অফিস থেকে ফিরেই শার্টটা খুলে ফ্যানের নিচে বসে হাঁপাতে লাগলাম। একদম ঘামিয়ে গেছি। বাইরে কি বিচ্ছিরি রোদ,একটা দিনও ছাতা নিতে মনে থাকে না, ধুর!!
আমি চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে বসে আছি, হঠাৎ শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখি মিতু আমার সামনের টেবিলে একগ্লাস পানি রেখে চলে যাচ্ছে। তার শাড়ির আচল কোমরে গোঁজা। কপালে ঘাম। রান্না ঘরে ছিলো বোঝা যাচ্ছে।
"রান্না শেষ হয় নি?" আমি পেছন থেকে ডাকলাম, কন্ঠে অনিচ্ছাকৃত ঝাঁঝ
মেয়েটা পেছনে ফিরেীকটু লজ্জিত ভংগিতে বললো "এই তো প্রায় শেষ ... একটু বসো, আমি এখুনি দিচ্ছি"
স্কাল থেকে অফিসের কাজের চাপ,বাইরের গরম,পেটের ক্ষুধা সব মিলিয়ে মেজাজটা এত গরম হয়েছিলো যে হঠাৎ চিড়িক করে মাথায় রাগ উঠে গেলো, মুখ বাঁকিয়ে বললাম "আমি সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সারা দুনিয়ার ঝামেলা ভেংগে আসলাম আর আপনি দুইটা পদ রান্না করতে পারলেন না? কি করেছেন বসে বসে? খালি টিভি দেখা, না?"
মেয়েটা আহত গলায় বলার চেষ্টা করলো "চুলায়গ্যাসের প্রেশার ছিলো না তো..."
আমার হঠাৎ বিতৃষ্ণা লাগতে থাকে, আমি তাকে থামিয়ে দিলাম "ইউ নো হোয়াট? আমি কিছু শুনতেও চাই না। যাও, ধীরে সুস্থে রান্না করো। যাস্ট মরে যাবার আগেই পারলে ডাক দিও, ওকে?" আমি তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে টিভির রিমোটের দিকে হাত বাড়ালাম। টাইম তো পাস করতে হবে!! মেয়েটা ধীর পায়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো। আমার মেজাজ অকারণেই চড়তে লাগলো তার এই কষ্ট পাওয়াটুকু দেখে।
বাবা মা দেখে শুনে আমাদের বিয়ে দিয়েছেন সেইটা সমস্যা না। বিয়ের আগেই প্রেম ভালো বাসা না থাকলেও বিয়ের পরে নাকি সব ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা হলো আমি মেয়েটাকে কিছুতেই ভালোবাসতে পারছিনা। একসাথে থাকছি, একই বিছানায় ঘুমুচ্ছি, দিন গুলো পার হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা আহামরি সুন্দর নয়, কিন্তু কমনীয়তা আছে। বাংলায় অনার্স করা সংসারী টাইপের মেয়ে। নরম স্বভাবের। অপছন্দ করার কোন কারণ নেই। তাও আমি কেন জানি মেয়েটার সাথে কানেক্ট করতে পারছি না। সম্ভবত আমি আরো উচ্ছ্বল, ফানি সেন্স অফ হিউমার ওয়ালা কাউকে চাইছিলাম মনে মনে। যার সাথে আমি মুভি, সিরিয়াল, ফেসবুক ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে পারবো। যে আমার ফান গুলা ধরতে পারবে। উলটা এই মেয়েটা একদমই চাপা স্বভাবের। আমার সাথে কোন কিছুতেই তার পছন্দ মিলেনা। মনে হচ্ছে বাকিটা জীবন এরকম বিরক্ত হয়েই কাটিয়ে দিতে হবে।
টিভির দিকে তাকিয়ে থেকেই ক্লান্তিতে চোখ লেগে এসেছিলো, মিতুর ডাক শুনে ঘুম ঘুম ভাব চটকে, "খেতে আসো, খাবার দিয়েছি"
আমি বহু কষ্টে সোফা থেকে উঠে ডাইনিং এ গেলাম। খিদা নষ্ট হয়ে গেছে। বিরক্ত লাগছে। কিন্তু টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। পদ দুইটা না না। পদের সংখ্যা আরো বেশি। আমি চরম বিরক্ত গলায় বসতে বসতে বললাম "এত আয়োজন করতে কে বলেছে?"
সে আমার প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে বললো "আম্মা কাল রাতে ফোনে কথায় কথায় বললেন তোমার নাকি গরুর কালো ভুনা খুব পছন্দ। আর বেগুন দিয়ে চিংড়ি। তাই উনার থেকে রেসিপি নিয়ে ট্রাই করলাম একটু"
আমার গলা একটু নরম হয়ে আসে, আমি লাউয়ের বাটির দিকে দেখিয়ে বললাম "এটা কার জন্য? আম্মু বলেনি আমার লাউ পছন্দ না?"
সে একটু থেমে নিচু গলায় বললো "আসলে আমার গরুর মাংস, বেগুন, চিংড়ি সব কিছুতেই প্রচন্ড এলার্জি আছে। ওষুধ খেয়েও কাজ হয় না। তাই আমার জন্য লাউ"
মেয়েটার কিছুটা লজ্জিত কিছুটা অপ্রস্তুত চেহারাটার দিকে আমার ভেতরে কি জানি নেড়ে চেড়ে গেলো। বেচাড়ি এই কিচেনের গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজে খেতে পারবে না এরকম জিনিস গুলো রান্না করেছে আমার জন্য। আর আমি রান্না করতে দেরি হওয়ায় কি না কি বলেছি এতক্ষণ ধরে!! আমি মাংসের, চিংড়ির বাটি সরিয়ে লাউয়ের বাটিটা নিজের দিকে টেনে নিলাম। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লাউয়ের তরকারি ভাত মাখিয়ে এক লোকমা তার মুখের কাছে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বললাম "যে রেঁধেছে সেই আগে খাবে, হা করো"
মেয়েটা খুবই লজ্জিত ভংগিতে অল্প অল্প করে খাচ্ছে আমার হাত থেকে। চাপা স্বভাবের মেয়েটার বিস্ময়ে ভরা চোখ দুটো ভর্তি পানি। মুছতেও পারছে না। হঠাৎ আমি টের পেলাম এই যে চোখে পানি, এই মুখে তুলে খাইয়ে দেয়াটা, এই যে লাজুক কান্না মাখা হাসি- এগুলোই তো ভালোবাসা। অযথাই ভালোবাসার সংজ্ঞা খুঁজে মরি আমরা।।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:০০