চায়নাতে আছি অনেক দিন।আমাদের ভার্সিটিতে বিদেশী ছাত্রদের একটা সংগঠন আছে।এর সাথে অনেক চাইনিজরা ও যুক্ত।কিছুদিন আগে সবাই মিলে ঠিক করলাম কোথাও ঘুরতে যাইয়া যাক।
তাই আজকে সবাই মিলে "বৃদ্ধাশ্রমে" গিয়েছিলাম, জীবনে প্রথম বারের মতো।তাও আবার চাইনিজ বৃদ্ধাশ্রম।আমরা বিদেশী ছাত্র ছিলাম ১০ জন আর সাথে ১০-১২ জনের মতো চাইনিজ বন্ধু।চায়নিজরা প্রায় সব কাজই সকাল সকাল করতে অভ্যস্ত তাই ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ও সকাল ৮ টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। সকাল ৮.৩০ এ রওনা দিলাম গন্ত্যব্যের উদ্দেশ্যে, আর প্রায় ১ ঘন্টার মধ্যেই পৌছে গেলাম।জায়গাটি শহর থেকে একটু দূরে।এই দিনটি আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে।বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি কিন্তু অনেক কাছ থেকে বৃদ্ধাশ্রমের এই জীবনটা দেখে অবাক হলাম।
আমাদের বয়সে এরাও হয়ত সারা পৃথিবী বেড়িয়েছে।কিন্তু এই বয়সে এসে নিঃসঙ্গতা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।রোগের ভারে আক্রান্ত মানুষগুলো স্বজনদের কাছ থেকে রয়েছে অনেক দূরে।যে সন্তানদের জন্য সারাজীবন কষ্ট করেছে তারা হয়ত সপ্তাহে বা মাসে একবার দেখতে আসে, অনেকে আবার আসেই না। আমাদের ততাকথিত সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূরে সরে আসা এই মানুষগুলো হয়ত প্রতিনিয়ত আমাদের ধিক্কার জানাচ্ছে।
আমাদের প্রথম দেখাতে অনেকে অবাক হলেও,বন্ধুসুলভ আচরণের কারণে তারা আমাদের বেশ দ্রুতই আপন করে নিয়েছিলো।আমরা যতক্ষন ছিলাম তাদের মুখে হাসি ফোটানোর সর্বচ্চো চেষ্টা করেছি।কেউ কেউ বে-সুরা গলায় গান গেয়েছে আর অন্যরা তার সাথে সামিল।আমাদের গান গাইতে দেখে একজন বৃদ্ধা ও গেয়ে উঠল "wen wo ai ni......"।তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আবার ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে সাজিয়ে নিয়েছে তাদের আপন রাজ্য।এরা নাকি খাবার সময় ছাড়া রুম থেকে বের হয় না।আমরা নিজেদের বিদেশী ছাত্র বলে পরিচয় দেয়াতে একজন শেষমেশ দরজা খুলে বের হলো, তাও আবার একপলকের জন্য।তবে বাকি সবাই ছিলো বেশ আনন্দমুখর।দোতালা বিল্ডিংটার উপরের তলায় গিয়ে একটু অবাক হলাম।ডাইনিংরুমে বিশাল বড় পিয়ানো দেখে।চাইনিজদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এটা কেউ বাজাতে পারে না।আমি নিজেও পারি না।জীবনে কোনদিন পিয়ানোর কিবোর্ড এ হাত না দিলেও আজকে চেষ্টা করে দেখেছি।বে-সুরা ভাবে বাজিয়েছি, শুধুমাত্র তাদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য।সবচেয়ে ভালো লেগেছে একটা দৃশ্য দেখে, তাদের মধ্যে একজন লোক (বয়স প্রায় ৮৫) চেয়ারে বসে একমনে বই পড়তেছে।তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছে।কিন্তু কোন জবাব পেলাম না।একটু পর ম্যানেজার এসে জানালো উনি কানে শুনতে পান না।চোখেও খুব একটা দেখেন না।কিন্তু তার দু-চোখ আটকে আছে বইয়ের পাতায়।এইবয়সে জীবনের সন্ধিক্ষণে এসেও জানার ইচ্ছা অথবা বইয়ের চোখে বাইরের পৃথিবীকে দেখার ইচ্ছা।
নিজের জানা চাইনিজ আর সাথে নেপালী বড় আপু একের পর বৃদ্ধার সাথে কথা বলেই গেছি।আর আপুর canon এর ক্যামরায় স্মৃতি গুলো ফ্রেম বন্দি করেছে বন্ধু " মোকারম"।
এইখানে একটা বিষয় আমাকে বেশ মর্মাহত করেছে।আমাদের সমাজে সাধারন বাস্তবতার মতো এইখানে ও ধনী-গরিব পার্থক্য।যাদের ছেলেমেয়ে ধনী এবং মাসে মাসে বেশ ভালো অংকের টাকা দিতে পারে তারা আছে অন্যদের তুলনায় আলাদা রুমে।তাদের জন্য আলাদা খাতির।তবে আপাত দৃষ্টিতে তাদের আলাদা মনে হলেও এরা আলাদা নয়।সকালে নাস্তার পর সবাই মাঠে এসে হাজির।শীতের সকালে রোদ পোহানো আর পেছনের জীবনে ফেলে আসা গল্প করতে করতে কাটছে সময়।কাটছে একটি একটি দিন।অপেক্ষায় আছে কবে লাশের গাড়িতে করে এই জেলখানা থেকে বের হবে!!!!
দুপুর ১২ টার দিকে চলে আসার সময় অনেককেই দেখলাম হাত দিয়ে চোখ মুছতে।হয়ত আমরা ক্ষণিকের অতিথিরা তাদের কিছু ভালো সময় উপহার দিয়েছি।
বৃদ্ধাশ্রম থেকে বের হতে হতে চোখের সামনে ভেসে উঠল "৭০ বছর বয়সী আমি"!!!!!!!!তবে কি......???না এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের হাতেই তোলা থাক।