যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি হাসান ফেরদৌস একটি নিবন্ধ লিখেছেন ‘আইএসকে ঠেকাব কীভাবে?’- এই শিরোনামে। প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে মাথায় পাল্টা প্রশ্ন আসলো। ধরে নিলাম আইএসকে ঠেকানো গেল। আমেরিকা-রাশিয়ার বোমা হামলাতেই হোক বা সেনা অভিযানেই হোক পৃথিবী থেকে আইএসের নাম মুছে ফেলা হলো। ইরাক-সিরিয়া যার যার ভূখণ্ড বুঝে পেল। কিন্তু তাতে কী লাভ হবে? ইরাকের মানুষ শান্তি পেয়ে যাবে? গণহত্যা বন্ধ হয়ে যাবে? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মতবাদ চাপিয়ে দেবার প্রবণতা থেমে যাবে? প্রশ্নই ওঠে না। আইএস দৃশ্যপটে আসার আগেও ইরাক-সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পায়রা উড়তে দেখা যায় নি।
আইএসের উত্থানের প্রেক্ষাপট রচনা করেছে একবিংশ শতাব্দীর অপ্রতিরোধ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র। ওই যুক্তরাষ্ট্রই এখন আইএসকে নির্মূল করার জন্য আকাশ থেকে বোমা ফেলছে। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করছে। বাড়ি-ঘর ধ্বংস করছে। দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে কোটি কোটি মানুষকে। দেশটির আগামী ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে চান এমন নেতা-নেত্রীরা প্রতিযোগিতায় নেমেছেন প্রেসিডেন্ট হতে পারলে আইএসের বিরুদ্ধে কে কত আক্রমণাত্মক উদ্যোগ নিবে তা নিয়ে। তাদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে হাসান ফেরদৌস বলছেন- ‘আইএসকে ঠেকাতে তারা হেন কাজ নেই যা করবে না, প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানো হবে।’ এই হলো যুক্তরাষ্ট্র, যারা আইএস উত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিল, অস্ত্র দিল, প্রশিক্ষণ দিল, সমর্থনও দিল, আর এখন তারাই আইএস ঠেকানোর শেষ ভরসা। প্রয়োজনে মহাযুদ্ধ বাঁধাবে কিন্তু আইএসমুক্ত মধ্যপ্রাচ্য গড়বেই গড়বে।
আমরা যারা পশ্চিমের চোখে দেখি, পশ্চিমের বুদ্ধিতে বিচার করি ও পশ্চিমের সিদ্ধান্তে ‘হ্যাঁ’ ধরি, তাদের বিশ্বাস- আজ হোক কাল হোক আমেরিকা আইএসকে উচিত শিক্ষা দিবে। আইএসের সৌভাগ্য যে, এখনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাদের অমার্জনীয় অপকর্মকে মার্জনা করে আসছে, অন্তত চূড়ান্ত শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত আছে। আইএসের অপকর্মগুলো কী? আসুন একটি তালিকা করা যাক।
ক. আইএস অধিকৃত অঞ্চলে ভিন্ন মতাবলম্বী হত্যা বা গণহত্যা।
খ. বিদেশি অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও হত্যা।
গ. নিজেদের ধর্মমতকে অধিকৃত অঞ্চলের মানুষের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া।
ঘ. কথিত শরীয়াহ আইন প্রয়োগ।
ঙ. পার্শ্ববর্তী দেশের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের বিরুদ্ধে অবৈধ যুদ্ধ।
চ. ইউরোপ-আমেরিকায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে সাধারণ নাগরিক হত্যা।
প্রধানত এগুলোই আইএসের অমার্জনীয় অপরাধ, যার কারণে তারা বিশ্বব্যাপী ধিক্কৃত ও ঘৃণিত একটি নামে পরিণত হয়েছে, যাকে বর্বরতা আখ্যায়িত করে মস্কো-ওয়াশিংটন নির্বিশেষে উচ্ছেদাভিযান চালাচ্ছে, সমগ্র ইউরোপ ক্ষোভে ফুঁসছে, ৩৪ টি মুসলিমপ্রধান দেশ তাদের নির্মূলে সামরিক জোট গঠন করেছে।
আইএসের বিরুদ্ধে এই বৈশ্বিক ডামাডোল দেখে সহজেই অনুমান করা যায় তাদের অপরাধগুলোকে বিশ্ববাসী কত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। আইএসের বর্বরতা-নৃশংসতা দেখে সকলের চোখ কপালে উঠেছে। ভাবটা এমন যেন এমন নৃশংসতা কেউ কখনও দেখে নি, পৃথিবীর আর কোথাও গণহত্যা হচ্ছে না, পৃথিবীতে কোনো স্বৈরশাসক নেই, কোথাও কোনো আদর্শকে মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না, পৃথিবীর আর কোনো দেশে কথিত শরীয়াহ আইন প্রয়োগ হয় না, কোনো প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে অবৈধভাবে যুদ্ধ করা হচ্ছে না, আনুষঙ্গিক ক্ষয়ক্ষতির (ঈড়ষষধঃবৎধষ ফধসধমব) অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে বোমা মেরে হত্যা করা হচ্ছে না, দেশ থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ গত একশত বছরে কেবল যুদ্ধে মানুষ মারা গেছে ১৭,৪৯,১৬,৫৩৩ (সতের কোটি উনপঞ্চাশ লক্ষ ষোল হাজার পাঁচশত তেত্রিশ) জন। আহত বিকলাঙ্গ হবে অন্তত এর ৪ গুণ অর্থাৎ প্রায় ৭০ কোটি। মানবজাতির মহাকলঙ্কজনক এই যুদ্ধগুলোর অধিকাংশই বাধিয়েছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা। জঙ্গিরা তো দৃশ্যপটে আসলো সেদিন।
জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটার পর থেকে এখন পর্যন্ত যত জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে এবং হচ্ছে তাদের হাতে বড়জোর ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এই ২০ হাজার মানুষ হত্যা করার অপরাধে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, ১৭ কোটি মানুষকে হত্যা করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে তার এক ভগ্নাংশও উচ্চবাচ্চ নেই, বরং তাদের অনুগ্রহ পাওয়ার আশায় উদগ্রীব সারা বিশ্ব।
সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে ইরাকে হামলা চালিয়ে বৈধ সরকারকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করা হলো ২০০৩ সালে। লক্ষ লক্ষ সাধারণ নাগরিক নিহত হলো মার্কিন বাহিনীর হাতে। বর্বরতা কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী তা ইরাকের মানুষ তখনই স্বচক্ষে দেখেছে, অনুভব করেছে। ইরাকের মাটিতে ওই যে যুদ্ধ ও বর্বরতা আরম্ভ হলো, আর শেষ হলো না। মার্কিন বাহিনী চলে গেলে বিধ্বস্ত ইরাকে হামলে পড়ল আইএস জঙ্গিরা। আইএস এখন যা করছে তা মার্কিন বাহিনীর আরম্ভ করা বর্বরতারই ধারাবাহিকতা। গুরু যে শিক্ষা দিয়ে গেছে, শিষ্য তারই প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। গুরু শক্তির জোরে ভূখণ্ড দখল করেছে, শিষ্যও করেছে। গুরু গণহত্যা চালিয়েছে, শিষ্যও সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। সামরিক শক্তিতে দুর্বল হওয়ায় গুরুর মতো বড় কোনো বিধ্বংস ঘটানো হয়তো সম্ভব হচ্ছে না, কিন্তু সাধ্যের মধ্যে সবটুকু উজার করে গুরুর মান রক্ষা করার চেষ্টা চলছে।
মার্কিনীরা যখন ইরাকে পুতুল সরকার ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেদের পছন্দমতো শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করল, তখন কি তারা ইরাকিদের মতামত নিয়েছিল? তাহলে আইএস কেন ইরাকি জনগণের মতামতের আশায় বসে থাকবে। তারাও নিজেদের পছন্দমতো মতবাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালাচ্ছে। অস্ত্রের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ইউরোপ-আমেরিকার কাছে সেটাকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে কেন তা বোধগম্য নয়।
মধ্যপ্রাচ্যেরই দুইটি দেশ, সৌদি আরব ও ইজরাইল। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরে ইয়েমেনে সামরিক হামলা চালাচ্ছে সৌদি আরব। তাতে অগণিত সাধারণ নাগরিক নিহত হচ্ছে। বাড়ি-ঘর, স্থাপনা বিধ্বস্ত হচ্ছে। এদিকে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইজরাইল নানান ছুতোয় ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। ২০১৪ সালে মাত্র এক মাসের আগ্রাসী হামলায় ফিলিস্তিনের ৬০০ শিশুসহ প্রায় ২ হাজার মানুষ হত্যা করে দেশটি। এখনও ছোট-খাটো হামলা লেগেই আছে। অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিলেও কেবল মধ্যপ্রাচ্যের এই দুইটি দেশ মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধগুলো এখন পর্যন্ত করে এসেছে তা আইএসের কৃত অপরাধগুলোর তুলনায় নৃশংসতার বিচারে অনেক বড়। ওদিকে তুরস্ক আইএস দমনের নামে কার্যত কুর্দি স্বাধীনতাকামীদের হত্যা করছে, কিন্তু বিশ্ব তাতে শঙ্কিত নয়। মিশরে গণতন্ত্রের কবর দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা হলে যখন মুরসীর সমর্থকরা বিক্ষোভ আরম্ভ করে তখন দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নজিরবিহীন দমন-পীড়ন ও গণহত্যা চালানো হলে পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্র ও মানবতার পুরোনো বুলি আউড়ানো বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে মৌন সমর্থন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করতে থাকে। তখনও বিশ্ব শঙ্কিত হয় নি। লিবিয়ায় ন্যাটো বিমান হামলা চালিয়ে মোয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুৎ করে। এখন দেশটি জঙ্গিদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। মানবতার বিরুদ্ধে এত বড় অপরাধ করার পর পশ্চিমারা এখন ভুলেও লিবিয়ার কথা মুখে আনতে চান না। এছাড়াও আফগানিস্তানে সরাসরি সামরিক হামলা চালিয়ে ও পাকিস্তানে ড্রোন হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে, তার তুলনায় আইএসের অবস্থান কোথায়? তবু আইএসকে ঠেকাতে হবে, আইএসকে নিয়েই যত আতঙ্ক, ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র দিব্যি বসে আছে মানবতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নায়কের আসনে।
সিরিয়া প্রসঙ্গে আইএসকে একবার দোষ দিলে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-সৌদি আরবকে দোষী বলতে হবে দশবার। আরব বসন্তের সূত্র ধরে সিরিয়ার সরকার ও সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে এ পর্যন্ত যে নোংরা খেলা পশ্চিমারা খেলেছে তার সাথে আইএসের তুলনা করা আর হাতির সাথে মুশিকের তুলনা করা সমান কথা। আইএসকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে তুরস্ক-সৌদি আরবের মতো পশ্চিমা অনুগত রাষ্ট্রগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। আইএসের এই সদস্যগুলোই যখন আসাদবিরোধী ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র অংশ হয়ে যুদ্ধ করল, প্রায় আড়াই লাখ মানুষ যুদ্ধে নিহত হলো, তখন তারা না বর্বর ছিল না জঙ্গি। কিন্তু যখন তারা পশ্চিমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিরিয়া-ইরাকের কিছু ভূ-খণ্ড দখল করে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে শাসন করতে আরম্ভ করল তারা হয়ে গেল বর্বর, জঙ্গি, গণহত্যাকারী।
অন্যদিকে সিরিয়ায় যুদ্ধের আগুনে বছরের পর বছর তুষ ছিটিয়েও পশ্চিমা ও তার আরব অনুগত রাষ্ট্রগুলো সাধুই রয়ে গেল। এহেন সাধুরাই আমাদের ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রতীক্ষায় থাকি একদিন আমেরিকা, রাশিয়া বা সৌদি আরব আইএসকে নির্মূল করবে। হয়তো করবে, আইএস মুছে যাবে বা চলে যাবে পেছনের সারিতে যেভাবে আল কায়েদা চলে গেছে, কিন্তু তখন নতুন কোনো আইএসের জন্ম দেওয়া হবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৮