ভাইকিং (ইংরেজি: Viking) বলতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সমুদ্রচারী ব্যবসায়ী, যোদ্ধা ও জলদস্যুদের একটি দলকে বোঝায়, যারা ৮ম শতক থেকে ১১শ শতক পর্যন্ত ইউরোপের এক বিরাট এলাকা জুড়ে লুটতরাজ চালায় ও বসতি স্থাপন করে। এদেরকে নর্সম্যান বা নর্থম্যানও বলা হয়। ভাইকিঙেরা পূর্ব দিকে রাশিয়া ও কনস্তান্তিনোপলপর্যন্ত পৌঁছেছিল। অন্যদিকে পশ্চিমদিকে গ্রিনল্যান্ডে ভাইকিঙেরা ৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইউরোপীয় বসতি স্থাপন করে এবং সম্ভবত প্রথম ইউরোপীয় জাতি হিসেবে ১০০০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা মহাদেশ আবিস্কার করে। আইসল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অনেক গাথায় ভাইকিংদের শৌর্য-বীর্যের কথা বলা হয়েছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মানুষেরাখ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হতে শুরু করলে ভাইকিংদের অভিযান ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়ে সমাপ্ত হয়ে যায়।
এদিকে ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্সের ফেরারি জলদস্যুরা তাড়া খেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হিস্পানিওলা (বর্তমান হাইতি) দ্বীপে গিয়ে সেখানকার ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে বাস করতে শুরু করলো। ইন্ডিয়ানরা ‘বুকান’ নামের এক ধরনের ছুরি ব্যবহার করতো। সেই থেকে তাদের নাম হয়ে গেলো ‘বুকানিয়র’। আবার কেউ কেউ বলে, তারা নাকি স্পেনীয়দের গবাদি পশু চুরি করে এনে সেগুলোর মাংস শুকিয়ে বিক্রি করতো, সেই শুকনো মাংসকে ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘বুকান’ বলা হতো। আর সেখান থেকেই ‘বুকানিয়র’ শব্দের উৎপত্তি।
আর এক ধরনের জলদস্যু ছিলো যারা রাজা বা রাণীর ভাড়া করা জলদস্যু। তারা শত্রু দেশের জাহাজ লুট করে, লুটের অংশ রাজা বা রাণীর কোষাগারে জমা দিতো। এদের বলা হত ‘প্রাইভেটিয়ার’ । রাণী প্রথম এলিজাবেথ এই ব্যবস্থাটি চালু করেছিলেন। স্যার ফ্র্যান্সিস ড্রেক, ক্যাপ্টেন উইলিয়াম কিড ছিলেন দুজন বিখ্যাত ‘প্রাইভেটিয়ার’। যেহেতু ‘প্রাইভেটিয়ার’রা দস্যুগিরির জন্য কখনও শাস্তি পেতো না তাই অনেক ‘প্রাইভেটিয়ার’ই শেষ পর্যন্ত পুরোদস্তুর জলদস্যু বনে গিয়েছিলো।
শুধু এলিজাবেথেরই ‘প্রাইভেটিয়ার’ ছিলো তা কিন্তু না। তুরস্কের অটোম্যান সুলতানদেরও ছিলো এই ভাড়া করা লুটেরা বাহিনী। তুরস্কের আশেপাশে জলদস্যু বলতে বারবারি কোরসায়াররাই ছিলো। এদের মাঝে সবচে বেশি নাম শোনা যেতো বারবারোসা ভাইদের। বড় ভাই আরুজের ছিলো লাল রঙের দাড়ি। ইটালিয়ান ভাষায় বারবা মানে দাড়ি আর রোসা মানে লাল। অর্থাৎ লাল দাড়ি। ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে আরুজ নিহত হলে তার ছোট ভাই হিযির, অটোম্যান সুলতানের ‘প্রাইভেটিয়ার’ হয়ে গেলো। তার হাতেই আবার স্পেনীয়রা গো-হারা হেরে আলজেরিয়া ছাড়তে বাধ্য হলো। পরে অটোম্যান সুলতান ‘সুলাইমান দ্যা ম্যাগনিফিশেন্ট’ খুশি হয়ে তাকে হায়ের-উদ-দীন উপাধি দেয়। ইউরোপীয়রা যাকে ডাকতো খায়ের-উদ-দীন বলে।
Pirates of the Caribbean: the curse of the black pearl চলচ্চিত্রটির ভিলেন হেক্টর বারবোসার চরিত্রটি কিন্তু এই খায়ের-আদ-দীন বারবারোসাকে নিয়েই বানানো।
রাণী প্রথম এলিজাবেথের ‘প্রাইভেটিয়ার’ ক্যাপ্টেন উইলিয়াম কিড। সে ছিলো অত্যন্ত বিত্তবান একজন স্কটিশ ব্যবসায়ী। পরে ‘প্রাইভেটিয়ার’ হলেও কিড তার লুটের কোনো অংশই রাণীকে দিতো না। তার জাহাজের নাবিকদের সে লুটের ভাগ ছাড়া আলাদা কোন বেতনও দিতো না। সে বলতো, কোনো শিকার নেই তো কোনো পয়সাও নেই। এজন্যে নাবিকরাও তাকে দেখতে পারতো না। রাণীও তাকে প্রতারণার দায়ে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন। একদিন ধরাও পড়লো সে। তার মৃত্যু ছিলো বিভীষিকাময়। ফাঁসির দড়ি খুলে যাওয়ায় দুই দুইবার ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো তাকে। তার লাশটা পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো জনসম্মুখে, যাতে আর কেউ এমন ভুল আর না করে।
ক্যাপ্টেন কিড যে লোকটিকে ধরার জন্যে ‘প্রাইভেটিয়ার’ এ নাম লিখিয়েছিলেন তার নাম ছিলো ‘ব্ল্যাকবিয়ার্ড’।আসল নাম উইলিয়াম টিচ। সেই প্রথম জলদস্যুর পতাকা ব্যবহার করতে শুরু করে। তার পতাকার নাম ছিলো ‘জলি রজার’। খুলি আর হাড় সম্বলিত আজকের যে জলদস্যুর পতাকা আমরা দেখতে পাই সেটা কিন্তু ঐ ব্ল্যাকবিয়ার্ডেরই সৃষ্টি।
জলদস্যুদের গানের ইতিহাসও ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে কেন্দ্র করেই। জলদস্যুর গান বললেই যে গানটা আমাদের মাথায় প্রথম আসে সেটি হলো-
Fifteen men on a dead man`s chest
Yo ho ho and a bottle of rum.
Drink and the devil had done for the rest
Yo ho ho and a bottle of rum.
১৮৮৩ সালে রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যান্ড বইয়ে জলদস্যুদের এই গান প্রথম পাওয়া যায়। এই গানটির কথা আসলে একটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একবার ব্ল্যাকবিয়ার্ড ১৫ জন নাবিককে ‘ডেড ম্যানস চেস্ট’ আইল্যান্ড নির্বাসিত করে। তাদের প্রত্যেককে জলদস্যুদের নিয়ম অনুযায়ী একটা করে কাটলাস ও এক বোতল করে রাম দেয়া হয়েছিলো। যদিও পাইরেটস অফ দ্যা ক্যারিবিয়ানের জ্যাক স্প্যারোকে কেবল একটি পিস্তল দিয়েই নির্বাসিত করা হয়েছিলো। যাই হোক, নির্বাসিত নাবিকেরাই যে এই গানের লেখক সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
জলি রজার ছাড়াও আর এক ধরনের পতাকা ছিলো। যাকে বলা হতো জ্যাক র্যা/কহ্যাম। জ্যাক র্যা কহ্যাম নামের এক জলদস্যু তার নিজের নামে এই পতাকাটির নাম রেখেছে। নাবিকদের মাঝে কুসংস্কার ছিলো, জাহাজে মেয়ের উপস্থিতি মানেই অশুভ সংকেত। সেখানে জ্যাক র্যাকহ্যামের জাহাজেই প্রথম মেয়ে জলদস্যু ছিলো। তার পতাকায় জলি রজারের হাড়ের পরিবর্তে দুইটি কাটলাস থাকে, আর খুলিতো থাকেই।
সর্বশেষ বিখ্যাত জলদস্যুটির কথা। ডাক নাম ব্ল্যাকবার্ট। আর আসল নাম জন রবার্টস। ধারণা করা হয়, এই ওয়েলশ জলদস্যু ৪০০ জাহাজ ক্যারিবিয়ান সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিলো! এমনকি ৮০ জন দাসসহ জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনার কথাও শোনা যায় তার নামে।
জলদস্যুদের নিয়ে গল্পের শেষ নেই, শেষ নেই কিংবদন্তীরও। আজকের দিনেও মনে করা হয় মেক্সিকো উপসাগরের পাদ্রে দ্বীপে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখা আছে। এ ধারণার পিছনে অবশ্য কিছুটা সত্যও আছে। কারণ সাগরে ঝড় উঠলেই নাকি সেখানকার পানিতে সোনার মুদ্রা ভেসে উঠতে দেখা যায়। ক্যাপ্টেন কিডের মৃত্যুর পর তার গুপ্তধন নিয়েও জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। এখনও ‘অক আইল্যান্ড’ এ গুপ্তধন শিকারীরা এসে ভীড় করে। আমেরিকার এক সময়ের প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন পর্যন্ত ক্যাপ্টেন কিডের গুপ্তধন শিকারে বের হয়েছিলেন। ভাবা যায়! কিন্তু কেউই আজ পর্যন্ত সেই গুপ্তধনের সন্ধান পায়নি।
কেউ জানে না, গুপ্তধন আছে কী নেই! কিন্তু গুজব থেমে নেই! গুপ্তধন আর গুপ্তধন শিকারীরাও বসে নেই।
তথ্য সুত্রঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।