সালাফ আস সালিহ যখন মৃত্যু শয্যায়, তাদের তখনকার উপদেশ, ধর্মভীরুতা এবং জ্ঞান পূর্ণ কথা এখানে সংগ্রহ করা হয়েছে, যা
“গ্লিম্পসেস অফ দ্যা লাইভস অফ রাইট আস পিপুল” থেকে নেয়া হয়েছে।
আল ফুদাইল ইবন আইয়্যাদ
ফুদাইল তাঁর মৃত্যু শয্যায় বেহুশ হয়ে যান এবং যখন হুশ ফিরে আসল, তখন তিনি চোখ খুললেন এবং বললেন,
“কত দীর্ঘ আমার সফর! তবুও আমি এই সময়ের জন্য কত অল্প অর্জন করতে পেরেছি (ভাল আমল)!”
ইবন আল মুনকাদির
তাঁর শেষ অসুস্থতায় সময়, ইবন আল মুনকাদির কান্না শুরু করলেন।
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, “কেন কাঁদছেন?”
তিনি বললেন,“আল্লাহর কসম! আমি গুনাহের জন্য কাঁদছিনা, কারন আমি জানি আমি প্রস্তুত। কিন্তু আমি এই ভয় পাচ্ছি যে, আমি কোন গুনাহ কে ছোট মনে করছি, যা আল্লাহর কাছে [বিচারের দিন] বড় হতে পারে।”
আমর ইবন আবদ কাইস
আমর ইবন আবদ কাইস তাঁর মৃত্যু শয্যায় প্রচূর কান্না শুরু করলেন। যখন তাঁকে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করা হল,
তিনি বললেন, “আমি মৃত্যুর ভয়ে বা দুনিয়ার প্রতি আকর্ষনের কারনে কাঁদছিনা, বরং আমি এজন্য কাঁদছি, প্রচন্ড গরমে পিপাসার্ত থাকা (গরমের দিনে রোযা রাখা) এবং শীতের রাতে দাড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়ার যে সময়, তা আমি আর পাবনা।”
বিলাল ইবন রিবাহ (রাদিআল্লাহু আনহু)
বিলালের মৃত্যু শয্যায় তাঁর স্ত্রী তাঁর নিকটে এসে বললেনঃ
“কত কষ্টের এই সময়!”
বিলাল (রাদিআল্লাহু আনহু) হেসে বললেন,
“এটি কত আনন্দের! কাল আমি আমার প্রিয় বন্ধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদের সাথে সাক্ষাত করব।”
ইবরহীম আন নাখাই
যখন ইবরহীম আন নাখাই তাঁর মৃত্যু শয্যায় কান্না করছিলেন, তখন কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কেন কাঁদছেন?”
“আমি কেন কাঁদব না” তিনি ব্যাখ্যা করলেন,
“যখন আমি আমার প্রভূ আযযা ওয়া জাল্লার (মহা পরাক্রমশালী) দূতের জন্য অপেক্ষা করছি, অথচ আমি জানিই না তারা আমার জন্য কি সংবাদ নিয়ে আসছেন-জান্নাত নাকি জাহান্নাম!”
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি’ই
মুহাম্মাদ ইবন ওয়াসি’ই যখন তাঁর মৃত্যু শয্যায়, তখন তাঁকে দেখার জন্য অনেকেই এসে জমা হচ্ছিল। কেউ দাড়ানো ছিল, কেউবা বসে ছিল। তাদেরকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, “আমাকে দেখান, কাল যখন আমার চুল ও পা ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তখন এরা সবাই আমার কি উপকারে আসবে?”
“গুনাহগাররা (মুশরিক, কাফির, ফাসিক ইত্যাদি) তাদের চেহারা (কাল চেহারা) দিয়ে চিহ্নিত হয়ে যাবে এবং তাদের কপালের চুল ও পা ধরে ধরে (হাকিয়ে) নেয়া হবে।” {আর-রাহমান;৫৫:৪১}
নাফিসা বিনতে হাসান ইবন যায়িদ
নাফিসা তাঁর মৃত্যু শয্যায় রোযা অবস্থায় ছিলেন। তাঁর ছেলে তাঁর রোযা ভাঙ্গার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন। তখন তিনি বললেন,“সুবহানাল্লাহ! আমি আল্লাহর কাছে ৩০ বছর ধরে দো’আ করছি রোজা অবস্থায় মৃত্যুর জন্য, আর এখন তুমি আমার রোযা ভাঙ্গার জন্য চেষ্টা করছ?”
অতঃপর, তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করতে করতে মারা জান,
“(হে নাবী!) তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর, আসমান সমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তা সব কার? তুমি বলো, (এর সবকিছুই) আল্লাহ তা’আলার জন্যে; (মানুষদের ওপর) দয়া করাটা তিনি তাঁর নিজের ওপর (কর্তব্য বলে) স্থির করে নিয়েছেন। কিয়ামাতের দিন তিনি তোমাদের অবশ্যই জড়ো করবেন, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।”
[আন আম;০৬:১২]
আবু সুফিয়ান (রাদিআল্লাহু আনহু)
ওমর (রাদিআল্লাহু আনহু)-র খিলাফাতের সময় আবু সুফিয়ান (রাদিআল্লাহু আনহু) অনুভব করলেন তাঁর শেষ সময় খুবই নিকটে। একদিন মানুষ তাঁকে আল-বাকীতে দেখল, এটি মাসজিদে নবওয়ীর নিকটবর্তী একটি কবরস্থান,
যেখানে অনেক সাহাবীকে সমাহিত করা হয়। সেখানে তিনি একটি কবর খুড়লেন এবং ঠিক করলেন। এতে সবাই অবাক হল। তিনদিন পর, আবু সুফিয়ান (রাদিআল্লাহু আনহু) ঘরের বাইরে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লেন, তাঁর পরিবার তাঁকে ঘিরে কান্না শুরু করল, কিন্তু তিনি বললেন,
“আমার জন্য কেঁদ না। আল্লাহর কসম! ইসলাম গ্রহণের পর আমি কোন বড় গুনাহ করিনি।”
তারপর তিনি মারা গেলেন।
আনাস ইবন আন-নাদর (রাদিআল্লাহু আনহু)
আনাস ইবন মালিক (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমার চাচা আনাস ইবন আন-নাদর (রাদিআল্লাহু আনহু) বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। সে জন্য তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন,
“হে আল্লাহর রসূল! ইসলামের প্রথম যুদ্ধে যা আপনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেছেন তা থেকে আমি অনুপস্থিত ছিলাম। আল্লাহ যদি আমাকে মুশরিকের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ দেন, তাহলে আল্লাহ দেখবেন যে, আমি কি করি।”
যখন উহুদের দিন ঘনিয়ে এল, মুসলিমরা শত্রুদের মুখোমুখি হল, তখন তিনি বললেন,
“হে আল্লাহ! এই লোকেরা যা করেছে তা থেকে আমি নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করছি।”
এরপর তিনি এগিয়ে গেলেন এবং সাদ ইবন মুয়ায (রাদিআল্লাহু আনহু) এর সঙ্গে তাঁর দেখা হল, তখন তিনি বললেন, “হে সাদ ইবন মুয়ায! নাদরের রবের শপথ করে বলছি, জান্নাত. . . উহুদ পর্বতের পিছনে, আমি এর ঘ্রাণ পাচ্ছি।”
সাদ (রাদিআল্লাহু আনহু) পরে বললেনঃ
“আমি তাঁর মত করতে সক্ষম নই (যেভাবে তিনি লড়াই করেছেন), হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”
আনাস (রাদিআল্লাহু আনহু) বললেন,
“সুতরাং আমরা তাঁকে প্রায় আশিটি তরবারির বর্শা ও তীরের আঘাতে জর্জরিত দেখতে পেলাম এবং আরও দেখতে পেলাম যে, মুশরিকরা কিভাবে তাকে হত্যা করেছে এবং তার দেহ ক্ষতবিক্ষত করেছে। তার বোন ছাড়া কেউই তাকে চিনতে পারছিল না। আর তার বোন তাকে তার আঙ্গুল দ্বারা চিনতে পেরেছিল।
সুতরাং আনাস (রাদিআল্লাহু আনহু) বললেন, “আমরা চিন্তা করেছিলাম যে এই আয়াতটি তাঁর বা তাঁর মত যাঁরা তাদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে,
“মু’মিনদের কতক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে, তাদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ অপেক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের সংকল্পে কোন পরিবর্তন করেনি।” [সূরা আল আহযাব;৩৩:২৩]
{সহীহ আল বুখারী}
লোহার বর্ম পরিহিত এক সাহাবী (রাদিআল্লাহু আনহু)
আল বারা থেকে বর্ণিত,
এক ব্যক্তি যার মুখ লোহার বর্ম দ্বারা ঢাকা ছিল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আসল এবং বললঃ
“হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি কি আগে জিহাদে যাব, নাকি ইসলাম গ্রহণ করব?”
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “প্রথমে ইসলাম গ্রহন কর, তারপর জিহাদ কর।”
তাই সে ইসলাম গ্রহণ করল এবং পরে জিহার করে শহীদ হল।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
“অল্প ইবাদাত, কিন্তু পুরস্কার বিশাল [সে ইসলাম গ্রহণের পর খুব্ অল্প আমলই করেছে, কিন্তু তার পুরস্কার অতি বিশাল]।”
{সহীহ আল বুখারী}
এক আনসার সাহাবী (রাদিআল্লাহু আনহু)
বাইহাকী বর্ণনা করেন, আশ শাফিঈ রহীমাহুল্লাহ বলেন যে,
“বীরে মাওনা কূপের কাছাকাছি জায়গায় সকল সাহাবীর মৃত্যুর ঘটনার বিপর্যয়ের পর কেবল একজন সাহাবী (রাদিআল্লাহু আনহু) পিছনে ছিলেন। তিনি পৌঁছে দেখলেন যে, শকুনেরা তাঁর সাথীদের খাচ্ছিল।
তখন তিনি আমর ইবন উমাইয়াকে (রাদিআল্লাহু আনহু) বললেন,
“আমি এই শত্রুদের মাঝে সরাসরি এগিয়ে যাচ্ছি যাতে তারা আমাকে মারতে পারে। আমি আমার সাথীদের শাহাদাতের স্থান হতে পিছনে থাকতে পারিনা। তিনি যেমনটি বললেন তেমনটিই করলেন এবং শহীদ হয়ে গেলেন। পরে আমর ইবন উমাইয়া মাদীনায় ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে উক্ত ঘটনা জানালেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রশংসা করলেন এবং আমরকে বললেন,
“এবং তুমি কেন তার সাথে অগ্রসর হলে না?”
আউফ বিন আল হারিস রাদিআল্লাহু আনহু
মুআয ইবন আফরাহ রাদিআল্লাহু আনহু বললেন,
“হে আল্লাহর রাসূল! কোন কাজ আল্লাহকে হাসায়?”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
“বর্ম ব্যতীতই কারও শত্রুদের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। একথা শুনে তিনি তার শরীর হতে লোহার পোষাক খুলে ফেলে দিলেন এবং লড়াই শুরু করে দিলেন এবং এমন অবস্থায়ই তিনি শহীদ হয়ে গেলেন।”
উমাইর ইবন আল-হামাম রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত,
বদরের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষনা করলেন,
“ওঠ! এমন এক জান্নাতের জন্য, যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিন পরিমাণ।”
একথা শুনে উমাইর ইবন হামাম বললেন, “আসমান ও জমিন পরিমাণ প্রশস্ত?”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,“হ্যাঁ”
তিনি বললেন, “বাখিন! বাখিন!”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি বাখিন, বাখিন, কেন বললে?”
তিনি বললেন, “না অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়, বরং আমি ঐ জান্নাতের অধিকারী হওয়ার জন্যই একথা বলেছি।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তুমি ঐ জান্নাতের অধিবাসী।”
সে তার ব্যাগ থেকে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগল, অতঃপর বলল,
“যদি এই খেজুরগুলো খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তবে সে তো দীর্ঘ সময়, অতঃপর সে খেজুরগুলো ছুড়ে মারল এবং তরবারী দিয়ে যুদ্ধ করতে লাগল এবং শহীদ হয়ে গেল।” [মুসলিম]
জীর্ণশীর্ণ এক দরিদ্র সাহাবী রাদিআল্লাহু আনহু
আবু বকর ইবন আবি মুসা বর্ণনা করেন,
“শত্রুদের মাঝে (যুদ্ধ ক্ষেত্রে) থাকা অবস্থায় আমি আমার বাবার কন্ঠ শুনতে পেলাম, তিনি বললেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“নিশ্চিতভাবে তালোয়ারের ছায়াতলেই জান্নাত।”
এক দরিদ্র ব্যক্তি দাড়িয়ে গেলেন এবং বললেন,
“হে আবিু মুসা! তুমি কি এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছেন?”
আমার বাবা বললেন, “হ্যাঁ”
লোকটি পিছনে তার সাথীদের নিকট গেলেন এবং তাদের বললেন,
“আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।”
তিনি তখন তার তরবারির খাপটি ভেঙ্গে ফেললেন এবং সেটি দূরে নিক্ষেপ করলেন এবং শত্রুদের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তরবারি দিয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।”
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৫