somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহতের পদে বাঁধা

১৯ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১০:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক.
গড়াই নদীর বালুকারাশির ভেতর মরীচিকাসম ধারাজলের রেখা দেখে মনে হলো জীবনে তৃষ্ণা আছে এর জন্যেই; চৈত্র্যের তাপদগ্ধ বসন্তের হাওয়া এসে চোখেমুখে জ্বালা ধরালে নারীর মতো ঘোমটা তুলে হেঁটে যাই সর্পিল ও সুবর্ণ নদীতীর ধরে। পেছনে ফেলে এসেছি শ্মশানঘাট, পোড়ারোদ, পাকুড় ও বটগাছের উষ্ণ-শীতলতা; পাগল ও যোগীর সমাবেশ হতে আনন্দগান ও হৃদয়পোড়া সুর তামাকের ধোঁয়ায় মিশে উড়ে যাচ্ছে কোথায়?
দু’টি মেয়ে হাত ধরে নদীর এপাড় হতে ওইপাড়ে এমনভাবে হেঁটে গেলো যেন দুটি পিঁপড়া অসীম খাদ্যভাণ্ডারের ওপর দিয়ে অনাগ্রহিতার মতো জীবনের অরুচীকে জানাতে জানাতে পার হয়ে গেলো, মাঝে মাঝে অগভীর নদীর বুকজলে ডুবে ডুবে উপেক্ষা করে সিক্ততার নিত্য সংস্কারকে। দূর হতে ডেকে বললাম কোথায় চলেছো তোমরা? পেছনে না তাকিয়েই ওরা বলে, বালি খুঁড়ে জলের ধারা যখন ঝর্ণার মতো বেরুবে সেইজলে ডুব দেবো। এই মরুসম শীর্ণ নদীর চরে ওরা খুঁজে ফেরে ভিন্ন জলধারা, ঊর্ধ্বমূখী স্রোত, শীতলতা, আনন্দের দেবালয়।

ওরা কোথায় হারিয়ে যায়, বেলা পড়ে যায়, ফিরে আসি সেই পথে যেখানে সকলেই হেঁটে যায় কিন্তু যেতে পারে কেউ কেউ। আগম-নিগম চরাচর ধরে তখন বেজে ওঠে ধ্বনি, এই সময়খানি পাগলদের, সন্ধ্যার সন্ধিক্ষণে দোলের প্রতিমা শ্রীপূর্ণিমা-চাঁদ ধীরে ধীরে নিজের রূপে প্রকাশ হচ্ছেন, অনতিদূরে বাজার বসিয়েছেন আলেক সাঁই, ঝোপে ঝোপে যেমন লুকিয়ে থাকে পাখি তেমন আসন পেতেছেন ফকির ও সাধকগণ, মানুষের ভিড়ে তাঁরা ঠিকই আড়াল করে নেন নিজেদের।

দুই.
শীতল জলের ধারা পেরুলে একখানি দীর্ঘ চরা, সাদাবালি, কাচের মতো ঝলক দিচ্ছে রোদে। ঠিক এর মাঝখানে বাথটাবের মতো স্বচ্ছ ও নাতিশীতোষ্ণ জলের একটি নিম্নভূমি, লোভীর মতো নেমে পড়লাম, শুয়ে পড়লাম। বালির কাদা তুলে শরীরে মাখলাম। উঠে বসলাম তপ্ত বালিতে, কাদা শুকিয়ে যেতে লাগলো, রোদ হতে শুষে নিলো শরীর বসন্তের বাতাসটুকু। মনে পড়ে নাগা সাধুদের কথা, তারা গায়ে কাদামাটি মেখে রাখেন, হয়তো রয়েছে এর বহু অর্থ, এই অর্থটি আজ জানা হলো।

আগুনের মতো তপ্ত বালিতে শীতল দেহখানি নিয়ে দৌড়ে গেলাম কিছদূর, দেখতে পেলাম বৈষ্ণবীদের স্নানপর্ব। নেমেছেন তারা নদীতে, আমি তাঁদের অপূর্ব স্নান দেখে নিজের দিকে তাকালাম, সমস্ত শরীর মেখে আছে মাটি, একখানি লাল গামছা কেবল জড়ানো। ঠিক এইসময়ে সকল জাগতিকতা হতে মুক্ত হবার প্রেরণা পেলাম, হয়তো এক পা এগুলেই প্রবেশাধিকার ঘটে, কিন্তু দেখলাম পা দু’খানি কেমন পাথর হয়ে আসে, নড়বার শক্তি নেই, শরীর হতে বালি খসে পড়ে, বের হতে থাকে লৌকিক দেহ।

গড়াইয়ের কোমরজলে গোসল সেরে যখন উঠে পড়লাম তখনও বুঝতে পারি নি কি অপেক্ষা করছে? যথারীতি রোদ হতে হাওয়াকে শুষে নিতে নিতে শরীরখানা বড়ই সতেজ হয়ে উঠলো। আমরা হাঁটলাম কিছুদূর, ফের বটগাছের নীচে, পাগলদের ডেরায়, চা-খানায় বসলাম। তখনও গান গাইছে সাধুরা, সুর ঘিরে রেখেছে পুরো চরাচর, মনে হলো এইবার আমি তালছাড়া হলাম না, বসে পড়লাম। এক পাগল এসে আমার চুলে দু’খানি খোঁপা বেঁধে দিল আর কাঁধের গামছাখানি দিয়ে ঢেকে দিল তা, তার চোখ বেয়ে জল ঝরছে, বলছে সে পাঞ্জুশাহর কথা, সতীমায়ের কথা, আমাকে ঘোমটা পরিয়ে দিলেন--আমি ভাবছি আমারই কথা..

মেয়ে হয়ে মেয়ের বেশে, ভক্তিসাধন কর বসে

আদি চন্দ্র রাখ কষে, কখনো তারে ছেড় না।

ডোব গিয়ে প্রেমানন্দে, সুধা পাবে দন্ডে দন্ডে

লালন কয় জীবের পাপ খন্ডে, আমার মুক্তি হলো না ।। --ফকির লালন


তিন.
একটি পদ গাইলেন তিনি, সেই পদের কর্তা যিনি তিনি কি এই গানে ধরা পড়েন? যেমন ধরা পড়েন না অগণিত মানুষের কাতারে কাতারে সেবা নেবার সময় প্রকৃত সেবী। এই হাটে চোখ মেলে যে বসে আছে তার কিছুই দেখা হয় না, যে আছে বুঁজে সে দেখতে পায় কিছু তার, সে দেখাও মিলিয়ে যেতে চায় যখন দৃষ্টিতে দৃষ্টির পর্দা পড়ে। সাধুর বাজার কোথায়? এ যে নিত্যপসরা, কেতাবী জ্ঞানের দোকান ও রকমারী দ্রব্যের হাজতখানা।

মরা কালীগঙ্গার বুকে মেলা বসেছে। মানুষও এইখানে দ্রব্য। যে যার মতো বিকিকিনি হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীর চোখ পড়ে আছে এইখানে, সেই চোখে বালির কণার মতো সাধু ও ফকিরদের মাঝে মাঝে দেখতে পেলে পোষাকী-সংস্কৃতির বেদনা জাগে। বিনোদনের তার হয়ে মানুষ যে যার মতো একে অন্যের বানানো যন্ত্রে বেজে উঠছে, বেসুরো ও বেচাল। মাঝে মাঝে গাছতলায় আশ্রয় নেয়া দিগম্বর পাগলদের আগুনচোখ সেঁকে নিতে চায় আত্মানুভবের কাই হতে নির্মিত রুটি--মনুষ্যসমাজ হতে বিচ্ছিন্ন ও অপরিচিত।

যে সহজে কথা কইতে পারে তার জীবন সহজ নয়। সাধারণ হয়ে ওঠা সুকঠিন। অবলীলায় যার কন্ঠে জেগে ওঠে সরলগান সে গান মহতের পদে বাঁধা। এইসকল বুঝতে হলে ভ্রমণে কাজ হয় না, নেমে পড়তে হয় পরিভ্রমণে-আত্মজাগরণে। বাউল মত ও পথের দিশা মেলে তাঁর কাছেই যার আছে সহজ হয়ে উঠবার, ভার বইবার প্রবল শক্তি। যে জেনেছে জীবন মানে ‘সামান্য’ আর অসামান্যে সুপ্ত আছে যা তাইতো ‘জীবন’

২০১৪

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১০:২৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×