১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের আক্রমণের তীব্রতা এমন ছিল যে মাত্র ৪/৫ ঘন্টার ব্যবধানে নিহত হয়েছিল,
- দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ,
(প্রতি মিনিটে গড়ে প্রায় ৬ শত মানুষ নিহত হয়েছিল)
- ২০ লাখ গবাদি প্রশু,
(প্রতি মিনিটে গড়ে প্রায় ৬ হাজার গবাদিপশু নিহত হয়)
- ধ্বংস হয়েছিল দুই লাখ ঘরবাড়ি,
- ধ্বংস হয়েছিল চট্টগ্রাম বিমান বন্দরসহ অনেক বিমান,
- ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ও অনেক জাহাজ,
- মাঝখানে ভেংগে গিয়েছিল কর্ণফুলি ২য় সেতু,
- বিচ্ছিন্ন হয়েছিল চট্টগ্রামসহ উপ্রদ্রুত এলাকায় বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ।
সাধারণত মানুষ আক্রান্ত হয় ঝড় অথবা অতিবৃষ্টি/জলোচ্ছ্বাস/বন্যা দ্বারা আলাদা আলাদা ভাবে। কোন কোন সময় ঝড়ের সাথে অন্যটি মিলিত হয়ে যৌথভাবেও আক্রমণ করে। কিন্তু সেখানে আগুন থাকে না। এমনিতে আমরা জানি আগুন ও পানি পরস্পর শত্রু। একটির স্পর্শে অন্যটি পালায়, এটাই আগুন পানির ধর্ম। কিন্তু ২৯ এপ্রিল ১৯৯১ সালের আক্রমণ ছিল ভিন্নধর্মী। এখানে ত্রিমুখি শক্তি কাজ করছিল। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সাথে আগুন শক্তিও মিলিত হয়েছিল। তিন শক্তির মিলিত আক্রমণে আক্রান্ত এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল সে রাত্রে।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের রাত্রে আমি চট্টগ্রামের চকবাজারের পূর্ব পাশে ঘাসিয়ার পাড়া এলাকায় ছিলাম। সে রাতে বাতাসের সাথে উত্তপ্ত গরম হাওয়া আমি নাকে মুখে অনুভব করেছি। আগুনের কোন ঝলকানি আমি দেখিনি বটে তবে রাগান্বিত রক্তিম আকাশ এবং গরম বাতাস আমি পেয়েছি। পরদিন দেখেছি গাছের পাতা কালো হয়ে ঝড়ে পড়েছে, বড় বড় গাছের ডাল ভেংগে গেছে। আমার মনে হয় চট্টগ্রাম শহরের অর্ধেক নারিকেল গাছ শিকড়সহ উপড়ে পড়েছিল সেদিন। সেই যে শহরে নারিকেল গাছের আকাল শুরু হয়েছিল এখন তা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
২৯ এপ্রিলের পরদিন সাতকানিয়া আমার বাড়ি যাওয়ার সময় দেখেছি আরাকান রোডের উপর বিশাল বিশাল গাছ শিকড়সহ উপড়ে পড়ে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। এর সাতদিন পর আমাদের এলাকা থেকে ত্রাণ সামগ্রি নিয়ে আমরা কয়েকজন কুতুবদিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে স্বচোঁখে দেখেছি ধ্বংসলীলার চিত্র। পুরো কুতুবদিয়া যেন এসিড দিয়ে গোসল করেছে। গাছ পালা যা ছিল সব তামাটে হয়ে গিয়েছিল। সেখানে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকটি পাড়ার একুল ওকুল সব দেখা যাচ্ছিল। মানুষ এবং প্শু পাখির মরা লাশের দূর্গন্ধে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ছিল। সম্প্রতি আমি ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের উপর বই লিখতে গিয়ে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণের জন্য বিভিন্ন মিডিয়ার দ্বারস্থ হই। যদিও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডি.সি) জনাব মেজবাহ উদ্দিন আমাকে এ বিষয়ে তথ্য সহযোগিতা দিয়েছেন তবু আমি অনলাইন জগতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিক্ষিপ্ত লেখাগুলো থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছি। পেয়েছি অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনাও। আবার কয়েকজন বিদগ্ধ মণিষি আমাকে তাদের নিজের অভিজ্ঞলদ্ধ লেখা দিয়েছেন আমার সংকলিত বইটির জন্য।
এখানে কয়েকজন লেখক ঐ দিন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সাথে আগুনের উপস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন। সেখান থেকে আমি কয়েকজনের উদ্বৃতি তুলে ধরছি; শিক্ষাবিদ, কবি, সাংবাদিক কমরুদ্দিন আহমদ লিখেন, ‘‘দরজার খিলক ছুটে গিয়ে কপাট দুটি খুলে গেল। তখন আমি একটি চেয়ার দরজায় দিয়ে তাতে বসে দেয়ালে দু’হাত ঠেস দিয়ে দরজা চেপে বসে থাকলাম। বাইরে বাতাসের ভয়াল শব্দ, গাছের ডাল ভাঙ্গার শব্দ, ঘরের টিন উড়ে যাওয়ার শব্দ। আর বৃষ্টির সাথে বিদ্যুৎ চমকের সাথে এক ধরনের আগুনের হল্কা ভেসে যাচ্ছে তা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। ভোরের দিকে ঝড়ের মাতম থেমে গেল।’’
লেখক, কলামিষ্ট, ব্যাংকার এম.ওসমান গনি লিখেছেন, ‘‘আমরা যে বাসায় অবস্থান করছিলাম তার দক্ষিণ দিকটা ছিল খালি। জানালার পাশে দাঁড়ানোই যাচ্ছিল না। আগুনের লেলিহান শিখা যেন দক্ষিণ দিক থেকে ধেয়ে আসছিল। এ যেন আগুনের লু হাওয়া। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা, যা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। এ রাত যেন কিয়ামতের নমুনা হয়ে ধরণীতলে অবতীর্ণ হয়। এ রাতের ভয়াবহতা দীর্ঘ দু’যুগ পরও ভুলা যায়নি। এটিই বাস্তবতা। ’’
এছাড়া ব্লগার তানভীর লিখেন, ‘‘ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হঠাৎ খুব ইচ্ছে হল বাইরেটাকে দেখার। আম্মার নিষেধ অগ্রাহ্য করে ড্রইংরুমের দরজা খুলে বাইরে যা দেখলাম তাতে রক্ত হিম করা একটা ভূতুড়ে অভিজ্ঞতা হল! দেখলাম ওই প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে একটা আগুন কুণ্ডলী সাপের মত হিস হিস শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই অদ্ভূত ঘটনার ব্যাখ্যা আজও আমি পাই নি। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, পরদিন ঝড় থামার পর দেখলাম, শহরে যে সব গাছ তখনো অক্ষত আছে সেসব গাছের পাতা প্রায় সবই পুড়ে কালো হয়ে গেছে! পৃথিবীর আরো অনেক ঝড় নিয়ে পরে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, কিন্তু ঝড়ের সময় এমন আগুন কুন্ডলী ছোটাছুটি করার আর গাছের পাতা পুড়ে যাবার কথা আর কোথাও শুনি নি।’’
ব্লগার বনবিলাসী লিখেন, ‘‘কথামত ৮টার সময় কারেন্ট চলে গিয়েছিল, আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত ১০টার পর থেকে আস্তে আস্তে বাতাস শুরু হল। আমরা সবাই আবার ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। রাত বাড়ার সাথে সাথে ঝড় আর বাতাসের তীব্রতা বাড়তে শুরু করল। আমাদের বাসার জানালার কাঁচগুলো একে একে ভাঙ্গা শুরু করল। আমাদের বাসাটা ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায়। আমরা যে বাসায় ছিলাম সেটি ছিল ৫ তলা বিল্ডিং, আমরা ৪র্থ তলায় ছিলাম। আমাদের বাসা থেকে সমুদ্রটা একটু একটু দেখা যায়। রাত ১২ টার দিকে আমার আব্বা একবার বারান্দায় গেলে দেখলো সমুদ্র থেকে কেমন যেন আগুনের ফুলকির মত উঠছে। এটা দেখে আমার বাবা একবার আজানও দিয়েছিল। কারণ তিনি নাকি শুনেছেন আজানের শব্দে ঝড়ের তীব্রতা কমে যায়।’’
ফেসবুকে ফিরোজ সুমন নামে একজন মন্তব্য করেন, ‘‘এই আগুনের বিষয়টা নিয়ে আমি অত্যন্ত দ্বিধান্বিত। অনেক প্রতক্ষ্যদর্শীই আগুনের কথা বলেছেন। আমার এক ফুপাত বোন আকাশে আগুন দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং পরে অনেক জ্বরে ভুগেছিলেন।ওনারা তখন চট্টগ্রাম শহরে ঈদগাঁ বউবাজারে থাকতেন। মনে হয় রাত ২টার দিকে বাইরে থাকিয়ে দেখেন আকাশ কালো না হয়ে আগুনের মত টকটকে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। তার ভাষ্যমত তিনি আকাশে আগুন জ্বলতে দেখেছেন, এরই মাঝে তিনি আতঙ্কে জ্ঞান হারান। এখন বুঝতে পারছি না সেটাকি আগুনের মত লাল হয়েছিলো নাকি সত্যিই আগুন ছিলো?’’
উপরোক্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এটা নিশ্চিত হতে পারি যে ২৯ এপ্রিলের ভয়াল রাতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সাথে আগুনেরও একটি সম্পর্ক ছিল। পানি, বাতাস ও আগুন এই তিন শক্তির সম্মিলিত আক্রমণের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধারণাতীত ছিল। আবার এটাও ঠিক যে যথা সময়ে মার্কিন যুক্তরাস্টের টাস্কফোর্সের সমন্বয়ে ‘‘অপারেশন সী এঞ্জেলস’ দূর্গতদের সাহায্যার্থে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। তাদের সাথে যুক্তরাজ্য, জাপান, চীন, ভারত, পাকিস্তানও যুগ দেয়। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ ও এনজিও সংস্থা সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। ফলে অল্প সময়েই দূর্গত অঞ্চল বিপদসীমা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। এটার কারণে আমরাও খুব তাড়াতাড়ি সেই ভয়ংকর তাণ্ডবলীলা আর জিবনযুদ্ধে নিহতদের কথা ভুলে গেলাম। সে জন্যেই আজকে শতাব্দীর এই ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়ের উপর কোন ডকুমেন্টারী মুভি, বিয়োগাত্মক চলচ্চিত্র, স্বজনহারা আহাজারী নিয়ে কোন গল্প, নাটক, উপন্যাস রচিত হয়নি। হয়নি একক ভাবে কোন গ্রন্থ। সংরক্ষিত হয়নি নিহতদের তালিকা। ঠিক কতটি পরিবার সমূলে নিহত হয়েছিল এটা কেউ বলতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ সেরকম কোন শুমারী হয়েছে বলে শোনি নি। ২৯ এপ্রিল এলে কিছু কিছু উপকূলীয় সংগঠন ক্ষীণ কণ্ঠে এক দিনের জন্য স্বোচ্ছার হয়। অথচ এটার জন্য একটা আলাদা গবেষণা শেল থাকা খুবই জরুরি ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:৪১