বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা জনগণকে মুক্ত করতে আবারো রাস্তায় নেমে এসেছি। আমরা আজকে এক দফার দাবিতে এখানে হাজির হয়েছি। আমরা বাংলাদেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা এবং সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এক দফার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এই সরকার কোনোভাবেই আর এক মিনিটও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।
নাহিদ ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা বলেছেন, গণভবনের দরজা খোলা আছে। আমরা মনে করি তিনি আগেই বুঝে গিয়েছেন যে গণভবনের দরজা খোলা রাখতেই হবে। আমরা শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। শুধু পদত্যাগ করলেই হবে না দেশে যত খুন, গুম হয়েছে তার দায়ে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। শুধু শেখ হাসিনা নয়, পুরো মন্ত্রিপরিষদকে পদত্যাগ করতে হবে। এই ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থাকে বিনাশ করতে হবে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে চাই যেখানে আর কখনোই কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসবে না। আমাদের এক দফা হলো শেখ হাসিনাসহ এই সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিদায়। এই সরকারের লুটপাট ও গণহত্যাসহ সব অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা। সব রাজবন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা প্রয়োজনে জেল ভেঙে আমাদের ভাইদেরকে মুক্ত করে নিয়ে আসব। আমরা জনগণকে বলতে চাই স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র নাগরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে, আপনারা তার সঙ্গে এসে যোগ দিন। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় সংগঠিত হন। আমরা খুব দ্রুতই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্লাটফর্ম থেকে ছাত্র নাগরিক অভ্যুত্থানের জন্য সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্র সংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করব।
তিনি বলেন, কোটা সংস্কার ও মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনের দাবিতে আমরা বাংলাদেশের ছাত্র তরুণরা সারা বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছিলাম। আমাদের ন্যায্য ও যৌক্তিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের হায়েনারা আমাদের বোনদের নির্মমভাবে পিটিয়েছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকেও দমন পীড়নে কাজে লাগিয়ে সারা দেশে ছাত্রদের ওপর নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে। যার প্রতিবাদে আমরা সারা দেশে শাটডাউন কর্মসূচি দিয়েছিলাম। সে কর্মসূচিতে সারা বাংলার ছাত্রদের সঙ্গে অভিভাবক, শিক্ষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের নাগরিকরা আমাদের নিরাপত্তা দিতে কর্মসূচিতে যোগ দেয়। কিন্তু আমরা দেখেছি সরকার শাটডাউন কর্মসূচিতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন শুরু করেছিল। পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে নামিয়ে কারফিউ জারি করা হয়। সেই রাতে আমরা কারফিউ ভাঙার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে ঘোষণা কোনো মিডিয়ায় প্রচার করতে দেয়া হয়নি। তারপরও ছাত্রজনতার প্রতিরোধ থামেনি।
নাহিদ বলেন, ১৯ জুলাই আমাদের সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। আমাদেরকে জবরদস্তি করে আন্দোলন প্রত্যাহার ও সরকারের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব দেয়। আমাদেরকে হাসপাতালে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সেটিও না পেরে আমাদের ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে জোর করে আমাদের থেকে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ানো হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদের বক্তব্য বিশ্বাস না করে রাজপথ দখলে রেখেছিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সমন্বয়কদের অনশনের কারণে সে পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই খুনের হিসাবটা পর্যন্ত আমরা পাইনি।
তিনি আরো বলেন, এই সরকার মানুষ খুন করেছে এবং লাশও গুম করেছে। যারা খুন করেছে তারা কিভাবে সেই খুনের বিচার করবে? আমরা এ সরকারের কাছে খুনের বিচার প্রত্যাশা করি না। সর্বস্তরের মানুষকে খুন, গুম ও গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে। একদিকে গ্রেফতার নির্যাতন করা হচ্ছে, অন্যদিকে আমাদের সংলাপের জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে।
এ সমন্বয়ক বলেন, সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যত বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা শিগগিরই আপনাদের সামনে ঘোষণা করব। আমরা জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনে আসার আহবান জানাচ্ছি। সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন চলবে। আমরা সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা ও সমর্থন করব না। যদি কোনোভাবে ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ দেয়া হয় তা আমরা প্রত্যাখান করব। আমরা প্রয়োজনে গণভবন ঘেরাও করব। সবার প্রতি আহ্বান থাকবে আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ ও রাজপথের কর্মসূচি পালন করবেন। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবেন। নিরাপত্তাবাহিনী, সেনাবাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা সবার কাছে আহ্বান থাকবে জনগণ যদি সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে, সরকার যদি জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ায় সেই সরকারের হুকুম মানতে আপনারা আর বাধ্য নন। সরকারকে সমর্থন না দিয়ে আপনারা জনগণের পাশে দাড়ান। আপনাদের আমাদের মিছিলে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা হুকুমের আসামির বিচার চাই, আপনাদেরকে কেন খুন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমরা সব গণহত্যার বিচার করব।
আমরা এক দফায় সরকার ও ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ ঘোষণা করছি। এজন্য ছাত্র নাগরিকের অভ্যুত্থান আহ্বান করছি।
এ সময় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের নির্দেশনা দেন আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, কেউ কোনো ধরনের ট্যাক্স বা খাজনা প্রদান করবেন না। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিলসহ কোনো ধরনের বিল পরিশোধ করবেন না। সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও কলকারখানা বন্ধ থাকবে। আপনারা কেউ অফিসে যাবেন না, মাস শেষে বেতন তুলবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো ধরনের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন না। সব ধরনের সরকারি সভা, সেমিনার আয়োজন বর্জন করবেন। বন্দরের কর্মীরা কাজে যোগ দেবেন না। কোনো ধরনের পণ্য খালাস করবেন না। দেশের কোনো কলকারখানা চলবে না, গার্মেন্টসকর্মী ভাইবোনেরা কাজে যাবেন না। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে, শ্রমিকরা কেউ কাজে যাবেন না। জরুরি ব্যাক্তিগত লেনদেনের জন্য প্রতি সপ্তাহের রোববারে ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে। পুলিশ সদস্যরা রুটিন ডিউটি ব্যতীত কোনো ধরনের প্রটোকল ডিউটি, রায়ট ডিউটি ও প্রটেস্ট ডিউটিতে যাবেন না। শুধুমাত্র থানা পুলিশ নিয়মিত থানার রুটিন ওয়ার্ক করবে। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যতীত অন্যান্য বাহিনী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ডিউটি পালন করবে না। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক এবং কোস্টাল এলাকায় থাকবে। আমলারা সচিবালয়ে যাবেন না, ডিসি বা উপজেলা কর্মকর্তারা নিজ নিজ কার্যালয়ে যাবেন না। দেশ থেকে যেন একটি টাকাও পাচার না হয়, সকল অফশোর ট্রানজেকশন বন্ধ থাকবে। বিলাস দ্রব্যের দোকান, শো রুম, বিপনী-বিতান, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট অর্নিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানপাট বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
তবে হাসপাতাল, ফার্মেসি, জরুরি পরিবহন সেবা যেমন-ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহন, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহন, জরুরি ইন্টারনেট সেবা, জরুরি ত্রাণ সহায়তা এবং এ খাতে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহন সেবা চালু থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২৪ সকাল ৮:৪৭