somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লাশ নম্বর ছয়

১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকক্ষণ ধরেই এই অন্ধকার ঘরটাতে শুয়ে আছি। অনেক চেষ্টা করে ও উঠতে পারছি না। অনেকক্ষণ আগে সাদা ড্রেস পড়া কয়েকজন আন্টিকে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছিলাম। এখন তাদের ও দেখতে পাচ্ছি না। আমার খুব ভয় করছে। খুব চেষ্টা করছি আম্মুকে ডাকার, কিন্তু মুখ থেকে কোন শব্দ ও বের হচ্ছে না। শরীরটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। অন্ধকারে কিছু দেখতে ও পাচ্ছি না। শুধু শরীরের সাথে সাদা কাগজে "ছয় নং" লেখাটা পড়তে পারছি।


আমার নাম পূর্ণতা রহমান। আব্বুর মতে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আমি এ পৃথিবীতে আসার মধ্য দিয়ে নাকি আব্বু আম্মুর ভালবাসা পুর্ণতা লাভ করেছে। এজন্য আব্বু আমার নাম রেখেছিল পূর্ণতা। তবে বাসার ভেতর আব্বু আম্মু আমাকে আদর করে রুপুমণি বলে ডাকে। আমি ছোট থেকেই অনেক অভিমানী আর চঞ্চল। সারাদিন হৈ হৈ রৈ রৈ করে বাসা মাতিয়ে রাখতাম। এজন্য অবশ্য আম্মু পিট্টি দিত। তবে আমি ও কম না। আব্বু আসলে আব্বুকে বিচার দিতাম। আব্বু তখন আম্মুকে বকা দিত। আম্মু তখন কিছু বলত না। খালি হাসত আর আমাকে কোলে তুলে নিত।





ভাত খেতে আমার একদম ভাল লাগত না। খাবারের মধ্যে আমার প্রিয় ছিল মিমি চকলেট আর আইসক্রীম। কিন্তু ভাত না খেলে আম্মু এগুলো খেতে দিত না। তাই বহু কষ্টে ভাত খেতাম। আম্মু আদর করে খাইয়ে দিত। আর আব্বু পাশে বসে থাকত। খাওয়ার পরে আব্বু বলত, "রুপুমণি এবার চোখ বন্ধ কর।" আমি চোখ বন্ধ করে আবার খুলতাম। দেখতাম সামনে হরেক রকমের চকলেট। আমি আহ্লাদে বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়তাম। আর নামতে চাইতাম না।


মা আদর করে সবসময় বলত, "আমার রুপুমণি'ই তো একটা পুতুল।" এ আদরটুকু আমি বুঝতাম। আর তাই আমিও তখন আবদার করে বসতাম আমাকে পুতুল কিনে দেওয়ার জন্য। এভাবে আমার অনেকগুলো পুতুল হয়ে গেছে। পুতুল খেলতে আমার অনেক ভাল লাগত। আমার হাতে তাই সব সময় একটা পুতুল থাকত।


এ মাসে আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। ডাক্তার হওয়ার জন্য স্কুলে যাওয়া লাগে। আমার পড়াশোনার চেয়ে বেশী আকিঝুকি করতে ভাল লাগে। ক্লাসের নতুন খাতাটা উলটা পালটা একে একদিনেই শেষ করে ফেললাম। এরপরে অবশ্য একটু ভয় পেয়েছিলাম বাবা বকবে নাকি। কিন্তু বাবা দেখি খাতা খুলে অনেকগুলো ছবির মানুষের ছবিটা বের করে হাসতে লাগল। আর বলল, "আমার মেয়ে এখনই ডাক্তারি শুরু করে দিয়েছে।" পুরষ্কারস্বরুপ পরের দিন আবার নতুন খাতা পেলাম একটা।


তবে এই খাতাটা শেষ করতে পারলাম না। এর আগেই আমার জীবনের খাতাটা শেষ হয়ে গেল। স্কুল থেকে আসছিলাম ঐদিন। আম্মু ছিল না, বুয়ার সাথে আসছিলাম তাই। হঠাৎ বুয়া রিকশা থামিয়ে হেটে যেতে চাইল। আমি বুঝি নি, একটু দূর যেতেই হঠাৎ কে যেন আমার মুখে কালো কাপড় বেধে দিল। এরপরে আর কিছু বলার নেই। শেষ নিঃশ্বাসটা নেওয়ার আগে শুধু এতটুকুই মনে আছে ওরা আমার শরীরে কিছু খুজছিল। কি খুজছিল আমি জানি না, কেনই বা এমন করছিল তাও জানি না। শুধু একটা অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করছিলাম সারা শরীরে আর সেই সাথে একটা ঘৃণা সমগ্র মানবজাতির প্রতি।


এরপরে কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে এখানে আবিষ্কার করলাম, আশে আশে কয়েকজন বলাবলি করছে দেখলাম ধর্ষণে মৃত। ধর্ষণ কি আমি অবশ্য জানি না। পেপারে শব্দটা অনেক কষ্টে পড়ে একবার আম্মুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আম্মু বলেছিল, "ওগুলো বড়দের কথা মা, বড় হলে বুঝবে এসব।" কিন্তু বড় হওয়ার আগেই বুঝে গেলাম, আর বুঝতে গিয়েই আজ বাবা মায়ের আদরের পূর্ণতা থেকে শুন্যতার রাজ্যের লাশ নম্বর ৬ হলাম।




শেষ কথা

পোষ্টমর্টেম রিপোর্টঃ "ধর্ষণের পরে শ্বাসরোধ করে হত্যা।" হাত থেকে রিপোর্টটা নামিয়ে সামনে সামনে তাকাল ডঃ রোজিনা।

সাফওয়ান সাহেব'কে ধরে অঝোরে কাঁদছে অরণী। পাগলের মত বলছে, "আমার পূর্ণতা'কে এনে দাও। আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাই না। আমার রুপুমণিকে আমার কোলে ফিরিয়ে দাও।" সাফওয়ান সাহেব পাথরের মত বসে আছে। কি বলবে?


আশেপাশে কিছু নিউজ পেপারের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট আর মানবাধিকার কর্মীদের জ্বালাময়ী ভাষণের ভিড় ঠেলে ডঃ রোজিনা আস্তে আস্তে হাসপাতালের করিডোরে হাটছেন। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এরকম ঘটনা নিয়মিত দেখা কিংবা নিয়মিত এই একই সাংবাদিক আর মানবাধিকার কর্মীদের কমন কথাগুলো শোনা রীতিমত অভ্যাস হয়ে গিয়েছে এখন। এই ত্রিশ বছরের ডাক্তারি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে খুব ভাল করেই জানে্ন দুই একদিন পরে সব আবার আগের মতই হয়ে যাবে।


এক প্রকার বিদ্বেষ নিয়েই করিডোরের পাশের জানালাটা খুললেন তিনি। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ অবাক হয়ে যান। বাইরে হাজারো মানুষ, বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন শ্রেণীর হাজারো মানুষ। তাদের হাতের প্ল্যাকার্ড দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না তারা কেন এখানে এসেছে। এরা কোন পেপারের বেতনভুক নিউজ রিপোর্টার না, এরা কারো ছাপোষা মানবাধিকারকর্মী না, এরা কোন রাজনৈতিক ভোট আকাংক্ষী নেতাও না। এরা স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রী, কোন অফিসের খেটে খাওয়া চাকুরিজীবি সাধারণ মানুষ সহ আপামর জনতা। হঠাৎ করে ভিতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করলেন তিনি, কারণ তিনি জানেন এই মানুষগুলোর ক্ষমতা। এরা এক হয়ে চল্লিশ বছর আগে দেশকে স্বাধীন করেছিল, এরা এক হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছিল, এরা এক হয়ে দেশ থেকে স্বৈরাচার দূর করেছিল। এরা বাংলাদেশের মানুষ। এরা এক হলে সূর্যকে ও পৃথিবীর চারদিকে ঘুরাতে পারে।


ডঃ রোজিনা এতদিনে নিজের ভেতরে একটা বিশ্বাস অনুভব করলেন। নিজের অজান্তেই আস্তে করে নিচে নেমে সবার মাঝে হাটতে লাগলেন। সাদা গাউন খুলে মিশে গেলেন জনতার স্রোতে। দৃঢ় বিশ্বাস আর পূর্ণ চেতনা নিয়ে সবার সাথে এক সুরে বলতে লাগলেন


আর সইব না কোনো অন্যায় আর অত্যাচার
এড়িয়ে যাব না দূর্ণীতি আর মিথ্যাচার
এক হয়ে লড়ি চল রীতিটাকে বদলাই
আর নয় ধর্ষন, এবার চলো পাল্টাই






খবরঃ
http://www.prothom-alo.com/detail/news/321202
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-01-14/news/321355



লেখকের অভিমত

ছোটবেলায় মানুষের স্বপ্নের আকাশটা অনেক বড় থাকে। বয়সের সাথে সাথে এ আকাশের সীমা কমতে থাকে। এর অনেক বড় কারণ বাস্তবতার থাবা। এই নিষ্ঠুর কালিমায় ভরা বাস্তবতায় আমরা তাই প্রায়ই ছুটে যেতে চাই শৈশবে। কিন্তু পারি না। তাই অনেক বড় একটা আক্ষেপ কাজ করে নিজের মধ্যে।


তবে পরের প্রজন্ম মনে হয় এই আক্ষেপ থেকে মুক্তি পাবে। কারণ সমাজে কীট পতঙ্গের মত বাস করা কিছু মানুষরুপী পশুর হিংস্র থাবা শিশুদের ও মুক্তি দিচ্ছে না। আর তারই ফলশ্রুতিতে শিশু পাচার কিংবা শিশু নির্যাতনের পরে এবার যুক্ত হয়েছে শিশু ধর্ষণের মত ন্যাক্কারজনক অপরাধ। আর তাই নিষ্পাপ শৈশবের বদলে অভিশপ্ত জীবনের ছোয়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু শিশুর জীবন। একটা চার পাঁচ বছর বয়সী শিশু ধর্ষণের কি বুঝে এটাই জানি না, সেখানে তারা ও এর শিকার হয়। ভাবতেই কষ্টে চোখের কোণে নোনা জল আবিষ্কার করি। কিন্তু আর কত?


ক্ষমতাশালীদের অনেক আশা প্রত্যাশা কিংবা ওয়াদা কখনোই এসব অন্যায়কে থামাতে পারে নি। আরো ভালভাবে বললে বলা যায় থামাতে চায় নি। আর তাই এবার সময় হয়েছে আপামর জনতার এক হয়ে জেগে ওঠার। আবার সময় হয়েছে নতুন এক যুদ্ধের ডাক দেওয়ার। তাই আসুন সবাই এক হয়ে রুখে দাঁড়াই ধর্ষণের বিরুদ্ধে। হয়ত আমাদের প্রচেষ্টাই বহু নারী কিংবা শিশুর একটি সুন্দর জীবন নিশ্চিত করবে।


পূর্বপ্রকাশিতঃ লাশ নম্বর ছয়
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×