চতুদর্শ ইউরোপের Black Death বা কৃষ্ণমৃত্যু ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম এক প্রানঘাতী মরক। এর ব্যপ্তি ছিল সমগ্র ইউরোপ মহাদেশ জুড়ে ; এবং মরকের প্রকোপে তৎকালীন ইউরোপের জনসংখ্যার ৬০%ঝরে পড়েছিল। কৃষ্ণমৃত্যুর সময়কাল ছিল ১৩৪৭ থেকে ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দ । এই নজীরবিহীন মহামারী ইউরোপের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, সৃষ্টি করেছিল সামাজিক অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় অভ্যূত্থানের । কৃষ্ণমৃত্যুর কারণ আজ উদঘাটিত হলেও সেই চতুদর্শ শতকে কৃষ্ণমৃত্যুর কারণে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়েছিল । কুয়ার পানি দূষিত করার অভিযোগে লাঞ্ছিত করা হয় ইহুদিদের; স্পেনে লাঞ্ছিত করা হয় আরবদের (ততদিনে আরবরা স্পেনে ক্ষমতাচ্যূত)। ১৩৪৯ সাল। রাইনল্যান্ড, স্ট্যাসবুর্গ, ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, মাইনয এবং কোলন-এ কৃষ্ণমৃত্যুর কারণ হিসেবে ইহুদিদের গনহত্যার সম্মূখীন হতে হয়।
Black Death বা কৃষ্ণমৃত্যুর কারণ আসলে প্লেগ বা মরক। তিন ধরনের মরক বা প্লেগ আছড়ে পড়েছিল ইউরোপে। (১) ব্যুবনিক প্লেগ; (২) নিউমোনিক প্লেগ; এবং (৩) সেপ্টিসিমিক প্লেগ। কৃষ্ণমৃত্যুর নাম কারণ সংক্রমনের লক্ষণ। কুঁচকির রক্তের মতন রংহীন পদার্থে সীমারেখায় ফুলে কালো হয়ে ওঠে। এই ফুলে ওঠাকে Buboes ও বলে; এ কারণেই ব্যুবনিক শব্দটির উদ্ভব। রোগীর শরীরে টিউমার দেখা দিত। এই টিউমারগুলির আকার ছিল ডিম থেকে আপেলের সাইজ। মরকটি ছিল ভয়ানক সংক্রমক। বিশেষ করে নিউমোনিক প্লেগটি। সংক্রমিত ব্যাক্তির হাঁচিকাশির দ্বারা নিউমোনিক প্লেগ সংক্রামিত হয় ফুসফুটে। সেপ্টিসিমিক প্লেগটি সবচে বিরল হলেও ছিল সবচে ভয়ঙ্কর; কেননা সেপ্টিসিমিক মরকের অণুজীব সরাসরি রক্তস্রোতে মিশত। সুস্থ মানুষ রাত্রে বিছানায় গেল পরের দিন তাকে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল। রাত্রিভর সহ্য করল মরণযন্ত্রণা। ব্যুবনিক প্লেগ-এর মৃত্যুর হার ছিল ৬০ থেকে ৯০%। নিউমোনিক প্লেগ ও দিন কয়েকের মধ্যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত।
কৃষ্ণমৃত্যুর প্রাদুভার্বের পূর্বে ১৩১৫ থেকে ১৩২২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক এক দুর্ভিক্ষের কারণে চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়; এই সাত বছরে ইউরোপের ১০% মানুষের মৃত্যু ঘটে। এর পর পরই কৃষ্ণমৃত্যু ইউরোপ জুড়ে ১৩৪৭-১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ছড়িয়ে পড়ে ।
মরকের মূলে Yersinia pestis bacterium নামে অতি ক্ষুদ্র এককোষী জীবাণু। জীবাণুটি পশুর রক্তপায়ী ক্ষুদ্র কীটের ( ফ্লি, এক ধরনের ডানাহীন নীলমাছি) উদরে বংশবিস্তার করে। ফ্লি পশুর রক্তপায়ী বলেই পরে ইঁদুরে সংক্রামিত হয় । মধ্যযুগের ইইরোপের সর্বত্রই ছিল ইঁদুর ...
এখন অবশ্য গবেষকরা বলছেন মরকে আক্রান্ত রোগীর এক ধরনের Viral hemorrhagic fever হত।
The viral hemorrhagic fevers (VHFs) are a diverse group of animal and human illnesses that are caused by four distinct families of RNA viruses: the Arenaviridae, Filoviridae, Bunyaviridae, and Flaviviridae. All types of VHF are characterized by fever and bleeding disorders and all can progress to high fever, shock and death in extreme cases. Some of the VHF agents cause relatively mild illnesses, such as the Scandinavian nephropathia epidemica, while others, such as the African Ebola virus, can cause severe, life-threatening disease.
লিমফ নড । লিমফ হল দেহগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বর্ণহীন ক্ষারধর্মী রস । আর লিমফ নড হল মানবদেহের ইমিউন (রোগ প্রতিরোধক) সিসস্টেমে ছোট গোলাকার বলের আকৃতির অরগ্যান বা অঙ্গ; যা লিমফাটিক শিরার মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকে। লিমফ নডরা বি, টি এবং অন্যান্য ইমিউন কোষের রক্ষীসেনা। এরা ‘ফরেন পার্টিকেল’ আটকে দেয়। ইমিউন সিসস্টেমের কার্যকারীতার জন্য এদের ভূমিকা অনন্য। ইয়ারসিনিয়া পেসটিস ব্যাকটেরিয়াম সংক্রমনে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
কিন্তু, মরকটি ইউরোপে এল কী করে?
গবেষনার ফলে এর জবাব মিলেছে।
মধ্য এশিয়ার ইসিক কুল হ্রদেরর অবস্থান। এই হ্রদের আশেপাশে মারমোট নামে এক ধরনের কাঠবেড়ালীর বাস। এদের ফুসফুসেই প্রথম ইয়ারসিনিয়া পেসটিস ব্যাকটেরিয়াম দ্বারা সংক্রমন আরম্ভ হয়। নীলমাছি ফ্লি এদের রক্ত চুষত। নীলমাছি ফ্লি কালো ইঁদুরে (Rattus rattus) জীবাণু সংক্রামিত করে।
মারমোট। মধ্য এশিয়ার কাঠবেড়ালী।এদের ফুসফুসে ইয়ারসিনিয়া পেসটিস ব্যাকটেরিয়াম দ্বারা সংক্রমন আরম্ভ হয়। এ প্রসঙ্গে জনৈক ঐতিহাসিক লিখেছেন: ‘‘...১৩৩০ সালের প্রথম দিকে চিনে প্রাণঘাতী ব্যুবনিক মরকের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ব্যুবনিক মরক প্রধানত ইঁদুর কাঠবেড়ালী ইত্যাদির ন্যায় তীক্ষ্মদন্ত প্রাণীদের আক্রান্ত করে। কিন্তু ফ্লি মানবদেহেও জীবাণুর সংক্রমন ঘটাতে সক্ষম। আক্রান্ত মানুষ অন্যকেও অতি দ্রুত সংক্রামিত করে ফেলে। মরকান্ত্র রোগীর জ্বর হয় ও তার ব্যুবস নামক লিমফ গ্ল্যান্ড ফুলে ওঠে। এই কারনেই মরকটির নাম ব্যুবনিক । ত্বকের ওপর দাগ পড়ে, প্রথমে লাল রঙের পরে কালো হয়ে ওঠে।’’
ওরিয়েন্টাল র্যাট ফ্লি। মরকের মূল অপরাধী প্রাচ্যদেশিয় নীলমাছি। এরা রক্ত শোষক পরজীবী। এরা ইয়ারসিনিয়া পেসটিস ব্যাকটেরিয়াম বহনকারী। নীলমাছির অন্ত্রে ইয়ারসিনিয়া পেসটিস ব্যাকটেরিয়াম বংশ বৃদ্ধি করে। এরা মানুষকে দংশন করলে মানুষ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়।
Kingdom: Animalia
Phylum: Arthropoda
Class: Insecta
Family: Pulicidae
Order: Siphonaptera
Genus: Xenopsylla
Species: cheopis
কালো ইঁদুর (Rattus rattus); এরাই ইয়ারসিনিয়া পেসটিস ব্যাকটেরিয়াম বহনকারী।
এবার আমরা দেখব চিনের মহামারী কীভাবে ইউরোপে ছড়াল।
চতুদর্শ শতকের শুরুতে মধ্য এশিয়া নিয়ন্ত্রণ করত মঙ্গোল সাম্রাজ্য । ওই অঞ্চলেই ছিল রেশম পথ, যে পথের ওপর দিয়ে বণিকের কাফেলা চলত। শান্তির পদক্ষেপ হিসেবে মঙ্গোল কর্তৃপক্ষ চতুদর্শ শতকের প্রথম দিকে সিল্ক রুটের কাফেলা পথে বণিক ও মার্সেনারি সৈন্যদের চলাচলের ওপর বিধি নিষেধ শিথিল করে দিয়েছিল। সে সময় বণিক ও সৈন্যরা কাফেলা-পথে ক্রিমিয়ায় পৌঁছে। তাদেরই অনেকেই চিনের (১৩৩০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত) মরকের জীবাণু বহন করছিল। এদের দ্বারাই ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার বন্দর নগরী কাফায় মরক ছড়িয়ে পড়ে।
ক্রিমিয়ার মানচিত্র।
সে কালের কাফা ছিল সমৃদ্ধ বন্দর। কাফা বন্দরে ইউরোপের বণিকেরা আসত, বিশেষ করে ইটালির জেনোয়ার বণিকেরা । ওই সময়ে অর্থাৎ ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মঙ্গোল সেনাপতি জানি বেগ কাফা নগরী অবরোধ করেছিলেন। তখন তিনিও মরকের সম্মূখীন হন। তার নির্দেশে মঙ্গোল সৈন্যরা মরকাক্রান্ত মৃতদেহ কাফা নগরী প্রাচীরের ওপর দিয়ে কাফা নগরী তে ছুড়ে ফেলেছিল! সংবাদটি জানাজানি হলে ওখানে অবস্থিত ইটালির জেনোয়া বণিকেরা পালিয়ে সিলিলি চলে আসে।
তারাই ইউরোপে মরকের বীজ নিয়ে এসেছিল!
পরে ১৩৪৭ সাল নাগাদ সিলিলি থেকে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় মরক ছড়িয়ে পড়ে, এতে প্রায় ৭৬ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এর মধ্যে প্রায় ২৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ইউরোপীয়। মরকের ছোবলে ইউরোপের জনসংখ্যার ৩০% থেকে ৬০% হ্রাস পায়।
মরকের গতিপথ
মনে থাকার কথা। ১৩১৫ থেকে ১৩২২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক একটি দুর্ভিক্ষের সংঘটিত হয়েছিল। এই কারণে এমনিতেই ইউরোপের মানুষ ভুগছিল অপুষ্টিতে। যার ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা দূর্বল হয়েই ছিল। ১৩৪৭ সাল নাগাদ ইউরোপে মরকের প্রকোপ দেখা দেয়। কৃষ্ণমৃত্যুরুপী মরক ভয়ঙ্কর গতিতে ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগের মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখী হয়। এই মহা দুর্দৈব নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল সরকারি প্রশাসন। ব্যর্থ হল । মানুষ তখন নিজস্ব কায়দায় নিরাময়ের দিকে ঝুঁকল। মৃতদেহের উৎকট গন্ধের কারণে অনেকেই ভাবল রোগটি বাতাসে ভেসে আসে। কাজেই বাতাসে সুগন্ধী ছড়াতে লাগল; কেউ-বা আগর কাঠ জ্বালাল। আর জুনিপার, লরেল, পাইন, বিচ, লেবুপাতা, রোজম্যারি, কর্পূর ও সালফার পোড়াল । অনেকেই এখানে-ওখানে যাওয়ার সময় রুমালে সুগন্ধী তেল মেখে মুখ ঢেকে নিত। অনেকে শব্দচিকিৎসার আশ্রয় নিয়েছিল। শহর ও গ্রামের গির্জায় ঘন্টা বাজত। নতুন কামান কেনা হয়েছিল গুরু গম্ভীর শব্দ তোলার জন্য। তারা ভেবেছিল গির্জের গম্ভীর ডিং শব্দে মরক পালাবে। বস্তুত তা হয়নি। আর তাবিজকবজ, মন্ত্রতন্ত্র ও গূঢ়গ্রন্থের তো ছিলই। স্থানীয় জটাবুড়িরা তাবিজকবজ বেচত। এলডার গাছের ফলের তৈরি পানীয় খেলে মরক দূর এমন এক ভুল ধারনা ছড়িয়ে পড়েছিল সেসময়টায়। কেউ-বা গলায় সবুজ জেডস্টোন পরত। ... এর পরও ইউরোপের যে কোনও শহরের অর্ধেকের মতো মানুষ প্রাণ হারায়। শহর ও গ্রামে মলনিস্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না -এতে জনস্বাস্থের আরও অবনতি ঘটে। এরকম রুগ্ন পরিবেশে মরকের লাশ ¯ত’পকৃত হয়ে ওঠে; যারা লাশ বইত তারাও সংক্রামিত হত। অসহায় মানুষ দৈব সাহায্যের আশায় আশ্রয় নিত গির্জেয়। গির্জের সাধু -যাজক -নান কেউই মরকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। মৃতের কফিন অতি দ্রুত তৈরি করা যায় না। ফলে গণ কবর দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর রইল না ।
সেই সময়কার একটি লেখায় মরক-দংশিত পরিবেশের বিভৎস চিত্র ফুটে উঠেছে ...“... একজন নাগরিক অন্যজন নাগরিককে এড়াইয়া চলিত, কদাচিৎ কোনও প্রতিবেশি অন্য প্রতিবেশির কথা ভাবিত, আত্মীয়েরা পারতপক্ষে অন্য আত্মীয়ের বাড়ি যাইত না, মরকের বিভৎসতা মানুষের হৃদয়ে এতই করুণাশূন্যতার সৃষ্টি করিয়াছিল যে ভাই ভাইকে এড়াইয়া চলিত, চাচা এড়াইয়া চলিত তাহার ভ্রাতুস্পুত্রকে, বোন ভাইকে এড়াইয়া চলিত এবং স্ত্রী স্বামীকে এড়াইয়া চলিত । এমনকী মা-বাবাও তাদের ছেলেমেয়েদের দেখভাল করিতে অস্বীকার করিত যেন তাহারা তাহাদের সন্তান নয়। এইভাবে অসংখ্য অসুস্থ মানুষ সেবাযত্ন হীন পড়িয়া রহিল। উদার হৃদয়ের বন্ধুরা অবশ্য সাহায্য করিতে চেস্টা করিত ; তবে কম। বেশি বেতনের লোভে চাকরবাকরকে নিয়োগ দেওয়া হইত। তবে ইহারা প্রায়ই টাকা পয়সা লইয়া পলাইয়া যাইত। নিজেরাও অবশ্য মরিত । আরও এক অভাবনীয় নির্লজ্জ ঘটনার অবতারনা হইয়াছিল। সুন্দরী অভিজাত মহিলারা অসুস্থ হইলে তরুণ কিংবা বৃদ্ধ পুরুষ ভৃত্য গ্রহন করিতে দ্বিধা করিত না। চিকিৎসার প্রয়োজনের সুন্দরী অভিজাত নারীগন শরীর অনাবৃত করিত। এই রূপে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হইয়াছিল ।”
চতুদর্শ ও পঞ্চদশ শতকে মরক অব্যাহত থাকে। ১৩৬১-৬২ মরকের পুনরায় প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়। এতে অধিক হারে শিশুর মৃত্যু ঘটে। এই কারণে ১৩৬১-৬২সালের মরক ‘শিশুদের মরক’ নামে পরিচিত। প্রধান কৃষ্ণমৃত্যুর পরে জন্মাবার ফলে এই শিশুদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা সহনশীল মাত্রায় ছিল না। নজিরবিহীন কিন্তু সদা উপস্থিত মরক একাধারে কৃষক অভিজাতের জীবন কেড়ে নিত। এই কারণে মৃত্যুভয় পরের প্রজন্মেও বাহিত হয়েছিল। পরিবারে কারও মৃত্যু হলে শিশুরা অল্প বয়েসে যন্ত্রণা ও মৃত্যু ভোগ করত। পরিবারে কেউ মরকাক্রান্ত হলে শিশুদের রাস্তায় ফেলে রেখে আসত। কন্যাশিশু দের ক্ষেত্রে এমন বেশি ঘটত। পুত্র সন্তান হলে দু-একবার ভাবত। জোসেফ পি.বিরনি তার ‘দ্য ব্ল্যাক প্লেগ’ বইতে লিখেছেন,‘কৃষ্ণমৃত্যু চলাকালীন সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের নারীদের নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মিশরের রাজধানী কায়রোর মুসলিম নারীরা হয়ে ওঠে বলির পাঁঠা। ১৪৩৮ সালে মুফতিগন মিশরের সুলতানকে জানায়- মরক হচ্ছে অবিবাহিত পুরুষ ও অবিবাহিতা নারীর মধ্যে স্বতঃপ্রবৃত্ত যৌনমিলনের কারণে আল্লাহর শাস্তি বিশেষ; কাজেই আইন করতে হবে নারীরা যেন ঘরের বাইরে না গিয়ে পুরুষদের প্রলুব্দ করতে না পারে। তো, সে আইন হয়। পরে উঠেও যায়। কেন? ধনীরা অভিযোগ করল তাদের বাঁদি খাবার কিনতে দোকানে যেতে পারছে না! ইউরোপেও একই ধরনের ধারনা প্রচলিত ছিল। আজ মরকের কারণ জানা গেলেও মধ্যযুগে মরকের কারণ ছিল অজ্ঞাত। অপরিমেয় মৃত্যুর কারণ হিসেবে নানা থিউরি কল্পনা করা হয়েছিল তখন। কেউ বলল, নক্ষত্রপুঞ্জের বিশেষ সমাবেশ; কেউ-বা বলল, গণমৃত্যু আসলে ঘন কুয়াশা ও ভূমিকম্পের মতোই প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে অনেকেই মনে করত ছিল অপরিমেয় মৃত্যুর পিছনে রয়েছে ঈশ্বরের ক্রোধ। বাঁচার উপায় পালিয়ে যাওয়া কিংবা একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকা। মরকের পটভূমিতে ইতালিও লেখক গিয়োভান্নি বোকাচিও (১৩১৩-১৩৭৩) লিখেছিলেন “ দি ডেকামের্যন” এক দল কমবয়েসী ইতালিও অভিজাত মরকঅধ্যূষিত ফ্লোরেন্সে বাস করত। তারা গ্রামের ভিলায় চলে যায় এবং গল্পের উদ্ভাবন করে সময় কাটাতে লাগল।
ইউরোপের ইতিহাসে কৃষ্ণমৃত্যু এক বীভৎস অধ্যায় হলেও এর প্রদুর্ভাব ইউরোপের মধ্যযুগের সমাজে অনুঘটকের কাজ করেছিল। কি ভাবে? ইউরোপ জুড়ে খ্রিস্টীয় আধ্যাত্মিক জাগরণে প্রণোদনা দিয়েছিল কৃষ্ণমৃত্যু। পূর্বের তুলায় অধিক হারে জনগন খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে অবনত হয়েছিল; জীবনমৃত্যুর কারণ নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েছিল। জীবনের উদ্দেশ্য নিয়েও গভীরভাবে ভাবিত হয়ে পড়েছিল এবং একই সঙ্গে নৈতিক দায়িত্ব সম্বন্ধেও সচেতন হয়ে উঠেছিল।
কৃষ্ণ মরকের দংশনে ইউরোপীয় অর্থনীতির ক্ষতিই ছিল সর্বগ্রাসী। ব্যাপক হারে শ্রমিক ও কারুশিল্পির মৃত্যু ঘটেলি। যে মিস্ত্রিরা বেঁচে গিয়েছি তাদের মজুরি হয়ে উঠল দ্বিগুন -যা মেটাতে ধনীদের হিমসিম খেতে হয়েছিল। এতে অবশ্য ইউরোপের সমাজে গরিব শ্রমিকদের অবস্থান জোরদার হয়। কৃষক ও কারিগর বেশি মজুরি দাবী করে বসে। অন্যদিকে সামন্তবাদী প্রথা থেকে ভূমিদাসরাও মুক্তি চাইল। গরিবরা এত বেশি মৃত্যু দেখেছে যে তারা জীবন উপভোগ করতে চাইল। ভূমিদাসেরা জমি ছেড়ে চলে গেল, তারা আর চাষাবাদ করল না। ফলে গমের আবাদ হল না, শস্যও শুকিয়ে মরে গেল, চাষের বলদও মরল খাদ্যের অভাবে। গৃহপালিত পশুরা অরণ্যে ঘুরেফিরে বেড়াতে লাগল। গেল কৃষক স¤প্রদায় উচ্ছন্নে । ফরমান জারী করে ভূমিদাসদের প্রভূদের কাজে ফিরে যেতে বলা হল। লাভ হয়নি। ওদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জনবলের অভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হল । এক ধরনের ডাকাতের উদ্ভব হল। এদের বলা হত বেকচিনি। এরা লাল রঙের লম্বা জোব্বা আর লাল মুখোশ পড়ে ডাকাতি করে বেড়াত, এদের কেবল চোখ দেখা যেত। বেকচিনি রা ঘরবাড়ি লুঠ করত, সেই সঙ্গে খুন, ধর্ষন রাহাজানিতে মেতে উঠত। এভাবে ইউরোপের অর্থনীতি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ল। এর প্রধান কারণ- জমি চাষের লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে ভূস্বামীরা পড়েছিল বিপাকে। এভাবে ইউরোপে সামন্তবাদের ক্ষয় সূচিত হয়। ফ্রান্সে ও ইংল্যান্ডে কৃষক বিদ্রোহ সূচনা করে।
কৃষ্ণমৃত্যু ইউরোপীয় সমাজের এতই গভীরে ঘা দিয়েছিল যে এমনকী শিশুতোষ ছড়ায় তার চিহ্ন আজও রয়ে গেছে। বাল্যকালে (না বুঝেই) সুর করে গাইতাম:
Ring a-round the rosy
Pocket full of posies
Ashes, ashes!
We all fall down!
রিং আ-রাউন্ড দ্য রোজি। ‘রোজি’ হল জপমালা (রৌজারি); যা ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনার প্রতীক। পকেট ফুল অভ পজিস। পকেটে পজি, মানে ফুটন্ত ফুল। ফুল কেন ? মৃতের দূর্গন্ধ ঢাকার জন্য। অ্যাশেজ! অ্যাশেজ! ছাই! ছাই!
উই অল ফল ডাউন ... আমরা পড়ে গেছি। ইউরোপ পড়ে গেছে।
এদ্দিন ছড়াটির মানে জানি নি।
আজ জানলাম।
তথ্য:
Jay Ruud সম্পাদিত ENCYCLOPEDIA OF MEDIEVAL LITERATURE এবং উইকিপিডিয়াসহ কৃষ্ণমৃত্যু সংক্রান্ত ইন্টারনেট বিভিন্ন সাইট
ছবি: ইন্টারনেট