সামাজিক জীব হিসেবে মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হয়। আর সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে গেলে সবার আগে যেটা প্রয়োজন হয় তা হচ্ছে এমন একটি মানদণ্ড, যা মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ চিনিয়ে দেবে। যেমন ধরুন- সুদ। সুদের লেনদেন করা ন্যায় নাকি অন্যায়? কেয়ামত পর্যন্ত এ প্রশ্নের সুরাহা হবে না যদি চূড়ান্ত ফয়সালা দেওয়ার কেউ না থাকে। কারণ ব্যক্তিগতভাবে সুদকে কেউ বলবে ন্যায় কেউ বলবে অন্যায়। কিন্তু সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে গেলে যার যেমন ইচ্ছা বললে তো হবে না। এখানেই দরকার পড়ে একটি সর্বজনবিদিত মানদণ্ডের। ওই মানদণ্ডের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে একটি সিস্টেম, যা দিয়ে ওই জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, বিচারিক জীবন পরিচালিত হবে।
এই যে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডের কথা বলা হলো, এই মানদণ্ড হতে পারে দুই ধরনের।
১। আল্লাহর দেওয়া মানদণ্ড।
২। মানুষের নিজের তৈরি করে নেওয়া মানদণ্ড।
মানুষ যদি সিদ্ধান্ত নেয় তারা আল্লাহর দেওয়া মানদণ্ড অনুযায়ী চলবে তবে তারা তওহীদে প্রবেশ করল। আর যদি নিজেরাই নিজেদের চলার পথ তৈরি করতে উদ্যত হয় তবে তওহীদ প্রত্যাখ্যান করল। আল্লাহর দেওয়া মানদণ্ড অর্থাৎ তওহীদ গ্রহণ করার অর্থ হেদায়াত লাভ করা, সঠিক পথনির্দেশ (Right Direction) পাওয়া। অন্যদিকে যারা তওহীদ গ্রহণ করল না তারা গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট হলো। যেহেতু সিদ্ধান্ত মোটের উপরে দু’টি (তওহীদ গ্রহণ ও বর্জন), পথও দু’টি (হেদায়াহ ও গোমরাহী), সেহেতু আল্লাহ মানুষের পরিণতিও রেখেছেন দুই ধরনের (জান্নাত ও জাহান্নাম)। যারা হেদায়াতে বা সঠিক পথে থাকবে তারা পৃথিবীতে শান্তিতে থাকবে আর পরকালে পাবে জান্নাত। এটা একটা পরিণতি। অন্যদিকে যারা হেদায়াতে থাকবে না, নিজেরাই নিজেদের চলার পথ তৈরি করে নেওয়ার স্পর্ধা দেখাবে তারা তাদের কৃতকর্মবশত পৃথিবীতে অন্যায়, অশান্তি, রক্তপাতে নিমজ্জিত হবে, আর পরকালে তাদের জন্য থাকবে জাহান্নাম।
সুতরাং বোঝা গেল জান্নাতে যাবার একমাত্র শর্ত হচ্ছে তওহীদে ঈমান আনা অর্থাৎ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই- এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। খুব সোজা একটি বিষয়। জীবনের যে অঙ্গনে আল্লাহর কোনো কথা আছে সেখানে আর কারোটা মানব না অর্থাৎ সমস্ত অন্যায়ের বিপক্ষে ন্যায়ের পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ। জীবন গেলেও অন্যায়ের সাথে আপস না করা, সত্য ও ন্যায় ত্যাগ না করা। ব্যস, তা করতে পারলেই ফলাফল হিসেবে পৃথিবীতে পাওয়া যাবে শান্তি আর পরকালে জান্নাত। মানুষের মূল পরীক্ষা কিন্তু এখানেই। ইবলিশ তার সমস্ত সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে চেষ্টা চালায় আর কিছু নয় মানুষকে এই হেদায়াহ থেকে বিচ্যুত করতে (বাকারা ৩৬, নিসা ১১৯)। অন্যদিকে আল্লাহ যুগে যুগে প্রত্যেক জনপদে নবী-রসুল পাঠিয়েছেন মানুষকে এই হেদায়াহর সন্ধান দিতে (বাকারা ৩৮, নাহল ৩৬)। এই যে আপাতদৃষ্টিতে আল্লাহ ও ইবলিশ তথা সত্য-মিথ্যার লড়াই, এ লড়ায়ে মানুষের ভূমিকা কী হবে? এর উত্তরে আল্লাহর রসুল বলেছেন, “মানুষের সাথে আল্লাহর চুক্তি (Contact) হলো মানুষ আল্লাহ ছাড়া আর কারও হুকুম মানবে না (ন্যায় ও সত্যের ধারক হবে), আর আল্লাহর পক্ষ থেকে চুক্তি (Contact) হলো আল্লাহ বান্দার সমস্ত ভুল-ত্রুটি, গুনাহখাতা ক্ষমা করে জান্নাতে দাখিল করবেন।
এই হলো হেদায়াহ, সেরাতুল মোস্তাকীম বা সহজ-সরল পথ। এ কারণে ইসলাম নামক ঘরের ভিত্তি হলো তওহীদ। জান্নাতের চাবিও কেবল তওহীদ (মুয়াজ বিন জাবাল থেকে আহমদ, মেশকাত)।
বিশ্বনবীর আগমনের উদ্দেশ্য:
আদম (আ.) থেকে শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত আল্লাহ এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বা মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসুল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন জনপদে আগত নবীদের দায়িত্ব ছিল সীমিত। নির্দিষ্ট এলাকা ও নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ। কিন্তু শেষ নবী মোহাম্মদ (সা.) এসেছেন সমস্ত মানবজাতির জন্য। এ কারণে তিনি রহমাতাল্লিল আলামিন, সারা জাহানের রহমত। তাঁর আনিত কিতাবও কোনো নির্দিষ্ট এলাকা ও নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়, সর্বকালে সমস্ত বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষের জন্য এই কিতাব সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রশ্ন উঠতে পারে- একটি বিশেষ সময়ের বিশেষ বিশেষ প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ গ্রন্থ কীভাবে সকল যুগের সকল প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য হবে? আসলে কোর’আন এমন এক গ্রন্থ যা প্রাকৃতিক সত্যে পরিপূর্ণ। যে সত্য সময় ও স্থানের সাপেক্ষে আবেদন হারায় না। উদাহরণস্বরূপ আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বে, এটা প্রাকৃতিক সত্য। লক্ষ বছর আগে হাত দিলেও হাত পুড়ত, লক্ষ বছর পরও পুড়বে। ইউরোপের মানুষ হাত দিলেও পুড়বে, এশিয়ার মানুষ হাত দিলেও পুড়বে। প্রাকৃতিক সত্য এরকমই। কোর’আন এমনই প্রাকৃতিক সত্যের আধার। মরু অঞ্চল-মেরু অঞ্চল, উষ্ণ অঞ্চল-শীতল অঞ্চল, পাহাড়ী অঞ্চল-সমতল অঞ্চল- কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর যে প্রান্তেই সে সত্যকে প্রয়োগ করা হবে সেখানেই অনিবার্যভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে। এ কারণে ইসলামের শেষ সংস্করণ এসে যাবার সাথে সাথে ধারণাগতভাবে সমস্ত মানবজাতি হচ্ছে এক জাতি। বস্তুত ন্যায় ও সত্যের পক্ষে সমস্ত মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করাই রসুল আগমনের উদ্দেশ্য।
আল্লাহ বলেন- হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক মর্যাদাবান যে মুত্তাকি। (সুরা হুজরাত ১৩) এ থেকে বোঝা যায় আল্লাহর কাছে মানুষে মানুষে জাতি-গোত্র-ভাষা-বর্ণের ভিত্তিতে কোনো ভেদাভেদ নেই। তাঁর কাছে সে তত মর্যাদাবান যে যত তাকওয়াবান বা ন্যায়ের পক্ষাবলম্বনকারী।
রসুল (সা.) এর আগমনের প্রেক্ষাপট:
ইসলামের চূড়ান্ত সংস্করণ নিয়ে আখেরী নবী, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় পৃথিবীতে এলেন, যে সময়কে আমরা বলি আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অজ্ঞানতার যুগ। আমাদেরকে প্রথমেই জানতে হবে ওই যুগকে অজ্ঞানতার যুগ বলার কারণ কী? এমন তো নয় যে সে যুগের মানুষ সম্পূর্ণ ধর্মবিমুখ হয়ে গিয়েছিল, আল্লাহ বিশ্বাস করত না। তা নয়। তৎকালীন আরবরা ধর্মকর্মে কারও চেয়ে পিছিয়ে ছিল না। তারা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করত, ক্বাবা তাওয়াফ করত, নামাজ পড়ত, রমজান মাসে রোজা রাখত, দান-খয়রাত করত, মানত করত, খাৎনা করত এবং নিজেদেরকে মিল্লাতে ইবরাহীম বলে দাবি করত। অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে ধর্মকর্ম বলতে যা বোঝানো হয় তা ওই সমাজেও ছিল। তাহলে জাহেলিয়াতটা কী?
আসলে অত ধর্মকর্ম থাকার পরও ওই যুগকে জাহেলিয়াতের যুগ বলার কারণ তারা ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করত না। অন্যায়, অবিচার, হানাহানি, রক্তপাত, শত্রুতা, জিঘাংসা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভরা ছিল তাদের সমাজ। সেখানে চলত ‘Might is Right’ এর শাসন। শক্তি যার হাতে, ক্ষমতা যার হাতে, তার কথাই ন্যায় বলে সাব্যস্ত হত। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, শৃঙ্খলাবোধ, আনুগত্যবোধের কোনো বালাই ছিল না। কৃষি বা ব্যবসা উভয়ক্ষেত্রেই তারা ছিল অনগ্রসর। অভাব, দারিদ্র, অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর বর্বরতার দরুন তৎকালীন পৃথিবীতে তারা গণ্য হত সর্বাধিক উপেক্ষিত, অবজ্ঞাত ও মর্যাদাহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে। সভ্য জাতিগুলো তাদেরকে দেখত অবহেলা ও ঘৃণার দৃষ্টিতে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৬