কিছু লেখালেখির অভ্যাস ছিল বলে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে অবসরের সময় কাটানোর জন্য প্রথম পরিচয় হয় এই সামহোয়্যার ইন ব্লগের সাথে। ডায়েরী লেখাটা আমার বরাবরের মত অভ্যাস ছিল। সেই ডায়েরীর পাতা থেকে সাহস করে কিছু লেখা শেয়ার করেছিলাম সেই ২০০৬/৭ সালে এবং সেই পোস্টগুলো দেখতাম বেশ সাগ্রহের সাথে ব্লগাররা অনেকই পড়তেন এবং মন্তব্য করতেন। তাদের সেই মন্তব্যর জের ধরে আমার লেখাটা অনেকদূর এগিয়েছিলো সে সময়।
সে সময় অনেকেই এই কন্গোর উপর একটা বই লেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন কিন্ত বিভিন্ন ব্যস্ততার কারনে এবং সর্বোপরি বই লেখার মত যোগ্যতা আমার আছে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ঠ সন্দিহান ছিলাম বলে বিষয়টি আর হয়ে উঠেনি। কিন্ত মনের ভেতরে ইচ্ছাটা একসময় প্রবল হয়ে উঠায় অনেক সাহস করে বই লেখার প্রাথমিক ধাপটি শেষ করে ফেললাম। জানিনা আসলে এই লেখাগুলো আপনাদের কেমন লাগবে। ইচ্ছে আছে সামনের বই মেলাতে ইনশাআল্লাহ এই লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করার । অনুরোধ করব ধারাবাহিকভাবে লেখাগুলো প্রকাশ করার সাথে সাথে আপনাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ পাবো। এই লেখাগুলো এখনও ড্রাফট আকারে প্রকাশের অপেক্ষায় আছে সেজন্য অনুরোধ রইল লেখাগুলো কোথাও শেয়ার না করা জন্য। আশা করি সকলে সাথে থাকবেন। আসুন ঘুরে আসি সেই গহীন কন্গোর অরন্যবেষ্টিত এক বিপদসংকুল পরিবেশে অজানা এক পৃথিবীকে আবিষ্কার করার জন্য।
কিছু কথা
লেখক পেশাগত জীবনে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ এক বছর আফ্রিকার কন্গো (ডিআরসি) তে অবস্থান করেন। সেই দীর্ঘ সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সেখানকার সমাজ জীবনের সাধারন মানুষের সুখ দুঃখের পাশাপাশি নিজস্ব ব্যক্তিগত অনুভূতিকে চেষ্টা করেছেন একজন ভিনদেশী হিসেবে এই ব্লগীয় পরিসরের ক্যানভাসে একেকটি অধ্যায়ে ছোট ছোট কিছু ঘটনার মাধ্যমে তুলে ধরার । প্রতিটি অধ্যায়ের ঘটনার সাথে মিল রেখে চেষ্টা করা হয়েছে সেখানকার সমাজ, সভ্যতা আর সাধারন মানুষের হাসিকান্না আর না বলা বেদনাকে তুলে ধরার। একজন সাধারন মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া আনন্দ আর বেদনার ছোট ছোট ঘটনাগুলো গল্পের মত এই কাহিনীর প্রতিটি অধ্যায়ে ছড়িয়ে আছে। এই লেখা পাঠককে নিয়ে যাবে সেই গহীন অরন্যবেষ্টিত কন্গোর বিপদসংকুল এক পরিবেশে। যেখানে একদিকে আছে অরন্যর অসাধারন সৌন্দর্যের হাতছানি অন্যদিকে ভয়ন্কর গৃহযু্দ্ধে বিধ্বস্ত জনপদের হাহাকার আর বেদনার দীর্ঘশ্বাস । কন্গোর কালোমানুষগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অসভ্য বর্বর কিন্ত তাদের মাঝেও আছে হৃদয়ের অনেক অব্যক্ত যন্ত্রনা আছে অনেক না বলা কথা । কৌশলে তাদের কে শেখানো হয়েছে বর্বরতা আর হাতে তুলে দেয়া হয়েছে মদ আর অস্ত্র অথচ তাদের হৃদয়ে আছে শিশুর সারল্যতা। আফ্রিকার গহীন অরন্যে মাথা উচুঁ করে শতবছর ধরে দাড়িয়ে থাকা মুল্যবান ব্ল্যাকউডস গাছের মত সেই কালো মানুষগুলোর হৃদয়গুলো যেন একেকটি মহামুল্যবান ব্ল্যাক উডস। সেই কালো ব্ল্যাকউডসের হৃদয়ে প্রতিনিয়ত নিঃসরিত হচ্ছে লাল শোণিত ধারা এ যেন যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়ানো অব্যক্ত বঞ্চনার নিঃশব্দ এক প্রতিচ্ছবি।
পটভূমিকা- বিদায় আফ্রিকা, বিদায় কংগো, বিদায় কালো মানুষের দেশ
ঝাপসা হয়ে আসছে জানালার কাঁচ, প্রচন্ড জোরে জেট ইন্জিনের শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে বিমানের পাখা; একটু পরেই রানওয়ে ধরে ছোটার জন্য অপেক্ষা করছে আমাদের বিমানটি । কিছুক্ষন আগে এক পশলা বৃষ্টিতে রানওয়ে ভিজে সিক্ত । তারই জলের ধারা কুয়াশা হয়ে জানালার কাঁচ ঝাপসা করে দিচ্ছে । রানওয়েতে জমে থাকা জলের ধারা কুয়াশা হয়ে জানালার কাঁচ ঝাপসা করে দিচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে বৃথা চেষ্টা করছি বাইরের কিনশাসা এয়ারপোর্টকে শেষবারের মত দেখার জন্য। আর কিছুক্ষন পর এই কংগোকে বিদায় জানিয়ে আমরা রওয়ানা হব আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের অভিমুখে। এক বছর অর্থাৎ ৩৬৫ দিন অথবা ৮৭৬০ ঘন্টার অনেক বেদনার স্মৃতি বুকে ধরে এই কংগো, এই আফ্রিকাকে বিদায় জানাবো। জানিনা আর কখনো এই কংগোতে আসা হবে কিনা, আর কখনো বান্দাকার জনাকীর্ন বাজারের খেটে খাওয়া মানুষের ভীড়ে হাঁটবো কিনা। জর্ডানের ক্যাপ্টেন মোহতাশিমের সাথে সন্ধ্যাবেলায় কংগো নদীর ধারে বসে আর কখনো কি প্রান জুড়ানো নদীর বাতাসে গা এলিয়ে গল্প করা হবে কিনা ? একে একে মনে পড়ছে কত স্মৃতি। স্মৃতির পটে ভেসে উঠছে চির পরিচেনা কত মুখ, আমার দোভাষী কংগোর বাসিন্দা জর্জ মোবোয়ু, ভারতের শেখ রিয়াজ, সিংজী, রামান যোশী, পাকিস্তানের রিজওয়ান, মরক্কোর ইমাদ আযমী, বাংলাদেশের কামরুল ভাই, সাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার পাটোয়ারী স্যার আরো অনেক নাম না জানা কত মুখের প্রতিচ্ছবি। এইসব মানুসের সান্নিধ্যে কাটিয়েছি গত একবছর । এই মানুষগুলোর সাহচার্য আমাকে পরিবার থেকে দূরে থাকার একাকীত্ব থেকে দিয়েছিলো মুক্তির স্বাদ। আজ এক বছরের অনেক মধুর স্মৃতিকে বুকে ধারন করে রওয়ানা হয়েছি বাংলাদেশের পথে। আমার মাতৃভূমি, আমার মা, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আর সন্তান আমার জন্য অপেক্ষা করছে, কতদিন তাদের দেখিনা। বাংলাদেশ কেমন আছে ? কেমন আছে আমার প্রিয় চিরচেনা পরিবেশের মানুষগুলো ?
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে কিনাশাসা এয়াপোর্টের টার্মিনাল ভবন। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বিমানটা রানওয়ের নির্ধারিত স্হান থেকে ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দৌড় শুরু করল, তারপর একটা মৃদু লাফ দিয়ে আফ্রিকান ভূমিকে শেষবারের মত স্পর্শ করে উড়াল দিলাম। চোখের কোনে কিছুটা আদ্রতা অনুভব করলাম। সৈনিকের কড়া পোশাকে এই অনুভূতিকে পশ্রয় দিলে চলেনা তাই চোখে কিছু একটা পড়েছে ভান করে চোখ থেকে আদ্রতা দূর করলাম। নিচে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে আফ্রিকার কংগোকে। ঠিক এক বছর আগে এই দেশে এসেছিলাম একবুক শংকা নিয়ে, অথচ আজ ফিরে যাওয়ার বেলায় মনে হচ্ছে রেখে যাচ্ছি আমার কত স্মৃতি।
মনে পড়লো এক বছর আগে এই কংগোতে আসার জন্য কত প্রস্তুতি আর প্রশিক্ষন নিতে হয়েছিলো। তারপর এই কংগোতে এসে শুরু হল ধীরে ধীরে আফ্রিকার নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার পালা। ধীরে ধীরে আফ্রিকাকে চিনতে শুরু করলাম। শৈশবে কল্পনায় আঁকা আফ্রিকার রুপ বদলে যেয়ে অন্য এক আফ্রিকাকে আবিষ্কার করলাম। আফ্রিকার কালো মানুষদের দুঃখ, হাসি, কান্নাগুলোকে উপলদ্ধি করতে শুরু করলাম। কাজের ফাঁকে ,অবসরে তাদের প্রাচীন ইতিহাস সংস্কৃতি , তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানলাম। তাদের মুখে শুনলাম যুগে যুগে তাদের উপর সাদা সভ্যতার অত্যাচারের কথা ,তাদের বন্চনার কথা । পশ্চিমা বিশ্বের কৌশলে আফ্রিকার উপর চাপিয়ে দেয়া গৃহযুদ্ধের কথা ।আর এই গৃহযুদ্ধের সুযোগে কিভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ চলে যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে তার কথা । লিওনার্দো ডি কাপ্রিয়িতি অভিনীত BLOOD DIAMOND মুভিটি তার এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি ।
এসেছিলাম একবুক শংকা নিয়ে । কিন্তু আজ দায়িত্ব শেষ করে ফিরে যাবার বেলায় নিয়ে যাচ্ছি এই কালোমানুষদের প্রতি ভালোবাসা আর সহমর্মিতা নিয়ে । একসময় ভেবেছিলাম হিংস্রতা এদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য । কিন্তু এদের সাথে মিশে ,কথা বলে জানার সুযোগ হয়েছে কিভাবে অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এদের কে কৌশলে হিংস্রতা শেখানো হয়েছে , লেলিয়ে দেয়া হয়েছে হিংস্র হায়েনার মত এক গোত্রকে আরেক গোত্রের উপর । এরা যখন একে অপরের সাথে হিংস্র যুদ্ধে লিপ্ত সেই ফাঁকে পাচার হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ এই আফ্রিকা থেকে । আফ্রিকার গহীন অরন্যর নিকষ কালো অন্ধকারে সেই বঞ্চনার ইতিহাস যুগ যুগ ধরে ধরে চাপা পড়ে আছে কিন্তু কে রাখে সেই খবর। এই মানবিকতার দোহাই দিয়ে উন্নত বিশ্ব আজ শোষন করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। তাই আমার কাছে মনে হয় মানবিকতা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বের এক প্রতারণার নতুন রূপ ।
এসেছিলাম ,দেখলাম ,অনেক কিছু জানলাম । শিখলাম নতুন করে অনেক পুরোনো শব্দকে । চিরচেনা মানবিক অনুভূতিগুলো আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে দ্রুত বদল হচ্ছে । বৈশ্বয়িক উষ্নতার বৃদ্ধির সাথে সাথে দেখছি কিভাবে মানুষের কোমল মানবিক অনুভূতিগুলো গলে পড়ছে তার উত্তাপে। পৃথিবীর এক নগণ্য মানুষ হিসেবে কংগোর এই বন্চিত কালোমানুষদের দেওয়ার মত আমার কিছু নাই । তাই আজ এই বিদায় বেলায় সাথে নিলাম স্মৃতির ঝুলিতে ভরে তাদের বন্চনার কথা, তাদের শোষনের কথা । আফ্রিকার গহীন অরন্যর ব্ল্যাক উডসের নিচে স্যাঁতস্যাঁতে নিকষ কালো অন্ধকারে যুগে যুগে চাপা পড়া সেই বঞ্চনার ইতিহাসকে তাই ছড়িয়ে দিলাম লেখনীর প্রতিটি শব্দ আর অক্ষরের সাথে । বিদায় বেলায় যেন আজ মনে হচ্ছে এই দেশটি যেন আমার খুব পরিচিত । কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই আমার দেশের মাটির কাছাকাছি বাস করা মানুষগুলোর সাথে । এই পৃথিবীর বঞ্চিত মানুষের চোখের ভাষা কি এক ?
পুনশ্চ:
এই লেখাটা ছিলো আমার কংগোতে শান্তিরক্ষা মিশনের শেষ যে দিন কংগোর রাজধানী কিনশাসা কে বিদায় জানাই সেদিনের শেষ কিছু অনুভুতি। আজও মনে পড়ে সেদিনের স্মৃতি যেদিন প্রথম জানতে পারলাম সরকারী আদেশে আমি কংগো যাচ্ছি।। তারপর সেই থেকে এক বিপদ সংকুল অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্যে আমার পথ চলার শুরু।
(চলবে)