রামু থেকে গর্জনিয়া যাওয়ার পথে বাসে একজন মাঝবয়েসি ভিক্ষু আমাকে বলল, খুব শিগগির নাকি আমি এক ডাকিনীর খপ্পড়ে পড়ব । কথাটা শুনে আমি সাঙ্ঘাতিক রকমের ঘাবড়ে গেলাম। আমার ঘাবড়ে হওয়ারই কথা। কারণ ডাকিনীর খপ্পড়ে পড়া তো ভারী সাঙ্ঘাতিক ঘটনা। তা ছাড়া আমি এর আগে কখনও ডাকিনীর খপ্পড়ে পড়িনি। সত্যিকারের ডাকিনীরা দেখতে কেমন হয়, তাও জানি না। তবে এই ইন্টারনেটের যুগেও যে ডাকিনীর মুখোমুখি হওয়া সম্ভব, সেকথা ভেবেও খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম । তবে ভিক্ষু আমাকে অভয় দিয়ে বলল, অসুবিধে নেই। এই শঙ্খটি ডাকিনীর হাত থেকে রক্ষা করবে । বলে আমার ডান বাহুতে ভিক্ষু একটা ছোট নীল রঙের শঙ্খ বেঁধে দিল। অবশ্য মন্ত্রপূতঃ নীল শঙ্খটি শরীরে ধারণ করে কোনওরকম টের পেলাম না।
চট্টগ্রাম থেকে রামু পৌঁছেছি দুপুর নাগাদ। একটা হোটেলে ঢুকে খেয়ে-দেয়ে আবার গর্জনিয়ার বাসে ওঠার পর ভিক্ষুর সঙ্গে পরিচয়। ভিক্ষু মুখ গম্ভীর। মাঝবয়েসি যে তা আগেই বলেছি। যথারীতি মঙ্গোলয়েড মুখ। মাথা নিখুঁত ভাবে কামানো। পরনে লাল রঙের গেরুয়া (বৌদ্ধরা চীবর বলে ) ।
ভিক্ষুকে আমি আমার নাম বললাম। গর্জনিয়া যাওয়ার কারণও বললাম। ভিক্ষুও গর্জনিয়া যাবে। ওখানেই একটা মঠে নাকি থাকে। নাম এথিন লামা। ভিক্ষুর নাম ‘এথিন লামা’ শুনে অবাক। এথিন লামা বলল, তার জন্ম রামুতে হলেও তরুণ বয়েসে তিব্বতে চলে গিয়েছিল। প্রায় তিরিশ বছর তিব্বতের একটি নির্জন গুম্ফায় ছিল। পাঞ্চেন নামে এক লামার কাছে গুপ্ত তন্ত্রবিদ্যা অধ্যয়ন করেছে। তারপর রামুতে ফিরে এসেছে। রামুর লোকজন তাকে এথিন লামা বলেই ডাকে । এথিন লামা নাকি অশুভ শক্তি নাশ করে। এই উদ্দেশ্যে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়।
এসব শুনে আমি কৌতূহল বোধ করি। তিব্বত নিয়ে আমার উৎসাহ আছে। শুনেছি তিব্বতের লামারা নানা গুপ্তমন্ত্র জানে। তারা নাকি উড়তেও পারে। কথাটা সত্যি কিনা জিগ্যেস করতেই এথিন লামা কিছু না-বলে মিটমিট করে হাসতে লাগল।
গর্জনিয়া পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হল। বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশে কড়–ই গাছের নীচে দাঁড়ালাম। ছোট খালু আমাকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছেন। ছোট খালু রামু তে সেটেল করার পর থেকে আমায় অনেকবার যেতে বলছেন । যাব- যাব করেও এর আগে আসা হয়নি। এবার এইচ এস সি পরীক্ষার পর ফুসরত মিলল । রামু থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার । মনে সমুদ্র দেখার লোভও ছিল।
আমার পাশে এথিন লামাও দাঁড়িয়েছে। জায়গাটা বাজারের মতো। রাস্তার দু’পাশে স্থানীয় আদিবাসীরা বাঁশের ঝুড়িতে আদা, আনারস, কাঁকরোল, কাঁচা কলা নিয়ে বসেছে। গর্জনিয়া রামুরই একটি ইউনিয়নে । রামু সদরের অনেকটা পুবে। প্রচুর আনারস আর আদা ফলে। বৌদ্ধ মন্দিরের জন্যও বিখ্যাত গর্জনিয়া। কাছেই রাস্তার ওপারে একটি বৌদ্ধ মঠ। এথিন লামা হাত তুলে মঠটি দেখিয়ে বলল, আমি ওই মঠেই থাকি।
বেশ বড় মঠ। কাঠের। চূড়টি ধবধবে সাদা। সুন্দর। বললাম। এথিন লামা হাসল।
কড়–ই গাছের নীচে একটা চা স্টল। বেঞ্চ। একটি অল্প বয়েসি রাখাইন ছেলে চা বানাচ্ছে। এরই মধ্যে আমার এথিন লামার সঙ্গে বেশ খাতির হয়ে গেছে। হাজার হলেও আমাকে একটি নীলশঙ্খ উপহার দিয়েছে। কাজেই বললাম, চলেন, চা খাই।
এথিন লামা রাজি। আমার সঙ্গে বেঞ্চিতে চা খেতে বসে। চা খাওয়া শেষ। বললাম, আজ আর সময় হবে না। কাল সকালের দিকে আপনার মঠে আসব।
এথিন লামা মাথা নাড়ল। দাঁত বের করে হাসল। ঠিক তখনই দূর থেকে রাস্তার ওপারে ছোট খালু কে একটি কাকাও গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমি এথিন লামার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তা পার হয়ে ছোট খালুর কাছে যেতেই খালু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, আয়।
ছোট খালু আগে চট্টগ্রামে মোটর পার্টসের ব্যবসা করতেন । তার আগে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। এখন ওসব ছেড়ে গর্জনিয়ায় জমি কিনে আদা আর আনারস চাষ করছেন। ছোট টিলার ওপর বাংলো বাড়ি করেছেন। ছোট খালা-খালুর একটাই মেয়ে। সাদিয়া আপা আমেরিকায় পড়াশোনা করছে।
বৌদ্ধ মঠের পাশ দিয়ে উঠে গেছে বাঁকানো লাল মাটির পথ। দু’ পাশে রেইনট্রি আর ইউক্যালিপটাস। শেষবেলায় অজস্র পাখি কিচিরমিচির করছে। একটা খরগোশ দৌড়ে রাস্তা পাড় হল। গাছ থেকে সরসর করে নেমে এল একটা কাঠবেড়ালী। আর ঝিঁঝির ডাকে কান পাতা দায়। চারিদিকে মনোরম আলো ছড়িয়ে আছে। গাছতলায় কেমন ছায়া-ছায়া। কী সুন্দর জায়গা। রোমেল কে মিস করছি। রোমেল আমার বন্ধু। একই কলেজ থেকে এবার এইচ এস সি দিয়েছি। রোমেলও গর্জনিয়া আসতে চেয়েছিল। হঠাৎ জ্বরে পড়ল বেচারা।
পথটা যেখানে শেষ হল সেখানে সাদা রং করা কাঠের বেড়া। মাঝখানে গেট। দু’পাশে দুটো ইপিল ইপিল গাছ। তারপর লন। এক পাশে ফুলের গাছ। অন্য পাশে ছবির মতো সাদা রং করা কাঠের একটা বাংলো। একতলা আর দোতলায় বিদেশি স্টাইলের গরাদহীন জানালা। জানালার ফ্রেমের রং সবুজ। মনে হল রূপকথার রাজ্যে চলে এসেছি। বাংলোর পিছনের ঢালে সম্ভবত আদার খেত আর আনারস বাগান। বাংলোর সামনে একটা জিপ।
মিলি খালা আমাকে দেখে এগিয়ে এল। বলল, এলি শেষ পর্যন্ত?
আমি হাসলাম।
ছোট খালু বললেন, মিলি তোমরা বসে কথা বল। আমি চট করে একবার বাজার থেকে ঘুরে আসি। বলে ছোট খালু জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন।
মিলি খালা বললেন, খরগোশ পেলে এনো কিন্তু। শান্তা খরগোশের মাংস খেতে চেয়েছে।
ওকে। বলে ছোট খালু জিপে উঠে স্টার্ট নিয়ে চলে গেলেন।
সূর্য ডুবতে এখনও অনেক দেরি । শেষবেলায় চারিদিকে যথেষ্ট আলো ছিল। আমরা লনেই বসলাম। বেতের চেয়ার পাতা ছিল। এলোমেলো ফুরফুরে বাতাস বইছিল। আকাশের রং বদলে যাচ্ছিল দ্রুত।
একজন অল্পবয়েসি ছেলে এল। হাতে ট্রে। ট্রেতে চায়ের পট আর কাপ। ছেলেটির গড়ন ছোটখাটো , শরীর হলদে রঙের । গলায় সাদা শঙ্খের মাদুলি। ছেলেটির পরনে সবুজ রঙের সারং আর সাদা রঙের ফতুয়া। ছেলেটিকে রাখাইন বলে মনে হল। রামুতে রাখাইনদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। টেবিলের ওপর চা রেখে চলে গেল ছেলেটি।
মিলি খালা ঝুঁকে চায়ের কাপ তুলে নিতে নিতে বলল, ওর নাম মং ছিং। ছেলেটা রাখাইন। বৌদ্ধ। বেশ বিশ্বস্ত। আর ধার্মিক। এথিন নামে এক তান্ত্রিক লামার শিষ্য মং ছিং ।
আমি চায়ের কাপ তুলেছি, চুমুক দেওয়ার আগে আমার হাত শূন্যে থমকে গেল। বললাম, এথিন লামা মানে- নীচের ওই বৌদ্ধ মঠে থাকে ?
হ্যাঁ। তুই চিনলি কি করে? মিলি খালার এবার অবাক হওয়ার পালা।
গর্জনিয়া আসার সময় বাসে দেখা হয়েছে। বললাম। চায়ে চুমুক দিলাম।
ও। জানিস আবীর। ভিক্ষু এথিন নাকি শূন্যে ভাসতে পারে।
তাই? এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। এথিন লামার সঙ্গে কত কথা হল, কই এ ব্যাপারে তো সে কিছু বলেনি ।
অকাল্ট সায়েন্স নিয়ে মিলি খালার বেশ আগ্রহ আছে। মিলি খালার লাইব্রেরিতে অকাল্ট সায়েন্স বিষয়ক অনেক বই আছে। এথিন লামা সম্বন্ধে তার জানারই কথা। মিলি খালা বলল, মং ছিং নাকি এথিন লামাকে একবার উড়তে দেখেছে।
আমি জিগ্যেস করলাম, সত্যি কি তিব্বতের লামারা উড়তে পারে?
মিলি খালা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, না। সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে, যাদের কাজ হল পৃথিবী থেকে অশুভ শক্তি দূর করা, শুধু তারাই পারে । আর যখন কেউই লামাদের আকাশে উড়তে দেখেনি তখন অবিশ্বাস করার কোনও মানে হয় না।
তুমি কখনও এথিন লামাকে উড়তে দেখেছ?
না। তবে মং ছিং উড়তে দেখেছে। মং ছিং মিথ্যে কথা বলার লোক না। অন্তত আমাদের কাছে । তিব্বতের লামাদের ওপর লেখা তোকে একটা বই দেব পড়তে।বইটা পড়লেই সব বুঝতে পারবি।
আমি কি বলতে যাব ... দূর থেকে একটা মেয়েকে আসতে দেখলাম। পরনে ফোলা সাদা শার্ট আর নীল রঙের লং স্কার্ট । পায়ে কেডস। মুখটা খুব চেনা চেনা ঠেকল। মেয়েটা কাছে আসতেই আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। মেয়েটি বেশ লম্বা। এক মাথা কোঁকড়া চুল। শ্যামলা মিষ্টি চেহারা। চোখে চশমা।
ছোট খালা বলল, আবীর। এ হল শান্তা। এবার এইচ এস সি দিল। আমার এক বান্ধবীর মেয়ে। শান্তারা সিলেট থাকে। শান্তা আজ সকালেই এসেছে। কিছুদিন বেড়াবে এখানে।
ওহ! আমার শরীরে হিমস্রোত বয়ে যায়। শান্তাকে আমি এর আগে দেখেছি। তবে ঠিক সামনাসামনি নয়, রোমেলদের পারিবারিক অ্যালবামে শান্তার ছবি দেখেছি। সিউর। আমার ভুল হওয়ার কথা না। রোমেলকে আমি জিগ্যেস করেছিলাম, এই মেয়েটির কি নাম রে? রোমেল বলল, শান্তা। আমার খালাতো বোন স্বপ্নার বান্ধবী। (স্বপ্নারা সিলেট থাকে, রোমেলের কাছেই জেনেছি ...) আমি বললাম, কী মায়াবী চেহারা। রোমেল বলল, গত বছর শান্তারা সপরিবারে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিল। শান্তার এক মামা রামুতে থাকেন। কক্সবাজার থেকে রামুতে যাওয়ার সময় রামুতে একটা বৌদ্ধবিহারের কাছে রোড অ্যাক্সিডেন্টে শান্তাসহ সবাই মারা যায়।
শান্তাকে দেখে এটাই আমার চমকে ওঠার কারণ। আমি ঘামতে থাকি। আমার গলা ভীষণ শুকনো ঠেকছে।
মিলি খালা বললেন, আয় শান্তা। বস । চা খা।
শান্তা বসল। বসে মেয়েটি আমার দিকে সরাসরি তাকাল। কী শীতল দৃষ্টি। মনে হল আমি যে ওর ছবি দেখেছি সেটা ও জানে।
মিলি খালা বলল, অনেক দিন থেকেই শান্তাকে এখানে আসতে বলছি। এদ্দিনে সময় হল। শান্তার এক মামা রামু থাকেন । ভদ্রলোক সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। তিনিই আজ সকালে শান্তাকে নামিয়ে দিলেন। দু-তিন দিন পর আবার নিয়ে যাবেন।
আমি ঘামছি।
শান্তার দিকে তাকিয়ে মিলি খালা বলল, এ হল আমার বড় আপার ছেলে। আবীর। আবীরও এবার এইচ এস সি দিল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে লনে ফুটফুটে জোছনা ছড়াল। ছোট খালা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা বসে গল্প কর আবীর। আমি দেখি মং ছিং রান্নার কদ্দূর কি করল। আজ ছোট আলু দিয়ে খরগোশ রাঁধব।
ছোট খালা চলে যাওয়ার পর চারিদিকে তাকিয়ে শান্তা বলল, কী সুন্দর জোছনা। চল, এখানে বসে না থেকে হেঁটে আসি। বলে উঠে দাঁড়াল।
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালাম। শান্তার সঙ্গে আমার দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না ।
লনের ওপর পাশাপাশি আমরা হাঁটছি। লনের ঘাসে আমার লম্বা ছায়া পড়লেও শান্তার ছায়া পড়েনি। আমার কেমন শীত শীত করে। ফুরফুরে বাতাস বইলেও কেমন এক আঁষটে গন্ধ পাচ্ছি। আজ এথিন লামা আমাকে বলল, খুব শিগগির নাকি আমি এক ডাকিনীর খপ্পড়ে পড়ব । আমি ডানবাহু স্পর্শ করি। নীলশঙ্খের স্পর্শে স্বস্তি বোধ করি ।
শান্তা বলল, আমি তোমাকে এর আগে কোথায় দেখেছি।
কোথায়? আমার কন্ঠস্বর কেঁপে উঠল। আমাকে তো ওর দেখার কথা নয়।
উত্তর না-দিয়ে শান্তা জিগ্যেস করল, আমাকে কি তুমি এর আগে কোথাও দেখেছ?
না।
সত্যি করে বল? শান্তার কন্ঠস্বর এই মুহূর্তে বুড়িদের মতো কেমন খনখনে শোনাচ্ছে।
আমি কি বলব? আমি কি শান্তাকে বলব যে রোমেলের বাসায় তোমার ছবি দেখেছি? তুমি আসলে মৃত। রামুর কাছেই কোথাও অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছ। এসব কথা কি বলা যায়?
আমরা হাঁটতে- হাঁটতে লনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আমরা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, ঠিক সেখানেই একটি কফি গাছ। টিলাটি এখানে ঢালু হয়ে অন্তত তিনশ ফুট নীচে নেমে গেছে। ধবল জোছনায় টিলার ঢালে শাল গাছ, কলা গাছ, কাঁঠাল গাছ এমন কী নীচের রাস্তাও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে মঠের চূড়াও চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।
আমার কেন যেন মনে হল শান্তা আমাকে ইচ্ছে করে টিলার কিনারে নিয়ে এসেছে। কেন? শান্তার উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা গেল না। তবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম। ওর চোখে মনি দুটি ফসফরাসের মতন জ্বলজ্বল করছে। জ্বলজ্বলে চোখে বারবার আমার ডান বাহুর দিকে তাকাচ্ছে। যেখানে এথিন লামা ছোট্ট নীল শঙ্খ বেধে দিয়েছে। মনে হল ওই নীলশঙ্খের ওপর শান্তার আক্রোশ।
শান্তা বলল, তোমার ডান বাহুতে কি একটা নীল রঙের শঙ্খ বাঁধা আছে?
হ্যাঁ। আমি চমকে উঠলাম। বললাম, তুমি জানলে কি করে?
খসখসে কন্ঠে শান্তা বলল, আমি জানি। তুমি এখন ওই নীলশঙ্খটা বাহু থেকে খুলে নীচে ফেলে দাও।
নীলশঙ্খ ফেলে দেব? কেন? আমার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠছে।
শান্তা ধমকের সুরে বলল, ওসব মাদুলিতে কাজ হয় না। তারপর কন্ঠস্বর নরম করে বলল। তা ছাড়া আমি তোমাকে আজ রাতে আশ্চর্য এক দেশে নিয়ে যাব । যেখানে দিনও হয় না রাতও হয় না ...
শান্তার কথা শেষ হল না ... কফি গাছের ওপাশ থেকে কে যেন বেরিয়ে এল। খসখসে কন্ঠে বলল, কেমন আছ?
কে? আমি চমকে উঠলাম।
আমি ... আমি এথিন লামা।
ওহ্ । আপনি?
কিন্তু এথিন লামা এখানে এল কী ভাবে? উড়ে আসেনি তো। তবে এথিন লামাকে দেখে শান্তা যে ভয় পেয়েছে তা ঠিকই বুঝতে পারলাম। শান্তার মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। আমার দিকে ফিসফিস করে বলল, চল, এখান থেকে চলে যাই। ওই লোকটা ভালো না।
আমি কতকটা রুক্ষ কন্ঠে বললাম, তুমি যাও । আমি আসছি।
শান্তা দ্রুত হাঁটতে থাকে। পিছন দিকে একবারও ফিরে তাকাল না। আমি মুখ ফিরিয়ে কফি গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি ওখানে এথিন লামা নেই। যেন এথিন লামা আসেনি।
গভীর বিস্ময় নিয়ে বাংলোয় ফিরে এলাম।
রাতে খাওয়া তেমন জমল না। খরগোশের মাংস রাবারের মতো ঠেকল। ছোট খালু সেনাবাহিনীতে থাকার সময় বান্দরবানের গভীর অরণ্যে অজগর শিকারের কাহিনী বলছেন। শান্তা মন দিয়ে শুনে যাচ্ছে। তেমন কিছু খেল না শান্তা।
আমি কিচেনে এলাম। মং ছিং প্লেট-গ্লাস ধুচ্ছিল। মিলি খালা চুলার সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে দুধ ভরতি সসপ্যান। মিলি খালাকে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলাম, শান্তার মা তোমার ঠিক কি রকম বান্ধবী হয় বল তো ?
মিলি খালা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল, কেন রে? হঠাৎ?
এমনি । বল না।
ছোট খালা বলল, শান্তার মা সাবিহার সঙ্গে কলেজে পড়েছি। তারপর ওর বিয়ে হয়ে গেল। মাঝে-মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ ছিল। এই।
অনেক দিন দেখাসাক্ষাৎ হয় না, না? আমি জিগ্যেস করি।
হ্যাঁ। তুই জানলি কি করে? মিলি খালাকে অবাক মনে হল। তার পর মিলি খালা বলল, সকালে আমার কিন্তু খটকা লাগল আবীর ।
কি?
আজ সকালে শান্তা যখন এল। তখন বললাম, বাড়ি চিনলে কি করে? শান্তা এড়িয়ে গেল। বলল, ওর এক মামা টিলার নীচে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক ওপরে উঠে এলেন না বলে কেমন খটকা লাগল। শান্তার সঙ্গে কোনও ব্যাগট্যাগও ছিল না।
হুমম। আমি শরীরে শিরশিরানি আর কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ নিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। তার আগে মিলি খালার লাইব্রেরি থেকে একটা বই নিয়ে এলাম। দোতলার সিঁড়ির পরে ছোট করিডোর। অল্প পাওয়ারের নীল আলো জ্বলে ছিল। ডান পাশের প্রথম ঘরটি আমার। ঘরটা ছোট। তবে গরাদহীন জানালাটা বেশ বড়। বিছানায় শুয়ে এ.আর আরভিং -এর লেখা ‘টিবেটান মিষ্ট্রি অভ ফ্লাইং লামা’ বইটি পড়ছি। মন বসছে না। কেবল শান্তার মুখটা ভাসছিল। রোমেল বলল, গত বছর শান্তারা সপরিবারে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে রামুর কাছে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মিলি খালা বললেন, শান্তাকে আজ সকালে ওর এক মামা দিয়ে গেলেন। ঠিক কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল? শান্তা যদি অ্যাক্সিডেন্টে মারাই যায় তাহলে শান্তা এলই-বা কেন? কী ভাবে এল? মৃত্যুর পরও কি বেঁচে থাকা সম্ভব?
এসব চিন্তা সরিয়ে বই পড়ার চেষ্টা করি। ‘টিবেটান মিষ্ট্রি অভ ফ্লাইং লামা’ বইটি মিলি খালার লাইব্রেরি থেকে এনেছি। লামারা উড়তে পারে কি না সেটাই জানতে ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ নেভির সদস্য এ.আর আরভিং তিব্বতে গিয়েছিলেন। বইতে সে অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করেছেন এ. আর আরভিং। তিনি নাকি লামাদের উড়তে দেখেছেন। কিন্তু কথাটা কতটুকু সত্যি? এথিন লামাও কি উড়তে পারে? মং ছিং নাকি এথিন লামাকে উড়তে দেখেছে।
ঘুম আসছিল না। ঘর অন্ধকার। ঘরে রিডিং ল্যাম্পের আলো। সে আলোয় হঠাৎ দেখি দরজার কাছে শান্তা দাঁড়িয়ে। দরজা তো বন্ধ ছিল। ও এল কি করে? শান্তার পরনে সাদা নাইটি। আমি আতঙ্ক সিদে হয়ে বসি। হাত থেকে বই খসে যায়।
শান্তা খনখনে কন্ঠে বলল, তখন তুমি কিচেনে মিলি খালাকে বললে আমাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে ?
আমি চমকে উঠলাম। ও জানল কি করে? কিচেনে মং ছিং ছাড়া অন্য কেউ ছিল না ।
মুহূর্তেই আমি এক লাফে জানালার কাছে চলে আসি। গরাদহীন জানালাটা খোলা। জানালার ওপাশে একটি গালিচা। শূন্যে ভাসছে। গালিচার ওপরে দাঁড়িয়ে এথিন লামা। আমি বিস্মিত হব কী- পরক্ষণেই নিজেকে গালিচার ওপর আবিস্কার করলাম। গালিচা খানিকটা সরে অনেকখানি ওপরে উঠে এল। ঠিক লনের ওপর। জোছনার আলোয় লন আলোকিত। যেন দিন। নীচে তাকিয়ে দেখি জানালা দিয়ে অনেকখানি কয়লার গুঁড়া ছিটকে বেরিয়ে এসে ঘূর্নির আকার ধারণ করল। গালিচা দুলছিল। কয়লার গুঁড়া নারীমূর্তি ধারণ করে গালিচা ঘিরে আকাশে ঘুরপাক খেতে লাগল। আর রক্ত হিম করা খল খল হাসি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল ।এথিন লামা চারপাশে নীল রশ্মি ছুঁড়ে মারতে লাগল। কালো নারীমূর্তি শূন্যে মিলিয়ে গেল।
নীচে তাকিয়ে দেখি লনে ছোট খালু, মিলি খালা আর মং ছিং এসে দাঁড়িয়েছে । মিলি খালা চিৎকার করে কী যেন বলছে।
এথিন লামা ধীরে ধীরে গালিচা নামিয়ে আনল।
গালিচা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি। তোর কোনও ক্ষতি হয়নি তে? বলে মিলি খালা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি লজ্জ্বা পেলাম। আমি তো আর ছোটটি তো নই। মং ছিং ঝুঁকে এথিন লামাকে প্রণাম করল। হাজার হলেও গুরু। ছোট খালু বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। লামাদের শূন্যে ওড়ার দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়েছেন। এথিন লামা হাসছিল। বলল, কদিন আগে মঠে বসে ধ্যান করার সময় জেনেছিলাম এমনই এক ঘটনা ঘটবে। তাই রামুতে বাসে উঠে এর পাশে বসি। বলে আমাকে দেখাল। আমার মনে পড়ল এথিন লামা আমার বাহুতে ছোট নীলশঙ্খ বেঁধে দিয়েছিল। বাহু স্পর্শ করে নীলশঙ্খটা ঠিক জায়গায় আছে বলে নিশ্চিন্ত হলাম। শঙ্খটি এথিন লামা তিববতের মানস সরোবরের পাড়ে কুড়িয়ে পেয়েছিল।ওটাই তো আমাকে ডাকিনী শান্তার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল। আবার যে ডাকিনীর খপ্পড়ে পড়ব না কে বলতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ১০:১৪