আফ্রিকার অরণ্য আর কালো মানুষের কথা (৬ষ্ঠঅধ্যায়)
এখানকার স্হানীয় জনসাধারনের প্রধান খাদ্য হচ্ছে কাসাভা ।এই কাসাভা হচ্ছে এক ধরনের গাছের মূল যা বেঁটে ময়দার মত পেস্ট করে এরা রুটি তৈরী করে খায়।তাছাড়া এর পাতা এরা শাক হিসেবে রান্না করে খায়। এখনও এখানকার বেশিরভাগ লোকজন চাষাবাদের সাথে পুরোপুরি পরিচিত নয় মুলত কাসাভাটা শুধু এরা চাষ করে কিণ্ত বাকী সব ধরনের ফলমূলের জন্য এরা এখনও অনেকাংশে প্রকৃতি তথা অরণ্যর উপর অনেকখানি নির্ভরশীল।
এখানকার স্হানীয় জনসাধারনের খাদ্য তালিকার মধ্যে আছে যেমন কাসাভা এর পাশাপাশি তারা বন থেকে সংগ্রহ করে নানারকম ফল যেমন মান্দারিন (কমলা জাতীয় ফল),আমড়া,পেঁপে,কলা,লিচু,আখ এবং আম। সব থেকে মজার বিষয় হচ্ছে এখানকার আমগাছগুলো । একই আমগাছে দেখা যায় মুকুল ধরেছে এবং ডালে ঝুলছে কচি আম থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাইজের আম, এমনকি পাঁকা আম পর্যন্ত ।এর কারন কংগোতে সারা বছর গাছে আম ধরে। আমগুলো সাইজে আমাদের দেশের আম থেকে একটু ছোট তবে স্বাদে মিষ্টি এবং উপাদেয়। এদের খাদ্য তালিকায় আছে আর একটি অভিনব মেন্যু আর তা হল বিভিন্ন প্রজাতির কীট পতংগ । এর আগে আমি দেখেছিলাম পার্বত্য চট্রগ্রামে চাকমাদের বড় বড় ঝিঁঝিঁ পোকা ধরে খেতে কিন্ত এদের খাদ্য তালিকায় ঝিঁঝিঁ পোকা থেকে শুরু করে শুয়োপোকা,ঘাস ফরিং এমন কোন পোকা নেই যা তারা খায়না। আফ্রিকার প্রত্যন্ত অন্চলে আমার বেশ কয়েকবার অফিসিয়াল কাজে ভ্রমনের সুযোগ হয়েছিলো এবং প্রায় সব গ্রামগুলোতে এদের খাদ্যভ্যাসের তেমন কোন পার্থক্য আমার চোখে ধরা পড়েনি । এদের খাদ্যভ্যাসের কথা বলতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। একদিন আমরা সবাই ক্যাম্পে বেশ একটা বিদঘুঁটে এবং পঁচা কিছুর গন্ধ টের পাচ্ছিলাম কিন্ত কোথা থেকে আসছে কেউ বুঝে উঠতে পারছিলামনা । এর মধ্যে ফ্রিজের এবং স্টোরের ভেতর সব খাবার পরীক্ষা করে দেখা হল কিন্ত সেই বিদঘুঁটে গন্ধের হদিস আর খুঁজে পাওয়া গেলনা । এই খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে আমাদের দোভাষী জর্জ এসে আমাদের এই কান্ডকারখানা দেখে হাসতে হাসতে স্টোরের পাশে এক দেয়ালের কোনা থেকে বের করে আনলো একটা কালো ব্যাগ আর তার ভেতর থেকে যা বের করে আনলো তা দেখে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। দেখি জর্জের হাতে আস্ত এক চামড়া শুদ্ধু ঝলসানো ছোট্ট এক বানর ঝুলে আছে শুন্যে। শুনলাম এই বানর নাকি তাদের কাছে এক অতি সুখাদ্যর একটি বিষয় । আমি কোনমতে তাকে বুঝিয়ে সেই বানরটি তৎক্ষনাৎ বের করে বাসায় নিয়ে যেতে বললাম আর ভবিষৎ এ এধরনের সুখাদ্য ক্যাম্প এলাকায় আনার আগে আমাকে জানাতে বললাম।
ছবি : শুয়োপোকার সাথে সালাদ এক বিচিত্র মেন্যু (সংগৃহীত) ।
আমাদের দেশের গ্রামের বাড়িগুলো যেরকম মাটির তৈরী অথবা কাঠ,বাঁশের বা পাতা দিয়ে তৈরী হয় সে রকমের আদলে এখানকার কংগোর প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িগুলো দেখা যায় মাটি, নলখাগড়া অথবা কাঠ দিয়ে তৈরী । আবার কখনো বা দেখা যায় সম্পূর্ন ঘরটি তারা পাতা বা নলখাগড়া দিয়ে তৈরী করছে।
ছবি : কংগো নদীর তীরে আফ্রিকান এক পল্লী ।
এদের গ্রামের বাড়ি গুলো আমাদের দেশের মত মাটির তৈরি হলেও আকৃতি গোলাকার আর উপরে তারা ব্যবহার করে ছনপাতা বা বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা। বান্দাকায় শহর থেকে দূরবর্তী অন্চলে বা গ্রামে অবশ্য আমি গোলাকার আকৃতি অপেক্ষা আমাদের দেশের ন্যায় দোচালা ঘর বেশি দেখতে পেয়েছি। বান্দাকার মূল শহরে বেশীরভাগ ঘরসমূহ পাকা এবং তার মধ্যে বেশ কিছু দোতালা দালান ও রয়েছে। এই বান্দাকা শহর থেকে আশেপাশের কিছু কিছু গ্রামে গোলাকৃতি আকারে ঘরগুলো দেখতে পাওয়া যায়। যে কথা বলছিলাম ,এখানে প্রাচীনকালে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রসার লাভের আগে এখানকার বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে কোন ধর্মের প্রচলন ছিলনা । এরা এক একটি গোত্র বিভিন্ন কাল্পনিক ভুত,প্রেত বা অশুভ আত্মার আরাধনা করত। যা AFRICAN BLACK MAGIC বা কালো জাদু নামে পরিচিত ।এমনকি এখনও এই বিদ্যার গোপন অনুসারীরা তাদের এই বিদ্যা দ্বারা মানুষের ক্ষতি করে আসছে। যারা এই বিদ্যার পারাদর্শী তাদের কে আফ্রিকান ভাষায় বলে ডকি বা ওঝা আর এই বিদ্যাকে তারা আফ্রিকান ভাষায় বলে কিনডকি । আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো কংগোতে থাকাকালীন সময়ে একবার লুবুম্বাসি নামে এক শহরে কিছুদিনের জন্য দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে অবস্হান করার। সেই সুবাদে সেখানে লুবুম্বাসি মিউজিয়ামে ভ্রমনের সুযোগ হয়েছিল। এই মিউজিয়ামটি ছিলো একটি সমৃদ্ধিশালী সংগ্রহশালা। সেখানে একটি গ্যালারী বা ফ্লোর ছিল শুধুমাত্র কংগো তথা আফ্রিকান মহাদেশের কালো জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত। এখানে দেখেছিলাম কালো বা অশুভ জাদু বিদ্যায় পারাদর্শী ওঝা বা কিনডকিদের ব্যবহৃত নানাধরনের সাজসরন্জাম আর পোশাক পরিচ্ছেদ।
অনেকে নিশ্চয় দেখে থাকবেন বিদেশী সিনেমায় একজন দুষ্ট ব্যক্তি একটি পুতুলের গায়ে সুঁচ ফুঁটিয়ে অনেক দূরে অবস্হানরত এক ব্যক্তিকে হত্যা করছে। আমি এরকম বেশ কিছু ঘটনা শুনেছি এখানকার লোকমুখে অবশ্য ঘটনাকতটুকু সত্য তা আমি জানতে পারিনি। তবে এখানকার স্হানীয়রা যারা এসব বিদ্যায় পারদর্শী তাদেরকে এরা ভয় পায় এবং এড়িয়ে চলে। আফ্রিকার দেশগুলিতে গোত্রের যেমন হিসাব নেই ঠিক তেমনি ভাষার ।তার প্রধান কারন এখানে প্রত্যেকটি গোত্রের নিজস্ব ভাষা আছে যেমন লুনটুম্বা, একোন্ডা, লোকুন্ডো এবং কিমংগো। এছাড়া আছে কিছু সাধারন প্রচলিত ভাষা যেমন লিংগালা,সোহেলী আর সরকারী ভাষা হিসাবে প্রচলিত আছে ফ্রেন্চ বা ফরাসী ।কংগো দেশটি আয়তনে আমাদের দেশের তুলনায় প্রায় ১৬ গুন বড় ,প্রায় ভারতের সমান ।
ছবি : ডকিদের দ্বারা ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য আর আছে একজন ডকির বা ওঝার মূর্তি পোশাকসহ ।
এমনকি বিভিন্ন গোত্রের মানুষদের মাঝেও অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যেমন আপনারা নিশ্চয় পিগমী জাতির নাম শুনে থাকবেন। এদের একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের আকৃতি বামনের ন্যায় হয়ে থাকে এবং এদের এটা জন্মগত একটি বৈশিষ্ট্য। তবে আকার ব্যাতীত আর সব মানবিক গুনাবলীর ক্ষেত্রে এরা সাধারন মানুষের মতই । এই পিগমীদের দেখা পেয়েছিলাম একবার বান্দাকার এক জনাকীর্ণ বাজারে যদিও সেদিন তাদের দেখে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তারা হয়ত জন্মগত বেঁটে মানুষ যা আমাদের দেশেও দেখতে পাওয়া যায় । কিন্ত জর্জ মোবোয়ু আমাকে জানালো এরা আসলে পিগমী। পরবর্তীতে এই পিগমীদের নিয়ে কাজের অবসরে আমি বেশ কিছুদিন ব্যক্তিগত উৎসাহ নিয়ে পড়াশুনা করি এবং অনুসন্ধান করে এদের সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ তথ্য জানতে সক্ষম হই । সেই গল্প না হয় আরেকদিন করা যাবে।
চলবে