somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বাগান বিলাস
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম, হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়, মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়। আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি, গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

অপ্রকাশিত গেজেট

২১ শে জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(বাবা দিবসে সকল শ্রমজীবী বাবার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ)
.
জন্মদিন নিয়ে আমার তেমন কোনো আতিশষ্য নেই।
আমার ঘরে যখন ফায়ার অ্যালার্মের মতো পুনঃপুন মনে করিয়ে
দেওয়া হয়-কাল তোমার জন্মদিন, ইন্টারকন্টিনেন্টালে
বুকিং কনফার্ম করা আছে।
আমি তখন ভেতর ভেতর শুকনো আম পাতার মতো কুঁকড়ে উঠি।
আমার জন্মদিন!
.
সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধুরা আমাকে পাঁজাকোলা
করে ধরে নিয়ে যেত। তখন আধুনিকতার নামে ক্যাম্পাসে
জন্মদিন পালনের এক চল শুরু হয়েছিল। স্কুলে ভর্তির সময়
হেডমাস্টারের দেওয়া তারিখটাকেই ওরা আমার আসল জন্মদিন
ধরে নিয়েছিল। আর সেভাবেই রেস্তোরাঁ কিংবা ক্রিকেট মাঠের
এক কোণায় বসে বছর বছর আমার জন্মদিনের কেক কাটার
আয়োজন হতো। বন্ধুদের টাকায় কেনা কেকের চারপাশে
বছর গুনে গুনে ওরা মোমবাতি জ্বালাতো।
মধ্যবিত্ত কায়দা নকল করে জ্বলন্ত মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে
নেভানোর সাথে সাথেই জন্মদিনের গান ও হাততালিতে
চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠত।
আমি কাঁঠালচাপা ফুলের মতো হা করে তাদের মুখের দিকে
তাকিয়ে থাকতাম।
আমার হা-করা মুখে কাটা কেক পুড়ে দিয়ে বন্ধুরা হৃষ্টচিত্তে বলত-
আহ্ রহমত, থার্ড ইয়ার শেষ করলি, এখনো তুই মানুষ হলি না।
বড্ড সেকেলেই থেকে গেলি। অন্যরাও সমস্বরে হো হো করে
হেঁসে উঠত। অশীতিপর বৃদ্ধের মতো আমার চোখে পানি এসে যেত।
আমি কাউকে বলতে পারি না-আদতে আমার কোনো জন্মদিন নেই।
.
জন্মদিন নেই বলতে, এ পৃথিবীতে আমি যখন প্রথম এসেছিলাম
তখন মা ছাড়া আমার জন্য আর কেউ ব্যতিব্যস্ত ছিল না।
পঞ্জিকা জ্ঞানহীন মায়ের পক্ষে আমার জন্মতারিখের হিসাব রাখার
কোনো সুযোগই তার ছিল না। সঙ্গত কারণে বসন্তের রাধাচুঁড়ার
কানেকানে নির্দিষ্ট করে মা বলতে পারেনি-সন্তানের জন্মতারিখ।
সত্যি বলতে কী, আমার জন্মের দিনক্ষণ মনে রাখার মতো
কোনো সামাজিক উপযোগিতাও তখন ছিল না।
.
মা এখন অনেক বয়সী, দাঁত পড়ে গেছে, কথাও অস্পষ্ট।
শুধু তাই নয় আলঝেইমারে আক্রান্ত মা এখন
আর মনে রাখতে পারে না কিছুই।
তার কেবল মনে আছে-চৈত্রের এক গরম আলোহীন অমাবস্যা
রাতে আমি এসেছিলাম তার কোলজুড়ে, এই গ্রহে।
.
আমার ওপরে ছিল আরো তিনটে। আমি ছিলাম চতুর্থ।
সংসারে অধিকতর মনোযোগী আমার উপোসী ছারপোকা বাবার
জন্য একগণ্ডা সন্তানের জন্মদিনের ফালতু হিসাব মাথায় রাখা
ছিল সময় নষ্ট করারই নামান্তর।
মায়ের কাছে আমাদের জন্মের বার-তারিখের কিছুটা গুরুত্ব
থাকলেও বাবার কাছে জন্মদিন ছিল খুবই অপ্রাসঙ্গিক একটা বিষয়।
বালবাচ্চার মুখে রোজ চারটা দানা জোটাতে বাবাকে হিমশিম
খেতে হতো। দারিদ্র সংসারে আমাদের জীবন জোগানোর
এন্তেজামই তার কাছে ছিল সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।
.
বাবা একটা পুরাতন হিরো সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যেত
ভোরের আলো ফোটার সময়, আমরা তখন ঘুমিয়ে থাকতাম।
তার কাছে জীবন মানে যুদ্ধ। পড়তি ক্যারিয়ারের ক্রিকেটারের
মতো আগামীর জন্য কেবল প্রত্যাশা ব্যক্ত নয়, বর্তমানটাই ছিল
তার কাছে সবচেয়ে বাস্তব, সমঅর্থে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ।
দিনভর পাড়ায় পাড়ায় কাচের বাক্সভর্তি হাওয়াই মিঠা বেচে
থলেতে যৎসামান্য সওদা নিয়ে বাদ মাগরিব সে ঘর্মাক্ত শরীরে
ঘরে ফিরত।
কুপির আলোয় বাবার একই দৈন্যপীড়িত ক্লান্ত ও নিরানন্দ চেহারা
দেখতে দেখতে তার একটি স্নেহহীন পাথর অবয়ব তৈলচিত্রের মতো
আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। আমার মনে মনে খুব আফসোস হতো
রাশভারী মানুষটা কি আরও একটু নরম, আরও একটু কোমল
ও স্নেহবৎসল হতে পারত না?
বাবার ওসব নিরেট বস্তুবাদী অর্থনীতির চেয়ে তার নিকট আর দশজন
শিশুর মতো পারিবারিক প্রীতিময়তা আমাদের বেশি আরাধ্য ছিল।
.
যাক সে কথা, জীবনের কানাগলিতে ঘুরতে ঘুরতে
সৌভাগ্যের পরশপাথর আজ আমাকে আলোকিত করেছে।
একশ’ত্রিশ গতিতে ল্যাম্পপোস্ট অতিক্রম করে ছুটে চলা
আন্তর্জাতিক সংস্থার অডি কিউ সেভেন পাজেরোতে বসে
বাবার সেই দায়িত্ববোধ, তার সেই স্নেহহীন স্নেহময়তা
নোঙরের মতো আমাকে পেছন থেকে টানে।
.
এখন আমার জন্মদিন পাঁচতারকা হোটেলে বছর বছর
আড়ম্বরে আয়োজন হয়। কিন্তু আমার ব্যবচ্ছেদের রক্তক্ষরণ
আমার স্মৃতির অলিন্দ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আমার ভেতর
অস্বস্তির বুদবুদে ভরে যায়।
যখন আমার কেতাদুরস্ত সুহৃদরা ফুঁ দিয়ে মোমবাতির
আলো নেভায় তখন আমার পৃথিবীর আলো পুরোপুরি নিভে যায়।
যখন মান্যগণ্য অতিথিবৃন্দের পারফিউমের সুগন্ধির
ভেতর ঘরময় পুঁজিবাদী সক্ষমতার বেলুন উড়তে থাকে
তখন আমার পিতার ঘামের সোঁদা গন্ধে
আমার ফুসফুস ভরে যায়।
সংবাদকর্মীরা যখন আমাকে ক্যামেরার ফ্ল্যাশে
সিক্ত করে জন্মদিনের চিত্তাকর্ষক মুহূর্ত ধারণের প্রত্যাশায়
প্রতিযোগিতায় নামে, তখন আমার পা দুটো প্রশ্নবোধক
চিহ্নের মতো কুঁজো হয়ে যায়।
যখন অতিথিবর্গ উড়ন্ত পায়রার ঝাঁকের মতো শব্দ করে
সমস্বরে জন্মদিনের গান গায়
তখন আমার নিজেকে মিথ্যাবাদী, চাঁড়াল অথবা গাড়ল
বলে গালি দিতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু আমি তা পারি না।
আমি নিজেকে গালি দেওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পারি না।
আমরা গরিব ছিলাম বলে দারিদ্রের সাথে দ্রোহের
অসম সমীকরণ শৈশব থেকে খুব নিখুঁতভাবে মিলাতে শিখেছিলাম।
প্রতিবাদের বদলে কীভাবে শুক্তোর মধ্যে দুঃখের মুক্তো
ঝামেলাহীন পুশে রাখতে হয় তাই রপ্ত করেছিলাম।
সাহস করে কখনো মিছিলে যাইনি, শ্লোগান দেইনি
মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার ওপরে ছুঁড়ে মারিনি।
সেই মুখ বুঁজে মেনে নেওয়া মিথ্যা, পরজীবী আলোকলতার
মতো আজও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে থাকে।
মিথ্যা অক্টোপাসের বাহুডোরে আচ্ছাদিত হয়ে
ভীরু কাপুরুষ কচ্ছপের মতো আমি মাথা গুটিয়ে রাখি।
.
এখন আমার জন্মোৎসবে প্রয়াত বাবার রক্ত জল করা
সেই কষ্টের তৈলচিত্র আমাকে নিরন্তর পোড়ায়।
আমার প্রতিটি জন্মতারিখবিহীন জন্মদিনে
মেঘমুক্ত তারাহীন অমাবস্যার কালো
অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে
ঘুর্ণিঝড়ের মতো দুমড়ে মুচড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-
ক্ষমা করো বাবা, কুপির আলোর বিপরীতে
তোমার সেই পরিশ্রান্ত ছায়া দেখে দেখে
বড় হওয়া রহমত এখন তোমার আলো থেকে অনেক দূরে।
তোমার রহমত আজ পুরাদস্তুর কপট,
ভোগবাদী ও আপাদমস্তক এক মিথ্যাবাদী।
ক্ষমা করো বাবা, আমার কোনো জন্মতারিখ নেই।
বাবা, ক্ষমা করো।
তোমার রহমতের কোনো জন্মদিন নেই।
.
ছবিঋণ: শিল্পী মাহবুবুল হক।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:২৫
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×