তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব গ্রহণ করার অর্থ হলো জীবনের সর্বাঙ্গনে ন্যায় ও সত্যের ধারক হওয়া, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। কিন্তু যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে আরব সমাজ তখন সর্বদিক দিয়ে আপাদমস্তক অন্যায় ও অসত্যের সাগরে নিমজ্জমান। সেই অন্যায়ের রাজত্বে নেতৃত্বদানকারী ধর্মব্যবসায়ীরা যখন দেখল আল্লাহর রসুল কার্যত ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্ম, বৈধ-অবৈধের মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষকে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন তখন তারা দিশেহারা ও বেপরোয়া হয়ে উঠল। প্রিয় বিশ্বস্ত মানুষটিই রাতারাতি পরম শত্রুতে পরিণত হলো। এ সময় দু’টি শ্রেণি আল্লাহর নবীর বিরোধিতায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটি হলো ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত শ্রেণি, অন্যটি কায়েমী স্বার্থবাদী নেতৃত্ব।
পূর্ববর্তী বিকৃত ধর্মকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত শ্রেণিটি। আঁকড়ে ধরে রেখেছিল তার কারণ এটা নয় যে, তারা খুব ধার্মিক ছিল। আসল কারণ হলো ওই বিকৃত ধর্মটি তাদের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শত শত বছর ধরে কোরাইশ পুরোহিতদের প্রধান সম্বল ছিল ক্বাবাঘরকেন্দ্রিক ধর্মব্যবসা। সারা আরব থেকে লোকজন মক্কায় আসত হজ্ব করতে। এই হজ্বের মৌসুমই ছিল কুরাইশদের বাণিজ্যের প্রধান মৌসুম। চারটি মাস যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ থাকার প্রধান ফসল ঘরে তুলত মূলত এরাই।
এই পুরোহিতদের প্রতি ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ছিল অগাধ বিশ্বাস। এরা যেটাকে বৈধ বলত সেটা বৈধ বলে বিবেচিত হত, এরা অবৈধ বললে অবৈধ পরিগণিত হত। যেহেতু ধরে নেওয়া হত ধর্মের ব্যাপারে এদের বিশেষ পাণ্ডিত্য আছে কাজেই তাদের কোনো ফতোয়া বা রায়কে চ্যালেঞ্জ করার অবকাশ ছিল না। অথচ কোনো ধর্মই এ ধরনের পুরোহিততন্ত্রকে সমর্থন করে না। আল্লাহ পাঠান সহজ-সরল দ্বীন, যা ব্যাখ্যা করার ও বোঝার সক্ষমতা থাকে সব মানুষের। তাই একটি শ্রেণি ধর্মের ব্যাপারে বিশেষ পাণ্ডিত্য অর্জন করবে, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধর্মের বিধি-বিধান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকবে, যে কোনো বিধান (ফতোয়া) জানার জন্য পণ্ডিত শ্রেণিটির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে, পণ্ডিতরা অর্থের বিনিময়ে মানুষকে সেই দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা দিবে এমন সিস্টেম ইসলাম সমর্থন করে না।
তবু যুগে যুগে এই পুরোহিত শ্রেণিটির জন্ম হয়েছে। একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এরা নিজেরাই নিজেদেরকে সৃষ্টি করেছে। একজন নবী নির্দিষ্ট একটি জনপদে সহজ-সরল দ্বীন প্রতিষ্ঠা করে চলে যাওয়ার সময় বারবার সতর্ক করে গেছেন দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, মতভেদ কর না ইত্যাদি। কিন্তু একটা সময় পর ঠিকই কিছু অতি উৎসাহী মানুষ দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। দ্বীনের ছোট-খাটো, খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, অতি বিশ্লেষণ শুরু করেছে। তা করতে গিয়ে স্বভাবতই মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে এবং দ্বীন সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে চলে গেছে। ফলে একদিকে ধর্মের মূলরূপটি হারিয়ে গেছে, অন্যদিকে ওই চূলচেরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণপ্রসূত দুর্বোধ্য বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে প্রয়োগ করার জন্য আলাদা একদল পণ্ডিতের দরকার পড়েছে। এই হলো পুরোহিত শ্রেণী এবং এমনি করেই প্রতিটি জীবন-বিধান, প্রতি ধর্মে এরা নিজেরা নিজেদের সৃষ্টি করেছেন এবং দ্বীনের মুল লক্ষ্যই বিনষ্ট হয়ে গেছে। জাতির জনসাধারণ অতি প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য ভুলে যেয়ে পুরোহিতদের কাছে প্রক্রিয়ার ছোট খাট ব্যাপারগুলি সম্বন্ধে বিধান (ফতোয়া) জানতে চেয়েছে আর পুরোহিতরা অতি উৎসাহে নতুন নতুন দুর্বোধ্য বিধান তৈরি করেছেন আর তা তাদের দিয়েছেন। বিশ্বনবী যখন জাতিকে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যের ডাক দিলেন এবং পূর্ববর্তী ধর্মের বিকৃতিগুলোকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরতে লাগলেন তখন সরাসরি এই শ্রেণিটির স্বার্থে আঘাত লাগল। দুইটি কারণে তারা সর্বাত্মকভাবে আল্লাহর রসুলের আন্দোলনকে স্তিমিত করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল। প্রথমত, ইজ্জত-সম্মান হারানোর ভয়। দ্বিতীয়ত, সুযোগ-সুবিধা তথা স্বার্থহানির ভয়।
এই শ্রেণিটি জানত রসুলের সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী, ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে খুব একটা সুবিধা করা যাবে না। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাদেরই পরাজয় হবে, তাদের বক্তব্য জনগণের কাছে গৃহীত হবে না। কারণ আল্লাহর রসুল ইতোমধ্যেই মক্কার আলামিন, আস সাদিক-এ পরিণত হয়েছিলেন। তাই তারা অন্য লাইনে হাঁটল। প্রথমে রসুলের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলল। লোকজনকে বলে বেড়াতে লাগল- আমরা এত জ্ঞানী ও সম্পদশালী মানুষ থাকতে আল্লাহ কিনা নবুয়্যত দান করলেন আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদকে (সা.), যে কিনা লিখতে-পড়তে পর্যন্ত জানে না? এছাড়া তারা সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের মধ্যে আল্লাহর রসুল সম্পর্কে সম্পূর্ণ মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে দিল যে, মোহাম্মদ (সা.) আমাদের ধর্ম ত্যাগ করে ধর্মদ্রোহী হয়ে গেছেন। অথচ রসুল (সা.) কখনই বলেন নি যে তিনি তাদের ধর্মকে অস্বীকার করছেন বা আগের ধর্মকে ত্যাগ করছেন। তিনি কার্যত ইব্রাহীম (আ.) এর আনিত দ্বীনুল হানিফের দিকেই মানুষকে আহ্বান করছিলেন। এ সত্যটি পাছে মানুষ বুঝে যায় সে ভয়ে ক্বাবার হর্তাকর্তা কুরাইশ ধর্মব্যবসায়ীরা পথেঘাটে, হাট-বাজারে, জনসমাগপূর্ণ স্থানে এবং দূর দূরান্ত থেকে আসা হজ্ব কাফেলাগুলোতে গিয়ে রসুলাল্লাহর ব্যাপারে ভয় দেখাত যে, তাঁর কথা তোমরা শুনবে না, মোহাম্মদ (সা.) যাদু জানেন, একবার তাঁর খপ্পরে পড়লে কিন্তু তোমাদের ঈমান থাকবে না, ধর্ম থাকবে না ইত্যাদি। পাগল, জীন-ভূতে আছরগ্রস্ত ইত্যাদি অপপ্রচার তো সব সময়ই চলত।
ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিতরা কেবল আখেরী নবীর ক্ষেত্রেই বিরোধিতা করেছে তা নয়, বস্তুত পূর্বের বিকৃত ধর্মের ধ্বজাধারী পুরোহিতরা বরাবরই নতুন নবীর বিরোধিতা করে এসেছে। যেমন ঈসা (আ.) এর বিরোধিতায় সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তৎকালীন ইহুদি পুরোহিতরা, যাদেরকে বলা হত রাব্বাই, সাদ্দুসাই ইত্যাদি। সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে বর্ণিত হয়েছে-
“ঈসা (আ.) এর প্রচারে ও অলৌকিক কর্মে তাঁহার প্রতি জনগণের আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা দেখিয়া ইয়াহুদি পণ্ডিত (Doctors of Low) এবং পুরোহিতগণ শংকিত হইল। তিনি তাহাদিগকে জনসমক্ষে কপট (Hypocrite), দুশ্চরিত্র, ধর্মব্যবসায়ী ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত করিতেন বলিয়া তাহারা ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল।”
নবী-রসুলদের বিরুদ্ধে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটির এই ঐতিহাসিক বৈরিতার মূল কারণ আর কিছু নয়, ‘জ্ঞানের অহংকার এবং বৈষয়িক স্বার্থ’।
যাহোক, একদিকে এই শ্রেণিটি রসুলাল্লাহর বিরুদ্ধে তাদের স্বভাবজাত অপপ্রচার অব্যাহত রাখল, অন্যদিকে রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃত্বটি ভাবল, মানুষ যদি মোহাম্মদের (সা.) কথা গ্রহণ করে নেয়, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ায় তাহলে তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের যে কায়েমী সুবিধা তারা ভোগ করে যাচ্ছে তা আর টিকবে না। মোহাম্মদ (সা.) যদিও দাবি করছেন তিনি একজন সতর্ককারী মাত্র (রা’দ: ০৭), নেতৃত্বের লালসা তাঁর নেই, কিন্ত তিনি যে কথা প্রচার করছেন তা যদি মানুষ গ্রহণ করে তবে আমাদের ক্ষমতা এমনিতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। ফলে কমন ইন্টারেস্টের ভিত্তিতে ঈসা (আ.) এর বিরুদ্ধে রোমান শাসক ও ইহুদি ধর্মব্যবসায়ী রাব্বাই-সাদ্দুসাইরা যেভাবে একাট্টা হয়েছিল বিশ্বনবীর বিরুদ্ধেও মক্কার ধর্মব্যবসায়ী ও গোত্রপতিরা সেভাবে হাত মিলাল। কিন্তু ঈসা (আ.) এর বিরুদ্ধে ইহুদি পুরোহিতরা সফল হলেও আখেরী নবীর বেলায় সেটা সম্ভব হল না। এখানে আল্লাহর পরিকল্পনার কাছে ধরা খেল সবাই। ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটির সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে কীভাবে আল্লাহ তাঁর হাবিবকে ও দ্বীনুল হক্বকে রক্ষা করলেন তা ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন, সে ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে লেখার পরিসর অনেক বড় হয়ে যাবে। আমি সীমাবদ্ধ থাকব কেবল ওই প্রতিকূল পরিবেশে আল্লাহর রসুল কী কর্মসূচি হাতে নিলেন সে আলোচনায়। (চলবে . . .)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৪:২৬