somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইতিহাসের পাঠশালায়: ৯ম অধ্যায়: খুলে যাওয়া প্যানডোরার বাক্স ও যিসাস

০৩ রা মে, ২০১৬ রাত ১০:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একজন মানুষ কি কখনও হাজার বছরের সভ্যতার চেয়েও দামী হয়ে উঠতে পারেন? রোমান প্রজানন্ত্রের পতনের পরপরই নবি যিসাসের আবির্ভাব এবং তার পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যজুড়ে খিস্ট্রধর্মের উত্থান আমাদের মনে এ প্রশ্নটিকেই জাগিয়ে তোলে। রোমান সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসে আমরা দেখি কী লাগামহীন নিষ্ঠুরতা আর ভয়াবহ নৃশংসতার ছড়াছড়ি! সমাজের একদিকে অবিশ্বাস্য বিপুলতায় উপছে পড়ছে ঐশ্বর্য্য আর অন্যদিকে অবিশ্বাস্য হাহাকারে তলিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার সমস্ত গৌরব!

সমাজের বেশিরভাগ মানুষ বড় লোকদের প্রবাদ প্রতীম বিলাসীতার শিকার; বড়লোকদের বিকারগ্রস্থ বিনোদনের জন্য নিষ্ঠুর এরেনার ভেতরে অগণিত গ্লাডিয়েটরের করুণ মৃত্যু! এসবই হল সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়জুড়ে টিকে থাকা সভ্যতা রোমান সভ্যতার আসল চেহারা। এ রোমান সভ্যতার নিষ্ঠুর ইতিহাসে যিনি কিছুটা করুণা ও ভালবাসার ছোয়া লাগিয়েছেন তিনি হলেন নবি যিসাস। তাই যিসাস হয়ে ওঠেন সভ্যতার চেয়েও দামী।

মানুষের দীর্ঘ রক্তাক্ত ও গ্লানিময় ইতিহাস আমাদেরকে এ কথাই মনে করিয়ে দেয় যে সভ্যতার চেয়েও দামী হল দয়া, ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসা; যার প্রকট অভাবে সভ্যতার ইতিহাস হয়ে ওঠে এক চরম দুঃস্বপ্ন! বস্তুত দাস সভ্যতার ইতিহাস নিষ্ঠুর শেকলে বাঁধা ক্রীতদাসের আতঙ্কগ্রস্ত আর্তনাদ ছাড়া কিছুই নয়; একই সাথে তা পরিণত হয় পৌরানিক দেবতাদের অপচ্ছায়ায় ভীত-সন্ত্রস্ত অনন্ত বিলাপধ্বনিতে - যে দেবতাদের অপচ্ছায়া তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছিলো, তাদের আশার আশ্রয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলো, তাদের স্বস্তিকে অস্থির উৎকণ্ঠায় পরিণত করেছিলো এবং তাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিলো। এক্ষেত্রে শিল্প ও জ্ঞানের দেবতা প্রমিথিউসের কাহিনি বেশ বড়ো ভূমিকা পালন করে। প্রমিথিউস ছিলেন মানুষের বন্ধু। দেবরাজ জিউস আগুন সৃষ্টি করেছিলেন মানুষকে পুঁড়িয়ে শাস্তি দেওয়ার জন্য। আর জ্ঞানী ও দয়ালু প্রমিথিউস সেই আগুন চুরি করে এনে তুলে দেন মানুষরই হাতে যাতে মানুষ তাদের প্রয়োজনে আগুনকে কাজে লাগাতে পারে।

মানুষের প্রতি প্রমিথিউসের এ পক্ষপাত ক্রুদ্ধ করে দেবরাজ জিউসকে। প্রমিথিউস শুধু আগুনই চুরি করেননি মানুষের জন্য, তিনি যজ্ঞের উৎসর্গীকৃত পশুর ভাল অংশটাও মানুষের হাতে তুলে দিয়ে দেবতাদের বঞ্চিত করেন। প্রমিথিউস এমন ব্যবস্থা করেন যাতে যজ্ঞের উৎসর্গীকৃত পশুর ভাল অংশটা পায় মানুষ আর দেবতারা পায় খারাপ অংশ। প্রমিথিউস একটা বিরাট ষাড় কেটে ভালো মাংশের অংশগুলো চামড়ায় জড়িয়ে রাখেন। আর এর উপরে ছড়িয়ে দেন নাড়িভুঁড়ি। অন্যদিকে হাড়্গুলিকে এক সাথে জড়ো করে এর উপর সাজিয়ে রাখেন চকচকে চর্বি। এরপর জিউসকে আহবান করেন ভাল অংশটি বেছে নিতে। জিউস বেছে নিলেন চকচকে চর্বিযুক্ত অংশটি। যখন জিউস দেখলেন তাকে ঠকিয়ে তাবৎ হাড়গোড় দেয়া হয়েছে, তিনি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হলেন। কিন্তু দেবকূলের বিধান অনুযায়ী তিনি যা বেছে নিয়েছেন তা-ই নিয়মে পরিণত হয়ে যায়। এরপর থেকে দেবতাদের পূজাবেদীতে শুধু হাড় এবং চর্বি পোড়ানো হয় আর ভাল মাংসগুলো মানুষ নিজেদের জন্য রেখে দিতে পারল।

কিন্তু মানবজাতি এবং দেবতাদের পিতা এ অপমান কীভাবে ভূলে যেতে পারেন? তাই তিনি শপথ করলেন প্রতিশোধ নেবেন, প্রথমে মানবজাতির উপর, পরে মানবজাতির বন্ধু প্রমিথিউসের উপর। এ উদ্দেশ্যে তিনি বানালেন মানবজাতির জন্য চরম অশুভ একটি সত্ত্বা যা কিন্তু মধুর ও দৃষ্টিনন্দন! এর নাম নারী! পূরাণের ভাষ্য অনুযায়ী এর আগে কোন নারী ছিল না। মূলত মানুষকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যেই সর্বনাশা নারীর সৃষ্টি! জিউস প্রথম যে নারীকে সৃষ্টি করলেন তার নাম প্যানডোরা।

তাকে তিনি সৃষ্টি করলেন মধুর ও আকর্ষণীয় লজ্জাবতী কুমারীর আদলে। সমস্ত দেবতারা তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ পোষাক ও অলংকারে বিভূষিত করে তুললেন। তার মুখের চারদিকে ঝালর দেয়া ঘোমটা ও রূপোলী পোশাক দেখে চোখ সরে না। তার গলায় বিশাল ফুলের মালা, মাথায় সোনালী মুকুট। সকল দেবতার উপহারে তাকে সাজানো হয়েছে বলে তার নাম হয়েছে ‘প্যানডোরা’ , যার অর্থ ‘সকলের উপহার’। এই সৌন্দর্যময়ী মূর্তিকে বানানোর পর জিউস তাকে বাইরে আনলেন। সমস্ত দেবকূল, মানবকূল তাঁর সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। প্যানডোরাই প্রথম মানবী। তাঁর কাছ থেকেই এসেছে নারী জাতি, যারা পুরুষের জন্য অশুভ; যাদের প্রকৃতিই হল অমঙ্গল ঘটানো!

প্যানডোরাই মানুষের সকল দুঃখযন্ত্রণার উৎস। তবে যতটা না তাঁর অশুভ প্রকৃতির কারণে তার চেয়ে বেশী তাঁর কৌতুহলের কারণে পৃথিবীতে সমস্ত অশুভ ঘটনার জন্ম হয়েছে। দেবতারা প্যানডোরাকে একটি বাক্স দিয়েছিলেন যার ভেতরে ছিল মানুষের জন্য সমস্ত অশুভ ও ক্ষতিকর জিনিস! তাঁরা তাকে সেটি খুলতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর প্যানডোরাকে জিউসের উপহার হিসেবে পাঠানো হল পৃথিবীতে - প্রমিথিউসের ভাই এপিমিথিউসের কাছে। এপিমিথিউস তাঁর ভাইয়ের মত জ্ঞানী ছিলেন না। ছিলেন এর উল্টো ও প্রবণতাস্বর্বস্ব।
পুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী দেবতারা অতীতে পৃথিবীতে প্রাণী ও মানুষ সৃষ্টির দায়িত্ব দিয়েছিলেন এ দু’ভাইকে।

অস্থিতমস্তিষ্কের এপিমিথিউস মানুষ সৃষ্টির আগে পশু-পাখি সৃষ্টি করে তাদেরকে দান করে ফেলেন সবচেয়ে ভাল জিনিসগুলি; অর্থাৎ- শক্তিমত্তা, দ্রুত দৌড়ানোর ক্ষমতা, চতুর্য, লোম, পাখনা ও শরীর রক্ষার জন্য শক্ত পালক ও খোলস ইত্যাদি।মানুষের জন্য প্রায় কিছুই বাকী থাকল না- শারিরিক ক্ষমতার জন্য কোন শক্ত খোলস, দন্ত-নখর-শিং কিংবা থাবাও নয় অথবা আত্মরক্ষার জন্য কোন ক্ষিপ্রগতিও নয়। তাই তিনি অনুতপ্ত হয়ে তাঁর ভাইয়ের শরণাপন্ন হলেন। প্রমিথিউস তখন হাল ধরলেন মানব সৃষ্টির এবং মানুষকে জীবজগতে প্রাধান্য দেয়ার কৌশল উদ্ভাবন করলেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করলেন সুন্দররূপে, দেবতাদের চেহারায়।

জ্ঞান ও প্রতিভা হল তাদের সবচেয়ে বড়শক্তি। তারপর তিনি গেলেন সূর্যদেবের কাছে। সূর্যের আলোতে একটি মশাল ধরিয়ে পৃথিবীতে নিয়ে এলেন আগুন। সে আগুন তিনি তুলে দিলেন মানুষের হাতে, শিখিয়ে দিলেন এর ব্যবহার; দেখিয়ে দিলেন আগুনের শক্তি কী অবিশ্বাস্য! আগুনের শক্তিতে মানুষ জয় করতে পারল অনেক কিছু। আগুনের শক্তিতে মানুষের শক্তি হল দ্বিগুণ! এভাবে প্রমিথিউস পরিণত হন দেবতাদের মধ্যে মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু ও রক্ষাকর্তায়। প্রমিথিউস ও এপিমিথিউস মানুষ ও জীবকূলকে দেখাশোনার জন্য পৃথিবীতেই অবস্থান করতেন। পৃথিবী চালাতেন তারাই।

মানুষের রক্ষাকর্তা প্রমিথিউস তাঁর ভাইকে জিউসের উপহারের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। তিনি এপিমিথিউসকে বলে দেন জিউসের উপহার প্যানডোরাকে গ্রহণ না করতে। কিন্তু এপিমিথিউস সানন্দে গ্রহণ করে নেন প্যানডোরাকে। গ্রহণ করার বুঝতে পারেন কী ধ্বংসাত্মক জিনিস এই নারী এবং তাঁর ভাইয়ের উপদেশ ছিল কতটা যথার্থ! সকল নারীর মতোই প্যানডোরার ছিল অদম্য কৌতূহল।
নিষিদ্ধ বাক্সের মধ্যে কী আছে তা জানা পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি হচ্ছিল না। তাই একদিন তিনি খুলে ফেললেন বাক্সটার ডালা – সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অগণিত রোগব্যাধি, দুঃখ-কষ্ট এবং মানুষের জন্য যা অনিষ্টকর তার সবকিছু।

ভয় পেয়ে ঢাকনা বন্ধ করে দিলেন প্যানডোরা। কিন্তু ততক্ষণে বেশ দেরী হয়ে গেছে। একটা ভালো জিনিসও অবশ্য বাক্স থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তার নাম আশা; অসংখ্য অশুভ বস্তুর মধ্যে ঐ একটিমাত্রই ছিল ভাল জিনিস। আজ পর্যন্তও মানুষের দুঃখের সমুদ্রে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ঐ আশাই। যাই হোক, এভাবেই জিউস প্রতিশোধ নিলেন মানবজাতির ওপর। এভাবে মরণশীল মানুষ বুঝতে পারে জিউসকে টেক্কা দিয়ে কিংবা তাকে প্রতারিত করে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এরপর জিউস মনোযোগ দিলেন প্রমিথিউসের দিকে।

মানবজাতিকে নারীর মাধ্যমে যথেষ্ট শাস্তি দানের পর জিউস প্রতিশোধ নিলেন প্রমিথিউসের ওপর। জিউস তাঁর দুই ভৃত্য – শক্তি ও সন্ত্রাসের সাহায্যে প্রমিথিউসকে বন্দী করলেন এবং পাঠিয়ে দিলেন ককেশাস - এ। সেখানে এক নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় তাঁকে কঠিন শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা হয়। প্রতিদিন দিনের বেলায় এক ঈগল পাখি এসে প্রমিথিউসের কলজে ও মাংস ঠুকরে ঠুকরে খেত। রাতের বেলা আবার নতুন করে কলজে ও মাংস সৃষ্টি হত। পরের দিন আবার পাখি এসে ঠুকরে ঠুকরে খেত। এভাবে শাস্তি চলতে থাকে। কিন্তু এই নৃশংস নিপীড়ন প্রমিথিউসকে টলাতে পারল না। নিষ্ঠুরতা ও স্বৈরাচারের কাছে তিনি নতি স্বীকার করলেন না। ফলে শৃঙ্খলিত প্রমিথিউসকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যান জিউসের দূত হার্মিস।

এই কল্পকাহিনি পুরনো ইউরোপীয় সভ্যতার সমস্ত সত্ত্বাজুড়ে জড়িয়ে ছিল। এই কাহিনী মানবতার ওপর শক্তি ও সন্ত্রাসের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং মানবতার উপর শক্তি ও সন্ত্রাসের বিজয়কে উর্ধ্বে তোলে ধরে। এই কাহিনীতে নৃশংস ও উৎপীড়ক দেবতাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষের অসহায় পরাজয়ের কথা বলা হয়েছে। এভাবে সভ্যতার বুকে মানবতার উপর শক্তি ও সন্ত্রাসের বিজয়ের একটি দৈব ভিত্তি রচিত হয়। তাই প্রাচীন সভ্যতার সমস্ত ইতিহাস জুড়ে দেখা যায় মানবতার প্রকট সংকটে সমৃদ্ধ সভ্যতার বুকে জীবন ছিল বিপন্ন ও অসহায়।

মানবতা ও করুণার সংকটে হাজার বছরের সমৃদ্ধ সভ্যতার ইতিহাসও হয়ে ওঠে একঘেয়ে, প্রাণহীন। রোমান সভ্যতাও এর ব্যতিক্রম নয়। রোমান সাম্রাজ্যের মানুষকে যিনি প্রথম মানবতার জয়গান শুনিয়ে ছিলেন তিনি নবি যিসাস। রোমান প্রজাতন্ত্রের বিলুপ্তির পরপরই ফিলিস্তিনের এই অখ্যাত নবির কন্ঠ হতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার সুর। মানুষের প্রতি মানুষের ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার ধারণা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন নবি যিসাস। তাঁর শিক্ষা গ্রহণের আগ পর্যন্ত ইউরোপের সমাজে সকল মানুষের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির কোন ধারণাও ছিল না। সকল মানুষের মধ্যে সাম্য স্থাপনের প্রাথমিক স্তরের ধারণাটি দেন নবি যিসাস। সে সাম্যের ধারণা আজকের মত এতটা ব্যাপক ছিল না। তবুও সেটা যেসময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর ছিল।

আজকের যুগে সাম্য ও মানবতার ধারণা যতটা ব্যাপক ও বিস্তৃত তার তুলনায় যিসাসের সাম্য ও মানবতা অনেকটা অপরিণত মনে হতে পারে। কিন্তু যিসাসের ভূমিকার মূল্যায়ন আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে করা যাবে না। বরং তাঁর সময়কার সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই করতে হবে। আধুনিক যুগের দৃষ্টিতে যিসাসের অবদানকে বড় করে দেখা না হলেও তাঁর সমসাময়িক বা পূর্বতন সভ্য সমাজের চিন্তারীতিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। সেসব সমাজের দর্শন ও চিন্তারীতিকে গুরুত্বের সাথে অধ্যয়নও করা হয়। আধুনিক মতবাদ ও চিন্তাধারায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রাচীন দর্শন ও সমাজ চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। আধুনিক চিন্তাধারায় রোম এবং এথেনসের প্রভাবকে অস্বীকার করা যাবে না। আধুনিক ইউরোপের উন্বেষের বেলায় খিষ্ট্রধর্ম, ইসলাম এবং মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনার স্থলে প্রাচীন চিন্তার পুনর্জাগরণের কারণ হয়ত প্রাচীন চিন্তাধারায় খুঁজৈ পাওয়া গিয়েছিল বিকশিত ও গতিশীল সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের প্রতিফলন।

মধ্যযুগের কম গতিশীল জীবন আধুনিক সভ্যতার ক্ষেত্রে খুব বড় প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে নি। মধ্যযুগের বিশাল আরব সভ্যতা খ্রিস্টান ইউরোপকে প্রভাবিত করেনি। তাই ইউরোপে রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে যখন আধুনিক যুগের যাত্রা শুরু হয় তখন সেখানে ইসলামী সভ্যতা কোন প্রভাব রাখে নি। সেখানে খ্রিস্টধর্মেরও তেমন কোন প্রভাব ছিল না। বরং ইউরোপে আধুনিক সভ্যতার সূচনা হয়েছে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সেই আগের গ্রিকো রোমান আমলের চিন্তা চেতনার পুনর্জাগরণের মধ্য দিয়ে। এর নামই রেনেসাঁ। চিরায়ত খ্রিস্টধর্মীয় প্রভাব ও মধ্যযুগকে উপেক্ষা করাই যেন রেনেসাঁর ধর্ম। তাই আধুনিক মতাদর্শে যিসাস উপেক্ষিত। ঐতিহাসিক পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে যিসাস ও প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টধর্মের সাথে মধ্যযুগের যাজকতন্ত্রী খ্রিস্টধর্মের ব্যবধান অনেক। তাই মধ্যযুগীয় খ্রিস্টধর্মের জরাগ্রস্থতার জন্য যিসাস নন, বরং সেসময়ের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিই দায়ী।

মধ্যযুগের ইউরোপীয় সমাজের খ্রিস্টধর্ম আর রোমান প্রজাতন্ত্রের পতনের পর রোমান সাম্রাজ্যের সূচনালগ্নে আবির্ভূত খ্রিস্টধর্মের সামাজিক পটভূমি ও ভূমিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তাই মধ্যযুগীয় খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে অনেক কুৎসিত অধ্যায় যুক্ত হলেও যিসাস ও প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে এটি অকল্পনীয়। যিসাসের সময়কার প্রাচীন পৃথিবী আর মধ্যযুগের পৃথিবী দুটি আলাদা পৃথিবী। তাই যিসাসকে দেখতে হবে তাঁর পৃথিবী থেকেই। সে পৃথিবীতে তার অবদানের গভীরতা অনুধাবন করতে হলে সেসময়ের সভ্যতার সংকটকে বুঝতে হবে। সেসব সভ্যতার শিল্প ও ধনের ঐশ্বর্যের সাথে যিসাসের মানবিক ঐশ্বর্য্যের তুলনা হতে পারে। যিসাসের সময় পর্যন্ত ইউরোপীয় সমাজ সভ্যতায় অনেক এগিয়ে থাকলেও তা সকল মানুষের জন্য মোটেও আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারে নি। প্রাচীন গ্রিকো রোমান সভ্যতায় অনেকদূর বিকাশিত ও গতিশীল জীবন ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও তাতে মানবিক সংকট ও শূন্যতা ছিল চরম মাত্রায়।

সমাজের অধিকাংশ মানুষকেই সেসব সভ্যতায় মানুষের মর্যাদা দেওয়া হত না। সমাজের ঐশ্বর্য্যের মূলে ছিল ক্রীতদাসেরা। কিন্তু বনের পশুর সাথে ক্রীতদাসের কোন পার্থক্য আছে বলে কেউ মনে করত না। এছাড়াও অধিকাংশ মুক্ত মানুষ যথা প্রলেতারিয়ান, ক্ষুদ্র কৃষক বা প্রজাদেরও মানুষের মত বেঁচে থাকার সুযোগ ছিল না। কিন্তু সেই সমাজ ব্যবস্থা মুষ্টিমেয় দাস মালিক, ভূমি মালিক বা অভিজাতদেরকে অধিষ্ঠিত করেছিল দেবতার মর্যাদায়। তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল ঈশ্বরের অধিকার। সমাজ ব্যবস্থা কিছু লোককে বানিয়েছিল অবিশ্বাস্য ঐশ্বর্য্যের মালিক আর বাকি সবাইকে করেছিল নিঃস্ব; বানিয়েছিল বড়লোকদের ক্রীতদাস। সমাজের অধিকাংশ মানুষ পরিণত হয়েছিল মনুষ্যেতর জীবে।

বড়লোকেরা ভাবত ক্রীতদাসের সাথে লাঙ্গলে তফাৎ হল ক্রীতদাস সচল যন্ত্র আর লাঙ্গল অচল যন্ত্র। লাঙ্গল চলাফেরা করতে পারে না আর ক্রীতদাস চলতে পারে; কিন্তু দুটোই যন্ত্রমাত্র। সে সমাজের বড় বড় পন্ডিতেরাও এসব কথায় বিশ্বাস করতেন। সে যুগের বড় বড় দার্শনিকরাও সকল মানুষকে মানুষ ভাবতে পারেননি। সক্রেটিস, প্লেটো বা এরিস্টটলের মত দার্শনিকরাও দাস ব্যবস্থাকে অপরিহার্য মনে করতেন। এরিস্টটল বলতেন দাস ব্যবস্থা প্রকৃতিরই নিয়ম। তিনি দাসদেরকে উৎপাদনের সজীব যন্ত্র মনে করতেন। তাঁর মতে উৎপাদনের যন্ত্র দু’ধরনের; কতগুলি যন্ত্র জড়, যেমন- হাতুড়ি, কাস্তে ইত্যাদি, আর কতগুলি যন্ত্র সজীব, যেমন- দাস।

এরিস্টটলের গুরু ছিলেন প্লেটো। তিনি বলতেন যদি উচ্চ চিন্তা করতে হয় তবে অবসর একান্ত অবশ্যক। অর্থাৎ সমাজে একশ্রেণির লোক থাকবে যাদের উচ্চচিন্তার জন্য অন্যরা তাদের কাজ করে দেবে। এরিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডার ছিলেন তখনকার পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয়ী সম্রাট। মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন সে যুগের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিক্ষাকেন্দ্র ও পাঠাগার। এ শিক্ষাকেন্দ্রের মাধ্যমেই গ্রিক বিজ্ঞান ও দর্শন সংরক্ষিত হয়ে মুসলিম দার্শনিকদের হাত ধরে আজকের যুগ পর্যন্ত এসে পৌছেছে।

গ্রিকো রোমান সভ্যতা বহুমাত্রিক সামাজিক উপাদানে সমৃদ্ধ ও উচ্চমাত্রায় বিকাশিত হলেও তা মানুষকে মুক্তি দিতে পারে নি। সভ্যতার বাইরের দিকের চাকচিক্য যতই উজ্জ্বল হউক, আন্দরমহলের চিত্র ছিল ভিন্ন। বেশির ভাগ মানুষের জীবনে সভ্যতা কোন আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারে নি। দুঃসহ সামাজিক শোষণের জালে শৃঙ্খলিত হয়ে পড়েছিল অধিকাংশ মানুষের জীবন। এ অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তির কোন পথও খোলা ছিল না। বিদ্রোহ বরাবরই হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই তা শেষ হয়েছে ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে। ক্রীতদাসদের বিদ্রোহ, প্রলেতারিয়ানদের শ্রেণিসংগ্রাম আর বণিক ও অভিজাতদের গৃহযুদ্ধ বারবার রোমান সভ্যতার ভিতকে নাড়িয়ে দিলেও তার চুড়ান্ত পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় প্রথমে সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও শেষ পর্যন্ত রোমান প্রজাতন্ত্রের বিলুপ্তি ও সাম্রাজ্যের সূচনা।

খ্রিস্টপূর্ব ২৭ সালে অক্টেভিয়ানকে অগাস্টাস উপাধি প্রদান এবং আজীবন কনসাল হিসেবে বরণের মধ্য দিয়েই মূলত রোমান প্রজাতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। অতীতের টারকুইন রাজাদের অত্যাচারের জন্য রোমানরা রাজা বা সম্রাট শব্দটি পছন্দ করত না। তাই অগাস্টাস সম্রাট হয়েও প্রজাতন্ত্রের ঐহিত্য অনুসারে ‘কনসাল’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। কিন্তু আজীবন কনসাল আর সম্রাটের মধ্যে কোন তফাৎ নেই।
তাই বলা যায় অগাস্টাসের সময়েই পাঁচ শত বছরের পুরনো রোমান প্রজাতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। আর ইতিহাসের এই অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণেই জন্ম হয় নবি যিসাসের। তাঁর জন্ম ১ সালেই নাকি এর আগে-পরে তা ঐতিহাসিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। কারণ সেসময়ের রোমান শাসকদের ধর্ম ছিল আলাদা। তাই যিসাসের জন্ম তাদের কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল না এবং তাদের দলিলপত্রেও এর কোন উল্লেখ নেই। তবে অগাস্টাসের সময়েই যিসাসের জন্ম - এ ব্যাপারে সবাই একমত।

অগাস্টাস ১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর সময়েই এশিয়া, ইউরোপ ও আফিকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা রোমান সাম্রাজ্য গৃহযুদ্ধের সংকট কাটিয়ে আপাতত অখন্ড ও ঐক্যবদ্ধ রূপ ধারণ করেছে। র্দীঘ দিনের রক্তাক্ত সংঘাত ও যুদ্ধ রোমান সাম্রাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবনে কোন পরিবর্তন আনতে পারে নি। বিদ্রোহ, শ্রেণিসংগ্রাম এবং গৃহযুদ্ধের শেষ পরিণতি হয়ে দাড়াল শেষ পর্যন্ত একজন শক্তিশালী সম্রাটের অবির্ভাব। সম্রাটের একনায়কতন্ত্রী শাসনে বাঁধা পড়ল রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিটি জীবন। সম্রাটের এই নিরঃকুশ আধিপত্যের মুখে রাজনৈতিক বিদ্রোহ ও বিল্পবের বিজয়ের কোন আশা ছিল না। সাম্রাজ্যের জনগণের জীবনে পরিবর্তনের সম্ভাবনাও হারিয়ে গিয়েছিল। সম্রাটের একনায়কতন্ত্র আর স্বৈরশাসনের শেকলে আটকে পড়া রোমান প্রজাজীবনে কোন বিকল্প পথেরও সন্ধান ছিল না।

সেই শৃঙ্খলিত প্রজাজীবনে আশা ও আলোর বার্তা নিয়ে অর্বিভূত হলেন নবি যিসাস। প্যানডোরার বাক্স থেকে একমাত্র ভাল যে জিনিসটি বেরিয়ে এসেছিল সেটাই যিসাস ছড়িয়ে দিলেন সর্বত্র – অর্থাৎ গভীর আশাবাদ। সমস্ত তিনি যা বললেন তা তাঁর পূর্বেও সেমেটিক নবিরা প্রচার করে গিয়েছেন। কিন্তু তাদের বেলায় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। তাদের সময়ে ফিলিস্তিন রোমানদের আওতায় ছিল না। রোমানদের আগে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন ছিল সেলুসিড সাম্রাজ্যের অধীনে।

৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সেনানায়ক পম্পেই কর্তৃক সিরিয়া ও ফিলিস্তিন বিজয়ের পর পুরো ফিলিস্তিন কতগুলো রোমান প্রদেশে পরিণত হয়। এগুলো হল গালীল, সামারিয়া, এহুদিয়া প্রভৃতি প্রদেশ। এগুলোর আশপাশে ছিল ইদোম, নাবাটিয়া, পেরিয়া, দিকাপলি, সিরিয়া ইত্যাদি প্রদেশ। যিসাসের জন্ম এহুদিয়া প্রদেশের বেথেলহেম গ্রামে। বেড়ে ওঠেন তিনি তাঁর মায়ের গ্রাম গালীল প্রদেশের নাসরত গ্রামে। লোকে তাকে ডাকত নাসরতের যিসাস বলে। এজন্য তার অনুসারীদের আরেকটি নাম হয়েছে নাসারা।

যিসাসের নামের উচ্চারণের মধ্যেও ভিন্নতা আছে। যিসাসের মাতৃভাষা ছিল আরামীয় ভাষা। আরামীয় এবং হিব্রু ভাষায় তার নামের উচ্চারণ হল ইয়েশুয়া। ইয়েশুয়া শব্দের অর্থ নাযাতদাতা। গ্রিকরা এ শব্দ উচ্চারণ করতে পারত না। তাই গ্রিক ভাষায় শব্দটির উচ্চারণ দাঁড়ায় ‘যিসাস’ পর্তুগীজ ভাষায় এর উচ্চারণ ‘যিশু’। আরবি ভাষায় উচ্চারণ হল ‘ঈসা’। যিসাসের (Jesus) হিব্রু নামের উচ্চারণের শুরুতে কোন J নেই এবং শেষে কোন S - ও নেই। তবে গ্রিকদের মাধ্যমে যিসাস নামটিই ছড়িয়ে পড়েছে।

ইতিহাসে দেখা যায় যিসাসের সময়েই ইউরোপ এবং মিসর-ফিলিস্তিনসহ বিস্তীর্ণ আরব অঞ্চল প্রথমবারের মত অখন্ড রোমান শাসনের অধীনে আসে। অগাস্টাস সিজারের হাতে মার্ক এন্টনির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরের পূর্ববর্তী আরব অঞ্চল প্রথমবারের মত স্থায়ীভাবে অভীন্ন রোমান শাসনের অধীনে প্রবেশ করে। মিসর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, তুরস্ক, গ্রিস ও ইতালিজুড়ে অখন্ড রোমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। রোমান সাম্রাজ্যের এ অখন্ডতার সুবাধেই যিসাসের শিক্ষা এশিয়ার সীমানা পেরিয়ে ইউরোপের গভীরেও ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে। সেমেটিক জাতির কাছ থেকে শিখে রোমানরাই খ্রিস্টধর্মকে ছড়িয়ে দিয়েছিল ইউরোপের সর্বত্র। জার্মানরা খ্রিস্টধর্ম শিখেছে রোমানদের কাছ থেকেই। দাস সমাজের ভাঙ্গন ও সামন্ত সমাজের উদ্ভবের প্রেক্ষাপটে পুরনো রোমান ধর্ম ও সমাজ চেতনা অনুযায়ী চলতে গিয়ে যে অচলায়তনের সৃষ্টি হয় তা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা থেকেই রোমান সাম্রাজ্য জুড়ে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটেছিল। তবে তাতে অনেকদিন সময় লেগেছিল।

অগাস্টাস সিজারের পরবর্তী সম্রাট টিবেরিয়াস সিজারের সময়েই (১৪-৩৭ খ্রি.) যিসাসের আবির্ভাব হয়েছিল। বাইবেলের ভাষ্য অনুযায়ী তিরিশ বছর বয়সে উপনীত হয়ে যিসাস তাঁর কাজ শুরু করেন। প্রথমে ইহুদি সমাজের অভ্যন্তরে তাঁর শিক্ষা প্রচার শুরু করলেও পরবর্তীতে অন্য জাতির লোকজনদের মধ্যেও তাঁর শিক্ষা প্রচার শুরু করেন। যিসাসের শিক্ষা তাঁর সময়ে কোন জোয়ার সৃষ্টি করেনি। তাই রোমানদের কাছে তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ বলে বিবেচিত হন নি। যিসাসের ধর্মমত রোমান ধর্ম বিরুদ্ধ হলেও তাঁর সময়কার রোমান শাসনকর্তারা এটাকে কোন বড় হুমকি হিসেবে দেখেনি। বরং রোমানরা তাঁর ধর্মমতকে সেমেটিক সমাজের প্রচলিত ধর্মমতেরই অংশ হিসেবে দেখত। সেমেটিক সমাজের এসব ধর্মীয় ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ ছিল না। খ্রিস্ট্রধর্মের রাজনীতিবিমূখতার কারণেও রোমানরা এটাকে প্রথমেই বড় সমস্যা হিসেবে দেখেনি। কিন্তু যিসাসের মতাদর্শকে প্রথমেই একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখল ইহুদি ধর্মনেতারা।

ইহুদি ধর্ম রোমানদের ধর্মের মত শাসকপুঁজারি না হলেও সেটা এক প্রাণহীন জরাগ্রস্থ মতবাদে পরিণত হয়েছিল। এ ধর্ম একত্ববাদের মানবিক চেতনা বিসর্জন দিয়ে একটি আচারসর্বস্ব যান্ত্রিক ধর্মে পরিণত হয়েছিল। যাজকতন্ত্র এবং জাতিগত সংরক্ষণবাদ ইহুদি ধর্মকে ধর্মব্যবসায়ীদের এক নোংরা হাতিয়ারে পরিণত করে। মানুষের ইতিহাসে এ ধরণের মতাদর্শিক বিকৃতি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এ বিকৃতির হাত থেকে কোন ধর্মই বাদ যায় নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন মতাদর্শের নজির নেই যা কমবেশি বিকৃতির শিকার হয়নি। বিকৃতির পথ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষের প্রচেষ্ঠার ইতিহাসও অপ্রতুল নয়।

এসব প্রচেষ্টা কখনও সফল হয়েছে আবার কখনও বিফল হয়েছে। যিসাস ইহুদি ধর্মকে বিকৃতির হাত থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। তিনি ইহুদি সমাজের নবিদেরই উত্তরসূরি ছিলেন। কিন্তু ইহুদি ধর্ম আপাদমস্তক এতটাই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল যে একে উদ্ধার করা যিসাসের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পুরো ইহুদি ধর্ম চলে গিয়েছিল সুবিধাবাদী ধর্মব্যবসায়ীদের পকেটে। তাই এই ইহুদি ধর্মযাজক ও ফরীশীরা তাদের আপন স্বার্থ রক্ষায় যিসাসের বিরুদ্ধে মরিয়া হয়ে মাঠে নামে। যিসাসের ধর্মীয় চেতনা ও শিক্ষা চলে গিয়েছিল এদের স্বার্থের প্রতিকূলে। তাই এসব ইহুদি ধর্মনেতারাই হয়ে ওঠে যিসাসের সবচেয়ে বড় শত্রু। এরা যিসাসের বিরুদ্ধে চক্রান্তে নামে। তাদের চক্রান্ত সফল হয়েছিল। একারণে বিকৃত ইহুদি ধর্ম তার আপন জায়গায়ই থেকে যায় এবং যিসাসের মতবাদ আলাদা ধর্মে পরিণত হল।

ইহুদি ধর্ম নেতারা যিসাসকে হত্যার জন্য পথ খুজতে থাকে। ধূর্ত ইহুদি মহাইমাম কাইয়াফা বৈধ উপায়েই যিসাসকে হত্যার একটি পথ খুঁজে বের করলেন। তাঁর নেতৃত্বে ইহুদিরা যিসাসকে বন্দী করে এহুদিয়ার রোমান শাসনকর্তা পন্টিয়াস পিলাতের কাছে নিয়ে গেল এবং তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনল। পিলাত যিসাসকে তাঁর শাসনের জন্য তেমন কোন হুমকি হিসেবে দেখলেন না। কিন্তু ইহুদিদের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে যিসাসের মৃত্যুদন্ডের আদেশনামা ছুড়ে দেন। বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের জীবনে এ ঘটনা তেমন কোন বড় ঘটনা ছিল না। তাই তৎকালীন রোমান ইতিহাসে এ ঘটনা তেমন গুরুত্ব পায়নি। খুবই সংক্ষিপ্তভাবে তৎকালীন রোমান দলিলপত্রে এ ঘটনার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। রোমান দলিলপত্রের সে ভাষ্য অনুসারে ৩৩ খ্রিস্টাব্দে পন্টিয়াস পিলাত যিসাসের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছেন।

ইহুদিরা যিসাসকে গ্রহণ না করলেও তাঁর ধর্মমত ধীরে ধীরে অন্য জাতির লোকজনদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। যিসাসের সময়ের বেশ কিছুদিন পর তাঁর ধর্মমতের একটি শক্তিশালী আবেদন সৃষ্টি হয়। ইহুদি ধর্ম ছিল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সংরক্ষণবাদের জালে বন্দী। অন্যদিকে যিসাসের ধর্মমতের মধ্যে ছিল একটি সার্বজনীন মানবিক সুর এবং তা ছিল সকল জাতির মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এ ধর্মমত সকল জাতির মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আহবান জানায়। জাতি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ধর্মীয় রীতির বাইরে পুরো মানবজাতিকে অভিন্ন ধর্মের ছায়াতলে আসতে আহবান করে।

এ ধরনের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ছিল অভূতপূর্ব। তাই অনেকদিন পর রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন তার ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু বিশাল আকারের রোমান সাম্রাজ্যের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য খ্রিস্টধর্মকে এক সম্ভাবনাময় শক্তি হিসেবে দেখেন এবং চিরায়ত রোমান ধর্ম বিসর্জন দিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। খ্রিস্টধর্মের এই প্রসারের মূলে ছিল এর কিছু অভূতপূর্ব বৈশিষ্ট্য, যা ক্ষয়িষ্ণু রোমান সাম্রাজ্যের জীবনে খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। রোমান সমাজ জীবনের পুর্ণগঠনের জন্য পুরনো ধর্মীয় অচলায়তন ভেঙ্গে ফেলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। আর এ ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মই সবচেয়ে ভাল বিকল্প হিসাবে দেখা দেয়। শুরুর দিকে খ্রিস্টধর্মকে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরোতে হয়েছিল।

যিসাসের জীবদ্দশায় খ্রিস্টধর্ম রোমান শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেও পরবর্তীতে যখন এর প্রসার বেড়ে যায় তখন খ্রিস্টধর্মের ব্যাপারটি রোমান শাসকদের কাছে আর চাপা থাকল না। আর চিরঅত্যাচারী রোমান শাসকরা খ্রিস্টধর্মের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাল চরম নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়েই। প্রথম শতকেই খ্রিস্টধর্মীদের ওপর রোমান শাসকদের অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। রোমান অত্যাচার থেকে ইহুদিরাও বাদ গেল না। যিসাসের বিরুদ্ধে চক্রান্তে ইহুদিরা সফল হলেও পরবর্তীতে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল না। ইহুদি ধর্মীয় সূত্র অনুযায়ী রোমান শাসনের কবল থেকে তাদেরকে মুক্ত করার জন্য তাদের মধ্যে একজন ‘মাসিহ’ বা ধর্মীয় রাজার আবির্ভাব হওয়ার কথা, যার নেতৃত্বে তার বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করবে। যিসাস নিজেকে সেই প্রতিশ্রুতি মাসিহ বলে দাবী করেছিলেন। কিন্তু ইহুদিরা তাকে গ্রহণ না করায় তাদের আর সংগঠিত হওয়ার সুযোগ হল না, স্বাধীনতা যুদ্ধও করা হল না। যিসাসের পরে ইহুদিদের মধ্যে আর কোন মাসিহেরও আগমন ঘটে নি।

মাসিহের নেতৃত্ব ছাড়াই তারা ৬৭ সালে বিদ্রোহ শুরু করে। ৬৩ খ্রিস্টাপূর্বাব্দে রোমানদের হাতে জুড়িয়ার পতনের পর সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় ইহুদি বিদ্রোহ। ৭১ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট টিটাস ভয়াবহ নৃশংসতায় সে বিদ্রোহ দমন করেন। ১৩৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট এলিয়াস হাডারিয়ানস আরেকটি ইহুদি বিদ্রোহ দমন করেন এবং বাইরে থেকে জেরুজালেমে ইহুদি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এসব বিদ্রোহ দমনের জন্য রোমান অভিযানের সময় খ্রিস্টানরা জেরুজালেম ছেড়ে মফস্বলে আশ্রয় নিত। ইহুদি বিদ্রোহের সময় সম্রাটরা খ্রিস্টানদের প্রতি কিছুটা নমনীয় ভূমিকা পালন করতেন। সম্রাট হাডারিয়ানস জেরুজালেমে ইহুদি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও সেখানে খ্রিস্টানদের থাকতে দেন। তাদের গীর্জাও সম্রাটের করুণায় টিকে থাকে। আলফ্রেড ডুগান রচিত The Story of the Crusades (1963) গ্রন্থ থেকে জানা যায় জেরুজালেমের খ্রিস্টধর্মীরা তাদের সেই প্রথম গীর্জাটি স্থাপন করেছিল ‘পেন্টিকস’ নামক ইহুদি পর্ব পালনের সময়।

ইহুদি বিদ্রোহের সময় রোমান শাসকরা খ্রিস্টধর্মীদের দিকে নজর না দিলেও অন্যান্য সময় তারা সুযোগ পেলেই খ্রিস্টধর্মীদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। ৬৭ সালের ইহুদি বিদ্রোহ শুরু হওয়ারও আগে খ্রিস্টান নিপীড়নে কুখ্যাতি অর্জন করেন সম্রাট নীরো (৬৪-৬৭ খ্রি.)। নীরো ছিলেন এক প্রবাদপ্রতিম নিষ্ঠুর সম্রাট। কথিত আছে, একবার রোমে ভয়ানক আগুন লাগে। দাউদাউ আগুনে রোম নগরী পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। আর সেসময়ে রাজপ্রসাদের ছাদে বসে সম্রাট নীরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন এবং নগরীর পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। খ্রিস্টানদের তিনি দু’চোখে দেখতে পারতেন না। অমানবিক কায়দায় তাদের ওপর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছিলেন সম্রাট নীরো।

কেউ কেউ মনে করেন সম্রাট নীরো পাগল ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। নীরোর পরে এসেছিলেন টিটাস। টিটাস ছিলেন ইহুদি নিপীড়নে রোমান সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত। টিটাসের মতই খ্রিস্টান নিপীড়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিলেন সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ান (২৮৪-৩০৫ খ্রি.)। সম্রাট ডমিটিয়ানও ছিলেন খ্রিস্টান গণহত্যার জন্য কুখ্যাত। কিন্তু এসব নিধনযজ্ঞ খ্রিস্টধর্মকে নির্জীব করতে পারল না। খিস্টধর্ম মানুষকে দিয়েছিল দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যেও বেঁচে থাকার এক আশ্চর্য জীবনীশক্তি। এ জীবনীশক্তিতে উজ্জীবিত খ্রিস্টধর্ম দিনে দিনে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে রোমান সাম্রাজ্যের মানুষের মধ্যে।

খ্রিস্টধর্ম অরাজনৈতিক হলেও তা ছিল শাসকপুঁজারি রোমান ধর্মচেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। একথাটি রোমান শাসকদের অজানা ছিল না। রোমান শাসকরা তাদের কর্তৃত্ব চিরস্থায়ী করার জন্য সাম্রাজ্যের সর্বত্র সম্রাট পুঁজার প্রচলন করেছিলেন। খ্রিস্টধর্মের একত্ববাদী মনোভাবের প্রসার হলে সেটা সম্রাটদের কর্তৃত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে- এ ব্যাপারটি রোমান শাসকদের দৃষ্টি এড়ায় নি। যদিও সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই সকল ক্ষমতার মূল নিহিত, তবুও সেসময়ের সমাজে ক্ষমতার মূলে গেঁড়ে বসা দৈব ভিত্তিটিও খুব দুর্বল ছিল না। আর এ ভিত্তিটি একত্ববাদের প্রভাবে নড়েবড়ে হতে দেয়া চলে না। তাই রোমান শাসকরা একত্ববাদকে ঠেকানোর জন্য নবদীক্ষিত খ্রিস্টানদের ওপরও তাদের তলোয়ার চালাতে দ্বিধা করলেন না। রোমান শাসকরা ইহুদিদের মত খ্রিস্টানদেরকেও রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিয়েছিলেন বহুবার।

খ্রিস্টধর্মের গোড়ায় আমরা খুজে পাই নবি যিসাস ও তাঁর বাণীগুলোকে। নবি যিসাস যা প্রচার করেছিলেন তা আজকের দিনে অত্যন্ত সাদামাটা ব্যাপার হলেও সেসময়ের প্রেক্ষাপটে তা ছিল সভ্যতার ইতিহাসের যুগান্তকারি বার্তা। কারণ তাঁর শিক্ষাই ইউরোপকে সর্বপ্রথম মুক্ত করে শাসকপুঁজার ব্যাধি হতে। এ ব্যধিমুক্তি মানুষের মুক্তির পথে একটি বিশাল অগ্রযাত্রা - তাতে কোন সন্দেহ নেই। একত্ববাদ মানুষের দৈব সত্ত্বাকে অস্বীকার করে মানুষকে দেবতার আসন থেকে নামিয়ে আনতে চেয়েছে। মানুষের দৈব সত্ত্বা ধুলিস্যাৎ করে তাকে মর্ত্যের মানুষে পরিণত করে একত্ববাদ মানুষের সাম্যের দিকে অগ্রযাত্রার পথকে প্রশস্থ করেছে। মানুষের কোন দৈব সত্ত্বা বা দৈব মর্যাদা নেই - এই একত্ববাদী মূলনীতি কিভাবে মানুষের মধ্যে ব্যবধানের একটি দেয়াল উঠিয়ে দিয়েছিল, তা বুঝতে হলে কিছু বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন।

আজকের যুগে আমরা মানুষের মধ্যে বৈষ্যম্যের মূলে যেভাবে অর্থনীতিকে প্রধান হয়ে উঠতে দেখি তাতে মনে হয় সকল যুগেই মানুষের মধ্যে বৈষম্যের একমাত্র ভিত্তিটি ছিল অর্থনৈতিক। কিন্তু ইতিহাসের বিশাল অধ্যায় জুড়ে আমরা দেখি মানুষের মধ্যে বৈষম্যের ব্যাপারটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল না। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরেই যদি সমস্ত শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকত তাহলে মানুষের দেবতা হওয়ার কোন প্রয়োজন পড়ত না; শাসক ও শোষককে দেবতার আসনে বসানোর প্রয়োজন হত না। সমস্ত প্রাচীন যুগের ইতিহাস জুড়ে দেখা যায় শাসকরা পুঁজিত হয়েছেন দেবতা রূপে। শাসকের ক্ষমতা ও শক্তির ভিতকে মজবুত করার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল দৈব মর্যাদা ও কর্তৃত্ব। শাসন ও শোষণকে স্থায়ী করার জন্য শাসককে নামতে হয়েছিল দেবতার ভূমিকায়।

দৈব সত্ত্বার ক্ষমতাবলে শাসকের শক্তি হয়ে উঠেছিল অজেয়। দৈব ক্ষমতার বাহাদুরী দেখিয়ে শাসক তার ক্ষমতা ও শোষণের পথকে রেখেছে নিরাপদ ও নিশ্চিত। শাসক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে কখনও দেবতারূপে আর কখনও দেবতাদের প্রতিনিধি বা বংশধররূপে। আবার কখনও শাসক নিজেকে দাবী করেছে সকল দেবতার উপরে শক্তিমান ঈশ্বর হিসেবে। দৈব সত্ত্বার নামে শাসক নিজেই সাধারণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে দৈব বিধান, যে বিধান বলে শাসকশ্রেণি পরিণত হয় মানুষরূপী দেবতায় আর জনসাধারণ পরিণত হয় এই দেবতার সেবাদাসে। জনগণ শাসকদের সেবাকে ঈশ্বরের সেবা মনে করে মেনে নিয়েছে সকল অন্যায় ও বৈষম্যের বিধান। শাসককে দেবতা হিসেবে মানতে যারা নারাজ হত তাদের মাথার ঝুলে থাকত দৈব শাস্তি ও অভিশাপের খড়গ!

প্রাচীন মিসর ও মেসোপটেমিয়ায় শাসকদেরকে যেভাবে দেবতার আসনে বসতে দেখা যায় সেভাবে প্রাচীন ইউরোপেও শাসকদেরকে খুজে পাওয়া যায় দেবতার আসনে। আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে জুলিয়াস সিজার, মার্ক এন্টনি হতে ক্লিওপেট্রো- সবাই পুঁজিত হয়েছেন জীবিত অথবা মৃত দেবতা হিসেবে। সে যুগের মানুষের জানার কোন সুযোগই ছিল না যে শাসকের কোন দৈব সত্ত্বা নেই। মানুষ জানত না শাসক ও ক্রীতদাসের মধ্যে যে ব্যবধান তা শুধুমাত্রই জাগতিক ব্যবধান, এর কোন দৈব ভিত্তি নেই। শাসক ও ধর্মযাজকরা মিলে দৈব বিধানের জালে বন্দী করে সাধারণ মানুষকে। এ বন্দীদশা থেকে মুক্তির কোন উপায় ছিল না। কারণ শোষিত ও দুর্বলেরা নিজেরাই শাসকের দৈব সত্ত্বায় বিশ্বাসী ছিল! তারা শাসক ও পুরোহিতদের দৈব ক্ষমতাকে ভয় করত। তারা শাসককে দেবতা হিসেবে সমীহ করত।

শোষিত মানুষেরা নিজেরাই বিশ্বাস করত যে এক পবিত্র দৈব বিধানবলেই তারা শোষিত হচ্ছে; মানুষের মধ্যে বৈষম্য সেই দৈব বিধানের সৃষ্টি। সেই দৈব বিধানবলেই কেউ হয় সম্রাট আর কেউ হয় ক্রীতদাস। বড়লোকের সেবা করলে দেবতারা খুশী হন। যে এই নিয়মে বিশ্বাস করে না সে পাপী এবং এই পাপের জন্য তাকে দেবতাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে। মানুষের সাম্যচিন্তা ছিল দৈব বিধান বিরোধী! এজন্য দেবতাদের নরকের শাস্তি ভোগ অনিবার্য। মানুষের মধ্যে ব্যবধান দেবতাদের তৈরি নিয়ম। এই নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল খোদ দেবতাদের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ। এভাবে প্রাচীন যুগের ধর্ম ও দেবতারা পরিণত হয়েছিল শাসক ও শোষক শ্রেণির স্বার্থরক্ষার এক নিখুত ও নিশ্চিদ্র ঢাল হিসেবে।

দেবতারা ছিল শাসকের নিরাপদ শোষণের পাহারাদার। প্রাচীন রোমে শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহের নায়ক স্পার্টাকাসের সৈন্যরাও দেবতাদের ভয় থেকে মুক্ত হতে পারে নি। স্পার্টাকাসের সঙ্গীরা শাসক প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের তলোয়ার হাতে উঠিয়ে নিলেও তারা দেবতাদের শাস্তির ভয়ে ছিল আতঙ্কিত! তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণও ছিল এটি। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহের রূপকার ছিল এই বিদ্রোহীরা। বিশাল রোমান সাম্রাজ্যের ভিত একমাত্র তারাই কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিল। এত বড় একটি বিপ্লবের কুশীলবদের মনে চেপে বসা দৈব শৃঙ্খলের প্রভাব যদি এতটা শক্তিশালী হয় তাহলে তা অন্যান্য মানুষের বেলায় কতটা শক্তিশালী ছিল সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।

রোমান সাম্রাজ্যের মানুষের মনে চেপে বসা এ দৈব শৃঙ্খলকে ভেঙ্গে ফেলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে খ্রিস্টধর্ম । রোমান সাম্রাজ্যের মানুষের মনে চেপে বসা শাসকপূঁজার ব্যধি অপসারণে ভূমিকা রেখেছে যিসাসের শিক্ষা। নবি যিসাস নিজেও কখনও ভাবতে পারেননি তিনি ইতিহাসে এতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। সময় ও প্রেক্ষাপটই তাঁর শিক্ষাকে এতটা মূল্যবান বানিয়ে দেয়। যিসাসের নিজের সময়ের বেশ কিছুদিন পরে খ্রিস্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ সামাজিক ভাঙ্গনের দৃশ্যপটে একটি শক্তিশালী ভূমিকা নিয়ে উপস্থিত হয়। যিসাস আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত কোন ব্যক্তি ছিলেন না; ছিলেন ফিলিস্তিনের এক সাধারণ নবি। কোন আন্তর্জাতিক পরিসরে নয়, বরং কয়েকটি শহর ও অঞ্চলে মধ্যেই তাঁর কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি প্রচার করেছিলেন করুণা ও মানবতার সরল শিক্ষা। কিন্তু এসব সরল শিক্ষার মধ্যেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত লুকিয়ে ছিল।

যিসাস বলে গিয়েছিলেন দয়া, মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের কথা। মানুষের মধ্যে ব্যবধানের দৈব তাৎপর্যকে তিনি অস্বীকার করেন। মানুষ হয়ে মানুষকে পূঁজা নয় বরং মানুষকে তিনি আহবান জানালেন একমাত্র আকাশের খোদার উপাসনায়, যার চোখে মানুষের মধ্যে কোন দৈব প্রভেদ নেই। তিনি সকল মানুষকে এক স্রষ্টার অনুগত হতে বললেন এবং সবাইকে ভাতৃত্ব ও ঐক্যের বাঁধনে যুক্ত হতে বললেন। মানুষকে দেবতার আসন থেকে নামিয়ে মানুষের স্তরে নিয়ে আসলেন; আবার ক্রীতদাসকে পশুর স্তর থেকে উঠিয়ে মানুষের মর্যাদায় ভূষিত করলেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে বললেন, দেবতা কিংবা পশু হিসেবে নয়। তাঁর ধর্মে দরিদ্ররাই খোদার বেশি প্রিয়। তারাই খোদার স্বর্গরাজ্যে আগে প্রবেশ করবে।

যিসাসের শিক্ষাগুলো গ্রিকো-রোমান প্যাগান ধর্ম বিশ্বাসীদের কাছে অচেনা হলেও তা ফিলিস্তিনের মানুষের কাছে অভিনব ছিল না। তাই ফিলিস্তিনের প্রেক্ষাপটে এসব শিক্ষার তেমন কোন আলাদা তাৎপর্য ছিল না। যখন এসব শিক্ষা ফিলিস্তিনের গন্ডি পেরিয়ে সূদুর অঞ্চলসমূহেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে কেবল তখনই এসব শিক্ষার আন্তর্জাতিক তাৎপর্যটি পরিস্কার হয়ে ওঠে। বিশেষ করে খ্রিস্টধর্মের ইউরোপ মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যেই এর মূল তাৎপর্য নিহিত। ইউরোপবাসীরা যখন তাদের হাজার হাজার বছরের পুরনো চিরায়ত ধর্ম ছেড়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিতে শুরু করে তখন খ্রিস্টধর্মের তাৎপর্যটি ফুটে উঠল।রোমান সাম্রাজ্যের সমাজ জীবনের দৈব অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসার পথ লুকিয়ে ছিল খ্রিস্টধর্মের গভীরে। তাই রোমান সমাজ ব্যবস্থার পতন যত দ্রুত হয়েছে, খ্রিস্টধর্মের উত্থানও ততটা দ্রুতটায় ঘটেছে।

রোমান সভ্যতা ভেঙ্গে পড়ার আগে আশ্রয় নিয়েছে খ্রিস্টধর্মের কোলে। তাই খ্রিস্টধর্মের উত্থান ঘটেছে সভ্যতার ঊষাকালে নয়; বরং সভ্যতার সুর্যাস্তের বেলায়- পতনের মুখে। তাই ক্ষয়িষ্ণু সমাজ জীবনের সাথেই এ ধর্ম নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বেশী। সভ্যতার প্রভাতবেলায় কোন গতিশীল ও বিকশিত সমাজ জীবনকে অবলম্বন করে বেড়ে ওঠেনি খ্রিস্টধর্ম; বেড়ে ওঠেছে জড়তা ও স্থবিরতার মধ্যে। তাই গতিশীল সমাজ জীবনের সাথে এর দূরত্ব তৈরী হবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই এ ধর্ম একসময় তার সামাজিক পরিস্থিতির গর্ভেই ধীরে ধীরে একটি রক্ষণশীল মতবাদে পরিণত হয়েছিল। তবুও এ ধর্ম সাম্য ও মানবতার যে প্রাথমিক ভিত্তিটি স্থাপন করেছিল তা কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না।

আজকের দিনে সাম্য ও মানবতার এত অগ্রসর ধারণা ও ব্যাখ্যার ছড়াছড়ির মধ্যে এটা কল্পনা করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় যে একসময় মানুষের মধ্যে ব্যবধান ছিল ঈশ্বর আর মানুষের ব্যবধানের সমান। অর্থাৎ মানুষের মধ্যেই একাংশ পরিণত হয়েছিল ঈশ্বররূপে আর বাকিরা ছিল তাদের সেবক। সে পরিস্থিতিতে মানুষের আর্থিক সাম্য তো দূরের কথা দৈব সাম্যও ছিল অনেক বড় ব্যাপার। অর্থনৈতিক সাম্যের কোন ধারণাও তখন সৃষ্টি হয়নি। তাই নবি যিসাসকে বলতে দেখা যায়, ‘সিজারকে তার প্রাপ্য দিয়ে দাও’। এখান থেকে বোঝা যায় অর্থ-সম্পর্কের পরিবর্তনের কথা যিসাস ভাবতে পারেননি। ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই অর্থনৈতিক সাম্য খুবই জটিল বিষয় এবং এটা আধুনিক যুগেও এটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই দুহাজার বছর আগের যিসাসের কাছে সাম্যবাদী অর্থনীতির রূপরেখা প্রত্যাশা করা যায় না। তাঁর সময়কার সমাজে যেখানে মানুষকে একদিকে দেবতা ও অন্যদিকে ক্রীতদাসে পরিণত করা হত সেখানে মানবজাতির অর্থনৈতিক সাম্যের প্রত্যাশা বাহুল্য মাত্র।

মানুষের সাম্যের মাত্রা নির্ভর করে তার সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থার প্রকৃতির উপর। সামাজিক স্তরবিন্যাসের মূলে থাকে সে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা। উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক মিলে হয় উৎপাদন ব্যবস্থা। প্রাচীন ইউরোপের উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল দাসকেন্দ্রিক। সেখানে অর্থনৈতিক সাম্যের কল্পনা করাও কঠিন । আধুনিক যুগে এসেও সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক সাম্যের কোন পদ্ধতি মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই দাস সমাজে সেটা কতটা অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল তা অনুমানে সমস্যা হয় না। এজন্য যিসাস দাস সমাজের অর্থনীতিকে অস্বীকার করতে পারেন নি। দাস সমাজের নিয়মকে পুরোপুরিভাবে অস্বীকারের উপায় তাদের জানা ছিল না। দাস সমাজের আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনের কথা তিনি বলতে পারেন নি, তবু যে পরিবর্তনটি তিনি ইউরোপবাসীর চেতনায় নিয়ে এলেন তার গুরুত্ব ও তাৎপর্যও কোন অংশেই কম নয়। স্রষ্টার চোখে সকল মানুষ সমান ও দৈবসত্ত্বাবিবর্জিত- এ সত্যটি ইউরোপবাসী তাঁর কাছ থেকেই শিখেছে। এ সত্যটি গ্রহণের ফলে মানুষের বৈষম্যের দৈব ভিত্তিটি দূর হয়েছে। মানুষ ভাবতে পেরেছে মানুষের মধ্যে ব্যবধান সমাজের সৃষ্টি, কোন ঐশী বিধানের সৃষ্টি নয়। কোন ঐশী বিধানবলে মানুষের মধ্যে ব্যবধান অপরিবর্তনীয়ও নয়, জন্মসূত্রে মানুষ কোন বৈষমের জালে বন্দি নয়।

মানুষের আর্থ রাজনৈতিক সাম্যের প্রশ্নটি তখনই আসে যখন মানুষের রক্তের মধ্যে কোন ব্যবধান থাকে না। মানুষের রক্ত যদি উৎকৃষ্ট রক্ত আর নিকৃষ্ট রক্তে বিভাজিত থাকে তাহলে সেখানে সাম্যচিন্তা অসম্ভব। মানুষ যদি জন্মসূত্রেই প্রভু আর ক্রীতদাসের রক্তের উত্তরাধিকারি হয় তাহলে সেখানে সাম্যচিন্তা একটি পাপ। খ্রিস্টধর্ম এই পাপ থেকে সাম্যচিন্তাকে মুক্তি দিয়েছিল। পৌরানিক দৈব বিধানের দ্বারা বেধে দেয়া মানুষের রক্তের বিভাজন অস্বীকার করাও সাম্যচিন্তার অগ্রযাত্রার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। খ্রিস্টধর্ম পৌরানিক বিধানের নিষিদ্ধ কল্পনাকে বাস্তব করেছিল। এটাই খ্রিস্টধর্মের গৌরবের দিক। এটাই যিসাসের আসল অবদান। অন্তত দৈব জগতেও মানুষের সাম্যচিন্তার একটি পথ খুলে দিয়েছিলেন যিসাস। এতে মানুষের জাগতিক সাম্যচিন্তাও যে সম্ভবনাময় হয়ে ওঠে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটাই খ্রিস্টধর্মের সফলতার দিক।

এ সফলতার পাশাপাশি খ্রিস্টধর্মের অপূর্ণতাকেও ব্যাখা করা প্রয়োজন। যিসাসের শিক্ষা রোমান জীবন চেতনায় অনেকখানি পরিবর্তন আনলেও সমাজ জীবনকে তা আমূল বদলে দিতে পারে নি। খ্রিস্টধর্ম সমাজের আর্থ রাজনৈতিক জীবনের প্রশ্নগুলো এড়িয়ে শুধুমাত্র মানুষের ধর্ম চেতনায় একটি পরিবর্তন সূচিত করে। সমাজের মানুষের মনকে এটি পৌরানিক দৈব প্রভাব ও পৌরানক নৈতিকতা থেকে মুক্ত করে। খ্রিষ্টধর্মের অর্জন এতটুকুই। সমাজ জীবনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিকটি এ ধর্মে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বৈষম্য ও অবিচারের মূলে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাজ করে তার বিকল্প ধারনা খ্রিষ্টধর্ম দিতে পারে নি। ফলে সময়ে পরিক্রমায় একসময় খ্রিস্টধর্মের ইতিবাচক আবেদন ফুরিয়ে যায়। নতুন কোন পরিবর্তনের ধারনা দিতে না পারায় খ্রিস্টধর্ম এক সময়ে পরিণত হয় এক রক্ষণশীল মতবাদে। চুড়ান্ত বিকাশ লাভের পর এক পর্যায়ে খ্রিস্টধর্ম সমাজ প্রগতির ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমস্ত জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলে। তবে এজন্য খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক যুগের ঐতিহাসিক অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। ইসলামের পূর্ব পর্যন্ত খ্রিস্টধর্মই ছিল সবচেয়ে অগ্রসর মতবাদ।

খ্রিস্টধর্ম তখনই প্রসার লাভ করেছিল যখন পুরাতন মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে আর সমাজ চালানো যাছিল না। পুরনো বিশ্বাসের ওপর চলতে গিয়ে ক্ষয়িষ্ণু রোমান সমাজ জীবনে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। প্রথম শতক থেকেই রোমান সমাজ জীবনের মূলে ভাঙ্গন শুরু হয়। অর্থনীতির যে পতন শুরু হয় তা আর কখনও থামে নি। পরবর্তী দুই শতকে অর্র্থনীতির এই পতন আরও বেড়েছে। পণ্যের বাজার সংকুচিত হতে হতে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যায়। বাজার অর্থনীতির সংকোচনের ফলে সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ধ্বসে পড়ছিল। ফলে হারিয়ে যাচ্ছিল আগের সেই গতিশীল জীবন ও সমাজ। সমাজজীবনের সর্বত্র এক অচলাবস্থা চেপে বসে। এ অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুর্নগঠন জরুরি হয়ে পড়ে। এ পুর্নগঠন প্রক্রিয়ায় পুরনো অর্থনৈতিক সম্পর্ক যায় বদলে। আগের ক্রীতদাসের জায়গায় এলো নতুন কলোন বা ভূমিদাস। অভিজাত দাস মালিকের জায়গায় এলো নতুন সামন্ত জমিদার। আগের দাস-মনিব সম্পর্কের স্থলে এলো নতুন ভূমিদাস-সামন্ত সম্পর্ক। এই নতুন পরিস্থিতির সাথে চিরায়ত দাসতন্ত্রী রোমান ধর্ম আর খাপ খাচ্ছিল না। দাসকেন্দ্রিক অর্থনীতির ভাঙন স্পর্শ করছিল সামগ্রিক সমাজ জীবনকে।

দাসতন্ত্রী অর্থনীতির ভাঙনের ফলে দাস সমাজের ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রসূত জীবন প্রণালীতেও ভাঙন সৃষ্টি হয়। তাই চিরায়ত ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের পরিবর্তন হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সমাজের মানুষ বাঁধা পড়ছিল নতুন সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কে। দাসদের দিয়ে উৎপাদন পরিচালনা বন্ধ হয়ে গিয়ে ভূমিদাসদের প্রচলন ঘটে; ক্রীতদাসরা আর মালিকের সম্পত্তি থাকে না। তারা কলোন বা ভূমিদাসে পরিণত হয়। ক্রীতদাসদের ভূমিদাসে রূপান্তর করতে গেলে তাদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির প্রয়োজন পড়ে। খ্রিস্টধর্ম মানুষ হিসেবে সকল মানুষদের স্বীকৃতির কথা বলে। তাই সে পরিস্থিতিতে খ্রিস্টধর্ম ছিল একটি কার্যকর সমাধান। তাই খ্রিস্টধর্ম ছিল দাসতন্ত্রী সমাজের স্থলে আগত নতুন সামন্তান্ত্রিক সমাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যিসাসের সমসাময়িক কালেও রোমান সমাজ ব্যবস্থা যথেষ্ঠ দাস নির্ভর হওয়ায় এ ধর্ম স্বীকৃতি পায় নি। পরবর্তীতে যখন ক্রমাগত দাস ব্যবস্থার পতন ঘটতে থাকে তখন দাসতন্ত্রী ধর্মীয় মূল্যবোধও অচল হয়ে যেতে থাকে এবং তার স্থান দখল করতে শুরু করে খ্রিস্টধর্ম।

ইতিহাসে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে ভূস্বামীরাই খ্রিস্টধর্মের প্রচলনে ভূমিকা রেখেছে। এভাবে নতুন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সাথে খ্রিস্টধর্মের একটি ঐতিহাসিক মেলবন্ধন ঘটে এবং ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের ইতিহাসের সাথে খ্রিস্টধর্ম অভিন্নভাবে জড়িয়ে যায়। সামন্ততন্ত্রের আগমন যত ত্বরাম্বিত হয়েছে, খ্রিস্টধর্মের প্রসারও ততটা দ্রুততায় ঘটেছে। সম্রাট ডায়োক্লেটিয়ানের হত্যাযজ্ঞ সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসারের কারণ ছিল চিরায়ত রোমান অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হওয়া নজরবিহীন ভাঙন। জার্মান বর্ববদের অব্যাহত আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্য তখন পতনের একেবারে দ্বারাপ্রান্তে পৌছে যায়। দাসত্বের ভিত্তির ওপর দাড়ানো রোমান অর্থনৈতিক কাঠামো ধসে পড়ে।

দাসের স্থানে আবির্ভাব হয় সর্বস্বান্ত আধা-স্বাধীন মানুষের। পতনোন্মুখ রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হয় নতুন সামন্ততান্ত্রিক সমাজ। এই চরম দুঃসময়ে রোমান সাম্রাজ্যকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন সম্রাট কনস্টানটাইন। তাঁর পূর্ববর্তী সম্রাটরা দাস ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এজন্য তারা পুরাতন ধর্ম ও মূল্যবোধকেই আকড়ে থাকতে চেয়েছিলেন। তাই তারা তলোয়ারের মুখে খ্রিস্টধর্মকে টেকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যের জীবন ও অর্থনীতির গভীরে যে ভাঙ্গন ধরেছিল তা আটকানোর সামর্থ তাদের ছিল না। তাই সময়ের সাথে সাথে প্যাগান ধর্মের স্থলে খ্রিস্টধর্ম জায়গা করে নিয়েছিল।

এভাবে যখন একদিন চরম হতাশা ও অবক্ষয়ের অন্ধকারে রোমান সভ্যতা উত্তরণের পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছিল তখন আশা ও আলোর বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল খ্রিস্টধর্ম; শুনিয়েছিল দয়া,ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের সুর; নতুনভাবে জাগিয়েছিল মানুষকে; জাগিয়েছিল আশার আলোয়।করুণা ও ভালবাসার সুর শুনিয়ে এবং আশার আলো দেখিয়ে সভ্যতাকে জয় করেছিলেন নবি যিসাস।তাঁর সেই আশার আলোয় লুকিয়ে ছিল কী অপরিমেয় শক্তি! এই আশা কি সেই আশা যা বেরিয়ে এসেছিল প্যানডোরার বাক্স থেকে?

আসিফ আযহার, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ রাত ১০:৩২
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পার্বত্য চট্টগ্রাম- মিয়ানমার-মিজোরাম ও মনিপুর রাজ্য মিলে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্ত চলছে?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০১


মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন । সেখানে তিনি ইন্ডিয়ানা তে বক্তব্য প্রদান কালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী chin-kuki-zo দের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে আমেরিকার সাহায্য চেয়েছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×