“কোনো ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলে তাকে হত্যা করা কি ইসলামের বিধান?” - ইসলাম বিশেষজ্ঞ ও মুফতি সাহেবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি এ প্রশ্নটি ফেসবুকে করেছিলাম। তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পেছনেও একটি ঘটনা আছে। তা হলো- ঐ দিন দুপুরে আমি একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইসলামের উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা ও মিথ্যা ফতোয়া দিয়ে কীভাবে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে অপব্যবহার করা হয়েছে সেটা বলার চেষ্টা করি। আমাকে ইসলামের কথা বলতে শুনে সেই জনপ্রতিনিধি রেগে আগুন। তিনি বলেন, “আপনি ইসলামের কথা বলার কে? আপনি কি মুফতি? ইসলামের কথা বলবেন মুফতিরা।” তার অগ্নিমূর্তি দেখে বুঝলাম, আমি কী কথা বলছি, কোর’আনের কথা বলছি না নিজের বানানো কথা বলছি সেটা তিনি বিবেচনাও করতে নারাজ। একজন শিক্ষিত সচেতন সমাজনেতা যদি ধর্মীয় বিষয়ে এমন অন্ধ, বিচারবোধহীন ও যুক্তিহীন হতে পারেন তাহলে দেশের আপামর ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বার বার ধর্মের নামে অধর্ম করা হবে এতে আর আশ্চর্যের কী? মানুষের ইতিহাসে অধিকাংশ অধর্ম তো ধর্মের নামেই করা হয়েছে।
যাই হোক ফেসবুকে একটি কমেন্ট আসলো, “মুসলিম সমাজ যদি সিদ্ধান্ত নেয় তবে আপনাদেরকে কতল করা অত্যন্ত হালাল।” কারা এই ‘মুসলিম সমাজ’ এ প্রশ্নটি আর করলাম না। তাকে প্রশ্ন করা হয় যে, “এ আইন আপনি কোথায় পেলেন? ব্যক্তিগতভাবে কোনো মানুষকে মারা তো কখনো বৈধ হতে পারে না। কেউ অপরাধ করলে সেটার বিচার রাষ্ট্র করবে। আমরা রসুলের জীবনীতে দেখতে পাই যতদিন রসুল রাষ্ট্রশক্তি পান নাই ততদিন তিনি কাউকে দণ্ডও দেন নাই।”
এর জবাবে তিনি বলেন, “এই আইন উলুমুল ফিকাহ থেকে প্রাপ্ত। উমর (রা.) এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল আপনি ইতিহাসে পান নি? তবে কথা হলো, এদেশ তো ধর্মনিরপেক্ষ। তাই আমাদের ধর্মের বিকৃতির বিচার আমাদেরই করতে হয়। এখানে রাষ্ট্রের নাক গলানোর কোনো সুযোগ নেই, কারণ রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ।”
উলুমুল ফিকাহ মোতাবেক এই সিদ্ধান্তে তিনি এসেছেন যে, কেউ যদি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে তাহলে তাকে হত্যা করে ফেলা ‘অত্যন্ত হালাল’ হবে এবং সেটার বাস্তবায়ন ব্যক্তিগতভাবেই করা যাবে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থাকে তিনি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করছেন। এই লেখাটি চলমান থাকা অবস্থায় খবর পেলাম কুড়িগ্রামে একজন ধর্মান্তরিত নির্বিরোধী খ্রিষ্টান মুক্তিযোদ্ধাকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করার সময় খুনীরা “আল্লাহু আকবার” বলে তাকবির দিচ্ছিল। ইতোপূর্বে ভিন্ন ধর্মের ও ভিন্ন মাজহাবের অনেকেই এভাবে নিহত হয়েছেন, ইসলাম বিদ্বেষী লেখালিখি করার অভিযোগেও অনেককেই প্রাণ হারাতে হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডকে ফেসবুকে কমেন্টকারী ভদ্রলোকের মতো অনেকেই ইসলাম-সম্মত বলে মনে করেন। তাই এ বিষয়ে লেখাটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করছি। কেননা ইসলামের দলিলগুলো ঘাটলে এর ব্যতিক্রমী এমনকি বিপরীতমুখী তথ্যও দেখতে পাওয়া যায়। তাই ইসলামী শরিয়তের বিশেষজ্ঞদের এ বিষয়ে ভাবনা চিন্তার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করছি।
ওমর (রা.) কর্তৃক মোনাফেক হত্যার অপব্যাখ্যা
এখানে ওমর (রা.) কর্তৃক এক ব্যক্তিকে হত্যার প্রসঙ্গটি এসেছে। যদিও ইবনে হাজার আসকালানি, ইবনে কাসীরের মতো মোফাসসির মোহাদ্দিসগণ এই ঘটনাকে “প্রামাণ্য নয়” বলেছেন। এটি বদর যুদ্ধের আগের ঘটনা, ইসলামের বিধিবিধান তখনও সেভাবে নাজেল হয় নি। একজন ইহুদি ও একজন আনসার মুনাফেক তাদের একটি বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য কার কাছে যাবে তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে। ইহুদি চায় রসুলাল্লাহর দরবারে যেতে, কিন্তু মোনাফেকটি মনে করে সেক্ষেত্রে রায় তার প্রতিকূলে যাবে। তারা এক ইহুদি গোত্রপ্রধানের কাছে যায়। কিন্তু তার রায়ে মোনাফেকটি সন্তুষ্ট হতে পারে না। এরপর সে ইহুদি কবি কা’ব বিন আশরাফের কাছে গিয়ে মকদ্দমা পেশ করতে চায়। কিন্তু ইহুদির পিড়াপিড়িতে এক পর্যায়ে তারা রসুলাল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয়। রসুলাল্লাহর (সা.) দেওয়া ফায়সালা সেই আনসারের মনঃপুত হয় না। সে রায় পুনর্বিবেচনা করার আবেদন নিয়ে ওমরের (রা.) কাছে যায়।
ওমর (রা.) ঐ মোনাফেককে জিজ্ঞাসা করেন যে, “অর্থাৎ তুমি রসুলাল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নও এবং আমাকে বলছ তাঁর সিদ্ধান্তকে উল্টে দেওয়ার জন্য?” আনসার লোকটি বলল, “ঠিক তাই।” ওমর (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি মুসলিম?” লোকটি জবাব দিল, “জ্বি আমি মুসলিম।”
তখন ওমর (রা.) বলেন, “আমি শিগগিরই তোমাকে এমন ফায়সালা দিচ্ছি যা তোমাকে সন্তুষ্ট করবে।” তিনি ঘরের ভিতরে গিয়ে একটি তলোয়ার নিয়ে আসেন এবং লোকটিকে হত্যা করে ফেলেন। (Hadrat Abu Bakr, Umar, Usman, Ali (ra) 4 Vol. Set - প্রফেসর মাসুল আল হাসান, পাকিস্তান)
ঘটনাটি শুনে আল্লাহর রসুল নীরব হয়ে যান এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। অতঃপর আল্লাহ সুরা নিসার ৬১-৬৩ নম্বর আয়াত নাজেল করেন। তিনি বলেন, যখন আপনি তাদেরকে বলবেন, আল্লাহর নির্দেশের দিকে এসো-যা তিনি রসুলের প্রতি নাযিল করেছেন, তখন আপনি মুনাফেকদিগকে দেখবেন, ওরা আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আপতিত হয়, তবে তাতে কি হল!
অতঃপর তারা আপনার কাছে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে খেয়ে ফিরে আসবে যে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কেও আল্লাহ তা’আলা অবগত। অতএব, আপনি ওদেরকে উপেক্ষা করুন এবং ওদেরকে সদুপদেশ দিয়ে এমন কোন কথা বলুন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। [সুরা নিসা: ৬৩]
আল্লাহর রসুল বর্তমান থাকা অবস্থায় ওমর (রা.) ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যে কাজটি করলেন তাকে ভিত্তি করে যে কাউকে মোনাফেক বা মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে হত্যা করে ফেলার মতো গুরুতর বিধান জারি করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? লক্ষ্যণীয় যে, ওমর (রা.) রসুলাল্লাহর অনুমতি বা নির্দেশে কাজটি করেন নি। পরবর্তীতে বহুবার তিনি মুনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন, কিন্তু রসুলাল্লাহ তাঁকে নিবৃত করেছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাদেরকে হত্যা না করে উপেক্ষা করতে এবং সদুপদেশ দিয়ে এমন কথা বলতে নির্দেশ দিচ্ছেন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। কোনো ব্যক্তির নিজেকে মুসলিম দাবি করা সত্ত্বেও তাকে হত্যা করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আমাদের দেশে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শাসনকাঠামো রয়েছে এটা বাস্তবতা। তাকে পাশ কাটিয়ে আরেকটি বিচারব্যবস্থা সমান্তরালভাবে পরিচালনা করা কোনো আইনেই বৈধ হয় না, রসুলাল্লাহর সুন্নাহ মোতাবেকও সঠিক হয় না। ইসলামের মূল যে উদ্দেশ্য ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ - এই সমান্তরাল ফতোয়া কার্যকরের দ্বারা সেই শান্তিও আসবে না। অর্থাৎ কাজটি অর্থহীন হবে। যখন রসুলাল্লাহ রাষ্ট্রশক্তি পান নি, মক্কায় ছিলেন তখন কি মুসলিমরা অত্যাচারী, রসুলকে গালিগালাজকারী কাফেরদের কাউকে হত্যা করেছিলেন? আজ যেমন ধর্মীয় আন্দোলনের নামে পেট্রল বোমা ছুঁড়ে নির্দোষ নারী-পুরুষ-শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় সেভাবে তিনি কি কাউকে পুড়িয়ে মেরেছিলেন? দোকানপাট রাস্তাঘাট ভাঙচুর করে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন? না, এমন একটা ঘটনারও উদাহরণ কেউ দেখাতে পারবেন না।
রসুলাল্লাহর সুন্নাহ অনুসরণ করলে প্রথমে তাদের উচিত রসুল যেভাবে আল্লাহর হুকুম মানার সুফল, অমান্য করার কুফল, সত্য - মিথ্যার পার্থক্য, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ত্রুটিগুলো অর্থাৎ নিজের আদর্শকে প্রকাশ্যে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে মদীনায় জনসমর্থন অর্জন করেছিলেন, সেভাবে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসমর্থন সৃষ্টি করা। সেই ভিত্তিতে রাষ্ট্রশক্তি পেলে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য দূর করা, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তা না করে, বৃহত্তর জনগণকে অন্ধকারে রেখে গুপ্তহত্যা করে ভীতি ও ত্রাসের দ্বারা যে ব্যবস্থা তারা ‘শরিয়ত’ প্রতিষ্ঠার নামে করতে চান সেটা কতটুকু কোর’আন-সুন্নাহসম্মত সেটা বিজ্ঞ আলেমগণ রায় দেবেন।
ফতোয়া যেন কোর’আন ও রসুলাল্লাহর নীতিকে লঙ্ঘন না করে
বর্তমানে কাফের মুরতাদ আখ্যা দিয়ে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে আইএস শাসিত এলাকায়, তালেবান অধ্যুষিত এলাকায় এবং এশিয়া আফ্রিকার যেসব দেশে ‘শরিয়াহ আদালত’ রয়েছে সবখানে। আমাদের দেশেও যারা ‘শরিয়ত’ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘জেহাদ’ বা রাজনীতি করছে তারাও সেই জবরদস্তিমূলক মোল্লাতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করতে চায় যার চিন্তাধারা, আকীদা অনেক ক্ষেত্রেই কোর’আনে ও রসুলের সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আর কে মুসলিম, কে কাফের, কোনটা ইসলাম, কোনটা অনৈসলামিক তা সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার তাদেরকে কে দান করেছে? তাদের উলুমুল ফেকাহতে যেটা বলা হবে সেটা ইসলাম নাকি কোর’আন হাদীসে, রসুলের জীবনে যে ঘটনা ঘটেছে সেগুলো ইসলাম? এই সিদ্ধান্ত এখন মুসলিম জাতিকে গ্রহণ করতে হবে। যদি আমরা ঐ মাদ্রাসাশিক্ষিত মুফতি, আল্লামা সাহেবদের কথাকেই ইসলাম বলে মনে করি, যদি কোর’আন হাদীসের বিরুদ্ধেও তারা কোনো ফতোয়া দেন আর সেটাকেই শিরোধার্য মনে করি তাহলে তাদের অনুসারীরা পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। কারণ আল্লাহর রসুল বিদায় হজ্বের ভাষণে বলে গেছেন, “দুটো বস্তু আমি রেখে যাচ্ছি যা তোমরা আকড়ে ধরে রাখলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। সে বস্তুদুটো হচ্ছে আল্লাহর কেতাব আর আমার সুন্নাহ।”
রসুলাল্লাহ আরো বলে গেছেন, “কোনো বিষয়ে যদি আমার বক্তব্যের সঙ্গে কোর’আনের অমিল দেখ তাহলে কোর’আনকে গ্রহণ করবে।” আর যে বিষয় কোর’আনে আছে সে বিষয়ে ইজমা-কিয়াস করাই ধৃষ্টতা।
মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কিনা?
বিশিষ্ট ইসলামি শরিয়াহ গবেষক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসান মাহমুদের “শরিয়ত কী বলে - আমরা কী করি” গ্রন্থে তার একটি মন্তব্য দিয়ে শুরু করছি। তিনি লিখেছেন, “ইসলাম কোন ইঁদুর-মারা কল নয় যে এতে ঢোকা যাবে কিন্তু বেরুনো যাবে না।”
মুরতাদ তাকে বলা হয় যে আগে মুসলমান ছিল কিন্তু এখন ইসলাম ছেড়ে দিয়েছে। মুরতাদ শব্দটির মূল হচ্ছে ‘রাদ্’। এর সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলো যেমন ইরতাদা, রিদ্দা এবং মুরতাদ সবই হল স্বকর্ম। নিজে থেকে না বললে বা না করলে বাইরে থেকে কেউ কাউকে স্বকর্ম করাতে পারে না। যেমন আত্মহত্যা। আত্মহত্যা যে করে সে-ই করতে পারে, অন্যেরা খুন করতে পারে কিন্তু কাউকে আত্মহত্যা করতে পারে না। ঠিক তেমনি মুরতাদও নিজে ঘোষণা করতে হয়, অন্য কেউ করিয়ে দিতে পারে না। মুরতাদের ওপরে কোরানে কোথাও কোন পার্থিব দণ্ড নেই বরং এর ভেতরে মানুষের নাক গলানো নিষেধ করা আছে। আল্লাহ বলেছেন তিনি নিজেই তাকে শাস্তি দেবেন।
ইউরোপিয়ান ফতোয়া ও গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য বিশ্ব-বিখ্যাত শরিয়া সমর্থক ড. জামাল বাদাওয়ীও এ কথাটি বলেছেন যে, “কোরা’আনের কোন আয়াতেই মুরতাদের দুনিয়ায় শাস্তির বিধান নাই। কোর’আন বলে, এই শাস্তি শুধুমাত্র পরকালেই হইবে” (ফতোয়া কাউন্সিলের ওয়েবসাইট)।
সুরা নিসার ৯৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “যে তোমাকে সালাম করে তাকে বলো না যে, তুমি মুসলমান নও।” আরো দেখুন সুরা ইমরান ৮২, ৮৬, ১০৬, সুরা নাহল ১০৬, সুরা মুনাফিকুন ৩, সুরা তওবা ৬৬ ও ৭৪ ইত্যাদি। এ আয়াতগুলোতেও আল্লাহ বলেছেন যারা তাঁর দীন থেকে ফিরে যাবে তাদেরকে তিনিই শাস্তি দিবেন, তাদের হিসাব নিকাশ তিনি নিবেন। মানুষকে কোনো শাস্তি দিতে বলেন নি।
অনেকে মনে করেন মুরতাদদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা বিধিসম্মত। এর পক্ষে সাধারণত সুরা বাকারার ২১৭ নম্বর আয়াতটি উল্লেখ করা হয়। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো আগুনের অধিবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে।”
স্পষ্টতই এখানে মুরতাদকে আখেরাতে জাহান্নামবাসী হওয়ার কথা বলা হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে মারার পার্থিব দণ্ডবিধি প্রদান করা হয় নি। জীবন্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার তো প্রশ্নই আসে না। রসুলাল্লাহ কোনো মানুষ, জীবজন্তু বা কোনো ফলদ গাছপালাকে আগুনে পোড়াতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আগুন দ্বারা কেবল আল্লাহই শাস্তি দিবেন। আল্লাহ ছাড়া আর কারো আগুন দ্বারা শাস্তি দেওয়ার অধিকার নেই” (বোখারি ও আবু দাউদ)।
আল্লাহ বলছেন, “যারা একবার বিশ্বাস স্থাপন করার পর (মুসলমান হয়ে) আবার কাফের হয়ে গেছে, আবার মুসলমান হয়েছে এবং আবার কাফের হয়েছে এবং কুফরিতেই উন্নতিলাভ করেছে, আল্লাহ তাদেরকে না কখনও ক্ষমা করবেন, না পথ দেখাবেন।” (সুরা নিসা ১৩৭)
অর্থাৎ কোর’আন মুরতাদকে ইসলামে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছে। তাকে খুন করলে ‘আবার মুসলমান’ হবার সুযোগ সে পাবে না, সেই খুন সরাসরি কোর’আন লঙ্ঘন হয়ে যাবে। রসুলাল্লাহর ওহি-লেখক আবদুল্লাহ বিন সা’আদ-ও মুরতাদ হয়ে মদিনা থেকে মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল। এ হেন মহা-মুরতাদকেও রসুলাল্লাহ মৃত্যুদণ্ড দেন নি (ইবনে হিশাম-ইসহাক পৃঃ ৫৫০) বরং ওসমান (রা.) পরে তাকে মিশরের গভর্নর করেছিলেন।
ইসলামের একটি মূল নীতি হচ্ছে, এই দীনে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই (সুরা বাকারা ২৫৬)। পবিত্র কোর’আনে কিছু অপরাধের দণ্ডবিধি আছে কিন্তু তাই বলে কোর’আন শুধুমাত্র দণ্ডবিধির বই নয়, এতে বহু কিছু আছে। আল্লাহ একে উপদেশগ্রন্থ বলেছেন। এখানে কিছু চিরন্তন মূল্যবোধ তুলে ধরা হয়েছে যা গ্রহণ করলে মানুষ ‘মানুষ’ হিসাবে উন্নত হবে এবং তাদের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই শান্তিই হচ্ছে ‘ইসলাম’। জোর করে কোনো ধর্মবিশ্বাস কারো উপর চাপিয়ে দেওয়া ইসলামের নীতি নয়, হত্যা করা দূরে থাক। আল্লাহ বলছেন, “সত্য তোমাদের সামনে উপস্থাপন করা হলো। অতঃপর যার ইচ্ছা তা গ্রহণ করুক, যার ইচ্ছা তা প্রত্যাখ্যান করুক (সুরা কাহাফ ২৯)।” তিনি বহুবার তাঁর রসুলকে বলেছেন, “তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তি করবে ঈমান আনিবার জন্য? (সুরা ইউনুস ৯৯) যে লোক বিমুখ হলো, আমি তোমাকে তাদের জন্য দারোগা নিযুক্ত করি নি। (সুরা নিসা ৮০)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:৩৪