একটি প্রশ্ন- আপনি কি আদর্শবান পুরুষ (বা নারী)? ভালো ভালো কথা বলেন? অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন? ভণ্ডামীর মুখোশ খুলে দেন? দলান্ধ বা ধর্মান্ধ না হয়ে যুক্তির চর্চা করেন? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তাহলে জেনে রাখুন, আপনি একজন দালাল। জেনে রাখতে বলছি কারণ আপনি এমন এক ‘ক্যাটাগরি’র দালাল যে কিনা ‘দালাল’ তকমা কাঁধে নিয়ে ঘুরেও বুঝতে পারে না সে কোথায় দালালী করল, কার দালালী করল। আপনার সুবিধার জন্য একটি ফর্মুলা দিচ্ছি, যেটা প্রয়োগ করে আপনি যে কোনো সময় জেনে নিতে পারবেন ওই মুহূর্তে কার দালালী করছেন। ফর্মুলা হলো-
‘যখন যার অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন আপনি তখন তার প্রতিপক্ষের দালাল।’
আসুন বাস্তব জীবনে ফর্মুলার প্রয়োগ দেখা যাক।
১. ধরুন, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করছেন, দোষ ত্র“টি তুলে ধরছেন, সংশোধন হবার আহ্বান জানাচ্ছেন, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস কিংবা যুবলীগের দখলদারিত্ব কীভাবে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা নষ্ট করছে পরিসংখ্যানযোগে ব্যাখ্যা করছেন, কথায় কথায় কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি’র দুই নম্বরীও উঠে আসছে। সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। শ্রোতারা সব উত্তেজিত ভঙ্গিত তাকিয়ে আছে। যাই হোক, আপনি ভাবছেন যে খুবই মহৎ কর্ম করে ফেলছেন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন বা দেশ ও জাতির উপকার করছেন। কিন্তু না, আপনি আসলে বিএনপির দালালী করছেন। এ ব্যাপারে আপনার ঘোর সন্দেহ থাকলেও আওয়ামী লীগারদের কোনো সন্দেহ নেই। তারা জানে- যে ব্যক্তি আওয়ামী লীগ করে বা আওয়ামী লীগের সাপোর্টার তারা কখনও দলের ভুল ধরবে না, সরকারের সমালোচনা করবে না। আপনি করছেন মানেই আপনাকে রোগে ধরেছে। রোগটা খুবই স্পষ্ট। ইদানীং মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে। আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাহীনতায় ভুগছেন। যার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাই আওয়ামী লীগের উপর তার ভক্তি-মহব্বতও নাই। অন্যভাবে বললে, আওয়ামী লীগের উপর যার ভক্তি-মহব্বত নাই তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও নাই। সে আওয়ামী লীগ নয়। সে বিএনপি হতে পারে আবার জামাতও হতে পারে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ লীগারের মতে সে দালাল। বিএনপির দালাল নাকি জামাতের দালাল সেটা আগেই বলা ঠিক হবে না। আপাতত সে বিএনপি-জামাতের দালাল।
২. ধরুন, এবার আপনি বিএনপি-জামাতের সমালোচনা করছেন, বিগত আমলে বিএনপি-জামাত কী কী দুর্নীতি করেছে, কয় হাজার কোটি টাকা লাগ ভেলকি লাগ বলে ‘নাই’ করে দিয়েছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন করেছে, জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে ইত্যাদি পুরোনো কাসুন্দি ঘাটছেন, কথা প্রসঙ্গে ২০১৩ সালের অবরোধ-হরতাল-পিকেটিং ঢুকে পড়ছে, ২০১৫’র প্রেট্রল বোমাও বাদ পড়ছে না, তার অর্থই হচ্ছে আপনার ‘দালালী’ ধরা পড়ে গেছে। আÍপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ নেই, সুযোগ থাকলেও লাভ নেই। জিয়ার সৈনিকরা যেখানে কেবল ‘হা’ করলেই বুঝতে পারে কে কী বলতে চায়, সেখানে আপনি ইতোমধ্যেই অনেক কথা বলে ফেলেছেন। ওদের আর বুঝতে বাকি নেই আপনি কোন ঝাড়ের বাঁশ, আপনি কার দালালী করছেন। ঘটনা খুবই পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, তাই বিএনপি-জামাতের সমালোচনার রশি ধরে অর্থাৎ সরকারের দালালি করে আসলে আপনি উপরে উঠতে চাচ্ছেন। এই তো? সমস্যা নাই, তরতর করে উপরে উঠতে থাকুন। আপনাকে রেড মার্ক করে রাখা হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে ঠ্যাং ধরে তরতর করে টেনে নামানো হবে। টেনে নামানো না গেলে পাছায় আগুন লাগানো হবে। তখন আপনা আপনি নেমে যাবেন। তাতেও না নামলে ‘বিশেষায়িত রগকাটা বাহিনী’ আছে, দেশব্যাপী তাদের সুনাম ও খ্যাতিও আছে, তারাই দেখে নেবে।
বিএনপি-জামাতের সমালোচনা করার আগে আপনার ভাবা উচিত ছিল যে, বিএনপি-জামাতে অনেক আল্লাহওয়ালা, নবীওয়ালা, বুজুর্গ, দ্বীনে আশেকীনরা আছেন। তারা যা করেন আল্লাহর রাস্তায় করেন। দুর্নীতি করলেও আল্লাহর রাস্তায় করেন। ককটেল মারলেও আল্লাহর রাস্তায় মারেন। আল্লাহর রাস্তায় অভিযানে যারা বাধার সৃষ্টি করে তারা হলো আবু জাহেলের বংশধর। সময়-সুযোগ আসলে অল টাইম আপনার মতো আবু জাহেলের বংশধরদের চটকানির উপর রাখা হবে। দালালী করার জায়গা পান না? আল্লাহ-রসুলের বিরুদ্ধে দালালী করেন?
৩. ধর্ম নিয়ে কথা বলার লোকের অভাব নাই। মোল্লা, মাওলানা, মুফতি, ক্বারী, আল্লামারা ধর্মের ঠিকাদারী নিয়ে রেখেছেন। তাদের অসীম জ্ঞান। তারা ধর্মের কোনো বিষয় জানেন না এমনটা মনে করাও পাপ। ধর্ম নিয়ে কিছু শুনতে চান? জানতে চান কোন আমল করলে ১০০ বছরের গুনাহ মাফ হয়? জানতে চান অজ্ঞান অবস্থায় নামাজের সময় পার হয়ে গেলে ক্বাজা পড়তে হবে কিনা? চলে আসুন মাওলানা সাহেবের দরবারে। প্রাণ খুলে আল্লাহর রহমতের বান্দারা দীনের জ্ঞান দান করবেন। অন্তর ঠান্ডা হবে। মন প্রশস্ত হবে। পাপ মুছে যাবে। নিষ্পাপ শিশুর মতো বাড়ি গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। আর না জাগলেও চলবে।
কিন্তু ধরুন, আপনি তাদের কাছে দ্বীনি জ্ঞান শিক্ষা না করে উল্টো তাদের সমালোচনা শুরু করেছেন। যেমন- ধর্মের কথা বলে বা ওয়াজ করে অর্থ উপার্জন করা ঠিক হচ্ছে কিনা, নামাজ পড়িয়ে, মিলাদ পড়িয়ে, কুরবানি-কুলখানি ও জেকের-আজগার করে টাকা-পয়সা নেওয়া ইসলামসম্মত কিনা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। অথবা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করে ব্যালট পেপারকে ‘জান্নাতের টিকেট’ আখ্যা দিয়ে মানুষের সমর্থন লাভের প্রচেষ্টা ইসলামের অপব্যবহার কিনা, নাস্তিক-মুরতাদ আখ্যা দিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের বিরুদ্ধে ঈমানদার মানুষকে খেপিয়ে তুলে সহিংস ঘটনা ঘটানো অনৈতিক কিনা সে প্রশ্ন তুললেন।
কিন্তু আপনি হয়তো ভুলে গেছেন দুনিয়ার সব কিছুর সমালোচনা করা চলে না। সূর্যের সমালোচনা হয় না। চন্দ্রের সমালোচনা হয় না। হুজুরের সমালোচনাও হয় না। হুজুরের যুক্তির পিঠে যুক্তি দেওয়া গুনাহের কাজ। শুধু গুনাহ বললে ভুল হবে, কবীরা গুনাহ। হুজুররা হলেন আল্লাহর নবীর উত্তরসূরী। তাদের সকল কথার একটাই উত্তর- মারহাবা মারহাবা। মারহাবা বলবেন না আপত্তি নেই, চুপ করে থাকুন। কিন্তু সাবধান- হুজুরের বিরুদ্ধে সমালোচনা মানি না মানব না। আপনার আসল উদ্দেশ্য আপনি ইসলাম ধ্বংস করতে চান। আপনি ইহুদির দালাল। খ্রিস্টানের দালাল। সরকারেরও দালাল। কারণ সরকারও ইসলাম ধ্বংস করতে চায়। দুয়ে দুয়ে চার। ইহুদি-খ্রিস্টানরা নাস্তিক আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে আপনার মতো দালাল উৎপাদন করেছে। আপনার কাছে খ্রিস্টানরা বস্তাভর্তি টাকা পাঠায়। বিধর্মীর টাকা খেয়ে দালালী করে আপনি মু'মিনদের ইমান-আকীদা নষ্ট করে ফেলার ফন্দি আটছেন। মনে রাখবেন, হুজুর আছে বলেই ইসলাম আছে। হুজুর নাই ইসলামও নাই। সুতরাং হুজুরের বিরুদ্ধে সমালোচনা মানে ইসলামের সমালোচনা। বাংলার মাটি শাহজালালের মাটি, শাহ মাখদুমের মাটি, পীর-বুজুর্গদের মাটি। সৌদি আরবের মতো খাটি। এখানে আপনার জায়গা নেই। দালালী করবেন বিদেশে গিয়ে করেন। আপনার ফেস চিনে রাখা হচ্ছে। পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমান সরকার মোল্লাদের কদর বোঝে না। বুঝলে ৫ মে মাদ্রাসার কোটি কোটি এতিম ছাত্রকে গুলি করে মারতে পারতো না। আহারে! এত খুন! এত রক্ত! সরকার ক্ষমতা থেকে নামুক। তারপর দেখবা ইমানের তেজ কাহাকে বলে?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:০২