। ৩০০ পৃষ্ঠার ‘অরণ্য ও সমুদ্রের দিনলিপি’ বইটি লিখেছিল জালিয়া পালং-এর নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে। শাহবাগে বইটির প্রকাশনা উৎসবে ইজাজের সঙ্গে পরিচয় মোহনায়। সবার সামনেই সরাসরি মোহনার চোখের প্রশংসা করেছিল ইজাজ। তার পর থেকেই ভয়ানক উতলা হয়ে উঠেছিল মোহনা; ইজাজের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠেছিল। মোহনার বাবা ইজাজের বইটির অকুন্ঠ প্রশংসা করলেও ভবঘুরে কবির হাতে মেয়েকে তুলে দিতে রাজি হননি। আজকাল বাংলাদেশি সমাজে পাত্র হিসেবে বাউন্ডুলে কবিদের চেয়ে বাইং হাউজের অধিপতিদের চাহিদাই বেশি। বিয়ের আগে ইজাজের সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল মোহনার । ইজাজ তখন বলেছিল: তোমাকে আমি খুঁজব মোহনা। সারা জীবন। তোমার আমার বিরহ সাময়িক। এর অন্য কোনও মানে আছে ... একদিন ঠিকই বুঝতে পারবে। কথাটা শুনে মোহনা কেঁপে উঠেছিল।
রাগীব চারপাশে তাকিয়ে স্পিড কমিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। জালিয়া পালং-এর মতো এমন প্রত্যন্ত একটি এলাকায় ইয়াসির কেন বাড়ি কিনেছে? খেয়াল? ওর তো পয়সার অভাব নেই। লীনা ভয় পাবার পর বাড়িটি বিক্রি করে দিতে চাইছে। ক্রেতা পাচ্ছে না। এর আগে বাড়ির মালিকানা ছিল একজন সৌদি প্রবাসী ব্যবসায়ীর । বাথটাবে তার এক ছেলের মৃত্যু হয়। যে বাড়িতে অপমৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা সে বাড়িতে আরও একটি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটলে কারও মনে সন্দেহ জাগবে না। রাগীব ক্রর হাসে।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বেশ উঁচু দেয়াল। কালো রঙের গেটা। দেয়ালে মার্বেল পাথরে লেখা: ‘নার্গিস ভিলা।’ দু’পাশে ইউক্যালিপটাস গাছ। রাগীব হর্ন বাজাল । একজন মাঝবয়েসি কালো মতন লোক গেট খুলে দিল। ভিতরে চমৎকার বাগান। তারপর সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। দেখলেই বোঝা যায় অনেক পুরনো। অন্তত পঞ্চাশ ষাট বছরের পুরনো তো হবেই । পাকিস্তান আমলে তৈরি বলে মনে হল। স্থানীয় কোনও ধনী লোকের খেয়াল। বাড়ির পিছনেই সমুদ্র সৈকত। সৈকতে চোরাবালি। আগামীকাল মোহনাকে ওখানেই মৃত পাওয়া যাবে ... যদি সাগরের ঢেউ ওকে ফিরিয়ে দেয়। রাগীব শ্বাসরোধ করে হত্যা করবে মোহনাকে ।
লোকটা গেট বন্ধ করে আবার দৌড়ে এসেছে। গাড়ি থেকে নেমে রাগীব জিগ্যেস করে। তুমি রউফ মিঞা?
লোকটা মাথা নাড়ে। বয়স চল্লিশ-এর বেশি বলে মনে হয় না। মাথায় সাদা টুপি। কালো ভাঙাচোরা মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। পরনে সাদা ময়লা ফতুয়া আর উঁচু করে পরা চেক লুঙি। কাঁধে গামছা। এতবড় বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে লোকটাকে ঠিক মানায় না।
আমরা যে আসব জান?
হ। সার। জানি। ছোট সারে ফোন করছিল।
একতলার ড্রইংরুমটা বেশ বড়। পুরনো আমলের আসবাবপত্র। মেঝেতে রংচটা কার্পেট। ঢাউশ কালো সোফা। দেয়ালে বাঘের ছাল আর হরিণের মাথা টাঙানো। ওপাশের দেয়ালে অল্প বয়েসি একটি মেয়ের বেশ বড় একটি ছবি। সাদা কালো। শাড়ি আর গয়না পরা। মেয়েটির চোখের দৃষ্টি এতই জীবন্ত যে মোহনা চমকে ওঠে। ডাইনিং রুমটিও বেশ বড়। অবশ্য ডাইনিং রুম না-বলে ডাইনিং হল বলাই ভালো। বড় টেবিল একসঙ্গে কুড়ি পঁচিশ। ঘরজুড়ে কেমন পুরনো গন্ধ।
বেডরুম দোতলায়। রউফ মিঞাই সুটকেস নিয়ে এল দোতলায় । বিশাল বেডরুম। মাঝখানে পুরনো আমলের একটি পালঙ্ক। জানলা ঘেঁষে একটা ইজিচেয়ার। পুরনো আমলের একটা ড্রেসিং টেবিল। দোতলার বসার ঘরের পাশে সমুদ্রমুখি বিশাল বারান্দাটিকে টেরেস বলাই ভালো। লোহার কারুকাজ করা রেলিং। নীচে বাগান। দেয়ালে ছোট একটা গেট। গেটের ওপাশে সিঁড়ি নেমে গেছে সৈকত অবধি । নভেম্বরের রোদে ঝিকমিক করছে সমুদ্র । টেরেসে কয়েকটা বেতের চেয়ার । ওরা ওখানেই বসল। রোদের আঁচ মিষ্টি লাগছে। রউফ মিঞা চা নিয়ে এল। মোহনা অবশ্য চা খেল না। একবারে গোছল সেরে ভাত খাবে । রাগীবকে বলল, তুমি বস। আমি গোছল সেরে নিই। সারা চিটচিট করছে।
ওকে। বলে রাগীব চায়ে চুমুক দেয়। মোহনা বাথরুমে চলে যায়। একটু পর রউফ মিঞা কাপ নেওয়ার জন্য ফিরে এল। রাগীব জিগ্যেস করে, নীচে সৈকতে যাওয়ার গেটের চাবি তোমার কাছে আছে তো?
হ সার। আছে।
আচ্ছা, বিকেলে দিও। বলে রাগীব সিগারেট ধরায়। রউফ মিঞা কাপ নিয়ে চলে যায়। লায়লা কে ফোন করে রাগীব । সব ঠিক আছে তো? লায়লা জানতে চায়।
এখন পর্যন্ত।
কখন?
রাত বারোটা।
এত দেরি?
রাগীব বলল, সি বিচে রাস্তার কাজ চলছে। তাই বারোটার আগে সম্ভব না। তাছাড়া বাড়িতে একজন কেয়ারটেকারও আছে। লোকটা কখন ঘুমাবে কে জানে।
লায়লা বলল, ওকে, তার আগেই আমি পৌঁছে যাব।
ওকে। ফোন অফ করে মুচকি হাসে রাগীব। লায়লা গত সপ্তাহে এ দিকটা ঘুরে গেছে। ‘নার্গিস ভিলা’ ওর চেনা। রাগীব ধোঁওয়া ছাড়ে। চারপাশে তাকায়। দিনের আলোয় বাড়িটা এখন স্বাভাবিক লাগছে। ইয়াসির ওর বউ লীনা কে নিয়ে এসেছিল এ বাড়িতে । বাথটাবে লাশ দেখেছিল লীনা । লাশটা কি সেই সৌদি প্রবাসী ব্যবসায়ীর ছেলের? এসব কথা অবশ্য মোহনাকে বলেনি রাগীব। মোহনা ভয় পেলে আসত না। আজ রাতেই মোহনা সমস্ত ভয়ের উর্ধে চলে যাবে।
মোহনা বাথরুমে ঢুকে থমকে গেল। বিশাল বাথরুম। ওপরে বড় ভেন্টিলেটার। উজ্জ্বল রোদ এসে পড়েছে পুরনো আমলের ঘিয়ে রঙের বাথটাব-এর ওপর। রোদে তিরতির করছে পানি। নগ্ন হয়ে বাথটবে নামে মোহনা। আহ্ । এখন একা হয়ে ভীষণ ভালো লাগছে। কাঁদতে পারবে বলে ভালো লাগছে। ইজাজের জন্য কাঁদবে । আজ ইজাজকে দেখল। কতদিন পর দেখল ... নিজের জন্যও কাঁদবে মোহনা। মাত্র ছ-মাস হল বিয়ে হয়েছে ওর। এরই মধ্যে রাগীব অনেক বদলে গেছে। রাগীব আর আগের মতো ওর প্রতি আকর্ষন বোধ করে না। মোহনা ঠিকই টের পায়। রাগীব আজ বাথরুমে এল না। অথচ বিয়ের পর ... আজকাল আর সেভাবে স্পর্শ করে না। রাগীবকে কেমন ক্লান্ত মনে হয়। কারও সঙ্গে জড়িয়েছে রাগীব? প্রমান নেই অবশ্য । লুকিয়ে রাগীবের মোবাইল চেক করেছে মোহনা । অপরিচিত কোনও মেয়ের নম্বর তো নেই। তাহলে?
আজ সকাল থেকে লং জার্নি হয়েছে। দুপুরে খেয়ে ওরা ঘুম দিল।
চারটের দিকে মোহনার ঘুম ভেঙে যায়। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দোতলার টেরেসে এসে বসল। বাতাসে শীত আছে। শাল জড়িয়ে নেয় মোহনা। অপরাহ্নের সমুদ্র চিকচিক করছে । বালিয়ারিতে ট্রাক। আর্মির লোকজন। হলুদ ক্যাপ পরা কয়েকজন চিনাও রয়েছে। সৈতকের ওপর দিয়ে কক্সবাজার-টেকনাফ রাস্তা তৈরি করছে। রেললাইন হলে অবশ্য বেশ হত। সাগর দেখতে দেখতে যাত্রী কুউউ ঝিকঝিক রেলে চড়ে টেকনাফ পৌঁছে যেত।
রউফ মিঞা চা নিয়ে আসে। মোহনা অবাক। আমি যে এখানে তা লোকটা কী ভাবে জানল? রউফ মিঞা নীচে থাকে। আমি টেরেসে বসেছি এক মিনিটও তো হয় নি। আশ্চর্য! লোকটাকে দেখলে কী রকম ছমছমে অনুভূতি হয়। তবে লোকটার রান্না ভালো। আজ দুপুরে খিচুরি আর ঝাল-ঝাল মুরগীর মাংস রেঁধেছিল। রাগীবও প্রশংসা করল। রাগীব সহজে রান্নার প্রশংসা করে না।
চায়ের কাপ নিল মোহনা। তারপর জিগ্যেস করল, এই বাড়িতে আপনি একা থাকেন?
রউফ মিঞা বলল, হ। কন্ঠস্বর কেমন খসখসে।
ভয় করে না?
রউফ মিঞা মাথা নাড়ে। হাসে।
আপনি বেশ সাহসী। আমি একা থাকতে পারব না। মোহনা বলে।
রউফ মিঞা চুপ করে থাকে।
এক তলায় বসার ঘরে একটা মেয়ের ছবি দেখলাম। ছবিটা কার জানেন? বলে চায়ে চুমুক দেয় মোহনা।
রউফ মিঞা বলে, হ। ছবিটা হইল আরশাদ চৌধরির মেয়ে নার্গিসের। আরশাদ চৌধরি জালিয়া পালং-এর খানদান বংশের সন্তান। তার বাপ-দাদারা বিস্তর জমিজমার মালিক। একমাত্র মেয়ে নার্গিসের বিয়ার আগে মেয়ের জামাইরে যৌতুক দিব বইলা মেয়ের নামে আরশাদ চৌধরির এই বাড়ি তৈয়ার করেন । এইসব হইল পাকিস্তান আমলের ঘটনা।
ওহ্।
মোহনার বিকেল আর সন্ধ্যা কাটল রাগীবের সঙ্গে বাড়ির ছাদ আর বাগানে ঘোরাঘুরি করে। রউফ মিঞার কাছ থেকে নীচে গেটের চাবি নিয়ে রাখল রাগীব। রাতে খেয়ে এসে টেরেসে বসল। নভেম্বরের মাঝামাঝি বলেই ফুটফুটে জোছনা ফুটেছে। চারপাশ নির্জন হয়ে আছে। পাশাপাশি বসে অনেকটা সময় কাটে। রাগীব ঘড়ি দেখে। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। বলে, চল, বিচে যাই।
চল। বলে মোহনা উড়ে দাঁড়ায়।
রউফ মিঞা এসে দাঁড়াল। বলল, স্যার।
কি হল? রাগীব বিরক্ত হয়।
একবার নীচে আসেন সার।
কেন? কি হয়েছে?
গেটের বাইরে কার জানি লাশ পইড়া আছে।
লাশ! কার! মোহনা আর্তচিৎকার করে ওঠে।
চিনিনা সার। মহিলা মানুষ সার। আপনে যদি একবার আসতেন।
মহিলা শুনে রাগীবের মুখের ভাব কেমন বদলে গেল ।
ওরা দ্রুত নীচে নেমে এল।
নীচের বাগান চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিল। যেন সার্চ লাইট জ্বেলেছে। তবে কুয়াশাও আছে। গেট খোলা। কুয়াশায় সাদা রঙের টয়োটা আভানজা ঠিকই চিনতে পারল রাগীব। ভয়ানক চমকে উঠল । লায়লার গাড়ি । লায়লা কোথায়? রাগীব দৌড়ে যায়। গাড়ির পাশে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর পড়ে আছে লায়লা। পরনে জিন্স। সোয়েটার। দেখেই মনে হল ডেড। ফ্যাকাশে মুখে চাঁদের আলো সরাসরি এসে পড়েছে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই। শ্বাসরোধ করে। জিভ বেরিয়ে আছে। কিন্তু কে ওকে খুন করল?
রাগীব, পুলিসে ফোন কর । প্লিজ। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মোহনা বলে।
না।
কেন? মোহনা অবাক।
পুলিস এলে ঝামেলা হবে। রাগীব বলল। রাগীবকে কেমন অস্থির আর উদ্ভ্রান্ত লাগছে । হঠাৎ রাগীব মেয়েটির নিষ্প্রাণ দেহের ওপর পড়ে কাঁদতে থাকে। বারবার বলে, আমায় ক্ষমা কর লায়লা। আমায় ক্ষমা কর ।
মোহনা স্তব্দ হয়ে যায় । মনে হল পায়ের তলার মাটি থরথর করে কাঁপছে। তীক্ষ্ম কন্ঠে প্রশ্ন করে, তুমি ওকে চেন?
হ্যাঁ। চিনতাম বলে দ্রুত উঠে দাঁড়ায় রাগীব। তারপর চোখের পলকে টয়োটা আভানজায় উঠে স্টার্ট নেয়।
দেখতে দেখতে গাড়িটা কুয়াশায় মিলিয়ে যায়।
মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর আর এ জীবনে আমার সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস হবে না। হঠাৎ মুক্তি পেয়ে গাঢ় ক্লান্তি বোধ করে মোহনা। রউফ মিঞার দিকে তাকালো। তারপর লায়লার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে মোহনা বলল, আপনি খালি খালি ঝামেলায় পড়লেন।
রউফ মিঞা মাথা নেড়ে বলে, না আফা, কুনও ঝামেলা হইব না। লাশটাস এইহানে বেশিক্ষণ থাকব না।
কেন? মোহনা অবাক।
মহিলারে যে মারছে লাশ হেই সরাই ফেলব।
আপনি তাকে কখনও দেখেছেন?
রউফ মিঞা বলে, হ মাঝে মাঝে ত দেখি। অনেক দিন ধইরা এই বাড়িত আছি। না দেইখা পারি?
আপনার কোনও ক্ষতি করে না?
না। আমার ক্ষতি করব ক্যান? যাগো মন পরিস্কার তাগো তারা ক্ষতি করে না। আমি কি কারও খুন করার বুদ্ধি করি নি?
এ বাড়িতে কে থাকে ? প্রশ্নটি না-করে পারল না মোহনা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রউফ মিঞা বলল, আরশাদ চৌধরির মেয়ে নার্গিস।
মোহনার শরীর জমে ওঠে। শীতের মধ্যেও ঘামতে থাকে। কি হয়েছিল?
রউফ মিঞা বলে, নার্গিস বিয়ার পর এই বাড়িত থাকত। বিয়ার পর নার্গিসের স্বামী এই বাড়িতেই এক দাসীবান্দির লগে মইজা যায় আর কি । বলে মুখ ফিরিয়ে নেয় রউফ মিঞা। তারপর বলে, সেই খানকির পুতে নার্গিসকে খুন করে। বলে থুঃ করে থুতু ফেলে রউফ মিঞা।
মোহনা চমকে ওঠে। এক নিমিষে ওর কাছে সব পরিস্কার। ছোট্ট শ্বাস ফেলে ও। তারপর দূরের ধূসর কুয়াশার দিকে তাকিয়ে মোহনা ভাবল: এই সব ঘটনা কে যেন সাজিয়ে রেখেছে। আড়াল থেকে দেখছে। নইলে ইজাজ কেন উখিয়ার জালিয়া পালং -এ থাকবে?
মোহনা কি মনে করে দোতলার দিকে তাকায়। বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে। একটা মেয়ে । ধবধবে চাঁদের আলোয় স্পস্ট দেখা যায়। যাকে আজ দুপুরে একতলায় ড্রইংরুমের ছবিতে দেখেছে। শাড়ি পড়া। মোহনার শরীর কেঁপে ওঠে।
রউফ মিঞা বলে, আপনে এখন সোজা নীচের দিকে হাঁটতে থাকেন আফা। যারে দেখবার চান তার লগে আপনের দেখা হইয়া যাইব।
মোহনা ভীষণ চমকে ওঠে। আপনি ...আপনি কি ভাবে জানেন?
খসখসে কন্ঠে রউফ মিঞা বলে, আমি আরশাদ চৌধরির দাদার আমল থেইকাই এই জায়গায় থাকি।
মোহনার শরীর কেঁপে ওঠে। কাঁপা কাঁপা স্বরে জিগ্যেস করে, আপনার .. আপনার বয়স কত?
আমার বয়ষ অনেক। এইসব কথা অখন থাউক । আপনি অখন যান। খসখসে কন্ঠে রউফ মিঞা বলে।
মোহনা এলোমেলো পায়ে হাঁটতে থাকে। ইজাজ-এর মুখটা ভেসে উঠছে বারবার । শেষবার দেখা হওয়ার সময় ইজাজ বলেছিল: তোমাকে আমি খুঁজব মোহনা। সারা জীবন। তোমার আমার বিরহ সাময়িক। এর অন্য কোনও মানে আছে ...একদিন ঠিকই বুঝতে পারবে। কথাটা শুনে মোহনা কেঁপে উঠেছিল।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ভোর হয়ে যায়। জীবনে এই প্রথম নিজেকে নির্ভার লাগছে মোহনার । হাঁটতে-হাঁটতে ও প্রায় বড় রাস্তার প্রায় কাছাকাছি চলে এল। হর্ন বাজিয়ে মহাসড়কে একটি ট্রাক চলে যায়। কুয়াশায় ডিজেলের গন্ধ মিশে আছে। স্কুলের কাছে চলে আসে মোহনা। মাঠ এখন কুয়াশায় ঢেকে আছে। স্কুলের বাইরে চায়ের স্টলটি বন্ধ। ... কুয়াশার ভিতর কে যেন হেঁটে হেঁটে আসছে। লম্বা। ঝুঁকে-ঝুঁকে হাঁটছে। গায়ে চাদর। শ্যামলা। মুখে চাপ দাড়ি। চোখে চশমা। ইজাজ? মোহনা জানে ইজাজ ভোরবেলা হেঁটে বেড়াতে ভালোবাসে। তখন যে অনুভূতি হয় ... সে অনুভূতিই শব্দরূপে ‘অরণ্য ও সমুদ্রের দিনলিপি’ বইয়ে ঠাঁই পায়। ... মোহনা দ্বিতীয় জীবনে পৌঁছে বুক ভরে শ্বাস নিল ...
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:১৮
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×