ইসলামকে রাষ্ট্র থেকে দূরে রাখতে চান যারা, তাদের অন্যতম অভিযোগ ইসলামের শরীয়াহ আইন নিয়ে, যেটা মৌলবাদী জঙ্গিরা জোর করে মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়।
পৃথিবীর যেসব দেশে বা ভূখণ্ডে কথিত শরীয়াহ আইন চালু করা হয়েছে বা অনেক আগে থেকে চলে আসছে, বস্তুত তা ওইসব দেশের অধিকাংশ জনগণই সমর্থন করে না। আবার প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করে না, কারণ জানের ভয়।
ওইসব দেশের দৃষ্টান্ত দেখে অনেকে মনে করেন ইসলামকে রাষ্ট্রের সাথে মেশানোর অর্থই হচ্ছে, এই শরীয়াহ আইনকে বলবৎ করে মানুষের হাত-পা কাটা, পাথর ছুড়ে হত্যা করা, শিরোশ্ছেদ করা ইত্যাদি। মূলত এই ভয় থেকে তারা যে কোনো রাষ্ট্র থেকে ইসলামকে একশ' হাত দূরে রাখতে চান। অন্য কোনো বিষয় নয়, শরীয়াহ আইনেই তাদের যত ভয়। চোর ধরে ধরে হাতকাটা শুরু হলে বছরান্তে দেশের হাতকাটা মানুষদের একটা ভালো পার্সেন্টেজ দাড়াবার আশঙ্কা আছে, এটা তারা ভালোভাবেই বোঝেন।
তাদের উদ্দেশে কথা হলো ইসলামকে যদি তারা মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীদের চোখ দিয়ে দেখেন তাহলে ভুল ধারণা পাবেন। শরীয়াহ আইন মানেই চোর-ডাকাত ধরে ধরে হাত-পা-মাথা কাটা নয়।
ইসলামের প্রথম ও প্রধান শরীয়াহ হচ্ছে ঐক্য। তাছাড়া শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকা, সরকার বা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যপরায়ণ হওয়া, রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে স্থানীয় দায়িত্বশীল পর্যন্ত সকলের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, সামাজিক সহযোগিতা, দান, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, সত্য কথা বলা, ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন, মিথ্যা ও অন্যায়কে প্রতিরোধ, আমানত রক্ষা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, সত্য সাক্ষ্য দেওয়া, অবৈধভাবে অর্থোপার্জন না করা, অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক না করা, অশ্লীলতা পরিহার করা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, ক্ষতিকর তথা হারাম দ্রব্য ভক্ষণ না করা, অন্যকে হারাম ভক্ষণে নিরুৎসাহিত করা, শ্রমিককে প্রাপ্য মজুরি দেওয়া, মাপে কম না দেওয়া ইত্যাদি সবই ইসলামের শরীয়াহর অন্তর্ভুক্ত।
একটি সমাজ যখন উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করবে, এগুলোকে এবাদত মনে করবে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এই গুণগুলো নিজেদের আত্মায় গেঁথে নেবে, তখন মানুষের চুরি করার দরকার পড়বে কি? ডাকাতি করার দরকার পড়বে কি? অন্যায়ভাবে মানুষ খুন করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কি? সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, এ ধরনের অপরাধ প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। তারপরও কেউ যদি কোনো গর্হিত কাজ করেই ফেলে তার জন্য ক্ষমার ব্যবস্থা আছে। ইসলাম ক্ষমাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে মানুষকে ক্ষমা করতে উৎসাহ দিয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা একে অপরকে ক্ষমা কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আছে রক্তপণের ব্যবস্থা। অর্থাৎ একজন চুরি করলেই তাকে হাত কেটে দেওয়া হবে ব্যাপারটা তা নয়।
মানুষের হাত-পা কাটার জন্য পৃথিবীতে ইসলাম আসে নি। ইসলাম এসেছে শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ইসলামের ইতিহাসে আমরা পাই, আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মানুষগুলো ইসলামের সংস্পর্ষে এসে এতটাই পাল্টে গিয়েছিল যে, তারা রিপুর তাড়নায় কেউ অপরাধ করে ফেললে নিজেরাই নিজের বিচার দাবি করতো। নিজেকে নিজে রশি দিয়ে বেধে রাখতো, আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তির আশা করতো যাতে অপরাধের গ্লানি কাধে নিয়ে পরপারে যেতে না হয়।
একদিন এক ব্যাভিচারী আল্লাহর রসুলের কাছে এসে বলল, হুজুর, আমি তো ব্যাভিচার করে ফেলেছি। রসুলাল্লাহ শুনলেন কিন্তু না শোনার ভান করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললেন। তিনি চাইলেন- যেহেতু অপরাধ গোপন আছে, কেউ অভিযোগ করছে না, সুতরাং গোপনই থাকুক, আল্লাহ চাইলে তাকে ক্ষমাও তো করে দিতে পারেন। কিন্তু ব্যাভিচারকারী নাছোড়বান্দা। সে আবার রসুলাল্লাহকে বলল, হুজুর আমি তো ব্যাভিচার করে ফেলেছি। রসুল আবার ঘুরে বসলেন। কিন্তু সে আবারও রসুলকে একই কথা বলল। এভাবে বারবার নিজের অপরাধের কথা বলে বিচার প্রার্থনা করলে এক পর্যায়ে রসুলাল্লাহ তার শাস্তির ব্যবস্থা করলেন।
যে সমাজে স্বার্থ নিয়ে বা পরিকল্পনা করে সংঘটিত কোনো অপরাধ নেই বললেই চলে, কেবল রিপুর তাড়নায় উত্তেজিত হয়ে দু-একটি অপরাধ ঘটলেও তাৎক্ষণিক অপরাধী তার ভুল বুঝতে পারে এবং সে অপরাধের শাস্তি ভোগ করে পবিত্র হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়- এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের লক্ষ্য। এটাই প্রকৃত ইসলামের শরীয়াহ আইন প্রয়োগের বাস্তব ফলাফল। যে শরীয়াহ আইনের ভয়ে মানুষ সদা তটস্থ থাকে, মানুষের উপর জোর করে বিধান প্রয়োগ করা হয় সেটা ইসলামের শরীয়াহ নয়, সেটা দিয়ে ইসলামকে বোঝার চেষ্টা করা ভুল।
আল্লাহর রসুল কি শরীয়াহ আইন প্রবর্তন করেন নি? তাকে কি কেউ ভয় পায়? আজ ১৪০০ বছর পরও তিনি কোটি কোটি মানুষের নয়নের মণি, ভালোবাসার পাত্র হয়ে আছেন। অন্যদিকে আজকে যারা শরীয়াহ আইনের ধ্বজাধারী সেজে আছে তাদেরকে মানুষ ভালোবাসে না, ভয় পায়। এর কারণ কী? কারণ এরা নিজেদের বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও সিদ্ধান্ত সমাজে জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় যা সম্পূর্ণভাবে ইসলামপরিপন্থী।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৯