۞۞ গত বছরের শেষ পোষ্টে আমি বলেছিলাম "নতুন বছরের প্রথম প্রার্থনা আমার- সোমালিয়ায় জিম্মি সকল নাবিক যেন নিরাপদে দেশে ফিরতে পারেন।" - আমার প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেছেন।
গতকাল বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের হেরে যাওয়ার এমনিতেই মন খুব খারাপ ছিল, তাই পেপার দেখা হয়নি। একটু আগে নেটে প্রথম আলো খুলেই দেখতে পেলাম সোমালি জলদস্যুদের হাতে আটক "এম ভি জাহান মনির" বাংলাদেশী নাবিকরা অবশেষে জাহাজ নিয়ে ওমানের সালালাহ বন্দরে নিরাপদে ভিড়েছে।
এম ভি জাহান মনির প্রাথমিক মুক্তির বিষয়টা জানতাম তবে জাহাজটি সালালাহ বন্দরে না ভেড়া পর্যন্ত দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারছিলাম না।
খবরটি নিম্নরুপ- ১০০ দিন পর মুক্তির আনন্দ
‘আজ আমাদের ঈদের আনন্দ। ১০০ দিন পার করেছি অনেক কষ্টে, দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণায়। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়েছে, এই বুঝি তারা আমাদের মেরে ফেলল! কিন্তু এখন মুক্ত হয়ে আমরা সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গেছি।’
সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আসা বাংলাদেশি জাহাজ এমভি জাহান মণির প্রধান কর্মকর্তা আবু নাছের প্রথম আলোর কাছে এভাবেই তাঁর বন্দিজীবনের কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
গতকাল শনিবার বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টার দিকে জাহান মণি নোঙর করে ওমানের সালালাহ বন্দরে। জাহাজে প্রথমে কথা হয় নাছেরের সঙ্গে। ওয়াকিটকি হাতে নাছের নাবিকদের যার যা দায়িত্ব, তা ঠিকভাবে পালনের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। একে একে কথা হয় ক্যাপ্টেন ফরিদ আহমেদ, প্রধান প্রকৌশলী মতিউল মাওলা, তাঁর স্ত্রী রোখসানা গুলশানসহ মুক্ত হওয়া ২৬ নাবিকের সঙ্গে। অনেকে স্বজনদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন। জানিয়ে দিলেন, ‘আমরা আসছি মঙ্গলবার। তোমরা থেকো চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে।’
দুঃসহ যন্ত্রণার ১০০ দিন: ফিরে আসা নাবিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আটক অবস্থায় জলদস্যুরা তাঁদের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেনি। কিন্তু থাকা-খাওয়া-গোসল-ঘুমানোর কষ্ট ছিল অবর্ণনীয়। বাথরুমের কষ্ট ছিল সবচেয়ে বেশি। ব্রিজ রুমের একটিমাত্র বাথরুম সবাইকে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়েছে। এই ১০০ দিনের মধ্যে কেউ দাঁড়াতে পারেননি। দিনরাত একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে সশস্ত্র পাহারা ছিল। শোয়া থেকে উঠে কেউ একটু বসতে চাইলেই জবাবদিহি করতে হতো। সব সময় ৩০-৪০ জন দস্যু পাহারায় থাকত। জেগে থাকতে তারা পাতাজাতীয় একধরনের মাদক সেবন করত।
জিম্মিদের একটি ছোট কক্ষে রাখা হলেও দস্যুরা নাবিক ও কর্মকর্তাদের কেবিনগুলো দখল করে রেখেছিল। একটি কক্ষকে (পাইলট রুম) তারা অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করে। একে-৪৭ রাইফেল, মেশিনগান, রকেট উৎক্ষেপক যন্ত্রের মতো ভারী অস্ত্র সব সময় তারা সঙ্গে রাখত।
ডেক ফিটার ইদ্রিস জানান, কখনো বাথরুম পেলে মাথার ওপর দুই হাত তুলে দাঁড়াতে হতো। বলতে হতো ‘ব্রাদার-হাম্মাম’। এরপর একজন দস্যু বন্দুক ধরে পেছন পেছন এসে বলত, ‘টু মিনিত’। অর্থাৎ দুই মিনিটের মধ্যে বাথরুম সারতে হবে। শেষের দিকে বাথরুমে কোনো পানিও ছিল না।
নাবিক রবিউল বলেন, ‘শেষের দিকে মুক্তিপণ দিতে বিলম্ব হওয়ায় জলদস্যুরা এসে আমাদের বলত, তোমাদের মালিক আমাদের টাকা দিচ্ছে না। আমরা প্রতি সপ্তাহে তোমাদের একজন করে গুলি করে করে মারব। তোমরা প্রস্তুত থাকো। এসব কথা শোনার পরও আমরা কীভাবে বেঁচে আছি, তা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন।’
এ প্রসঙ্গে জাহান মণির মালিক মো. শাহজাহান বলেন, ‘সমঝোতার একপর্যায়ে চোরাইয়্যারা (জলদস্যুরা) আমাকেও এ কথা বলেছিল। আসলে ওরা কাউকে এভাবে মারে না। মুক্তিপণের টাকা দ্রুত পেতে এটা তাদের কৌশল।’
মুক্ত নাবিকেরা বিশ্রামে: মুক্ত নাবিকেরা গতকাল সন্ধ্যায় জাহাজ থেকে নেমে গেছেন। এর আগে অপর ২৬ নাবিক জাহান মণির দায়িত্ব বুঝে নেন। মুক্ত নাবিকদের একটি তিনতারকা মানের হোটেলে রাখা হয়েছে। দুই দিন এ হোটেলে তাঁরা বিশ্রাম নেবেন। মঙ্গলবার তাঁদের চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা। গতকাল রাতে নাবিকদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করে ওমানের বাংলাদেশ দূতাবাস। কেনাকাটার জন্য জাহাজমালিক প্রত্যেক নাবিককে ৫০০ মার্কিন ডলার করে দিয়েছেন।
গতকাল সকালে জাহান মণি সালালাহ বন্দরের জেটিতে ভেড়ার পর ওমানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নূরুল আলম চৌধুরী ও অন্যান্য কর্মকর্তা সেখানে যান। তাঁরা নাবিকদের খোঁজখবর নেন এবং দেশে ফেরার যাবতীয় সহায়তা করার আশ্বাস দেন। এর আগে জাহাজমালিক, তাঁর প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মেহেরুল করিম সস্ত্রীক জাহাজে গিয়ে নাবিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
☯☯ আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ -
একজন বাংলাদেশী নাবিক হিসাবে আজ আমার আনন্দের সীমা নেই। আমার ভাইরা নিরাপদে অক্ষত অবস্থায় মুক্তি পেয়েছে তাই আমি আজ অনেক অনেক খুশি।
প্রথমেই আমি কৃতজ্ঞ মহান আল্লাহতালার কাছে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই সামহোয়্যার ইন ব্লগের মোডারেটরদের, তারা এই ইস্যুতে আমার লেখা একটি পোস্ট ষ্টিকি করে আমাদের অসহায় নাবিকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
আমরা নাবিকরা যেহেতু এক প্রকারের যাযাবর জাতি- তাই আমরা সংঘবদ্ধ ভাবে কিছু করতে পারি না। আপনারা অনেকেই অবগত আছে আমি বেক্তিগত ভাবেও একটা সমস্যায় আছি, তবু আমি আমার সবটুকু চেষ্টা দিয়ে এই ইস্যুতে নাবিকদের পক্ষের একজন প্রতিনিধি হয়ে কিছু করার চেষ্টা করেছি।
আর যারা আমাকে সেই সময়ে মানুষিকভাবে এবং ব্যাক্তিগত ভাবে সাহায্য করেছেন তাদের আবারও ধন্যবাদ জানাই- বিশেষ করে- ব্লগার জিশান ভাই, শিপু ভাই, ছোট মির্জা ভাই, দু পেয়ে গাধ ভাই।
অভিনন্দন ব্রেভ রয়্যাল শিপিং কম্পানির মালিক জনাব শাহজাহান সাহেব কে- যিনি কম্পানির মালিক হিসাবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন এবং বাংলাদেশ শিপিং জগতে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
আরও ধন্যবাদ ব্রেভ রয়্যাল শিপিং কম্পানির মহাব্যবস্থাপক চিফ ইঞ্জিনিয়ার মেহেরুল করিম স্যার কে- যিনি শুধু একজন মহাব্যবস্থাপক হিসাবে এবং নাবিকদের একজন হয়ে বিশাল এই সমস্যাকে দক্ষতার সাথে সমাধান করেছেন।
সবশেষে ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশ সরকারকে- এই ইস্যুটিকে গুরুত্তের সাথে বিবেচনার জন্য এবং নাবিকদের এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।
আমাদের জন্য দোয়া করবেন সবাই, আর যেন কোন বাংলাদেশী নাবিক এই ধরনের ভয়াভহ সমস্যায় না পড়েন।
ভাল থাকবেন সবাই!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ৩:৪৯