১ম পর্বের পর
মক্কার কাফেলাকে বিদায় জানিয়ে সেই অত্যাচারী বেদুইন যুবক উমর ইবনে আল খাত্তাব বাড়ী ফিরে আসলো । কিন্ত কিছুতেই মন থেকে দূর করতে পারছেনা উমর কি আছে সেই সত্যর মাঝে ? যার জন্য বাপ দাদার ধর্ম ভুলে এই কাফেলার সাথে দলে দলে নতুন সেই সত্যর অনুসারীরা আজ সবকিছু ফেলে ছুটে চলেছে আবিসিনিয়ার পথে। এত অত্যাচার আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কেন তারা অটল পাহাড়ের মত সেই সত্যকে আগলে ধরে আছে? কি আছে সেই সত্যর মাঝে ? কিছুদিন আগেরই এক ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় তার।এই সত্যকে গ্রহনের জন্য সেদিন চাবুকের আঘাতে জর্জরিত করেছিলো তার এক ক্রীতদাসীকে এবং এতটাই সেদিন সে ক্ষীপ্র হয়েছিল সেই দাসীর উপর যে ক্লান্ত হয়ে হাত থেকে চাবুক খসে না পড়া পর্যন্ত সেদিন সে আঘাত করেই যাচ্ছিলো । দাসীটির ভাগ্য ভাল যে সেদিন আবু বকর নামে আরবের এক সহৃদয় ব্যক্তি তাকে নগদ অর্থে কিনে নেয় তার কাছ থেকে। কিন্ত এতসব ঘটনার পর শুধু একটি প্রশ্ন অনবরত মনে জাগছে কি আছে সেই সত্যর মাঝে?
উমর ইবনে আল খাত্তাব কুরায়শ বংশের এক সভ্রান্ত পরিবারে যার জন্ম । যদিও তার বাবা আল খাত্তাব তাকে শৈশব থেকে মেষপালনের মত কঠিন পরিশ্রমের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন অনেকটাই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। কিন্ত পরবর্তীতে উমর তার বাবার মেষপালনের পাশাপাশি তার মামা যে কিনা বানু মাখজুম গোত্রের অধিবাসী তারও মেষপালন তিনি করেছিলেন। এখনও উমর তার জীবনের এই সময়টি সবচেয়ে ভয়াবহ এক কষ্টের স্মৃতি হিসেবে মনে করেন । কিন্ত জীবনের এই কষ্টকর সময় তাকে করেছে পরিশ্রমী। মেষপালনের পাশাপাশি উমর পারাদর্শী হয়ে উঠেছিলেন নানা ধরনের খেলায় বিশেষ করে মল্লযুদ্ধে এবং ঘোড়া দৌড়ে তার সমকক্ষ আরবের সমাজে পাওয়া ছিল ভার। পরবর্তীতে যৌবনে পদার্পনের সাথে সাথে উমর ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেন এবং পেলেন আশাতীত সাফল্য অবশ্য এর পেছনে তার ছিলো নিজের অধ্যাবসায় বিশেষ করে তার জ্ঞানস্পৃহা তাকে দিয়েছিলো তৎকালীন আরবে কবির মর্যাদা । আরবের সে সময়ে জাহিলিয়াতের যুগে বড় বড় মেলা হত যেগুলো উকায নামে পরিচিত ছিলো। এই মেলায় আরবের বিভিন্ন গোত্র বিভিন্ন স্হান থেকে এসে জমায়েত হত। যুবক উমর এই সময়ে আরবের বিভিন্ন গোত্রের সাথে ব্যবসার সুযোগে মিলিত হত তখন তাদের কাছে থেকে জেনে নিত সেই গোত্রের প্রাচীন ইতিহাস আর বিভিন্ন যুদ্ধের কাহিনী। এভাবে ব্যবসায়িক কারনে বিভিন্ন গোত্রের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে উমর সে সময়ে আরবের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞানী হয়ে উঠলেন। এছাড়াও সে সময়ে বিভিন্ন গোত্রের মাঝে চল ছিলো তাদের প্রাচীন শৌর্যবীর্যের কাহিনী নিয়ে সাহিত্য রচনার । এর ফলে সেখান থেকেও উমর নিজের তথ্যভান্ডারকে করতে পেরেছিলেন অনেক সমৃদ্ধশালী । কিন্ত অনেক সময় দেখা যেত এই গীতি কাব্যে এক গোত্র অন্য গোত্রকে ধরাশায়ী করার চেষ্টা থেকে বেঁধে যেত মারাত্বক রকমের যুদ্ধ। উমরের এখন ও মনে পড়ে এই উযাকের মেলার কারনে আরবে বেঁধে গিয়েছিলো চারটি বড় যুদ্ধ যেগুলো পরিচিত ছিল " ফিজারের যুদ্ধ" নামে ।
ব্যবসায় প্রভুত উন্নতি একদিকে যেমন উমরকে স্বচ্ছল এবং ধনী হিসেবে আরবের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো অন্যদিকে তার কবিত্ব, আরব ইতিহাসের উপর তার দখল তাকে করেছিলো অতন্ত্য সুপরিচিত। অনেক কম বয়সের এই যুবক উমরকে কুরায়শ গোত্রের সর্দার প্রধানরা অনেক সম্মান করে থাকেন তার জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার জন্য। বিশেষ করে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ বাঁধার আশংকা দেখা দিলে তাকে পাঠানো হয় মিমাংসাকারী হিসেবে। কারন এই কাজে তিনি ইতিমধ্যে সাফল্য লাভ করেছেন একাধিকবার। যদিও উমরের এই সম্মান এবং সাফল্যর পেছনে ছিলো তার পূর্ব পুরুষের অবদান। বিশেষ করে তারা পিতামহ নুফায়েল ইবনে আব্দুল উজ্জা ছিলেন তার প্রজ্ঞা এবং ন্যায়বিচারের জন্য কুরায়শদের মাঝে অতন্ত্য পরিচিত ও সম্মানিত একটি নাম । উমরের আরেক পূর্বপুরুষ কাব ইবনে লুয়াইহ আরবের ইতিহাসে আরেকজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। আরবের ইতিহাসের উপর যুবক উমরের অনন্য দখল অন্যদিকে যুগযুগ ধরে গড়ে উঠা পূর্বপুরুষের সম্মান সব মিলিয়ে উমর আরবের এই ঐতিহ্যকে ভালোবাসতেন। আর এই কারনেই সে ধর্মীয় রীতিনীতি চাইতে বিষয়টিকে আরবের ঐতিহ্য হিসেবে পালন করতে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন । যখন হঠাৎ করে কুরায়শ বংশের আরেক যুবক মুহাম্মদ নতুন এক ধর্মের কথা শোনালেন যা কিনা যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠা আরবের ঐতিহ্যগত ধর্মীয় বিশ্বাসের গোড়ায় আঘাত হানলো তখন বিষয়টিকে উমর মেনে নিতে পারলেন না । আর তখন থেকেই উমর এই নতুন ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে খেঁপে উঠলেন। তাকে কাছে পেয়ে কুরায়শ সর্দার রা যেমন খুশী হয়ে উঠলেন অন্যদিকে হতাশ হল আরবের নওমুলিমের দল।
কিন্ত এতকিছুর পরও কোথায় যেন বারবার মনে খটকা লাগছে যুবক উমরের হৃদয়ে। উমর যখন ক্লান্ত আর বিষন্ন মনে ভেবে চলেছে এই সত্যর পেছনে সেই শক্তির কথা। তখন সেই আরবের একই শহর মক্কার আরেক প্রান্তে একটি খেঁজুর পাতার জীর্ন কুটিরে কয়েকজন ব্যক্তি এই উমরের সম্পর্কে আলাপ করছিলো অত্যন্ত ক্ষীনস্বরে। তারা ছিলো কজন সত্যর অনুসারী তারা নিজেদের মাঝে আলাপ করছিলো আর হতাশ হয়ে বলছিলো আজ যদি উমর আমাদের সাথে যোগ দিত, সত্যকে গ্রহন করত হয়ত আমরা আরও শক্তিশালী হতে পারতাম আর কুরায়শরাও আমাদের উপর এমন নির্বিচারে অত্যাচার করতে পারতোনা । তাদের এই হতাশায় অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে সেই জীর্ন কুটিরের মধ্যে হঠাৎ হাত তুললেন অতুজ্জল নুরের অধিকারী এক ব্যক্তি। আকাশের পানে তাকিয়ে তিনি বলে উঠলেন " হে আল্লাহ তুমি ইসলামকে সাহায্য কর এই দুই ব্যক্তির যে কোন একজনের মাধ্যমে। আবু জাহল ইবনে হিশাম অথবা উমর ইবনে আল খাত্তাব যাকে তুমি এই কাজের জন্য সবচাইতে পছন্দনীয় মনে কর।" সাথে সাথে ভাগ্য লেখা হয়ে গেল আরবের জাহিলিয়াতের যুগে চরম ইসলাম বিদ্বেষী যুবক উমরের।
(চলবে)