পটভূমিকা- বিদায় আফ্রিকা, বিদায় কংগো, বিদায় কালো মানুষের দেশ
যখন শুনলাম জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের ডাক এসেছে এবার যেতে হবে যুদ্ধপীড়িত আফ্রিকার কংগোতে, তখন থেকেই মনের কল্পনাতে কাঠ কয়লায় আঁকিবুঁকি শুরু হয়ে গেল । একদিকে প্রিয়জনদের ছেড়ে বহুদিন দুরে থাকা বেদনা অন্যদিকে হাজারো বিপদের হাতছানি । সমুদ্রে ভাসিয়েছি যখন তরী তখন কি আর আকাশ কোনে কালোমেঘ দেখে ভয় পেলে চলে? মনের শত সহস্র শংকাকে তাই অর্ধচন্দ্র দিয়ে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম।
আফ্রিকার সাথে প্রথম পরিচয় শৈশবে টিভি সিরিজ টারজানে জনি ওয়েসমুলারকে দেখে । তখন থেকেই আমার কাছে আফ্রিকা মানে গভীর বনে ভয়ন্কর সব জীবজন্তুর বাস, বনের ভেতর চোরাবালির হাতছানি অথবা মাংশাসী গাছের উপস্হিতি আর নয়তো নরখাদক কালোমানুষের আক্রমন। এই সব কিছু নিয়ে আমার কল্পনার আফ্রিকা । জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য আমরা নির্বাচিত অফিসার এবং সৈনিকরা বিভিন্ন ইউনিট হতে এসে জড়ো হতে লাগলাম ঢাকা সেনাবাহিনীর একটি ইউনিটে। সেখানে আমাদের নির্ধারিত দিন থেকে শুরু হয়ে গেল কন্গোতে যাওয়ার পূর্ব প্রস্ততি হিসেবে সে দেশের আবহাওয়া, সে দেশের ব্যবহৃত ফরাসী ভাষার দু একটা কাজ চালাবার মত শব্দ শেখা। পাশাপাশি সেখানকার আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে আমাদের নিজস্ব পেশাগত দায়িত্ব কিভাবে পালন করব তার ওপর প্রশিক্ষন শুরু হল। একইসাথে কংগোর সামাজিক পরিবেশ এবং রোগবালাই ও তার প্রতিকার সম্পর্কে আমরা সাধারন ধারনা লাভ করলাম কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে।
তারপর দেখতে দেখতে সেই মহেন্দ্রক্ষন চলে আসলো সবাইকে বিদায় জানাবার, এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেওয়ার আগে পরে নিলাম চিরপরিচিত সেই জলপাই রঙের কমব্যাট । নিজেকে যখন আরেকটু পরিপাটি ও গুছিয়ে নেয়ার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়ালাম তখন হঠাৎ মনে হল আজকের এই চিরচেনা পোশাকটা যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে । চোখ পড়ল আমার ডান হাতের আর্ম ব্যান্ডের সাথে বাংলাদেশের লালসবুজের পতাকা। আজ থেকে বিদেশের মাটিতে যেখানেই যাবো সে যত প্রতিকুল পরিবেশই হোকনা কেন আমি আমার পতাকা, আমার দেশকে ধারন করে থাকবো। একই সাথে নিজেকে মনে হল আজ থেকে আমার প্রতিটি মুহূর্তের কাজ, আমার কথা, আমার ব্যবহারে আমার আশেপাশের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছে আমি আমার দেশকে তুলে ধরবো। একদিকে ভাল লাগা অন্যদিকে এক কঠিন দায়িত্ববোধ যেন আমার কাঁধে সেই মূহূর্ত থেকে চেপে বসলো
ঘর থেকে বের হওয়ার আগে একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বাবাকে হারিয়েছি দুবছর হতে চললো। মাকে কিছুক্ষন জড়িয়ে ধরে থাকলাম , মায়ের শরীরের গন্ধ যেন ক্ষনিকের জন্য আমার শৈশবকে মনে করিয়ে দিলো। সবার সাথে দু একটা কথা বলে আমার সন্তান মালিহা আর সহধর্মিনী রুপাকে সাথে নিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে বারবার মনে পড়ছিলো কতদিন এই প্রিয় ঢাকা শহরকে দেখা হবেনা , দেখা হবেনা আমার প্রিয়মুখ গুলো। আমার সন্তান……. নাহ্ আর ভাবতে ইচ্ছে করছেনা জানালার বাইরে থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে তাকালাম সহধর্মিনীর মুখের দিকে ও আমার দিকে চেয়ে সামান্য হাসলো । আমি জানি ও এক ভীষন মানসিক শংকা আর ভীতি নিয়ে আমাকে বিদায় দিচ্ছে । রুপাকে একটু ভিতু বলেই জানতাম অথচ পরিস্থিতিতে পড়ে ও নিজেকে ঠিকই মানিয়ে নিয়েছে । শান্ত আর হাসিমুখে আমার বিদায়বেলায় সব পোশাক, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিষপত্র একে একে গুছিয়ে ব্যাগ আর লাগেজে ভরে দিয়েছে। আসলেই আমি ওকে খুব মিস করবো ।
হঠাৎ গাড়ীর হর্নে চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে এলাম বাস্তবতায় তাকিয়ে দেখলাম দূর থেকে অন্ধকার আকাশে জ্বলজ্বল করে জিয়া আন্তজার্তিক বিমানবন্দর লেখাটি নিয়ন আলোয় দেখা যাচ্ছে। এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছানোর সাথে সাথে সহজাত দায়িত্ববোধের টানে প্রয়োজনীয় সকল ধরনের আনুষ্ঠানিকতাগুলো সম্পন্ন করতে শুরু করলাম। সামরিক রীতি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তারা আমাদের দলটিকে বিদায় জানালেন। সেনাবাহিনীর ধর্মীয় শিক্ষক সকল অফিসার এবং সৈনিকদের সাথে নিয়ে আমাদের সার্বিক মংগল এবং দেশের সুনামের জন্য দোয়া করলেন। একে একে দ্রুততার সাথে সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন শেষে একসময় বিদায় ঘন্টা বেজে উঠলো। সৈনিকরা সারবেঁধে সামরিক রীতি অনুযায়ী ধীরে ধীরে রানওয়েতে দাড়িয়ে থাকা জাতিসংঘের ভাড়া করা একটি বেসরকারী থাই বিমানের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। একসময় আমার যাওয়ার পালা চলে আসলো আমি আমার দলকে সাথে নিয়ে রওয়ানা দেবার আগে সংক্ষিপ্তভাবে বিদায় নিলাম আমার সহধর্মিনীর কাছ থেকে আর আমার সন্তানের গালে শেষবারের মত চুমু দিয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম আমার দলটি নিয়ে বিমানের দিকে।
রাত তখন আনুমানিক ১১০০টা বাজে , আমরা প্রায় আনুমানিক ২৫০ জনের একটি দল ধীরে ধীরে সারি বেঁধে বিমানের পেটে প্রবেশ করছি। রানওয়েতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগে দেখা এক মুভির কথা, ভিয়েতনাম যুদ্ধের উপর এরকমই এক গভীর রাতে একদল আমেরিকান সৈন্যদের দল বেরিয়ে পড়েছিলো যুদ্ধের উদ্দেশ্য আমেরিকা ছেড়ে ভিয়েতনামের পথে । তাদের স্ত্রী আর প্রিয়জনেরা ঠিক আমাদের প্রিয়জনদের মত একবুক শংকা নিয়ে বিদায় দিয়েছিলো তাদের। আসলে কিছু কিছু মানবিক অভিব্যক্তি মনে হয় ভাষা, কাল ,পাত্র ভেদে সার্বজনীন একইরূপ । প্রিয়মুখ ,প্রিয় ঘর,আমার জন্মস্হান, আমার বাংলাদেশ কে বিদায় জানিয়ে গভীর রাতে উঠে পড়লাম উড়োজাহাজে । উড়োজাহাজটি যখন আমাদের কে নিয়ে ঢাকার রাতের আকাশ অতিক্রম করছিলো জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম, দেখলাম সারা ঢাকা শহর সোডিয়ামের আলোতে ঝলমল করছে। সারা ঢাকা তখন গভীর ঘুমে অচেতন কিন্তু এই শহরে জানি আমরা যারা এই উড়োজাহাজে রওয়ানা হয়েছি বিপদসংকুল এক দেশের উদ্দেশ্য তাদের প্রিয়জনেদের চোখে আজ আর ঘুম নেই হয়তো আগামী এক বছর তাদের চোখে পরম শান্তির নিদ্রা খুব কমই আসবে।
সেই রাত আমারও ঘুম আসেনি । উড়োজাহাজের টিভি স্ক্রিনে দেখছিলাম আমাদের কে নিয়ে উড়োজাহাজটি একে একে ভারত মহাসাগর ,আরব সাগর অতিক্রম করে আফ্রিকা মহাদেশে প্রবেশ করলো । এর মাঝে একসময় ভোর হল , অতিচেনা সূর্য আজ এক অচেনা আকাশে দেখা দিলো । রিফুয়েলিং এর জন্য আমাদের থাই বিমানটি এসে নেমেছে এক জনবিরামহীন এয়ারপোর্টে শুনলাম এটা নাকি জিবুতি নামের একটি আফ্রিকান দেশ। বিশাল এয়ারপোর্টের আশে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছেনা সকালের সোনালী রোদে দূরে টার্মিনাল ভবনটি অলস ভংগীতে দাড়িয়ে আছে যেন এখনও তার ঘুম ভাংগেনি।
ছবি : জিবুতি এয়ারপোর্ট সকালের দৃশ্য (সংগৃহীত) ।
আমাদের কে বলা হল কেউ যেন বিমান থেকে না নামে কারন এখানে একঘন্টার মধ্যে রিফুয়েলিং শেষে আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করবো উগান্ডার উদ্দেশ্যে। আমরা কজন অফিসার, সিনিয়র অফিসারদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দাড়ালাম বিমানের খোলা দরজার সামনে। সেখানে দেখি ইতিমধ্যে সিঁড়ি লাগানো হয়েছে ,এরই মধ্যে দেখি একটি বিশাল এয়ার রিফুয়েলিং এর লরী এসে তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। রিফুয়েলিং শেষে আবারও গতানুগতিক ভাবে আমরা যার যার সীটে বসে পড়লাম । যান্ত্রিক কন্ঠে স্পীকারে শোনা গেল পাইলটের সীটবেল্ট বাধার বিনীত অনুরোধ। সকালে আমরা এরই ফাঁকে হালকা নাস্তা সেরে নিয়েছিলাম। থাই বিমানটি আবার ছুটতে শুরু করলো তারপর একটা মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বাতাসে ডানা মেলে ভেসে চললো উগান্ডার উদ্দেশ্যে।
বিমানে ভেতরে সবাই যেহেতু একই সংস্থার তাই নিজেদের মাঝে শংকাকে কিছুক্ষনের জন্য ভুলে থাকার উদ্দেশ্যে আমরা গল্পগুজবে মেতে উঠলাম। প্রায় ঘ্ন্টা দুই পর আবার পাইলটের ঘোষনায় জানতে পারলাম আমরা এসে গেছি উগান্ডার এনটিবি এয়ারপোর্টে। এনটিবিতে নেমেই আমরা দ্রুত আমাদের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিলাম । এর মাঝে ঘটলো এক বিব্রতকর ঘটনা। আমি যখন ইমিগ্রেশন চেকিং এর জন্য কাউন্টারে এসে আমার হাতব্যাগ জমা দিলাম স্ক্যানিং এর জন্য। স্ক্যানিং শেষে আমাকে কাউন্টারে দায়িত্বরত একজন কৃষ্ণাংগ মহিলা জিজ্ঞেস করলেন আমি কেন হাতব্যাগে ধারালো জিনিষ বহন করছি। আমি বেশ অবাক হলাম কারন এ বিষয়ে আমরা পূর্ব থেকেই জানা ছিলো এবং সেভাবেই আমরা হাতব্যাগে কোন ধারাল জিনিষ যেমন সেভিং আইটেম বা নেইলকাটার নেইনি। আর আমি নিজে গতরাতে বাংলাদেশ থেকে রওয়ানা দেয়ার আগে শুধুমাত্র আমার পছন্দের কিছু বই ভরে নিয়েছিলাম। আমার আপত্তি শুনে মহিলা প্রায় ক্ষেপে যাওয়ার দশা , আমি দেরী না করে তড়িঘড়ি করে ব্যাগ খুলে সব ঢেলে দিলাম টেবিলের উপরে । সব বই গুলো একে একে টেবিলে উপরে পড়তে লাগলো আমিও বেশ বিজয়ীর বেশে সেই মহিলার দিকে তাকিয়ে হাসছি ঠিক এই সময় হঠাৎ দেখি ছোট্ট একটা নেইল কাটার টেবিলে পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে যেন দাঁত বের করে হাসছিলো। আমি বেশ কাচুঁমাঁচু হয়ে তাকালাম সেই মহিলার দিকে । সে আমার দিকে তার ৩২ পাটি ঝঁকঝঁকে দাঁত ( কেন জানি কৃষ্ণাংগ পুরুষ অথবা মহিলাদের দাঁত খুব ঝকঝকে সাদা দেখায়) বের করে হেসে বললো মিস্টার আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম তুমিতো আমার কথা মানলেননা আরেটু দেরী করলেই আমি তোমার জন্য সিকিউরিটি ডাকতাম। আমি বোকার মত হেসে বলললাম ম্যাম. আমার স্ত্রী আসলে আমাকে না জানিয়ে আমার ভালো করতে গিয়ে এই কর্মটি করেছে, যেটা আমার আসলেই জানা ছিলোনা। যাই হউক তাকে অনেক সরি বলে আমি নেইলকাটারটা তাকেই গিফট করে ছুট লাগালাম আমাদের শেষ বিমানটি ধরার জন্য।
অবশেষে অনেক ঝক্কিঝামেলা পার হয়ে আমাদের বাসটি রানওয়েতে দাড়ানো নির্ধারিত বিমানের সামনে এসে থামলো। এগিয়ে দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহৃত একটি ৫০ সীটের ইউক্রেনীয় বিমান। বিমানটি দুপাশের দুই ডানায় দুটো বিশাল আকৃতির প্রপেলার ইন্জিন দেখে বুঝলাম বেশ পুরোনো মডেলের। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শান্তিরক্ষীদের আনা নেয়ার জন্য জাতিসংঘ কিছু নির্ধারিত দেশের বেসামরিক বিমান ভাড়া করে। এরকমই একটি ভাড়া করা থাই বিমানে আমরা উগান্ডা পর্যন্ত এসেছি। কংগোতে গৃহযুদ্ধ চলছে বলে সেখানে সরাসরি কোন বেসামরিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ছিলো নিরাপত্তাজনিত কারনে। কংগোতে পরিচালিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য উগান্ডা মূলত লজিস্টিক বেইস বা রসদ সরবরাহের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর এই জন্য উগান্ডা বেশ মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা গ্রহন করে আসছে জাতিসংঘের কাছ থেকে। যাই হউক অবশেষে কংগোতে পৌঁছানোর শেষ বিমানে চড়ে বসলাম বেশ শংকিত হৃদয়ে। কারন ইউক্রেনীয় পাইলটদের বেশ সুনাম রয়েছে , তারা নাকি বেশী পরিমানে মদপান না করলে ভালভাবে বিমান চালনা করতে পারেন না। পরবর্তীতে এই বিষয়ে আরো অনেক ভয়ংকর মজার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো ।
অবশেষে বিমানের দরজা একসময় বন্ধ হলো দুপাশের প্রপেলার ইন্জিন চালু হওয়া মাত্র সমস্ত বিমানটি যেন জায়গায় দাড়িয়ে কাঁপতে শুরু করলো, হঠাৎ মনে হল আমার সীট থেকে শুরু করে নিয়ে পাশের সহযাত্রী এমনকি মেঝের সাথে ফিটিং করা নাট বল্টু এমনভাবে কাঁপা শুরু করলো যে ভয় পাচ্ছিলাম কখন না জানে তা ছিটকে খুলে আসবে। মনে মনে সমানে আয়তুল কুরসী পড়ছি আর ভাবছি কোথায় কংগো, এযে দেখি বিমানের কারনেই এখানে না পটল তুলি । হঠাৎ যেন মনে হল ছিটকে সীট থেকে বেরিয়ে আসবো ভাগ্য ভাল সীট বাঁধা থাকায় সে যাত্রায় রক্ষা । বিমানটা মৃত্যুযন্ত্রনায় কাটা মুরগীর মত কাপঁতে কাঁপতে হঠাৎ যেন শুন্যে ডাইভ দিলো। মনে হচ্ছিলো বিমান নয় আমি যেন মহাকাশযানে এইমাত্র মধ্যাকর্ষনের মায়া ত্যাগ করে মহাশুন্যে প্রবেশ করলাম। একসময় বিমান প্রায় ২০০০০ ফিট উঁচুতে উঠে শান্ত হয়ে আসলো আর আমরাও মানসিক প্রশান্তি আর ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে মগ্ন হলাম।
অবশেষে ইউক্রেনীয় পাইলট আমাদের কে তার মহাশুন্যযানে করে কংগোর একটি প্রদেশ কিসাংগানী নামিয়ে দিলো প্রায় দেড় ঘন্টা উড্ডয়নের পর। অবতরনের সময়ের অভিজ্ঞতা আবারো একই রকম হল । সেই ঘটনা আর নাইবা বললাম।অবশেষে যাত্রা পরিক্রমায় আফ্রিকার কংগোতে এসে পৌছাঁলাম। কিসাংগানী ,কংগোর একটি প্রদেশ এখানেও গৃহযুদ্ধের রেশ তখনও কাটেনি , শান্তি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই কিসাংগানী থেকে আমাদের মূল দল অফিসারদের নেতৃত্বে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে যার যার নিজস্ব দায়িত্বপূর্ন প্রদেশে একে একে যাওয়া শুরু করলো। প্রতিটি গন্তব্যস্থলের জন্য নির্ধারিত সময়ে এয়ারপোর্টে ছোট ছোট বিমান এসে ভিড়তে লাগলো । একে একে বিমানগুলো আমাদের ছোট ছোট দলগুলোকে কে নিয়ে বেনী, গোমা, কিভু, বুকাভু, উভিরা, কালিমি, লুবুম্বাসি এবং রাজধানী কিনশাসাতে নিয়ে যেতে লাগলো। এই কিসাংগানী এয়ারপোর্টে প্রায় ৩ ঘন্টা বিরতির পর একসময় আমাদের ডাক চলে আসলো গন্তব্যস্থল বান্দাকা।সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার দলটি নিয়ে দলনেতা হিসেবে আরেকটি ছোট বিমানে চড়ে বসলাম গন্তব্যস্থল বান্দাকা যার ইংলিশ বানান হচ্ছে MBANDAKA। ছোট্ট এই বিমানটিও একটি ইউক্রেনীয় প্রপেলার চালিত বিমান । অবশ্য এই প্রপেলার ফোবিয়া ইতিমধ্যে আমাদের সবার কেটে গেছে। তাছাড়া আমরাও উদগ্রীব ছিলাম কখন এই দীর্ঘ যাত্রা শেষে আমরা আমাদের নিজস্ব দায়িত্বপূর্ন এলাকায় ক্যাম্পে পৌঁছবো। কারন মন চাই ছিলো একটি গভীর ঘুমে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে।অবশেষে দীর্ঘ যাত্রা শেষভাগে আবারও বিমানে চড়ে রওয়ানা হলাম বান্দাকা আমাদের শেষ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। মনে মনে হাসলাম এইভেবে ছোটবেলায় আকাশে বিমান দেখে খালি ভাবতাম কবে আমিও এই বিমানে চড়তে পারবো। আজ যেন আল্লাহ আমাকে সারা জীবনের এই বিমান চড়ার আশা পূরন করে দিচ্ছে । একদিনে এতবার বিমানে উঠা আর নামার পর আর বিমান চড়ার শখ আর আগের মত অনুভূত হচ্ছেনা । যাই হোক অবশেষে ছোট বিমানটি আকাশে উড়লো আমি চেয়ে রইলাম জানালার ওপারে মেঘেদের রাজ্যে । বাংলাদেশে এখন কয়টা বাজে? সবাই কি করছে? অনেক প্রশ্ন আর আকুতি নিয়ে ক্লান্ত শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলামনা।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৪ রাত ১:৩৪