‘’অপ্রাসঙ্গিক বলে অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করে আমরা এড়িয়ে যাই । আবার প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও আমাদের মগজে বা গরজে ধরেই না । আমরা পরশ্রীকাতর, উদাসীন এবং অহংকারী । নিজের শক্তি সামর্থ্য দিয়ে অন্যের সামর্থ্য মাপার চেষ্টা করি । কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছিলেন;
‘’আমরা সবাই পাপী;
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে
অন্যের পাপ মাপি ! ‘’
আমি অবশ্য পাপ মাপার কথা বলছিনে, বলছি সামর্থ্য মাপার কথা । আমাদের মাঝে এমন লোকের অভাব নেই যারা নিজের পকেটের অবস্থা দিয়ে অন্যের অবস্থা বিবেচনা করি । কারো কাছ থেকে দুচার হাজার টাকা ধার করে ফেরত দিতে ভুলে যাই বা দিতে গড়িমসি করি । লজ্জা ফেলে পাওনাদার যদি সেই টাকা চেয়ে ফেলে, তাইলে ভাবি ব্যাটা ছোট লোক! এই কটা টাকার জন্য ধর্না দিচ্ছে ! অথচ আমরা বুঝতে চাই না যে, এই অল্প কটা টাকায় এই দুর্মূল্যের বাজারে এখনো কারো কারো সংসার চলে, চালাতে হয় । অবশ্য হাজার কোটি টাকাও যার কাছে মামুলি মনে হয় সেও মরে মাটি হয় আবার পথের ভিখেরি যে দশ টাকা দান পেলে অনেক মনে করে সেও মরে মাটি হয় । একজন দিন মজুরের কাজ করে ভালো খেতে পারে অথচ একজন চাকুরে কেন সেটা পারে না তা ঐ মুজুর লোকটির মগজে ধরে না।যদিও সব দিন মজুরের মুজুরি এক নয় আবার সব চাকুরের মাইনেও সমান নয় ।
এক গ্রামে মসজিদে পাঞ্জেগানা নামাজ পড়ানোর জন্য একজন ইমাম রাখা হোল । সাব্যস্ত হোল, সমাজের প্রতিটা ঘরে ধারাবাহিক ভাবে ইমাম সাব মাসে একদিন করে খাবেন । সামর্থ্য অনুযায়ী সকলে ইমামের বেতনের জন্য মাসিক চাঁদাও দেবেন । সেখান থেকে ইমামের বেতন হিসেবে মাসে ছয় হাজার করে দেওয়া হবে, বাড়তি টাকা ফান্ডে জমা থাকবে । কেউ পঞ্চাশ, কেউ একশ, কেউ পাঁচশ আবার কেউ বা হাজার টাকা করে দিতে লাগলো । অল্প কয়েক ঘর লোকের মধ্যেও কিছু লোক খাবার ও টাকা দুটোই দিতে অপারগ । যারা দিচ্ছিলো দুয়েক মাস পরে তাদেরও ভীমরতি ধরলো, অনেক বার বলে কয়ে টাকা আদায় করতে হয় তাদের কাজ থেকে । যারা খাবার দিচ্ছিলো তাদের মধ্যে পাঁচ ঘর থেকে যা খাবার আসতো তা নাকি মুখে দেবার যোগ্য না । জনৈক মুরুব্বি তা প্রতক্ষ করে ঐ পাঁচ ঘরের খাবার নিষিদ্ধ করেছেন । কেন বাপু? টাকা যখন সবাই সমান অঙ্কের দিতে পারে না খাবারও তো সমান মানের হবার কথা নয় । আপনি ভাবছেন, মাসে একদিন খাওয়াবে, সে খাবারের মান খারাপ হবে কেন? আরে বাপু, আপনি না হয় সপ্তাহে তিন দিন মাংস খান, খবর নিয়ে দেখেন ও বেচারা হয়তো শুধু ঈদ উপলক্ষে মাংস খায় । দয়া করে আপনার গোলার ধান দিয়ে অন্যের কোলার ধান মাপতে যাবেন না ।
আমার এক সহকর্মীকে (শ্রমিক) যদি জিজ্ঞেস করা হতো, আজ দুপুরের ভাত কি দিয়ে? তার হাসি মাখা জবাব, খাসির মাংস । প্রতিদিনই সে খাসির মাংস দিয়ে মধ্যান্ন ভোজ সম্পন্ন করে । একদিন তার সম পদের একজন জোর করে তার খাবারের বাটি খুলে ফেলল সত্যি সত্যি কি আছে দেখবে বলে। দেখলো, একটু সবজি আর একটু আলু ভর্তা সাথে কাঁচা লঙ্কা । সহকর্মী জিজ্ঞেস করলো, কিরে তোর খাসির মাংস কই? সে হাসি মাখা জবাব দিলো, বউ আজকে খাসি রান্না করে সারতে পারেনি ! তার মত শ্রমিকের পক্ষে রোজ রোজ তো দূরে থাক বছরে একদিনও খাসির মাংস কিনে খাওয়া অসম্ভব । আমরা সামর্থ্যবানরা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যের সামর্থ্যকে কটাক্ষ করি, বিদ্রূপ করি । কিন্তু, সে তার নিজের সামর্থ্যকে ব্যঙ্গ করে পরোক্ষ ভাবে সামর্থ্যবানদেরই কি ব্যঙ্গ করেনি?
আরও একটি কাল উপযোগী অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা হওয়া দরকার । এখন রমজান মাস চলছে । মুসলমানদের সংযম আর আত্মশুদ্ধির মাস । রাত দুটো বাজতে না বাজতে পাড়া মহল্লার প্রতিটি মসজিদের মাইকে মাইকে ডাকা ডাকি শুরু হয়ে যায় । একবার দুবার নয় বহুবার ! কেউ সুরা কেরাত বলে, কেউ ওয়াজ নসিহত করে, কেউ গজল গায়, আবার কেউ গজল বা ওয়াজের রেকর্ড বাজিয়ে কান ঝালাপালা করে দেয় । এতে করে অন্য ধর্মের যারা আছে তারা যে কি ভাষায় গালি গালাজ করে তা তারাই ভালো জানে । মুসলমান পরহেজগার লোকজন যে একটু শান্তিতে তাহাজ্জুতের নামাজ পড়বে তারও উপায় নেই । গত রাতের কথাই ধরুন, এক মসজিদের মাইকে বাজছে, মা ওগো মা……… আরেক মসজিদের মাইকে বাজছে ভাই বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী…… ইবাদতে মশগুল হবার উপায় আছে ?
উমর (রা.)-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদে-নববীতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করে, এতে পাশেই হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাজে ব্যাঘাত হতো, তাই তিনি উমর (রা.)-কে বিষয়টি অবহিত করলে উমর (রা.) ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে উমর (রা.) এসে তাকে শাস্তি দেন।’ (আখবারু মাদিনা : ১/১৫)
ইদানিং রুচি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ সরব । তাই আমাদের রুচি আর রুচি বোধ নিয়ে কটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না । কালের পরিক্রমায় আমাদের রুচিতে বেশ পরিবর্তন হয়েছে । পাড়ায় মহল্লায় নানা উপলক্ষে বিনা উপলক্ষে বিকট শব্দে সাউন্ড বক্সে ডিজে মিউজিক বাজানো পরিবর্তিত রুচি বোধের একটি উদাহরণ । একদিন এশার ওয়াক্তে সবে মাত্র জামাতে ফরজ নামাজ শেষ হয়েছে পাশের গ্রাম থেকে শুরু হোল বিকট শব্দে মিউজিক বাজানো । ভাবলাম, পাশের গ্রামে তো মুসলিম ব্যাতিত অন্য ধর্মের কোন মানুষ নাই তাহলে এহেন কর্ম কাদের হতে পারে ? সে হিসেবে তো তাহলে গ্রামের হিন্দুরাই ভালো আছে । এরা বিভিন্ন পূজা পার্বণে গান বাজনা বাজালেও অন্তত মুসলমানদের ইবাদতের সময় বন্ধ রাখে ।
রমজান এলে আমাদের রুচি বহুগুণে বেড়ে যায় । যদিও ধনি নির্ধন ভেদে রুচির ভিন্নতা রয়েছে । নির্ধনের রুচি বৃদ্ধি হলেও উপার্জনের স্বল্পতা দরুন অল্পতেই তুষ্ট থাকতে হয় । গত রমজানের কোন এক বিকেলে দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সাথে হঠাৎ দেখায় জোর করেই তার বাসায় নিয়ে যায় । ইফাতারিতে বাহারি রকমের নানা পদ, বাজারে পাওয়া যায় এমন কোন ফলেরই বুঝি কমতি নাই । যেন তেন উপার্জনের টাকায় এলার্জি আছে জেনেই গৃহকর্তা ইফতার সাজাতে সাজাতেই বললো, নামাজ কালাম পড়ছি, রোজা রাখছি ! সব বাদ দিয়ে দিয়েছি, আর কত! বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়েই দিব্যি চলে যায় । ভাবলাম বাড়ি ভাড়ার টাকা হালালই বটে ! সংকোচ ভেতরে রেখেই ইফতার সারলাম ।
অনেকে বাহারি ইফতার আইটেম সামনে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি পোস্ট করে, তাদের রুচির জানান দিতে । রোজা রেখেছিল কিনা বলা মুশকিল । তবে এমন বাহারি আইটেম দিয়ে ইফতার সেরে বহু মানুষকে আমি নামাজে দাঁড়াতে দেখিনি । যাই হোক আমাদের রুচি বোধ আর মূল্যবোধ যেন মানবিক হয়, অন্যের সমস্যার কারন না হয়, এতটুকু আবদার এই অধমের কাম্য ।‘’
রুদ্র আতিক, সিরাজগঞ্জ
১৭ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
পুনশ্চঃ ছবি http://www.banglawave.com See less
Comments
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৩ রাত ২:৩১