যে কোর'আন পড়ে মানুষ হাফেজ হয়, মাওলানা হয়, মোফাসসের হয়, সেই কোর'আন পড়েই মানুষ নাস্তিক হয়, ইসলামবিদ্বেষীও হয়। যে কোর'আন পড়ে মানুষ সুন্নি হয়, সেই কোর'আন পড়েই মানুষ শিয়া হয়। যে কোর'আন পড়ে মানুষ সুফি হয়, সেই কোর'আন পড়েই মানুষ জঙ্গি হয়। যে কোর'আন পড়ে মানুষ জামাতে ইসলামী হয়, সেই কোর'আন পড়েই মানুষ চরমোনাই হয়। যে কোর'আন পড়ে মানুষ আইএস হয়, সেই কোর'আন পড়েই মানুষ আল কায়েদা হয়। যে কোর'আন পড়ে মানুষ মডারেট মুসলিম হয়, সেই কোর'আন পড়েই মানুষ মৌলবাদী মুসলিম হয়।
সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, কোর'আন যদি শিয়া মাজহাবকে সমর্থন করে তাহলে সুন্নি মাজহাব পথভ্রষ্ট। একইভাবে কোর'আন সুফিবাদকে সমর্থন করলে জঙ্গিবাদ পথভ্রষ্ট, জঙ্গিবাদকে সমর্থন করলে সুফিবাদ পথভ্রষ্ট। কোর'আন মতে জামাতে ইসলামী সঠিক হল চরমোনাই পীরের দল পথভ্রষ্ট। কওমী মাদ্রাসা সঠিক হলে আলেয়া মাদ্রাসা পথভ্রষ্ট। আইএস প্রকৃত জেহাদী হলে আল কায়েদা পথভ্রষ্ট, আল কায়েদা প্রকৃত জেহাদী হলে আইএস পথভ্রষ্ট। মডারেট মুসলিমরা সঠিক পথে থাকলে মৌলবাদীরা ইসলামে নেই, মৌলবাদীরা ইসলামে থাকলে মডারেটরা ইসলামে নেই।
কিন্তু আমরা জানি, প্রতিটি ফেরকা-মাজহাব থেকে দল-উপদল, জনগোষ্ঠী- সকলেই নিজেদের স্বপক্ষে কমবেশি কোর'আনের আয়াত উপস্থাপন করতে সক্ষম। তার মানে কি কোর'আন মতে সকলেই সঠিক পথে আছে? কখনই না।
বস্তুত তারা কেউই প্রকৃত অর্থে কোর'আনের ধারক নয়। কোর'আন বুঝতে হলে ইসলাম সম্পর্কে যে সামগ্রিক ধারণা (আকীদা) থাকা লাগে, তা তাদের নেই। অন্ধের হাতি দেখার গল্প আমরা সকলেই জানি। তাদের অবস্থা ওই অন্ধদের মতো। যে হাতির পা ধরেছে, সে ভাবছে হাতি খাম্বার মতো, যে লেজ ধরেছে সে ভাবছে রশির মতো, যে কান ধরেছে সে ভাবছে কুলার মতো। সকলেই নিজেদের হাত দিয়ে স্পর্শ করেই কিন্তু কথাগুলো বলছে এবং তাদের অবস্থান থেকে তারা যে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে তা মিথ্যে নয়। কিন্তু এও তো বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, হাতি একইসাথে দেখতে খাম্বার মতো, রশির মতো ও কুলার মতো। মুসলিমদের অবস্থা হয়েছে তেমন। তারা কোর'আন থেকেই নিজেদের স্বপক্ষে রেফারেন্স দিচ্ছেন, আপাতদৃষ্টে তাদের কথাকে মিথ্যা বলার কোনোই যৌক্তিকতা নেই, কিন্তু সম্পূর্ণ হাতিকে যিনি এক দৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম, ইসলাম সম্পর্কে যার সম্যক ধারণা আছে, তিনি জানেন- যদিও সকলেই নিজেদেরকে খাটি ইসলামী ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে, প্রকৃতপক্ষে তারা কেউই সঠিক পথে নেই, কারণ ইসলাম সম্পর্কে তাদের কোনো সম্যক ধারণাই নেই।
অনেকে বলবেন- এত বড় কথা! ইসলামের এত বড় পণ্ডিত হয়ে গেছো যে, সমগ্র মুসলিম জাতিকে আকীদা শেখাচ্ছো? কোন মাদ্রাসায় পড়েছো? কয় পারা কোর'আন মুখস্থ? তাদের জন্য বলে রাখি- আমি নিজেকে পণ্ডিত দাবি করি না, আমার জ্ঞানের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে এবং আমি জীবনেও মাদ্রাসায় পড়ি নি। তথাপি আমি যা বলছি তা সম্পূর্ণ সত্য বলছি, যা চোখে দেখা বস্তুর মতো সত্য।
লাল রং দেখতে কেমন? আপনি যদি জীবনেও লাল রং না দেখে থাকেন তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর কোন বই-পুস্তক পড়েই শিখতে পারবেন না। যত বড়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুন তারা আপনাকে লাল রং বলে বোঝাতে পারবে না, লিখে বোঝাতে পারবে না। আপনি লাল রং এর উপর পি.এইচ.ডি করে বের হবেন কিন্তু যেহেতু আপনি জীবনে কখনও লাল রং দেখেন নি, তাই তখনও যদি আপনাকে লাল রং দেখানো হয়, আপনি চিনবেন না। অন্যদিকে যে ব্যক্তি লাল রং দেখেছে, সে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পড়েই লাল রং চিনতে পারবে।
পাহাড় দেখার জন্য খালি চোখই যথেষ্ট, যদি সে চোখে দৃষ্টিশক্তি থাকে। কেউ যদি পাহাড় দেখার জন্য বিবর্ধক কাচ নিয়ে পাহাড়ের গায়ে ঠেকিয়ে দেখার চেষ্টা করে, সে যে দৃশ্য পাবে তাকে পাহাড় বলা যায় না। কারণ, তখন পাহাড়ের গাযের অতি ক্ষুদ্র বালুকণা বৃহৎ আকারে দেখা যাবে, ওই বালুকণাকেই মনে হবে সুউচ্চ পাহাড়। প্রকৃত পাহাড় তার দৃষ্টির ধারণক্ষমতার বাইরেই থেকে যাবে। সে পাহাড়ের সবচেয়ে কাছে গিয়েও পাহাড় দেখার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে। আমাদের আলেম-মাওলানা ও ইসলামের পণ্ডিতরা খালি চোখে পাহাড় দেখা ছেড়েছেন হাজার বছর আগেই। তারা এখন আধুনিক থেকে আধুনিকতম বিবর্ধক কাচ ব্যবহার করে পাহাড় দেখার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন। বালুকণাকেই পাহাড় ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন।
আল্লাহর অসীম করুণা যে, তিনি আমার চোখের সামনে থেকে বিবর্ধক কাচ সরিয়ে খালি চোখে ইসলাম দেখার সুযোগ দিয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৩