এ রাতগুলো গভীর অন্ধকার।প্রতি বছর এমনি ডিসেম্বরে বিজয়ের দিনগুলো এলে করিম পাগলার মন কেন যেন বিজয়ের উল্লাস বা স্বাধীনতার ত্যাগের মহিমায় আর জ্বলে উঠেন না।স্বাধীনতার যুদ্ধে তার বয়স তখন অনুমানিক চৌদ্দ কি পনের বছর।ঐ একটা বয়সে সে সমরাস্ত্র দিয়ে পাক বাহিনীর সাথে সন্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন।দেশকে স্বাধীন করতে-নতুন সূর্যোদয়ের আশায় পাকিদের বন্দুকের আঘাতে এক চোখ তার এখনো অচল।শুধু তাই নয় কেবল মাত্র করিম পাগলা মুক্তিযুদ্ধাদের দলে নাম লেখানোর কারনে সেসময় একের পর এক পাকিদের অমানবিক নির্যাতনের টার্গেট তার পরিবার থেকে শুরু করে কুনজর পড়ে তার বংশানুক্রমের উপরও।মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে করিমের কাছে প্রায় খবর আসত-পাক বাহিনী একদিন তার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে,মাকে পাকিদের বন্দুকের নলের আঘাতে নাড়ীভুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।একমাত্র বোনটিকেও ওরা ধরে নিয়ে যায়।যাবার বেলায় ঘরবাড়ীতে আগুন লাগিয়ে যায়। ঘরে বিছানায় পড়ে থাকা অসুস্থ দাদী সহ গরু ছাগল যা ছিলো তা সব পুড়ে ছাড়খার করে যায়।একমাত্র বড় ভাইকে বুদ্ধিজীবি হিসাবে সেই যে কবে ধরে নিয়ে গেছে পাকিরা, তা সে আর ঘরে ফিরে আসেনি।
একদিন যুদ্ধরত অবস্থায় করিম একটি খালের জলে একটি লাশ ভেসে উঠতে দেখে চমকে উঠেন।এ তো তার নাড়ী ছেড়া ধন বুদ্ধিজীবি ভাইয়ের লাশ।সে দিন তাদের একটি পূর্ব পরিকল্পিত অপারসনে। খুব গোলাগুলি চলছিল পাকিদের সাথে।এক পর্যায়ে করিমের দল একটি ছোট খাল সাতরিয়ে ওপারে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন নিজেদের সেইফে রাখতে।ঠিক সেই সময় জলে ভাসা ভাইয়ের লাশ দেখে নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।নিজের আবেগকে কন্ট্রোল করে জলে ভাসমান ভাইয়ের লাশটিকে ভাসিয়ে সাতরিয়ে সাতরিয়ে সাথে নিয়ে ওপারে উঠলেন।বন্দুকটা এক পাশে রেখে করিম হাটু গেড়ে বসলেন তার ভাইয়ের পাশে।পাকিরা কী অবস্থানা করেছে তার ভাইয়ে সুন্দর সুস্থ দেহটিকে। দুটো চোখের মণি চোখে আর আর নেই।সেখানে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে সেই গর্তে জলজ জীবের বিচরণ।যেই হাত দিয়ে যে আঙ্গুলের সাহায্যে কলমের কালিতে হানাদার পাকিদের নিরীহ বাঙালীদের উপর অত্যাচার নির্যাতনের কথা লিখতো পত্রিকায় সেই হাত দ্বয়ের একটি আঙ্গুলও নেই।সবগুলো আঙ্গুল গোড়ায়ে কেটে ফেলেছে পাকিরা।
সবাই খাল সাতরিয়ে চলে গেলেও করিম ভাইয়ের লাশের কাছেই বসে রইলেন।কিশোর করিম কত আর ধৈর্য ধরবেন।দেশের জন্য এক এক করে সবিইতো গেল।এখন আর ইচ্ছে করছে না যুদ্ধ করার।কী হবে আর যুদ্ধ করে,কার জন্য আর যুদ্ধ করবেন?দেশকে স্বাধীন করতে তারতো আর আপণ বলতে বেচে কেউ রইল না।দলে করিমকে না দেখে দলের একজন সেই খালের সামনে ব্যাক করে ফিরে এসে দেখল করিম এখনো সেখানেই একটি লাশের পাশে বসে আছেন।করিমের কাছে গিয়ে সহযোদ্ধা খালের ওপারে চোখ পড়ল।কারা যেন খালের দিকেই আসছেন।সহযোদ্ধা করিমকে ফিসফিস করে বলছেন।
-এই,,করিম,,এই করিম-উঠ জলদি! চল, পাকিরা মনে হয় এদিকেই আসছেরে…।
করিমের যেন বোধ শ্রবন শক্তি বলতে কিছুই আর নেই তাই বুঝতে পেরে এবার সে করিমের এক হাত ধরে হেচরা টানছেন।আর বলছেন,উঠ উঠ উঠ….।হঠাৎ করিমের জ্ঞান ফিরে বাস্তবতায় ফিরে এলেন।করিম অনেকটা ঝাকুনিতে নিজের হাতটা সহযোদ্ধার মুষ্টি হাত হতে ছাড়িয়ে নিলেন এবং অশ্রুঝরা কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বললেন।
-ছাড়ুন ছাড়ুন আমায়….আমি আর যুদ্ধ করুম না।আমারতো সব শেষ!মা বাবা বোন-মৃত্যু পথযাত্রী দাদীমা আর একমাত্র বড় ভাই! সবিইতো শেষ!আর কার জন্য যুদ্ধ করমু?কীসের তরে এ রক্তের হলি খেলা খেলমু আর।
তার চিৎকার শুনে কমান্ডার ফিরে আসেন তার কাছে।কমান্ডারকে দেখে করিম উঠে দাড়িয়ে কমান্ডারের বুকে মাথা রেখে কান্নারত অবস্থায় নিজের মনে আত্ম তৃপ্তির রস খুজঁতে লাগলেন।
-আমারে ক্ষমা কইরা দেন কমান্ডার আমি দলের নিয়ম ভাঙছি…আমারে ক্ষমা করেন।
কমান্ডারের এক হাতে বন্দু আর অন্য হাতটি দিয়ে করিমের মাথার চুলে আদর ভালবাসার পরশ বুলিয়ে তাকে শান্তনা দিলেন।
-করিম তোমার বয়সী আমারো একটি ছেলে ছিলো..এক রেইটে আমাকে না পেয়ে তাকেও নির্মম ভাবে হত্যা করে পাকিরা কেবল আমারি কারনে আমি কেন মুক্তিযুদ্ধ করছি।সেই যে ঘর ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে ময়দানে যুদ্ধ করছি।জানি না বাদ বাকী সবাই এখন কেমন আছেন!বেচে আছেন নাকি মরে গেছেন।শুনেছি ঘর বাড়ী সব পুড়িয়ে ফেলেছে স্থানীয় রাজাকার আলবদর স্বদেশী মুনাফিকরা।
কমান্ডার কিশোর করিমের থুথনিতে ধরে গালে মুখে চুমো খেয়ে আদরের পরশ বুলিয়ে দিয়ে তাকে সাহস দিতে থাকেন।
-এই যে আমি,ঐযে রহিম, জব্বার,কাউছার, এরা সবাই তোমরি মত নিঃস্ব।এঁরা কার জন্য যুদ্ধ করছে বলো?পরাধীনতার শিকল হতে একটি ফুলকে বাচাতে,আগামী প্রজন্মের জন্য পূর্ব বাংলাকে একটি স্বাধীন মাতৃভুমি হিসাবে পরিনত করতে আমরা যুদ্ধ করে যাচ্ছি।হয়তো এ লক্ষ প্রানের ত্যাগে এ স্বাধীনতার ফল ভোগে আমাদের আত্মত্যাগের তৃষ্ণা মিটবে না কখনো কিন্তু এ দেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায়,এদেশের মানুষের হৃদয়ের প্রতি নিশ্বাসের কণিকায় আমাদের আত্মত্যাগের নামগুলো লেখা থাকবে,গর্বের সাথে প্রজন্ম উচ্চারিত করবে আমাদের সাহসী মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ইতিহাসগুলো।আমাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় নত থাকবে এ দেশের প্রতিটি মানুষের শির।
দৃশ্য পতন।পাগলের বিকট হাসি।দু’হাত দুদিকে উচু করে মুখোবয় রৌদ্রতপ্ত আকাশপানে চেয়ে করিম পাগলার কমান্ডারের স্মৃতি মনে করে হাসতে লাগলেন।হাসতে হাসতে এক সময় সে কান্নার অববয়ে ধীরে ধীরে নিজ দেহ গুটিয়ে রাজপথেই বসে পড়লেন।খানিক নীরবতা।কোন সাড়া শব্দ নেই।
পুরো শহর জুড়ে বিজয়ের উল্লাসে।বিজলী বাতিতে সাজাঁনোর হচ্ছে মার্কেট দোকানপাট রাস্তাঘাট।করিম পাগলা এক হাত উচু করে তর্জনী আঙ্গুলে চিহ্নিত করছেন কোথায় কোথায় বিজলী বাতিতে সাঁজানো হল শহরময়।হঠাৎ তার চোখ পড়ল কিছুটা দূর।রাজপথে বেশ কয়েকজন নতুন প্রজন্মের ছেলেদের বিজয় দিবসের আনন্দঘন পরিবেশের প্রস্তুতি পর্ব।কোন এক গ্রুপ রাজপথে বাহারী রংয়ের আঁলপনা আকঁছেন।কেউ রঁশিতে কাগুজে ছোট ছোট জাতীয় পতাকা আঠায় আটকাচ্ছেন।করিম পাগলা মনের খুশিতে মুখে বিড়বিড় শব্দ করে তাদের সামনে গেলেন।এর মধ্যে দু’একজন ছেলে রাজপথে কাপড়ের তৈরী জাতীয় পতাকা ফেলে তার উপর বসে কিছু একটা আহার করছেন।পাগলা তাই লক্ষ্য করে হঠাৎ তড়িৎবেগে সেখানে ছুটে গিয়ে ছেলেগুলোকে আক্রমনাত্ব ভাবে হটিয়ে রাজপথে পড়ে থাকা পতাকাগুলো বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কান্না ভরা কণ্ঠে বলতে থাকলেন।
-হায়রে স্বাধীনতা!হায়রে আমার লাল সূর্যের পতাকা।এই কী তোর দশা!
অতপর খুব আবেগী শব্দে মুখের লালা বের করে।
-সব শেষ হয়ে যাবে-শকুনেরা সব শেষ কইরা ছাড়বে…অর্জিত বহু আত্মত্যাগের স্বাধীনতার লাল সূর্য,,, ঐতো ডুবছে শুধু ডুবছে…..।কেউ আর ধবাইয়া রাখবার পারবা না।
এর মধ্যে ছাত্র জনতার ভীড় তার চারপাশ বৃত্তাকারে সৃষ্টি করল।চতুর দিকে জনতা মাঝখানে করিম পাগলা ঠিক যেন একটি ক্যানভেচারের মজমা।জাতীয় পতাকাগুলো এক হাতে বুকে চেপে ধরে অন্য হাতের এক আঙ্গুল উচিয়ে উচিয়ে কখনো একে, কখনো ওকে কখনো তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলেন।তার আগে উপস্থিত জনতাকে হঠাৎ তার আত্ম চিৎকারে গাভরে দিলেন।
-এ্যাটেনসন!!ল্যাফ্ট রাইট…ল্যাফ্ট রাইট…।।হুশিয়ার!সাবধান।ডানে তাকাও…বায়ে ঘুরো…পজিসনস!!ফায়ার….।।ঠা ঠা ঠা…।
বলতে বলতে মাথা ন্যুয়ে এলো।চোখের জল গাল উপচিয়ে পড়ছে।তারপর হঠাৎ দৌড়ে জনে জনে জিজ্ঞাসা করল।
-এই…এইটা কী জানো?পতাকা-দেশ…।মাপ জানো?জানো না?
-তুই কী জাতীয় সঙ্গীত গাইতে জানিস?জানিস না হতভাগা?
-ক’ স্বাধীনতা কী? স্বাধীনতা পেয়েচিস?পাসনি,,,আর কবে পাবি?
-কার অর্ডারে তোরা দেশের পতাকা রাজাকারের হাতে দিলি? সব শেষ হয়ে যাবি,শকুনেরা এখনো!!!…ঐতো ঐতো ঐখানে সারা বাংলাতে-এখনো আছে।সময়ের অপেক্ষায় সুযোগ পেলেই তগো ঘার মটকাবে…..।।বুঝলি?।কিছুই বুঝছ নাই,,কিছুই বুঝছ নাই…।পাগলের কথা ভাসি হলেও ফলে….হা হা হা…..।
হঠাৎ বিকট শব্দের হাসিতে দ্রুত দৌড় দিল করিম পাগলা।চক্রাকারে সমাবেত জনতা তার দৌড়ের লক্ষণ বুঝতে পেরে এক সাইট ফাকা করে দিলেন।
পতাকাগুলো দিয়ে করিম পাগলা চমৎকার ভাবে নিজেকে সাজাঁলেন।একটি পতাকার লাল সূর্যটা ঠিক কপাল বরাবর রেখে মাথায় টুপির ন্যায় বাঁধলেন।দুটো পতাকা- লাল সূর্যটিকে ঠিক রেখে দু’হাতের দুই বাহুতে বাধঁলেন।তারপরও তাঁর হাতে অবশিষ্ট ছিলো আরো তিনটি পতাকা।একটি বাধঁলেন মসজিদের ঠিক উচু মিনারে।দ্বিতীয়টি বাধঁলেন গিয়ে মন্দিরের নিশানায়।তৃতীয়টি বাধাঁর জন্য হন্নে হয়ে গীর্জা খুজছেন।অবশেষে পেলেন এবং বাধঁলেন যীষুর মাথায়।এ সব গুলো পতাকা বাধাঁর কাজগুলো করলেন করলেন কমান্ডো স্টাইলে ঠিক ’৭১ এ যে ভাবে নিশব্দে কৌশলে শত্রুর খোজঁ রাখতেন।শত্রুর মোকাবেলা করতেন।
চলবে…
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২২