জাহাজটিকে আস্তানায় নিয়ে যাচ্ছে জলদস্যুরা
জলদস্যুরা ইডেন উপসাগরের দিকে বাংলাদেশি জাহাজ 'জাহান মনি' নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ জলদস্যুদের কবল থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ জাহাজটি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। নৌ-বাণিজ্য অধিদফতরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান জানান, 'ঘণ্টায় ৯ নটিক্যাল মাইলের সর্বোচ্চ গতিতে জাহাজটি চালাচ্ছে দস্যুরা। দিনভর উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলেও সন্ধ্যা নাগাদ হঠাৎ এটি গতিপথ পরিবর্তন করে। তবে দিক পরিবর্তন করলেও শেষ পর্যন্ত জাহাজটি নিজেদের আস্তানাতেই নিয়ে যাবে তারা।' এদিকে ঢাকায় নৌমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা
আলোচনার মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান চান।
জলদস্যুকবলিত জাহাজটি উদ্ধার করতে গতকাল দিনভর একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে ঘটনাস্থল থেকে ৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকা মুম্বাইয়ের রেসকিউ সেন্টারে। সেখানে থাকা নেভির সদস্যরা সকাল সাড়ে ১০টায় প্রয়োজনে হেলিকপ্টার দিয়ে জিম্মিদের মুক্ত করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু দিনভর অপেক্ষা করেও ভারতীয় নেভি কিংবা দুবাইভিত্তিক পাইরেসি মনিটরিং সেল ইউকে এমটিওর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেন কবির গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ব্রেভ রয়েল শিপ ম্যানেজমেন্ট (বিডি) লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মেহেরুল করিম। সমকালকে তিনি বলেন, 'জাহাজটি দস্যুকবলিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরও আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার তৎপরতা দেখিনি। তাই আমরা চেয়ে আছি সরকারের দিকে। কূটনৈতিক কোনো তৎপরতা ছাড়া জাহাজ উদ্ধারের সম্ভাবনা দেখছি না।'
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে জিম্মিদের
'জাহান মনি'তে থাকা ২৬ নাবিক ও ক্রুর কারও সঙ্গেই গতকাল দিনভর কথা বলতে পারেননি সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর, নৌ-বাণিজ্য অধিদফতর কিংবা জাহাজ মালিকরা। তবে বাংলাদেশি নাবিক ও ক্রুরা অক্ষত আছেন বলে আশা করছেন সবাই। অতীত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জাহাজের মালিক পক্ষের জেনারেল ম্যানেজার জানান, সোমালিয়ান জলদস্যুরা সচরাচর শারীরিক আঘাত করে না জিম্মিদের। তারা হয়তো মুক্তিপণের জন্যই জাহাজটি ছিনতাই করেছে।
মুক্তিপণ দিতে প্রস্তুত জাহাজ মালিক
যে কোনো কিছুর বিনিময়ে জাহাজে থাকা ২৬ বাংলাদেশি নাবিক ও ক্রুকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে কবির গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মেহেরুল করিম জানান, 'যে কোনো মূল্যে ২৬ ক্রুকে অক্ষত ফেরত চাই আমরা। এ জন্য যত টাকাই লাগুক তা দেবে আমার কোম্পানি।' পাইরেসি মনিটরিং সেলেও এ বার্তা পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। মালিক পক্ষের ধারণা, মুক্তিপণ চাইতে আরও দু'তিন দিন সময় নেবে দস্যুরা। কারণ ছিনতাইকৃত জাহাজটি তাদের আস্তানায় নিয়ে যেতে আরও অন্তত চার দিন সময় লাগবে দস্যুদের।
হতভাগ্য সেই ২৬ জন
জাহাজে সস্ত্রীক জিম্মি হয়ে আছেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার মতিউল মাওলা। তার স্ত্রী রোখসানা গুলজারকেও জিম্মি করে রেখেছে জলদস্যুরা। আরও জিম্মি হয়ে আছেন_ ক্যাপ্টেন ফরিদ আহমেদ, চিফ অফিসার আবু নাছের মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার, সেকেন্ড অফিসার জিএম নুর ই আলম, থার্ড অফিসার মোঃ কামরুল হোসাইন, ডেক ক্যাডেট শরীফুল ইসলাম, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মোঃ মাঈনউদ্দিন, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার সুব্রত কুমার মণ্ডল, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার মোঃ তারিকুল ইসলাম, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সাহাবু আলম, ইঞ্জিন ক্যাডেট শাহরিয়ার রাবি্ব, ডেক সারেং মুহাম্মদ রুহুল আমিন, সিম্যান মোহাম্মদ এমদাদ হোসাইন, মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ও আবদুল ফাতাহ, ক্রু রবিউল ইসলাম, গ্রোসার ফখরুল ইসলাম, কিবরিয়া আহমেদ, ফায়ারম্যান মোঃ ইলিয়াছ, চিফ কুক মোঃ মশিউর রহমান, জেনারেল স্টুয়ার্ট জসিম উদ্দিন, ডেক ফাইটার মোঃ ইদ্রিস, ইঞ্জিন ফাইটার মোঃ মহিউদ্দিন, জুনিয়র ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আবুল হোসেন এবং সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার আবুল বাশার।
ভারত নজর রাখছে
এএফপি জানায়, ভারত বলেছে_ তারা বাংলাদেশের জাহাজ ছিনতাইয়ের ব্যাপারে নজর রাখছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার পিভিএস সতিশ এএফপিকে বলেন, আন্তর্জাতিক নীতি অনুসারে ভারতীয় নৌবাহিনী বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ জলদস্যুদের দখলে চলে যাওয়ার পর হস্তক্ষেপ করতে গেলে জাহাজের নাবিকদের জন্য তা বিপজ্জনক হতে পারে। বর্তমানে সোমালিয়ায় সমুদ্রসীমার কাছে ভারতের একটি যুদ্ধজাহাজ অবস্থান করছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ ক'টি দেশের নৌবাহিনীও আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে টহল দিচ্ছে। তারপরও এ অঞ্চল থেকে জলদস্যুদের তৎপরতা বন্ধ করা যায়নি।
পরিবার উদ্বিগ্ন
বিলকিস রহমানের স্বামী ক্যান্সারের রোগী। সন্তান বলতে আছে দুই ছেলে। এর মধ্যেও আবার একজন অসুস্থ। তার দুঃখ-কষ্টের এই পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম বড় ছেলে শাহরিয়ার রাবি্ব। ২১ বছর বয়সী সেই রাবি্বকেই এখন জিম্মি করে রেখেছে জলদস্যুরা। কবে নাগাদ মায়ের বুকে ফিরবেন রাবি্ব_ সে উত্তর জানা নেই কারোরই। কারণ রাবি্বর মতো আরও ২৬ বাংলাদেশিকে জিম্মি রেখেই সোমালিয়ান জলদস্যুরা জাহাজটি নিয়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। জাহাজ মালিক যে কোনো কিছুর বিনিময়ে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তৎপর আছে সরকারও। কিন্তু কারও কোনো প্রতিশ্রুতিই আশ্বস্ত করতে পারছে না জিম্মিদের স্বজনকে। ভাই, বাবা কিংবা প্রিয়তম স্বামীর জন্য চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন তারা।
মেরিন একাডেমীর ৪৪তম ব্যাচের ছাত্র শাহরিয়ার রাবি্বর খবর নিতে পতেঙ্গার ঈশা খাঁ ঘাঁটি থেকে জাহাজ মালিকের কার্যালয়ে ছুটে এসেছেন বিলকিস রহমান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানান তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিলকিস রহমান বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটাই আবেদন_ আমার সন্তানকে আমার বুকে ফিরিয়ে দিন। আমার স্বামী অসুস্থ, ছেলে অসুস্থ। রাবি্ব ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।'
কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠছে জাহাজের আরেক জিম্মি চিফ অফিসার আবু নাছের মোঃ আবদুল্লাহ মজুমদারের বাড়ি। তার আড়াই বছর বয়সী মেয়ে নাফিউন নাওয়ার সবেমাত্র বাবা বলা শুরু করেছে। কিন্তু পরিবারের সবাইকে কাঁদতে দেখে নির্বাক হয়ে গেছে নাফি। চিফ অফিসার আবু নাছেরের স্ত্রী ফারজানা আক্তার পপি বলেন, 'তার সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয়েছে শুক্রবার সকালে। এক মিনিটের সেই আলাপচারিতায় সে শুধু আমাকে বলেছিল সাগর উত্তাল। নেটওয়ার্কে সমস্যা হচ্ছে। আমরা গ্রিসে যাচ্ছি। দোয়া করবে সবাই।' আবু নাছেরের মা শাহানারা বেগম বলেন, 'আমার ছেলেকে রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।' একই আকুতি জানান নাছেরের বড় ভাই শাহজালাল মজুমদার।
সূত্র : সমকাল