পুরোনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ করেই। সুঁইয়ে সুতো গাথতে গাথতে মনে পড়ে গেল কথাগুলো।
একদম ছোট থাকতে মোটামুটি জমিদারি হালতে দিন কাটাতাম। যখন নার্সারিতে পড়তাম তখনকার কিছু দৃশ্য ঝাপসা ঝাপসা মনে আছে। ময়মনসিংহ শহরে থাকতাম। বাবা ছিলেন রোডস এন্ড হাইওয়েজের ইঞ্জিনিয়ার। যে জায়গায় থাকতাম তার নাম ছিল সাহেব কোয়ার্টার।পাজেরো গাড়ি করে শিশু কাননে পড়তে যেতাম। কিন্ডারগার্ডেনের তাবৎ ছেলে মেয়ে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমি গাড়ি থেকে নামা মাত্রই এক দঙ্গল ছেলে গাড়ির বাম্পার, পা দানি তে চড়ে লাফালাফি করতো। আমি চিৎকার করে বলতাম অই নামো সব নামো এইটা আমার গাড়ি।
১৯৯২ সালের পর থেকে বেশ বড় একটা সময় নিদারুন অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলো আমাদের পরিবার। রোডস এন্ড হাইওয়েজের মত একটা জায়গায় বাবার মত সৎ মানুষদের টিকে থাকা ছিল যুদ্ধের মত। প্রমোশন না কিসের জন্য একটা এক্সাম হয়েছিল বাবা আর এক আংকেল ছাড়া সবাই ফেল মারেন। যারা ফেল মেরেছিলো টাকা পয়সা খাইয়ে বাবার প্রমোশন আটকে দেয়। তারপর মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি কারনে দীর্ঘ ৫-৬ বছর বাবার চাকরি ছিলো না। যদিও পড়ে চাকরি ফিরে পান এবং ক্ষতিপূরন বাবদ মোটা অংকের টাকা পান যেটা হাসিনার আগের আমলের শেয়ার বাজারে বানের জলে ভেসে গিয়েছিলো।
দারিদ্রের মধ্য দিয়ে কাটানো সময় টুকু আমি কখনো ভুলবো না। কিভাবে দিন কাটাতাম তা নিয়ে কিছু সাধাসিধে কথা বলি। ফার্মগেটের জাহানারা গার্ডেনের দুই বেডের ছোট্ট একটা বাসায় ভাড়া থাকতাম আমরা। একরুমে বাবা মা আরেক রুমে গাদাগাদি করে আমরা ৪ ভাই। বাবার চাকরি ছিলোনা বলে মা ছাত্রী পড়িয়ে সংসার চালাতেন। আমাদের পরিবারে কিছু আঘোষিত নিয়ম ছিল। যেমন, কোন কিছু চাইলে অবশ্যই তা পাওয়া যাবে না। তাই বাবা মায়ের কাছে মুখ ফুটে কিছু চাইতাম না। স্কুলের সাদা ইউনিফর্মটা যখন সাদা থেকে হলুদ হয়ে কালচে টাইপের হয়ে যেত উপায় না দেখে বাবা নুতন আরেকটা কিনে দিতেন। ঈদে খালা নানুরা যা দিতেন ওটাই প্রয়োজনের তুলনায় অধিক ছিলো। বাবা মায়ের কাছে কিছু চাইবার প্রয়োজনও বোধ করতাম না। দুপুরে কিংবা রাতের খাবারে গরুর গোস্ত রান্না হলে তরকারি নেবার নিয়ম ছিল দুই টুকরো আলু আর দুই টুকরো গোস্ত (মোটেও প্রমাণ সাইযের টুকরো নয়) আর মুরগি হলে এক টুকরো মুরগি আর দু টুকরো আলু। ডিমের তরকারি রান্না হত প্রায়ই। কখনো গোটা ডিম খাইনি। অর্ধেক করে খেতাম। একদিন টিফিন নিয়ে গিয়েছিলাম দুটো পাউরুটি আর আধখানা ডিম। কয়েকজন সহপাঠী বেশ ঠাট্টা করেছিলো দেখে। ছেলেপেলেরা দেখতাম প্রত্যেক সাবজেক্টের জন্য একটা টিচারের কাছে পড়তো ক্লাস সিক্স থেকেই। আমি প্রথম পড়া শুরু করি ক্লাস নাইনে থাকতে। ততদিনে অবশ্য আবার সচ্ছলতা ফিরে আসা শুরু করেছিলো। এত কিছুর মধ্যে আজ যেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লো সবচেয়ে বেশি তা হলো সুঁইসুতোর কাহিনী। সেলাইয়ের ঘটনা। ঐ সময় না ধুমিয়ে সেলাই করতাম। অবশ্যই কারুকার্যের জন্য না। সেটা কিভাবে করে জানিও না। বাবা মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন অল্প ছিড়ে ফেটে গেলেই জামা কাপড় ফেলনা হয়ে যায়না। আমি সেটা বুঝে দিনরাত সেলাই করতাম। ছোট থাকা অবস্থায় কি কারণে জানি জামা কাপড় ছিড়তো বেশি। দুদিন পরপর এই প্যান্টের সেলাই খুলে যায় আবার হঠাৎ ওই জামা ফুটো হয়ে গেলো। কাজ চালানোর মত সেলাই পারতাম। নেহায়েত আমার সাধ্যের বাইরে চলে গেলে মায়ের কাছে নিয়ে যেতাম উনি সেলাই করে দিতেন। প্যান্টের সাথে পাল্লা দিয়ে সেলাই করতাম স্কুল ব্যাগ। অকারনেই স্কুল ব্যাগ গুলো ছিড়ে যেতো। সেলাই করতাম তিন চার পাঁচবার করে।
আজ অনেকদিন বাদে কি মনে করে অনেকগুলো ফেলে রাখা প্যান্ট সেলাই করলাম। হালকা ছেড়া কিছু প্যান্ট বহুদিন ধরেই পড়ে ছিলো। সেলাই করতে করতে মনে পড়ে গেলো পুরোনো দিনের সেই সুইসুতোর দিনের কথা।
আমার কষ্টের দিনগুলো আমাকে শিখিয়েছিলো অনেক কিছু। ভুলে যেতে বসলেও প্রবৃত্তির কারণে কিছু জিনিস চলে আসে আগের মত। এখনো গোস্তের তরকারি নিতে গিয়ে দুটোর জায়গায় যখন ৪-৫ টূকরো নিয়ে নেই কিংবা আলু নিয়ে ফেলি অনেকগুলো, প্রায়ই মনে পড়ে যায় দু টুকরো আলু আর গোস্তের টুকরোর কথা। জুতো কিংবা স্যান্ডেল ছিড়ে গেলে ফেলে না দিয়ে রাবার গাম কিংবা সুপারগ্লু দিয়ে দীর্ঘজীবি করার প্রচেষ্টা চালাই। ডিমের তরকারি পেলে ছুরি দিয়ে কেটে আদ্ধেক ডিম খাই।
সবার সবদিন সমান যায় না। বাবা সৎ অফিসার ছিলেন বলে চাকরি ফিরে পাবার পরও যে খুব প্রাচুর্যে দিন কাটিয়েছি তা না। কিন্তু অসচ্ছলতা দূর হয়েছিল। আর বাবা রিটারয়ার করার পর চিত্র আরো পালটে গেলো। ভালো ভালো কোম্পানি থেকে অফার পেলেন। মোটা মাইনের চাকরি করেন এখন। বড় ভাই কামাই করেন। আমি যা কামাই করি তাতে আমার ভালই চলে যায়। সুন্দর ছিমছাম চলছে সব। আগের মত সুঁইসুতো নিয়ে ঘনঘন বসা লাগেনা আর...