বিডিহটনিউজ এক্সক্লুসিভ: তিনি বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। নিজেও বরাবরই প্রভাবশালী ছিলেন। ছিলেন টানা সংসদ সদস্য।তার আসন থেকে তার জিতে আসাটা সবসময়ই নিশ্চিত ছিল। মন্তব্য করতে কখনও তিনি থেমে থাকেন নি। নিজের দলের প্রধানসহ বিচারপতি, প্রধাণমন্ত্রী নানা মন্ত্রী, এমপি সবাইকে নিয়েই সব সময় বাকা মন্তব্য করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন সাকা চৌধুরী। এমন কি সংসদে দাড়িয়ে নানা সময়ে স্পিকারকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন একধিক বার। সংসদে সাকা একবার বলেছিলেন, মাননীয় স্পিকার,আমিতো চোদনা হয়ে গেলাম। স্পিকার এমন অশ্লিল কথা না বলার অনুরোধ করলে সে জবাব দেয়,আমি আবারও চোদনা হয়ে গেলাম!
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, আমার নাম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরি থেকে যদি সাকা চৌধুরি হতে পারে তাহলে আমিও বলতে পারি Bangladesh Awami league থেকে বাল (Bal) ।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেও তিনি অশ্লিল মন্তব্য করেছিলেন। চট্টগ্রাম এ এক সমাবেশে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন খুজে পাওয়াকে কটাক্ষ করে সাকা বলেন, বঙ্গবন্ধু এত বেশি স্বপ্ন দেখতেন যে মনে হয় উনার স্বপ্নদোষ (!!!) আছিল।
এছাড়াও তিনি অন্য একজায়গায় বলেছিলেন, আমার নাম যদি সাকা চৌধুরী হয়, তাহলে আজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শেমু রহমান।
শেখ হাসিনাকে নিজের ছেলের বিয়ের দাওয়াত দিতে গেলে হাসিনা গ্রেনেড মেরে তাকে হত্যা করতে যাওয়ার অপবাদ দেওয়ায় সাকা বলেন, আমি গ্রেনেড মারলে সেটাতো মিস হত না।
আওয়ামী লীগের একটি মহল প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাকে উস্কে দিচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ওই মহলটি জানে না যে তারা যে বিলের মাছ আমি সালাউদ্দিন ওই বিলের বক।
সাকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট উক্তি, হাসিনার যদি সোনার প্রতি এতই লোভ থাকে তাহলে ওয়াজেদ মিয়াকে তো বলতে পারে, আমার সোনা নিয়ে এতো টানাটানি কেন?
বিচারকরাও তার হাত থেকে গ্রেফতারের পূর্বেও বাদ যায়নি। পঞ্চম সংশোধনী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন,
পঞ্চম সংশোধনীর কথা আর কি বলব? সোনা মিয়ারে বানাইসে লাল মিয়া আর লাল মিয়ারে বানাইসে সোনা মিয়া। মিয়া কিন্তু ঠিকই আছে। সোনা ডা খালি লাল হইয়া গেছে।
স্ক্যাইপি কেলিংকারীর পর বিচারকদের বললেন, সতিত্বের কোনো পার্সেন্টেজ নেই। বলা যায় না কারো এতো পার্সেন্ট সতিত্ব আছে, এতো পার্সেন্ট নেই।
তিনি একবার সংসদে বলেন মাননীয় স্পীকার দেশে আজব এক্কান মেশিন আইছে...তখন স্পীকার কৌতহুল বশত জিজ্ঞাসা করলেন কিসেই আজব মেশিন? মাননীয় স্পিকার সেই মেশিনের নাম আওয়ামিলীগ যার একদিকে যুদ্ধপরাধী ইনপুট দিলে আরেকদিকে মুক্তিযোদ্ধা বাহির হইয়া অসে...।
যুদ্ধপরাধীদের বিচার সম্পর্কে সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, মাঠে যারা ফাউল করেছে তাদের বিচার হচ্ছে না...গ্যালারিতে বসে যে হাততালি দিয়েছে তাদের বিচার নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
গ্রেফতার আতঙ্কের মধ্যেও এতটা নির্ভার কিভাবে আছেন গ্রেফতারের পূর্বে এক সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে সাকা চৌধুরী, ধর্ষন যখন নিশ্চিত, তখন তা উপভোগ করাই শ্রেয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম আলোচিত মামলা ছিল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাটি। বিচার চলাকালে নানা মন্তব্য ও বক্তব্য দিয়ে সব সময় আলোচনায় থাকতে চেয়েছেন সাকা চৌধুরী। বিচারকের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, আসামির কাঠগড়ায় বসে বিচারকাজে হস্তক্ষেপ, সাক্ষী ও চলমান রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করা, বিচার চলাকালে বারবার সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে চাওয়ার আবদার, আইনজীবীকে বাদ দিয়ে নিজেই মামলা পরিচালনা করতে চাওয়া, চট্টগ্রাম থেকে আইনজীবী নিয়ে আসা—বিচার চলাকালে এজলাসে এমন বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন তিনি।
প্রসিকিউশন হিমশিম খেয়েছে তাকে সামাল দিতে। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, বিচার চলাকালে সালাউদ্দিনের উপস্থিতি একইসঙ্গে নটরিয়াস আর উদ্ধত ছিল। সে মনেই করতো না তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এবং সে মানবতাবিরোধি অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হবে। এমনকি ট্রাইব্যুনালের রায়ের দিন, বিচারকদের রায় পাঠের পুরোটা সময় সে বিদ্রুপাত্মক নানা ভঙ্গীতে তীর্যক মন্তব্য করায় মত্ত ছিল।
ট্রাইব্যুনাল নিয়ম অনুযায়ী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আমলে নেয়া ২৩টি ঘটনায় ৭৩টি অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর তার উদ্দেশ্যে জানতে চান, আপনি কি অভিযোগগুলো শুনেছেন?
এ সময় তিনি বলেন, না আমি শুনিনি।
আমার কিছু আবেদন রয়েছে। সেগুলোর শুনানি আগে করতে হবে। আইন অনুসারে সেটা সম্ভব নয় বলে ট্রাইব্যুনাল জানালে তিনি বলেন, গাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর গাড়িতে চড়বেন, সেটা তো চলবে না। আগে আমার আবেদন শুনতে হবে।
ট্রাইব্যুনাল জঙ্গলের শাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে - বিএনপি নেতা এমকে আনোয়ারের দেয়া বক্তব্যের বিষয়ে শুনানির সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, তাকেও জেলে পাঠান আমি সঙ্গী পাবো। উনিত মহাঅপরাধ করে ফেলেছেন। জঙ্গলের বিচারকে জঙ্গলের আইন বলে।
জেলে সেবকের সাথে যৌন সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেন, আগে জানতাম জেলে জানের নিরাপত্তা নেই,এখন দেখি ইজ্জতেরও নিরাপত্তা নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চট্টগ্রামে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক নিধনে অংশ নেওয়া এবং নির্যাতন কেন্দ্র চালানোর অপরাধে ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়ার পর হেসে দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, উই আর সারপ্রাইজড।
ট্রাইব্যুনালে বিচারক যখন রায়ের শুরুর অংশ পড়ছিলেন তখন কাঠগড়া থেকেই উচ্চস্বরে সালাউদ্দিন বলে ওঠেন, রায়তো কাল ইন্টারনেটেই পড়ে ফেলা গেছে, এখন আর এসব পড়ে কী হবে। চলেন বাড়িত যাই।
বিচারক রায় পড়ার সময় একটি অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার কথা বললে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলে উঠেন এ রায় পড়া কবিরা গুনাহ।
উল্লেখ্য, ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর রায় ঘোষণার ঠিক আগের রাতে ট্রাইব্যুনাললিকস নামে একটি ওয়েবসাইটে রায়ের খসড়া চুরি করে প্রকাশ করা হয়। সাকা চৌধুরীর পরিবার তার প্রিন্টেড অংশ বাঁধাই করে রায় শুনতে ট্রাইব্যুনালে হাজির হন। এই রায়ের খসড়া লিক করার অভিযোগে বর্তমানে তার স্ত্রী, ছেলে, আইনজীবী ও ট্রাইব্যুনালের অভিযুক্ত কর্মচারী বিচারাধীন রয়েছেন।
গত ১৭ জুন থেকে ট্রাইব্যুনালে নিজেই নিজের সাফাই সাক্ষ্য দেন সাকা চৌধুরী। তখন আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, -আমার না হলে, ফাঁসি কারো হবে না।
এর আগে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে তিনি বলেন,কলকাতার জেলে পাঠাবেন না?
সাফাই সাক্ষ্য সময় বলেছেন,বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ট্রাইব্যুনালে ডকুমেন্ট হিসেবে জমা দিলে কি কবিরা গুনাহ হবে? তার বিরুদ্ধে মামলাকে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে আমি এ মামলার আসামি হয়েছি। আজ চাচার (বঙ্গবন্ধু) বই নিয়ে এসেছি।
নিজের আইনজীবিকে বাদ দিয়ে এসে বলেন, সাইদী সাহেবের সাথে ঝুলার (ফাসিতে) ব্যবস্থা করে আসলাম।
ট্রাইব্যুনালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন,"ফাঁসি তো আমাকে দেবেনই এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন?"
কেবল সাকাই নয়, তার পরিবারের সদস্যরাও পুরো বিচারপ্রক্রিয়ার সময় আদালতে উপস্থিত থেকে হাসি ঠাট্টা মশকরায় মেতে থাকতেন। এই ট্রাইব্যুনাল দলীয়, সাকা চৌধুরীর বিচার হচ্ছে কেবল রাজনৈতিক কারণে, এই ট্রাইব্যুনাল থাকবে না- এ ধরনের কথা একাধিকবার গণমাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন তারা।
রায়ের দিন ফাঁস হওয়া খসড়া রায়টি নিয়ে তার স্ত্রী বলেন, আমি এতক্ষণ ধরে রায়টি মিলাচ্ছিলাম। পুরোটাই হুবহু এক এবং অভিন্ন। তিনি হাতে থাকা বাঁধাই করা একটি বই দেখিয়ে বলেন, এটাই রায়। আমরা কাল অনলাইনে পেয়েছি। যদিও সেখানে দণ্ডের বিষয়ে কিছু লেখা ছিল না।
ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার সময় এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের কথা বলা হলে সাকা কাঠগড়া থেকেই বলে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মারা গেছে। তার মধ্যে ২০ লাখ আমি মারছি বলে দিলেইতো হয়।
রায়ের ধারাবাহিকতায় কোন অভিযোগে তিনি দোষী বা দোষী না সে অংশ পড়া শুরু হলে সাকা বলে ওঠেন, দিয়ে দাও ফাঁসি তাড়াতাড়ি। এ সময় সাকার স্ত্রী বলে উঠেন, একটায় দাও, তিনটায় দাও, আর ৯টায় দাও, ফাঁসিতো দিবাই।
রায়ে ১৯৭৩ সালের আইনের কথা বলা হলে সাকা জোরে বলে ওঠেন, কিসের ৭৩ সালের আইন। এটা ২০০৯ সালে হইছে। সেটাতে ভুতাপেক্ষা কার্যকর দেওয়া হয় নাই।
বিচারের পুরো সময়ই সাকা বারবারই বলতে থাকেন, এই আইনতো আমি করসি, আমি পাস করাইছি, ফাঁকফোঁকর ক্যামনে বাইর করতেসেন সেটা কতোটা অন্যায় তাতো আমি জানি।
মামলার অন্যতম সাক্ষী নতুন চন্দ্রকে রায়ের একটি অংশে জনপ্রিয় উল্লেখ করা হলে সাকা বলে ওঠে, হ্যাঁ, জনপ্রিয়। তবে মদ বেচতো।
ট্রাইব্যুনাল পুরো রায় পাঠের সময়ে প্রতিটা শব্দের বিপরীতে কথা বলে গেছেন এই অপরাধী। এইদিনই ছিল আদালতে আসার তার শেষ সুযোগ। ফাঁসির দণ্ড শোনার পর তার মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, বাবা, দাঁড়াও। দাঁড়িয়ে তুমি তোমার রি-অ্যাকশন বলো। সাকা হতাশার সুরেই বলেন, এই রায় মিনিস্ট্রি থেকে বের হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দিলাম।
সূত্র: বিডিহটনিউজরায় নিয়ে সাকার বাকা মন্তব্য