সকাল বেলা। বাজার থেকে ফিরে গোছল সেরে খেয়ে দেয়ে অফিস যাবার জন্য তৈরি হয়েছি । নীচের গেটে শব্দ। মা বলল, দ্যাখ তো বাদল, কে এল।
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। একতলায় অ্যাডভোকেট নাজমূল করিম ভাড়া থাকেন। সাধারণত কেউ এলে ওদেরই কেউ একতলার গেট খুলে দেয়। নাজমূল করিম সাহেব গতকাল পরিবার নিয়ে দেশের বাড়ি বেড়াতে গেছেন। আগামীকাল ফেরার কথা। পিকলুকে মিস করছি। পিকলু নাজমূল করিম সাহেবের ছেলে। ক্লাস সেভেনে পড়লেও পিকলু সঙ্গে আমার বেশ ভাব। পিকলুকে ঘুড়ি ওড়ানোর কলাকৌশল শেয়ার করতে করতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি।
টিনের গেটটা খুললাম। কাপড়ের বোচকা হাতে একজন বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। পরনে কালো পাড় সাদা শাড়ি। ঘোমটার নীচে মুখটি বেশ ফরসা। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মুখেচোখে এককালে শ্রী থাকলেও এখন কুঁচকে গেছে। কপালে পাকা চুলও চোখে পড়ল। বৃদ্ধাকে আমি এর আগে কখনও দেখিনি। বললাম, কাকে চান?
বৃদ্ধা খনখনে কন্ঠে বলল, এইটা তৈয়বের বাড়ি না?
তৈয়ব মানে, তৈয়বুর রহমান?
হ।
হ্যাঁ। তৈয়বুর রহমান আমার বাবা। আপনি ভিতরে আসুন।
না, তুমি আগে তৈয়বরে ডাকো।
আমি কি বলতে যাব। থমকে গেলাম। আমার বাবা গতবছর মারা গেছে। বৃদ্ধা বাবাকে চেনে অথচ বাবা যে গত বছর মারা গেছে তা জানে না। বললাম, মানে ... বাবা তো মারা গেছে।
মারা গেছে? কবে? বৃদ্ধা তীক্ষ্মকন্ঠে জিগ্যেস করে।
গত বছর।বললাম।
হায় আল্লা, কও কি ... আমারে কেউ খবর দিল না। বৃদ্ধা আর্তনাদ করে উঠল।
ততক্ষণে মা দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, কে রে বাদল?
আমি চিনি না মা। মুখ ফিরিয়ে বললাম।
মরিয়ম বু না? বলে মা চেঁচিয়ে বলল।
হ, আমি মরিয়ম। বৃদ্ধা মাথা নেড়ে বলে।
দাঁড়াও। আমি আসছি।
একতলার সিমেন্টের উঠানটি রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উঁচু। বললাম, আপনি ভিতরে আসেন। বলে বৃদ্ধার হাত ধরলাম। ধরেই চমকে উঠলাম। বৃদ্ধার হাত ভীষণ ঠান্ডা। আর ভেজা। যেন মরা মাছ ছুঁয়েছি।
মা নীচে নেমে এল। বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কত বছর পর তোমারে দেখলাম মরিয়ম বু। আমাগো একদম ভুইলা গেছ। বলে আমার দিকে তাকিয়ে মা বলল, মরিয়ম বু তোর আব্বার ফুপাত বোন। জগদীশপুর থাকে।
ও।
আমি ঘড়ি দেখি। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। বললাম, মা, আমি গেলাম।
মা বলল, আচ্ছা, তুই যা। চল, বুবু, ওপরে চল। তেমারে কতদিন পর দেখলাম । সেই বিয়ে পর একবার দেখছিলাম।
গলিতে নেমে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। বেশ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। সকালের দিকে অবশ্য মেঘলা ছিল। আমার অফিস কাছেই। আমার ভাগ্য ভালো। এইচএসসি-র পর ঢাকা শহরে পড়াশোনা করলেও নিজের মফঃস্বল শহরেই একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গেছি। বাবা গত বছর মারা যাওয়ার পর ছোট্ট সংসারে আমি আর মা। আমার অবশ্য বড় এক বোন আছে। শাপলা আপার বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়ি রূপপুর। ফাঁকা শূন্য ঘরে আমার মায়ের ভালো লাগে না। মা আমার জন্য পাত্রী দেখছে। আমার চাকরির পর মা আমার বিয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস হয়েছে। পাত্রী অবশ্য একরকম ঠিক। নাদিরা। এ শহরেরই মেয়ে। শাপলা আপার বান্ধবী শিখা আপার ছোট বোন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে স্থানীয় একটি মহিলা কলেজে বি . এ পড়ছে নাদিরা। প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসে। মায়ের সঙ্গে খুব ভাব নাদিরার। নাদিরাকে সঙ্গে নিয়েই মা বিয়ের শাড়ি কিনছে। নাদিরার বড় মামা কুয়েত থাকেন। মাস খানেক পর তিনি দেশে ফিরবেন। তখন বিয়ে।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে মরিয়ম ফুপুর কথা মনে হল।
অফিস থেকে হাঁটতে-হাঁটতে বাজারে গেলাম। এলোমেলো ঘুরলাম কিছুক্ষণ। কি কিনব বুঝতে পারছি না। সকালে বাজারে এসে বড় একটা রুইমাছ কিনেছি। তরিতরকারিও আছে ঘরে। বেছে-বেছে দরদাম করে এক ডজন কমলা কিনলাম । হঠাৎ মনে পড়ল। মা কালরাতে সুপারি কিনতে বলেছিল। সুপারি কিনে বাজারের বাইরে এসেছি। ঠিকই তখনই মনিরুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। মনিরুল ভাই সেতারা ফুপুর ছেলে। সেতারা ফুপু আমার বাবার খালাতো বোন। সেতারা ফুপুরা তালতলা থাকে। অনেক দিন দেখা সাক্ষাৎ নাই। মনিরুল ভাইয়ের সঙ্গেও অনেক দিন পরে দেখা। মনিরুল ভাই পোলট্রির বিজনেস করেন। বললেন, মা খুব অসুস্থ।
শুনে আমার মন খারাপ হল। বললাম, আজকালের মধ্যেই মাকে নিয়ে তালতলা যাব।
মনিরুল ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গলিতে হাঁটছি। লোড শেডিং চলছিল বলে গলি অন্ধকার। সেতারা ফুপু অসুস্থ শুনে খারাপ লাগছিল। আজকাল সেতারা ফুপুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কমে গেলেও এককালে যোগাযোগ ছিল। ছেলেবেলায় সেতারা ফুপু আমাকে আদর করতেন । ঘুড়ি কেনার পয়সা দিতেন ।
বাড়ির সামনে আসতেই কারেন্ট এল।
দরজা খুলল মা। বললাম, বাজারে মনিরুল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা।
কি কইল মনিরুলে? ওর মায়ে কেমন আছে?
বললাম, সেতারা ফুপু অসুস্থ। শুনে মা অস্থির হয়ে উঠল। বলল, তুই কালই আমারে তালতলা নিয়া চল।
বললাম, আচ্ছা, তোমাকে কালই তালতলা নিয়ে যাব।
ঘরে ঢুকে রান্নার চমৎকার গন্ধ পেলাম। রান্নাঘরে এলাম। মরিয়ম ফুপু চুলার সামনে বসে । হাতে কমলার ঠোঙা দিতেই ফুপুর আঙুলের স্পর্শে চমকে উঠলাম। হাত কেমন ঠান্ডা। যেন মরা মাছ ছুঁয়েছি। মরিয়ম ফুপু অদ্ভুত শব্দ করে হেসে উঠল। চশমার কাঁচের ওপাশে চোখ দুটি যদিও নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছি। আমার শরীর শিরশির করে উঠল।
রাতে খেতে বসে অবাক হলাম। মুগের ডালের খিচুরি আর ধনে পাতা দিয়ে রুই মাছ। চমৎকার রান্না। মা বলল, তোর মরিয়ম ফুপুর রাঁধছে । তোর আব্বায় মুগের ডালের খিচুরি আর ধনে পাতা দিয়ে রুই মাছ পছন্দ করত।
ওহ্ ।
রাতে ঘুম এল না। বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে একবার নাদিরা মিস কল দিয়েছিল। তখন মোবাইলে নাদিরার সঙ্গে বেশ খাণিক ক্ষণ উষ্ণ প্রেম হল। মোবাইলের কল্যাণে এখন এসব মফঃস্বল শহরেও পৌঁছে গেছে। তারপর ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙার পর মনে হল ঘরে আমি একা নই। আরও কেউ আছে। যে আছে সে অন্ধকারে ঘরে হাঁটছে। ঘর অবশ্য একেবারে অন্ধকার নয়। জানলা গলে চাঁদের সাদা আলো ঢুকেছে ঘরে। খুট করে শব্দ হল। মনে হল কেউ কিছু খুঁজছে। বেশ ভয় পেলাম। আমার শরীর ঘামে ভিজে গেছে । সাহস করে উঠে বসলাম। তারপর আলো জ্বালালাম। নাঃ, ঘরে কেউ নেই। আবার আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম । তার আগে ঘড়ি দেখলাম। রাত দেড়ট বাজে। জানালায় অস্থির বাতাস। আর জোছনার আলো । একটা সিগারেট ধরালাম। গন্ধটা বাজে ঠেকল। মনে হল তামাকের বদলে আলকাতরা ভরে দিয়েছে। বিরক্ত হয়ে সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে দিলাম। ভিতরে-ভিতরে ভীষণ চঞ্চল বোধ করছি। কেন জানি না। বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে এলাম । নীচে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। সিমেন্টের উঠানের ঠিক মাঝখানে পিকলু দাঁড়িয়ে। হাতে নাটাই। ওরা কবে এল? এখন রাত প্রায় দুটো বাজে । এত রাতে পিকলুর তো উঠানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা না। জলদি বারান্দায় এলাম। নীচে তাকিয়ে দেখি উঠানে কেউ নেই। ঠিক তখনই বসার ঘরে শব্দ হল। কে যেন চেয়ার সরাল। দ্রুত বারান্দা থেকে বসার ঘরে এলাম। বসার ঘরে আগরবাতির গন্ধ। আশ্চর্য! ঠিক তখনই শোওয়ার ঘর থেকে ‘ঘটাং’ শব্দ হল । শোয়ার ঘরের পুরনো লোহার আলমারীটা খোলার সময় এরকম ‘ঘটাং’ করে শব্দ হয়। আশ্চর্য! এত রাতে কে আলমারী খুলল? মার তো ঘুমিয়ে থাকার কথা। দ্রুত শোয়ার ঘরে এলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আলো জ্বালালাম। নাঃ, আলমারী বন্ধ। ঘরের ঠিক মাঝখানে বড় একটি পুরনো আমলের পালঙ্ক। তারই একপাশে মা গুটিশুটি মেরে শুয়ে। পাশে ফুপু নেই। ফুপু গেল কই? বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার নীচে আলো । পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম । ওহ্, ফুপু তাহলে বাথরুমে? ঘরের আলো নিভিয়ে আমি ঘরে ফিরে আসি। একবার জানালায় উঁকি দিই। নাঃ, নীচের উঠানে কেউ নেই। কেবল সাদা জোছনার আলোয় ভরে আছে। নাহ্, আমারই মনের ভুল।
পর দিন দুপুর। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছি । মা তৈরি হয়ে ছিল। জিগ্যেস করলাম, মরিয়ম ফুপু কি তালতলা যাবে?
মা বলল, না। সকাল থেকে মরিয়ম বুর শরীর খারাপ। ঘুমায় আছে।
থাক, ঘুমাক তাহলে। বললাম।
নীচে নেমে আমি আর মা পাশাপাশি হাঁটছি। বাসস্টপটা কাছেই। বাসস্টপ থেকে আপেল-কমলা কিনে বাসে উঠলাম। তালতলা জায়গাটা কাছেই। পৌঁছতে সময় লাগবে না। সাত কিলোমিটারের মতো বাসরাস্তা ।
বাসে মাকে বললাম, মরিয়ম ফুপু আমাদের ঠিক কেমন আত্মীয় হয় বল তো ?
মা বলল, মরিয়ম বু তোর আব্বার ফুপাত বোন। তোর আব্বার সঙ্গে মরিয়ম বু-র বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। মরিয়ম বুর আব্বা বিয়াতে রাজি হয় নাই। তারপর জোর কইরা মরিয়মের জগদীশপুর বিয়া দেয়।
ও। তাহলে মরিয়ম ফুপুর একটা বিষন্ন অতীত আছে? তার টানেই এসেছে? এখন বেশ বুঝতে পারছি বাবার মুখে কেন কখনও মরিয়ম ফুপুর কথা শুনিনি। কেন বাবা কখনও জগদীশপুরের কথাও বলেনি। তবু খটকা গেল না। মরিয়ম ফুপু বাড়ি চিনলেন কি করে? বৃদ্ধা মানুষ। একা এলেনই বা কি করে?
মা বলল, আমার বিয়ার পর মরিয়ম বুরে একবার দেখছিলাম। তিরিশ বছর আগে। আমারে হিংসা করে মরিয়ম বু।
হিংসা করে কেন? আমি অবাক।
তর আব্বা লগে আমার বিয়া হইল বইলা।
ও।
এরপর মা বলল, কালাই আমারে মরিয়ম বু জিগ্যাস করল, তোমার বিয়ার গয়নাগাঁটি সব কি করছ মমতাজ। কইলাম, বাদলের বিয়া ঠিক হইছে। গয়নাগাঁটি আমি ওর বৌয়েরে হাতে দিমু। দেখি মরিয়ম বুর মুখ কেমন কালো হয়ে গেল। কইল, তৈয়ব ভাইয়ের লগে আমার বিয়া হইলে গয়নাগাঁটি আমিই পাইতাম।
শুনে অবাক হয়ে গেলাম।
তালতলা অনেক দিন পরে এলাম। পাঁচ-সাত বছর তো হবেই। কেবল শহর নয়, এখন মফঃস্বলের লোকজনের মধ্যেও দূরত্ব বেড়েছে। তালতলায় সেতারা ফুপুদের টিন সেডের বাড়িটি গাছপালায় ঘেরা। বাড়ির সামনে উঠান। বাঁ পাশে গোয়াল ঘর। জামরুল গাছ। পুকুর । ছেলেবেলায় ওই পুকুরে অনেক দাপাদাপি করে। মনিরুল ভাই পোলট্রির ব্যবসা ছাড়াও মাছ চাষও করে । পুকুর পাড়ে ঘন বাঁশ ঝাড়। অস্থির বাতাসে শরশর শব্দ। বাসে ওঠার পর আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হতে পারে।
উঠানে মনিরুল ভাইয়ের বউ সালমা ভাবী দাঁড়িয়ে। কাপড় তুলছিল। আমাদের দেখে হাসল। তারপর দৌড়ে বারান্দায় কাপড় রেখে ফিরে এসে মাকে সালাম করল। বলল, আসেন। ঘরে আসেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, কেমন আছেন বাদল ভাই?
বললাম, ভালো। বলে, আপেল-কমলার ঠোঙা দিলাম সালমা ভাবীর হাতে।
সেতারা ফুপু একটা ঘরে শুয়ে আছে। শরীর আগের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে গেছে। কালো মুখটা। বিশেষ করে চোখের চারপাশে ঘন কালি জমে আছে। মাথা ন্যাড়া। মনিরুল ভাই গতকালই ইঙ্গিত দিয়েছিল ... ক্যান্সার।
মা অনেক ক্ষণ। কাঁদল। দুজনের অনেক কথা হল। বেশির ভাগই পুরনো দিনের। আমি ফুপুর মাথার কাছে বসলাম। ফুপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। টিনের চালে তখন বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ। ঘরটা অন্ধকার হয়ে এসেছে।
সালমা ভাবী পান নিয়ে এল । তারপর ঘরের আলো জ্বালিয়ে বলল, আপনার ভাইরে ফোন করছি। এখনই আসতেছে।
মা পান মুখে দিয়ে বলল, মরিয়ম বু আমাগো বাড়িত বেড়াইতে আসছে।
কার কথা কও? কোন মরিয়ম? সেতারা ফুপু ক্ষীণ দূর্বল কন্ঠে বললেন।
মা বলল, ওই যে মরিয়ম। বাদলের আব্বার ফুপাতো বোন। যার জগদীশপুরে বিয়া হইছিল।
সেতারা ফুপু আর্তস্বরে বলল, হায় হায়। কও কি ভাবী ! মরিয়ম তো পাঁচ বছর আগে মারা গেছে।
মারা গেছে! কি কও সেতারা বু? বলে মা আমার দিকে তাকাল। আমি থ। মরিয়ম ফুপু মারা গেছে মানে?
হ। পাঁচ বছর হইল। সালমা গো বাড়িও জগদীশপুরে। আমরা তখন জগদীশপুরে বেড়াইতে গেছিলাম। সালমাও মরিয়মরে চিনে।
হ। চিনি। বলে সালমা মাথা নাড়ল।
মনিরুল ভাই এলেন। অনেকটা ভিজে গেছেন। মাকে সালাম করলেন। তারপর সব শুনে মনিরুল ভাইও বললেন: মরিয়ম ফুপু মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। তখন মনিরুল ভাইও জগদীশপুরে ছিলেন। কবর দেওয়ার সময়ও ছিলেন।
মা আমার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে রইল। ফিসফিস করে বলল, এরা কি কয় রে বাদল? তাইলে আমাগো বাড়িতে কে আইল?
আমি আর কি বলব। এতগুলো লোক কি আর মিথ্যে কথা বলবে?
হঠাৎ আসা বৃষ্টিটা কমে এসেছে। যত শিগগির সম্ভব বাড়ি যাওয়া দরকার। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাসস্টপ পর্যন্ত ছাতা নিয়ে মনিরুল ভাই এলেন। ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে বাসে ছাড়ল। বাসে মায়ের সঙ্গে তেমন কথা হল না। দুজনে গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলাম। মা কেবল একবার বলল, এরা কি কইল রে বাদল। মরিয়ম বু নাকি বাঁইচা নাই। তা হইলে কে আইল?
বাড়ি না-ফেরা পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। বললাম।
বাস থেকে নেমে হাঁটছি। ততক্ষণে আবার ঝরঝরে রোদ উঠেছে। তখনও ঘোর কাটেনি। মরিয়ম ফুপুকে আমি গতকাল দু-বার স্পর্শ করেছি। দু-বারই অত্যন্ত শীতল অনুভূতি হয়েছে। মরিয়ম ফুপুর চোখের দৃষ্টিও কেমন নিষ্প্রাণ। মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরছিল: মরিয়ম ফুপু যদি মারাই যাবেন তা হলে আমাদের বাড়ি যে এসেছে সে কে? কেন এসেছে? মরিয়ম ফুপু বাবাকে খুব ভালোবাসত। বাবা মুগের ডালের খিচুরি আর ধনে পাতা দিয়ে রুই মাছ খেতে ভালোবাসে বলে রাঁধল। মায়ের কাছে বিয়ার গয়নাগাঁটি খোঁজ নিল।আশ্চর্য! কাল রাতে ঘরে খুটখাট শব্দ পাচ্ছিলাম। যেন কেউ কিছু খুঁজছে। মরিয়ম ফুপু আমাদের বাড়ি আসার পর থেকেই অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটছে। পিকলুকে দেখলাম গতকাল মাঝ রাতে জোছনার ভিতর নীচের উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে। ... এসব ভেবে আমার কেমন শীত-শীত করতে লাগল।
আমি আর মা পাশাপাশি হাঁটছি। দূর থেকে দেখলাম বাড়ির গেটের সামনে পিকলু দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে স্বস্তি পেলাম। পিকলুর পরনে হলুদ গেঞ্জি আর নীল হাফ প্যান্ট। হাতে নাটাই। স্কুলের মাঠে যাচ্ছে বলে মনে হল।
কাছে এসে বললাম, কি রে, তোরা কখন এলি?
একটু আগে। বলে মিষ্টি হাসল। তারপর বলল, দেখ না বাদল ভাই, দাদুবাড়ির হাট থেকে নতুন নাটাই কিনেছি।
আমি হেসে মাথা নাড়লাম।
একটু পর সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। সিঁড়িতে নাদিরা কে দেখলাম । নীচে নেমে আসছে। মাকে দেখে ভীষণ চমকে উঠল নাদিরা। তারপর ওমাঃ। বলে হাত দিয়ে মুখ চাপা দিল। চশমা পরা ফরসা মুখটা কেমন ভয়ে আতঙ্কে নীল হয়ে গেছে। চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি। মায়ের দিকে চেয়ে খসখসে কন্ঠে নাদিরা বলল, আপনি! এখানে!
হ। আমি। ক্যান। কি হইছে?
তাহলে ঘরে আমি কাকে দেখলাম?
কারে দেখলা?
নাদিরা বলল, আপনাকে দেখলাম। আপনি আমাকে বিয়ের শাড়ি বের করে দেখালেন।
কও কি? দরজা খুলল কে?
নাদিরা বলল, কেন আপনি? বললেন, আস মা। বাদল এখনও অফিস থেকে ফেরেনি।
আমি বললাম, ঘরে আর কাউকে দেখনি? বৃদ্ধ মতন ?
না তো। নাদিরা বলল।
আমরা দ্রুত উপরে উঠে এলাম।
ফাঁকা ঘর। কেউ নেই। মরিয়ম ফুপুর কই গেল? আশ্চর্য!
মা দ্রুত শোবার ঘরে ঢুকল। পালঙ্কের ওপর শাড়ির স্তূপ। এলোমেলো ছড়িয়ে। শাড়িগুলি আমার পরিচিত। নাদিরার বিয়ের শাড়ি। ঘরের আসবাবপত্রগুলি সব ওল্টানো। অগোছালো। আলমারী খোলা। মা আর্তচিৎকার করে আলমারীর কাছে ছুটে গেল । তারপর ঝুঁকে বসে আলমারীর নীচের একটি ড্রয়ার খুলল। তারপর ‘হায় আল্লা’ বলে চিৎকার করে উঠল।
কি হল! আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে জিগ্যেস করি।
গয়নার বাক্সটা নাই ! মরিয়ম নিয়া গেছে কবরে। গয়না নাদিরারে দিব না।
কথাটা শুনে আমার সারা শরীর জমে যায় ...
উৎসর্গ: আকাশ পাগলা ...
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১২ ভোর ৫:২৮