আজ যে ঘটনা বলব তা যেমন হৃদয় বিদায়ক, সেই সাথে অপরাধীদের চরিত্রটাও ফুটে উঠে। আমি সাধারণত সারা রাতই জাগি। কাজ করার ফাকে ২-১বার নিচে গিয়ে চা খেয়ে আসি। আমার বাসাটা বাস ষ্ট্যান্ড হওয়ায় সারা রাতই মানুষ থাকে। সেই জন্য দোকান গুলোও খোলা থাকে।রাতে চায়ের দোকানে নামলে পুলিশের সাথে দেখা হওয়া প্রতি দিনের ঘটনা।পল্লবী থানা পুলিশ বেশীর ভাগ এসআই-ই পরিচিত।এর মাঝে দুই-একজনের সাথে বেশ সখ্যতাও আছে। তারা যেহেতু জানে আমি রাত জাগি। আমার এলাকায় টহলে আসলে আমাকে একটা কল দেয়। আমি নিচে নেমে চা খেয়ে তাদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আসি।এমনই এক রাতের ঘটনা।আমি, শাহাদাৎ নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী এবং পুলিশের এক এসআই বসে চা খাচ্ছিলাম।হঠাৎই কিছুটা দূরে জটলা দেখতে পাই।কিছুক্ষণ পর একজন এসে জানাল একজন মহিলাকে একটি ছেলে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তখন রাত ৩টার মতো বাজে।পুলিশের টহল টিম চা ফেলে দৌড়ে গেল। আমি এবং শাহাদাৎ কিছুক্ষণ পর গিয়ে ঘটনা কি জানতে চাইলাম। স্থানীয় যারা ছিল তারা জানাল এখানে এক মহিলা রাত ১০টা থেকেই ছিল। সেই মহিলার বাড়ী বরিশাল। সাধারণত লঞ্চে করে এসে জুট পট্টি থেকে জুট কিনে আবার রাতের লঞ্চেই রওনা হয়।কিন্তু, সেদিন কোন কারণে লঞ্চ দেরী করে। ফলে সে জুট পট্টিতে আসতে আসতে দোকান বন্ধ হয়ে যায়।ওরা জুট কিনার টাকা দেয় বিকাশের মাধ্যমে।টাকা পেয়ে জুট পট্টি থেকে জানান হয় কবে আসতে হবে। সেই হিসেবে আসে। তাদের সাথে শুধু লঞ্চ ভাড়া, পথে খাওয়ার টাকা এবং বাস ভাড়ার বাইরে আর কোন টাকা থাকে না।মহিলা পড়ল বিপদে। তার ঢাকা যাওয়ার কোন জায়গা নেই।কোথায়ও থাকবে তার টাকাও নেই।এই অবস্থায় পূরবী ষ্ট্যান্ড যেহেতু সারা রাত সরগরম থাকে, তাই ভাবল এই ষ্ট্যান্ডেই রাতটা কাটিয়ে সকালে দোকান খুললে জুট কিনে বাড়ী ফিরবে। রাত ১টা থেকে একটি ছেলে মহিলাকে বিরক্ত করা শুরু করল। মহিলা বার বারই বলল, আমি ওই টাইপ না। বিপদে পড়ে ষ্ট্যান্ডে আছি।কিন্তু, ছেলেটি নাছড়বান্দার মতো মহিলার সাথে সেটে রইল।২.৪৫ মিনিটের দিকে ছেলেটি মহিলাকে জোর করে চুলের মুঠি ধরে তার সাথে যেতে বাধ্য করল। সেই সময় যারা ছিল, তারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু, ছেলেটি একটা ইট নিয়ে হাতে বলল, যে এগিয়ে আসবে, তাকেই ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে দিবে।মহিলাকে নিয়ে যাওয়ার ১০ মিনিটের মাথায় পুলিশ গেল ঘটনাস্থলে। লোকজন পুলিশকে ঘটনা জানাতেই ছেলেটি যেই রাস্তায় গিয়েছে সেই রাস্তায় পুলিশ মহিলা এবং ছেলেটিকে খুজতে বের হলো।আমি শাহাদাৎকে বললাম, চলেন আমরাও খুজে দেখি। শাহাদাৎ প্রথম রাজী হলো না। পরবর্তীতে আমার জোরাজুরীতে রাজী হলো।আমরা যখন খুজতে বের হয়েছি তখন দেখলাম পুলিশ ফিরত আসছে। কাউকে খুজে পায়নি। আমি পুলিশকে জোর দিয়ে বললাম, এই ব্যাপারটা গুরুতর।কোনভাবেই ছাড় দেওয়া যায় না। চলেন, দেখি পাওয়া যায় কিনা। আমি স্থানীয় দারোয়ানদের কাছে জানতে চাইলাম কোন দিকে নিয়ে গেছে। দারোয়ানরা যেভাবে যেভাবে বলল, সেই লোকেশানে যাওয়ার পর আরেক দারোয়ান জানাল, এই দিকে গেছে। সেই জায়গার শেষের অন্য দারোয়ান জানাল সে কাউকে দেখেনি। পুলিশ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝে নিল, এই এরিয়া টুকুর মধ্যেই আছে।সেই অনুসারে পুলিশ খুজা শুরু করল। আমাকে শাহাদাৎ বলল, পুলিশ এখন খুজুক।আমরা যাই।১০ মিনিটের মাথায় পুলিশের ফোন এলো, পাওয়া গিয়েছে। দুই বাসের মাঝে। ছেলেটি এরই মাঝে দুই দফা মেয়েটির উপর তার পশুত্বটুকু প্রয়োগ করল। মেয়েটি একাধারে কেদে যাচ্ছিল। পুলিশ স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েটি পতিতা কিনা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করল প্রথমে।মেয়েকে নানা ভাবে প্রলোভন দেখাল। যদি মেয়ে মামলা না করে তাহলে বড় অংকের টাকা দেওয়ার কথাও বলল।মেয়েটি বলল, তার বিচার চাই। তার টাকা লাগবে না।এর মাঝে পুলিশ ছেলেটিকে বেশ ভাল মারল।আমার প্রত্যক্ষ ইন্দন ছিল এতে।এটা অস্বীকার করার জোর নেই।ছেলেটিকে আবার শাহাদাৎ চিনে। চুরি, ছিনতাই-এর সাথে জড়িত।এর আগেও একজনকে ছুড়ী মেরেছে।শাহাদাৎ থেকে কয়েক দফা নানা হুমকী দিয়ে টাকাও আদায় করেছে। ছেলেটি এবার শাহাদাৎ-এর কাছে তার মুক্তির জন্য দাবী জানাচ্ছিল।কিন্তু, শাহাদাৎ কোন প্রকার তদবীর করেনি।
পরের দিন আমি নিজ উদ্যোগে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলাম। পুলিশ জানাল মামলা হয়েছে।ছেলেটি জেলে।মেয়েটি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। অনেকে হয়তো জানে না, এসব মামলা হলে পুলিশের অনেক লস। কারণ মেয়ের মেডিকেল টেষ্ট করাতে হয়। তার জন্য পুলিশকে ঢাকা মেডিক্যালে ঘুষ দিতে হয়।যেমন এই মামলাটার পিছনে এসআই-এর নিজের পকেটের ১৪০০টাকা খরচ হয়েছে।
যাই হোক ঘটনা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎই একদিন শাহাদাৎ-এর ফোন। বলল, ছেলেটি জেল থেকে খবর পাঠিয়েছে সে জেল থেকে বের হলে শাহাদাৎ-কে একটা হলেও পোচ দিবে! কারণ ছেলেটির ধারণা শাহাদাৎই আমাকে দিয়ে তাকে গ্রেফতার করিয়েছে।বেচারাকে দেখলাম বেশ চিন্তিত। আমি বললাম, থানায় গিয়ে জিডি করেন। শাহাদাৎ সেই সাহস টুকুও পেল না।এরপর আরো অনেক দিন কেটে গেল। আমিও যথারীতি ভুলে গেলাম।হঠাৎই শাহাদাৎ-এর ফোন। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে এসআই ফরিদা তাকে গ্রেফতার করতে এসেছে।ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে বিস্তারিত তদন্তের স্বার্থে ছেলেটিকে আবার রিমান্ডে এনেছিল। সেখানে ছেলেটি জানিয়েছে, প্রথমে শাহাদাৎ মেয়েটিকে নিয়ে যায়। শাহাদাৎ মেয়েটির সাথে শারীরিক সম্পর্কের পর ছেলেটিকে দিয়ে জোর করে মেয়েটির সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করে। এরপর স্থানীয় পুলিশকে দিয়ে ছেলেটিকে ফাসিয়ে দেয়!
যাই হোক আমি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের এসআই-এর সাথে কথা বলি এবং দেখা করি। তাকে বলার পর, সে বলে ভাই, কেউ সাক্ষি দিতে রাজী হচ্ছে না। আপনি কাউকে বলেন যাতে সাক্ষি দেয়।আমি বললাম, তাহলে আর কি আমিই দিব। বলল, না থাক।আপনার এসব ঝামেলায় না জড়ানই ভাল।দেখলেন না,শাহাদাৎ সাহেবকে কিভাবে ফাসিয়ে দিচ্ছিল!
এটি গতকালের ঘটনা। আজ শুরু হলো নানা জায়গা থেকে তদবির। ছেলেটিতে মানবিক দিক বিবেচনা করে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করার জন্য। আর আমি যাতে সাক্ষি না হই। শুধু পুলিশের সাক্ষি আদালতে ততটা গ্রহণযোগ্য নয়।আমি উত্তর দিলাম সবাইকে পশুর জন্য পশুর দিক বিবেচনা করা যায়। মানবিক দিক কি আদৌ বিবেচনা করা যায়?
অন্যদিকে শাহাদাৎ বেচারা কিছু না করেই আছে বিপদে।অপরাধীরা শাস্তি পাবে কি করে?