‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই’ করতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ৩৪ টি মুসলিমপ্রধান দেশের সামরিক জোট গঠন করা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ বলতে নির্দিষ্ট করে আইএসকে না বোঝালেও বলা হচ্ছে, এই সামরিক জোট ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, মিশর ইত্যাদি দেশের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। জোটের সদস্য দেশগুলো হচ্ছে- সৌদি আরব, বাহরাইন, বাংলাদেশ, বেনিন, চাদ, কোমোরোস, আইভরি কোস্ট, জিবুতি, মিশর, গ্যাবন, গায়েনা, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মালি, মরক্কো, মৌরিতানিয়া, নাইজার, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিস্তান, কাতার, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, সুদান, টোগো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, আরব আমিরাত এবং ইয়েমেন। তবে এ জোটে ইরাক, ইরান, সিরিয়া ইত্যাদি শিয়াপ্রধান দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।
যেহেতু এই জোট সিরিয়া, ইরাক, মিশর ও আফগানিস্তানের সন্ত্রাস মোকাবেলায় কাজ করবে বলে জানানো হয়েছে, সুতরাং প্রধানত জোটটিকে আইএস জঙ্গিদের মোকাবেলা করতে হবে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদের শিরোমণি ‘আইএস’ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বহু পূর্বেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট গঠিত হয়েছিল। তাতে সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রও অংশ নেয়। আইএসবিরোধী ওই জোট জঙ্গিবাদ নিয়ে রাজনীতি না করে যদি ঠিকমতো ব্যবস্থা নিতো, তাহলে বর্তমানে আইএসের প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্ধেকে নেমে আসার কথা ছিল। সন্ত্রাসবাদ এত বিস্তৃত হবার সুযোগ পেত না। কিন্তু বাস্তবে ওই জোটের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে যা দেখা গেছে, তাতে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে যে তারা প্রকৃতপক্ষে আইএস নির্মূল করতে চায় কিনা। এ সন্দেহ আরও বৃহৎ আকার ধারণ করে আইএসকে লক্ষ্য করে রাশিয়া বিমান হামলা শুরু করলে। তাতে অল্প দিনের ভেতরে আইএস কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে প্রশ্ন ওঠে- তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট এতদিন কী করল, তারা আদৌ আইএসকে নির্মূল করতে চেয়েছিল কিনা ইত্যাদি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী দেশ হিসেবে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে সৌদি আরবও। এছাড়াও সৌদি আরব ও তুরস্কের বিরুদ্ধে সুন্নি আইএসকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা করার বহুল পুরোনো অভিযোগ তো রয়েছেই। যাই হোক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘সন্ত্রাসবাদ’ ইস্যুতে সৌদি আরবের অবস্থান বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। অথচ সেই সৌদি আরবের নেতৃত্বেই কিনা গঠিত হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সামরিক জোট। তাই বিশেষজ্ঞরা দেশটির এই উদ্যোগকে সাদামাটা দৃষ্টিতে না দেখে তার পেছনের রহস্য খুঁজতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সৌদি আরব সুন্নি মুসলিম দেশগুলোকে একত্র করে বাস্তবে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকেরই।
বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে ঘুরে ফিরেই আলোচনায় আসছে সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কেউ বলছেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কেউ বলছেন প্রেক্ষাপট রচিত হচ্ছে বা প্রস্তুতি চলছে। সিরিয়া ইস্যুতে রুশ-মার্কিন উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। যে কোনো উপায়ে রাশিয়া সিরিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যর নিয়ন্ত্রণ নিতে বা আধিপত্য বিস্তার করতে আগ্রহী। প্রয়োজনে যুদ্ধ বাধাতেও পিছপা হবে না। অন্যদিকে মার্কিন-সৌদি-ইজরাইল ব্লক মধ্যপ্রাচ্যকে শিয়াপ্রভাব থেকে মুক্ত করে নিজেদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে অনেক আগে থেকে। এমন সময় মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া স্থায়ী আসন গেড়ে বসলে মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে সৌদি-মার্কিন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে। শিয়া প্রভাব থেকে আরবকে মুক্ত করে সুন্নিঅধ্যুষিত ও মার্কিন অনুগত আরবাঞ্চল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হোচট খাবে। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যে কোনো মূল্যে রাশিয়াকে প্রতিরোধ করতে বাধ্য। এমতাবস্থায় যে পক্ষ পিছু হটবে কার্যত তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হবে। আর সামনে এগোলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য। হতে পারে তা ‘বিমান ভূপতিত’ করার মতো তুচ্ছ একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই।
এমন প্রেক্ষাপটে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আমরা যতই নিশ্চিন্ত থাকি, পরাশক্তিগুলো ঠিকই তলে তলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কৌশলগত প্রস্তুতিগুলো সেরে ফেলছে পর্দারে আড়ালে বসেই। এরই অংশ হিসেবে সন্ত্রাসবাদ দমনের নাম করে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলোকে সৌদি আরব মার্কিন বলয়ে প্রবেশ করালো কিনা সে প্রশ্ন তোলা অবান্তর নয়। বিশ্বকে রাশিয়াপন্থী ও আমেরিকাপন্থী দুইভাগ করলে দেখা যাবে সুন্নি সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে, আর শিয়া ইরান-সিরিয়া-ইরাক কার্যত চলে গেছে রাশিয়ার পক্ষে। এর বাইরে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব কম-বেশি নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিল এতদিন। কিন্তু সৌদি আরবের এই সামরিক জোটে যোগ দিয়ে সেসব দেশ তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান হারালো বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এত বড় একটি পদক্ষেপ সৌদি সরকার মার্কিন ইঙ্গিতেই নিয়েছে সন্দেহ নেই। অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে সৌদি সরকার প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। যেমন- ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ হলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় মুসলিমদের নিয়ে জেহাদী দল গঠনে সৌদি আরবের সর্বাÍক সহযোগিতা এবং সাম্প্রতিক সিরিয়ায় বাসার আল আসাদকে উৎখাত করতে বিদ্রোহীদের সহযোগিতায় দেশটির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। মার্কিন স্বার্থ ও সৌদি স্বার্থের মধ্যে পার্থক্য করা যতটা কঠিন, সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া ততটাই সহজ। বস্তুত এরপর থেকে জঙ্গিবাদ দমনের ধুয়া তুলে মুসলিম দেশগুলোকে ইচ্ছামতো চালিত করবে সৌদি আরব, আর সৌদি আরবকে চালিত করবে যুক্তরাষ্ট্র। রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্বে মুসলিম বিশ্ব চলে গেল যুক্তরাষ্ট্রের পকেটে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমাদের এই ভারত উপমহাদেশের মুসলমানরা প্রভু ব্রিটেনকে বিজয়ী করার জন্য প্রাণ দিয়েছিল, যে প্রাণ দেওয়ার কথা ছিল ব্রিটিশ অপশাসনকে উৎখাত করার সংগ্রামে। এবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মুসলিম বিশ্ব নিজেদেরকে কুরবানি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে বিজয়ী করার জন্য। অথচ এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিটি চলতি শতাব্দীতে লক্ষ লক্ষ মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছে। এখনও তাদের হাতে নিরপরাধ মুসলমানের রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়।
জোট গঠনের আরও একটি কারণ বিশ্লেষকরা ব্যাখ্যা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত তারা কোনো দেশে মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠাবে না। তাই দেশটি চাইছিল আইএসসহ অন্যান্য জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মুসলিম দেশগুলোর সেনাবাহিনীকে মাঠে নামাতে। কিন্তু পারছিল না। কারণ, অনেক মুসলিমপ্রধান দেশের সরকার এ ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না, আবার সরকার আগ্রহী থাকলেও জনগণের সেন্টিমেন্ট ছিল ভিন্নমুখী। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে মুসলিম জনসাধারণ ভালো চোখে দেখে না। ‘যুক্তরাষ্ট্রকে ইসলামের শত্র“ ভাবা’ সাধারণ মুসলমান সব দেশেই কম-বেশি আছে। সব মিলিয়ে মুসলিম দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটে অংশ নেওয়ানো ও তাদের সেনাবাহিনীকে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো অসম্ভব ছিল। আর সে কারণেই সৌদি আরবের নেতৃত্বে এই জোট গঠন করা হলো কিনা তা ভেবে দেখছেন অনেকে। এতে উদ্দেশ্যও অর্জিত হলো, ইসলামী সেন্টিমেন্টও বজায় থাকলো। রসুলের দেশ সৌদি আরবের নেতৃত্বকে মানতে তো কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
আমাদের জন্য চিন্তার বিষয় হলো- বাংলাদেশও সেই জোটে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটে যখন সারা বিশ্ব ‘ধর্ম’ ইস্যুতে টালমাটাল, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে তীব্র গতিতে জঙ্গিবাদের সঞ্চার ঘটছে, বড় বড় পরাশক্তিগুলো জঙ্গিবাদকে কেন্দ্র করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, একের পর এক মুসলিম দেশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে, তখন ১৬ কোটি মুসলমানের দেশ বাংলাদেশকে আরও সাবধানতা অবলম্বন করে পথ চলতে হবে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যতকে মাথায় রেখে, ভেবে-চিন্তে, সাবধানে। এ ব্যাপারে সরকার সচেতন রয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে মনে রাখতে হবে, এই সতর্কতার রশির মাত্র একটি জায়গায় কাটা পড়লেই সমস্তকিছু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। আমরা যেন পাকিস্তান হবার পথে পা না বাড়াই। এ দেশে যদি জঙ্গিবাদ থেকে থাকে তার মোকাবেলা আমরাই করতে পারবো। অন্য কাউকে দাওয়াত করে আনার যেমন দরকার নেই, তেমনি পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থে যে দেশগুলোতে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে এখন জঙ্গি দমনের নামে তামাশা শুরু করেছে, সেসব দেশে জঙ্গিবাদ দমনের জন্য আমাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতাও নেই। আমাদের দেশের জনসাধারণ মধ্যপ্রাচ্যের ঝামেলায় জড়ানোর পক্ষপাতী নয় বলেই আমার ধারণা।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, এই জোটের উদ্দেশ্য হচ্ছে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান। কিন্তু সৌদি আরবের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, জোটের সদস্য দেশগুলো প্রয়োজনে জঙ্গিবাদ দমনের জন্য সামরিক অভিযোনে সৈন্য পাঠাবে। সে মোতাবেক বাংলাদেশও যদি আইএস বা অন্যান্য জঙ্গিদের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে নেমে পড়ে তাহলে অচীরেই বাংলাদেশকে টার্গেট করে বসবে জঙ্গিরা। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি আমরা, যার দায় স্বীকার করেছে কোনো না কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী। ফলে বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি নতুন কোনো ঝুঁকির কারণ হবে কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন। অনেকে বলছেন, সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরতা বিবেচনা করে এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু অর্থনৈতিক নির্ভরতার বাধ্যবাধকতা থেকে ‘যুদ্ধ’ করতে হবে তাও তো মানা যায় না। আশা করি সরকার বিষয়টিকে বাস্তবতার আলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:১২