somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যখন আমি ওয়াজ শুনতাম

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক সময় খুব ওয়াজ শুনতাম। রাত-বেরাতে চলে যাইতাম দূর দূরান্তে ওয়াজ শুনতে। ওয়াজের মধ্যে সবার ওয়াজ কিন্তু ভালো লাগতো না। যারা খালি কথায় কথায় কোর'আন-হাদীসের রেফারেন্স মারে, আরবি ঝাড়ে, ঠাস ঠাস করে কথা বলে, অল্প সময়ে বেশি জ্ঞান দেবার চেষ্টা করে তাদেরটা ভালো লাগতো না। বেশি ভালো লাগতো ঘটনাকেন্দ্রিক ওয়াজ। ঘটনা মানে কোনো নবীর ঘটনা বা নবীর সাহাবির হৃদয়বিদারক দুঃখের কোনো কাহিনী।
যেমন ধরেন- হযরত আলী (রা.) কত কষ্ট করে সংসার চালাইছেন, হাসান-হোসেনরে না খেয়ে থাকা লাগছে, ফাতেমা (রা.) কে তালি দেওয়া কাপড় পড়া লাগছে। একদিন হযরত আলী (রা.) কিছু খাবার জোগার করছেন, হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন, হোসেনের মুখে খাবার তুলে দিতে যাইবেন অমনি সময় দরজায় কড়া নাড়ল এক ফকির। এইবার আলী (রা.) কী করবেন? হোসেনরে খাওয়াবেন নাকি ফকিররে দিবেন? হোসেন কিন্তু গত তিনদিন কিছু খায় নাই। ...
এইভাবে ঘটনা আগাইতে থাকে। একটা ঘটনা শুরু হইল তো হইলই, শেষ আর হয় না। এদিকে ঘটনা যতই সামনে বাড়ে আগ্রহ বাড়ে তার কয়েক গুন বেশি গতিতে। সুরেলা কণ্ঠে এমন একটি মনোহর কাহিনী শোনা শেষ না করে কেই বা উঠতে চায়? তাছাড়া ওয়াজ শুনলে কয় মিনিটে কয়টা নেকি লেখা হয়, কয়টা ফেরেশতা ওয়াজের ওই জান্নাতের বাগান থাইকা একজনের ঘাড়ে আরেকজন চড়ে আল্লাহর আরশে গিয়া ঠেকছে সেই হিসাবও তো জানা। এতকিছু জানা, শোনা ও দেখার পরও কেউ ওয়াজ শুনতে না গেলে না যাক, আমি যাইতাম। আমার কবরে অন্য কেউ যাবে না, আমার মা-বাপও না, সেই মোতাবেক মা-বাবা মানা করলেও মর্দে মুজাহিদের মতো সেই মানারে থোরাই কেয়ার করে বিসমিল্লাহ বইলা আগাইতাম।
যাই হোক ওয়াজ শুইনা রাত্রি একটা-দেড়টার সময় যখন বাড়ি ফিরতাম, বুকভর্তি ঈমানের আগুন জ্বল জ্বল করতো, শীতের দিন হইলেও ঠান্ডা লাগতো না। খালি ভাবতাম- রসুলের সাহাবীরা ইসলামের জন্য কত কষ্ট করছেন, আমি এইটুকু ঠান্ডা সহ্য করতে পারব না? আমার ঠান্ডা সহ্য করা বা না করাতে ইসলামের কী লাভ-ক্ষতি হইল সে প্রশ্ন তখনও এন্টেনায় ধরে নি।
সারা বছরতো আর ওয়াজ হইতো না, যখন হইত তখন শুনতামই, যখন হইতনা তখনও শুনতাম- মোবাইলের মাধ্যমে। মেমোরি কার্ড ভর্তি করে ওয়াজ লোড করে নিতাম। তারপর রাস্তাঘাটে, বাসে-ভটভটিতে, হাটে-বাজারে, মাঠেঘাটে সবখানে সুযোগ পাইলেই বাজাইতাম। নিজে শুনতাম দশ জনেরে শুনাইতাম। মানুষের হেদায়েত হইতো তো টাইম লাগে না। অনেকেই আগ্রহ নিয়া শুনতো। কিন্তু কাউরে হেদায়েত হইতে দেখা যেত না। তারা আসলে ওয়াজ শুনতো সওয়াব কামানোর আশায়। বসে বসে মোবাইল শুনে সওয়াব কামানোর সিস্টেম আসছে, অবসরে বসে বসে সওয়াব কামানোর সিস্টেমটা তাদের ভালোই লাগতো।
আমার ওয়াজ শোনার জীবনে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হইতাম মহিলাদের ওয়াজ শোনা দেখে। এই বেচারিদের অপরাধের অন্ত নাই। নারীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বাঙ্গ হইল শয়তানের কারখানা। নারী হইতে সাবধান। নারী হইল পাপের দরজা। নারী সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, সুযোগ পাইলেই আপনারে জাহান্নামে ঢুকায়ে মজা নিবে। নারীর এই দুই নম্বরী চরিত্র আমার জানা ছিল না, আমি জানবো কী, নারীরাই তো জানে না। হুজুরের মুখ থেকেই সবার প্রথম শোনা। আশ্চর্যের ব্যাপার হইল- মহিলারা কিন্তু হুজুরের এই কথাগুলারে মোটেও অবিশ্বাস করতো না। হুজুর সাহেব বলছেন বলে কথা? তিনি কি মিথ্যা বলতে পারেন?
পাবলিক 'নারী' সংক্রান্ত ওয়াজ খায় ভালো। নামাজ, রোজা, কবরপূজা, শেরক, বেদাত, দান-খয়রাতের ওয়াজ শুনতে শুনতে পাবলিক যখন ঝিমাইতে থাকে, হুজুর তখন চট করে ওয়াজের ইস্যু চেঞ্জ করে ফেলে। লাইমলাইটে আসে ওয়াজের জাতীয় ইস্যু- নারী। নারী কী করে আর কী করে না- শুরু হয় বিস্তর আলোচনা, প্রসঙ্গের সাথে সাথে চিত্রপটও পরিবর্তিত হতে থাকে, মনে হয় এতক্ষণে পাবলিক যেন প্রাণ ফিরে পাইল।
দেখা যায় নারী যা করে সবই খারাপ কাজ করে, আর যা করে না ভালো কাজগুলাই করে না। নারী স্বামীকে শ্রদ্ধা করে না, বোরখা পরে না, সংযম করে না, বাড়িতে থাকে না, অন্যদিকে নারী বিশেষ বিশেষ অঙ্গ খোলা রাখে, সাজ-গোজ করে, স্কুল-কলেজে যায়, চাকরি করতে চায়, নেতা হইতে চায়, পুরুষ মানুষরে সুরসুরি দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ওয়াজরে যদি সিনেমা হিসেবে নেন, তাইলে নারী হইল ওই সিনেমার ভিলেন। আজকাল যৌন সুরসুরি ছাড়া যেমন সিনেমা চলে না, ওয়াজেও যৌনতার একটা বিশেষ জায়গা রাখা হয়। ওই জায়গার ওয়াজ শুনেছে যে, সেজন বুঝেছে হুজুরের রস। রস তো নয় যেন রসে রসমালাই। যাই হোক, সিনেমা শেষে ভিলেনরে মেরে ফেলার রেওয়াজ থাকলেও বহুবিধ প্রতিকূলতার কারণে হুজুর সাহেবরা ওয়াজ শেষে নারীদের হত্যা করার আদেশ দিতে পারেন না। এজন্য তাদের কোনো আক্ষেপ আছে কিনা জানা হয় নাই।
তবে আমার একটা দুর্বলতা ছিল, যার কারণে মাঝে মাঝে আমার ঈমান নিয়ে আমি নিজেই সন্দেহ করতাম। সমস্যাটা হলো- যতক্ষণ ওয়াজ চলতো আমি ভালোভাবেই বসে থাকতাম, নেকি হাসিল করতাম, কিন্তু ওয়াজের মধ্যে যখন টাকা-পয়সা, ধান-চাল, ডিম-ডামের ব্যাপারটা ঢুকে পড়ত আমি আর বসে থাকতে পারতাম না। দানের পরিমাণের তারতম্যের সাথে হুজুরের কণ্ঠে 'মারহাবা'র উঠানামা করতে দেখে হাসিও পেত একটু একটু।
একদিনের ঘটনা। ওয়াজ প্রায় শেষ। কাহিনীর শেষ করেও শেষ করা হয় নাই। এরই মধ্যে শুরু হল মসজিদের জন্য টাকা তোলা। মারহাবা আর আলহামদুলিল্লাহ-য় মুখরিত চারিদিক। যে যা পারছে দান করছে। যে পারছে না সে এদিক ওদিক না তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে। একজনকে দেখা গেল আট বস্তা সিমেন্ট দান করতে। হুজুর এখনও সন্তুষ্ট নন। তিনি বারবার সবাইকে দানের ফজিলত শোনাচ্ছেন, তার কথা শুনে মনে হচ্ছে- যদি এখান থেকে কেউ পকেটে করে এক টাকাও ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যান সেই এক টাকার জন্য হাশরের ময়দানে তাকে আধহাত সূর্যের নিচে দাড়ায়ে থাকা লাগবে, অন্যদিকে সে যদি ওই একটা টাকা মসজিদের সংস্কারে দিয়ে দেয়, নিঃসন্দেহে ওই এক টাকাই তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। অবস্থা বেগতিক দেখে বিরক্ত হয়ে কয়েকজনকে দেখলাম আস্তে করে সটকে পড়তে। আমার কাছেও হুজুরের আচার-আচরণ অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মনে হলো। যে-ই না উঠতে যাবো অমনি হুজুর ঘোষণা দিলেন- যে ব্যক্তি ওয়াজ শেষ হবার আগে এই জান্নাতের বাগান থেকে উঠে যাবে বুঝতে হবে তাকে শয়তানে ধরেছে। তিনি এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে, পাবলিক উৎসুক হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো যেন তারা চাক্ষুষ শয়তানকে দেখতে যাচ্ছে। এটাকে আমার কাছে আরও বাড়াবাড়ি মনে হলো এবং আমি উঠে পড়লাম। কোনোদিকে না তাকিয়ে গজ গজ করে মাঠ ত্যাগ করলাম। আসতে আসতে মাইকে হুজুরের ঘোষণা শুনলাম- সময় স্বল্পতার কারণে আজকের আলোচিত ঘটনাটি শেষ করা সম্ভব হলো না, আগামীকাল 'অমুক' জায়গার মাহফিলে আমি বক্তব্য রাখবো, সেখানে এই ঘটনার শেষটুকু আলোচনা করব ইনশা'আল্লাহ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:১৮
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×