প্রাচীন পারস্যের কাসিত গোত্র ব্যাবিলন জয় করে ৪৫০ বছর শাসন করেছিল। ক্ষুদ্র এক পার্বত্য গোষ্ঠী সংগঠিত হয়ে কী করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল সে ইতিহাস সত্যিই বিস্ময়কর। কাসিত সভ্যতার সময়কাল: ১৫৯৫ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১১৫৫ খ্রিস্টপূর্ব । ব্যাবিলন উরুক ও নিপপুর নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল কাসিত সভ্যতা । কাসিত শব্দটি দিয়ে মূলত বোঝায় (ক) প্রাচীন পারস্যের এক পাহাড়ি নৃগোষ্ঠী। (খ) একটি প্রাচীন ভাষা। (গ) প্রাচীন ব্যাবিলনের একটি রাজবংশ; এবং (ঘ) ইতিহাসের বিশেষ একটি সময়।
চূনাপাথর ও ডোলোমাইটে পরিপূর্ন ১,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ জাগ্রস পাহাড়শ্রেণিটি পশ্চিম ইরনের লুরিস্তানে অবস্থিত। এই পাহাড়শ্রেণিটির অর্ন্তগত জারদ কুহ-র উচ্চতা ৪,৫৪৮ মিটার । শীতে পাহাড়ময় তুষার ঝরে এবং বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের হারও উক্ত পার্বত্য অঞ্চলে সন্তোষজনক। যে কারণে জাগ্রস পাহাড়ের উপত্যকাসমূহ অত্যন্ত উর্বর; ফলে প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের নিওলিথিক বিপ্লবটি সম্পন্ন হয়েছিল অত্র এলাকায় । অর্থাৎ প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের মানবগোষ্ঠীর কৃষিবিপ্লবের প্রধান কেন্দ্র ছিল জাগ্রস পাহাড়ের উপত্যকা ।
জাগ্রস পর্বতমালা। এখানেই বাস করত প্রাচীন কাসিত জাতি । কাসিতরা আসলে ছিল জাগ্রস পর্বতমালার যাযাবর গোত্রের আর্ন্ত-সংগঠন। কসিত ভাষা সেমিটিকও নয়, ইন্দো-ইউরোপীয়ানও নয়। ভাষাটি ছিল আইসোলেট; অর্থাৎ, কোনও প্রধান ভাষা পরিবারের অর্ন্তভূক্ত না ভাষাকে ভাষাকে বলা হয় আইসোলেট।
মানচিত্রে জাগ্রস পর্বতমালা।
টাইগ্রিস নদীর অববাহিকায় প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ব্যাবিলনের অবস্থান জাগ্রস পাহাড়ের পশ্চিমে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতকে টাইগ্রিস নদীর উপত্যকায় কাসিতরা অনুপ্রবেশ করতে থাকে। সেসময় ব্যাবিলন শাসন করতেন প্রখ্যাত ব্যাবিলনিয় শাসক হামমুরাবির এক উত্তরসূরি: সামসু-ইলুনা। তিনি কাসিতদের বিচ্ছিন্ন অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। তবে ১৫৯৫ খ্রিস্টপূর্বে হিট্টি সম্রাট প্রথম মুরসিলিস ব্যাবিলন আক্রমন করে তছনছ করলে ব্যাবিলনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়েছিল। এর পরপরই কাসিতদের বিচ্ছিন্ন অনুপ্রবেশ রুপ নেয় প্রবল আগ্রাসনে।
ব্যাবিলন
প্রশ্ন উঠতে পারে কাসিতরা পার্বত্য বাসভূমি ত্যাগ করে টাইগ্রিস নদীর উপত্যকায় কেন অনুপ্রবেশ করেছিল?
এর উত্তরে আর্য আগ্রাসনকে চিহ্নিত করা যায়। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী আর্যরা বাস করত কাসপিয়ান সাগরের দক্ষিণে। জায়গাটির অবস্থান ইরানের উত্তরে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি ইন্দো-ইউরোপীয়রা সমাজে প্রযুক্তিক বিপ্লব ঘটে। তারা ঘোড়ার সামরিক ব্যবহার করতে শেখে ও রথের ব্যবহার আবিস্কার করে । এর ফলে যাতায়াতের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। যে কারণে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্দ আর্য মাইগ্রেমন সম্ভবপর হয়, যে অভিপ্রয়ানের ফলে নানা এশিয় জাতি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ও আদিবাসভূমি থেকে উৎখাত হয়ে যায়। এভাবেই জাগ্রস পাহাড়ের পার্বত্য আদিবাসী কাসিতরা আদিবাসভূমি থেকে উৎখাত হয়ে যায়। আগেই বলেছি কাসিতরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর নয়।
আর্য অভিপ্রয়ান
১৫৯৫ খ্রিস্টপূর্বে কাসিতরা দজলা (টাইগ্রিস) ও ফোরাত (ইউফ্রেতিস) নদীর উর্বর উপত্যকায় বসতি গড়ে তুলতে থাকে। ব্যাবিলনের আদি অধিবাসীদের পরিবারের গঠন ছোট হলেও কাসিতদের বিশাল পরিবারের পাহাড়ি ট্রাইবাল জীবন অব্যাহত থাকে এবং তাদের গোত্রীয় স্বকীয় রীতিনীতি বজায় থাকে। তবে খুব শিগগির কাসিতদের ওপর নগর সভ্যতার প্রভাব পড়ে। ক্রমেই তারা শিখল কী করে বিশাল ঐক্যবদ্ধ সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলে রাজ্য চালাতে হয়, প্রশাসন কি ও কেন, এবং প্রশাসনিক কাজে কীভাবে গতিশীলতা বৃদ্ধি করতে হয় । কাসিরা গোত্রপতির পরিবর্তে একজন সম্রাটের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করে। সামাজিক বিবতর্নের এক পর্যায়ে গোত্রীয় জীবন ভেঙ্গে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়-কাসিতদের ইতিহাস আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
কাসিত মূর্তি
গানদাশ। কাসিতদের প্রথম সম্রাট। তার সময়েই সমগ্র ব্যাবিলন কাসিতদের করতলগত হয়ে যায়। তারা ব্যাবিলনের একটি নতুন নামও দেয়: কারানদুনিয়াশ। নগরটির ধ্বংসস্তুপ বর্তমান ইরাকের দার কুরিজারজু । ব্যাবিলনের ১৫০ কি মি উত্তরে।
তবে কাসিতদের সম্বন্ধে খুব বেশি জানা যায়নি। ব্যাবিলনের নথিপত্রে মাত্র ৩০০ কাসিত শব্দ পাওয়া গেছে। তারা ছিল বহু ঈশ্বরবাদী। তাদের ৩০ দেবদেবীর নাম পাওয়া গিয়েছে। কাসিত প্রধান দেবতার নাম শুকামুনা। তবে ধর্মীয় ব্যাপারে কাসিতরা ছিল উদার। ১৫৯৫ খ্রিস্টপূর্বে হিট্টি সম্রাট প্রথম মুরসিলিস ব্যাবিলন আক্রমন করে তছনছ করার পর তিনি ব্যাবিলনীয় দেবতা মারডুকের মূর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন। মূর্তিটি কাসিতরা উদ্ধার করে পুনরায় ব্যাবিলনে স্থাপন করে এবং মারডুকের উপাসনা পুরুরায় প্রচলন করে ব্যাবিলনীয় দেবতা মারডুককে কাসিতরা প্রধান দেবতা শুকামুনার সমকক্ষ ঘোষনা করে।
ইরাকের দার কুরিজারজু ।
কাসিত সভ্যতায় নগরজীবনের কেন্দ্রে ছিল প্রধানত বানিজ্য ও কারুশিল্প। স্বর্নের সঙ্গে লাপিস লাজুলি (নীলকান্ত মনি) বিনিময় করা হত। ঘোড়া ও রথ রপ্তানি করে আমদানী করা হত কাঁচামাল । নগরের বাইরে চারণক্ষেত্রে ছিল রথের জন্য ঘোড়ার খামার। গ্রামীনজীবনের ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন। গ্রামীণজীবন শাসন করত কাসিত অভিজাতরা; অভিজাতদের প্রতিনিধিরা গ্রামে বাস করত এবং তারা অঢেল জমির মালিক ছিল। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে সীমান্ত প্রাচীরকে বলা হত কুদুররু। শব্দটি আককাদিয়। এর অর্থ: সীমান্ত বা ফ্রনটিয়র। করদ রাজ্যের রাজাদের ভূমিদানের বন্দোবস্ত বিষয়ে লেখা থাকত।
কুদুররু । কাসিত সভ্যতার প্রাপ্ত একমাত্র শিল্পবস্তু। ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামে আছে। ইরাকের জাতীয় জাদুঘরেও থাকার কথা, অবশ্য বুশ সাহেবের গুন্ডাপান্ডরা না নিয়ে গেলে।
কাসিত অভিজাতরা ছিল সংখ্যালঘু। তাদের ওপর ব্যাবিলনের রীতিনীতির প্রভাব পড়েছিল। অভিজাতরা ব্যাবিলনিয় নাম নিত। কাসিত সরকারি কর্মচারিরাও অনুরুপ । যা হোক। কাসিত সম্রাটদের পরাক্রম অব্যহত থাকে। পরাক্রমশালী মিশর ও সিরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক। গড়ে ওঠে। ১৪২০ খিস্টপূর্বে রাজা কারাইনডাস উরুক এ প্রধান দেবতা শুকামুনার একটি উপসনালয় স্থাপন করেন। হিট্টি (ব্যাবিলনের উত্তরের দেশ) আগ্রাসন রোধ করার জন্য রাজনৈতিক বিবাহ করে । তবে ইলাম ও আরিরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ইলামিয় সাম্রাজ্য ছিল ব্যাবিলনের পূর্বে। ইলামিয়রা ব্যাবিলন আক্রমন করে লুন্ঠন করে এবং কাসিত সভ্যতা ধ্বংস করে। কাসিতরা আবার জাগ্রস পাহাড়ে ফিরে যায়।
পারস্যের আকামিনিদ শাসনামলে কাসিতরা ছিল অনেকটা স্বাধীন । ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বে এদের আবারও ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে দেখা যায়। মেসিডোনের সম্রাট আলেকজান্দার যখন একবাতানা (পারস্যের একটি নগর) থেকে ব্যাবিলন ফিরছিলেন, পথে Cossaeans দের মুখোমুখি হলে রক্তক্ষয়ী সংঘাত বাধে। এই Cossaeans রাই ছিল কাসিত । গ্রিকসূত্রে কাসিতদের বলা হয়েছে গুহামানব, যাযাবর নয়!
প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য
কাসিত সাম্রাজ্য